মহাবিস্ময়ের মহাকাশ
মাউন্ট উইলসন অবজারভেটরিতে অবস্থিত হান্ড্রেড ইঞ্চি (inch) হুকার টেলিস্কোপ। এডউইন পাওয়েল হাবল এ টেলিস্কোপটি ব্যবহার করেই মহাবিশ্বের আয়তন বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছিলেন পৃথিবীর কক্ষপথে স্থাপিত হাবল স্পেস টেলিস্কোপ। মহাকাশ সম্পর্কিত গবেষণায় এর গুরুত্ব অনেক আমেরিকার সান ফ্রান্সিসকোর ২৯০ মাইল উত্তর-পূর্বে নির্মাণাধীন এলেন টেলিস্কোপ অ্যারে লাখো-কোটি নক্ষত্রের মধ্যে প্রক্সিমা সেন্টাওরি। সূর্যের পর এটাই পৃথিবীর নিকটতম নক্ষত্রযিশু খ্রিস্টের জন্মের আগে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের বিশ্বাস ছিল, সম্পূর্ণ মহাবিশ্বের কেন্দ্রে রয়েছে স্থির পৃথিবী আর পৃথিবীকে কেন্দ্র করে গোলাকার কক্ষপথে সবকিছু ঘুরছে। এ ধারণাকে পূর্ণতা দিয়েছিলেন খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের গ্রিক এবং ইজিপশিয়ান গবেষক টলেমি।
টলেমি জ্ঞানের চর্চা করতেন ইজিপ্টের আলেকজান্দ্রিয়ায়। সে সময় ইজিপ্ট রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। টলেমি এমন একটি মহাবিশ্বের মডেল দেন যার কেন্দ্রে রয়েছে পৃথিবী। পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সাতটি ভিন্ন গোলাকার কক্ষপথে ঘুরছে চাদ, সূর্য এবং পাচটি গ্রহ বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনি। এর বাইরে আরো একটি গোলাকার বৃত্তে অবস্থান করছে মহাবিশ্বের অন্যসব তারকা বা নক্ষত্র।
এগুলো স্থির রয়েছে, ঘুরছে না। এর বাইরে আরো কিছু আছে কি না সে সম্পর্কে টলেমি কিছু বলেননি। অ্যারিস্টটল এবং টলেমির এ মহাবিশ্ব আজকের মহাবিশ্বের সাপেক্ষে কতোটা ক্ষুদ্র ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়। এখানেই শেষ নয়। তাদের মহাবিশ্ব মডেল ক্রিশ্চিয়ান গির্জার কাছ থেকেও স্বীকৃতি পেয়ে যায়।
কিন্তু এর বিরোধিতা করেন কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও এবং কেপলার। তখনকার দিনে গির্জার বিরোধিতা ছিল খুবই দুঃসাহসী কাজ। আর এ কাজটি করার জন্য কোপার্নিকাস ও গ্যালিলিওকে শাস্তিও দেয়া হয়। সময় বয়ে যেতে লাগলো এবং এক পর্যায়ে কোপার্নিকাস, কেপলার আর গ্যালিলিও যা বলেছিলেন তা সত্য বলে প্রমাণিত হলো। ১৬৮৭ সালে স্যার আইজাক নিউটন প্রকাশ করলেন তার বিখ্যাত বই ‘ফিলোসোফিয়ে ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া অফ ম্যাথমেটিকা’।
এতে তিনি মাধ্যাকর্ষণের ধারণা দিলেন। মহাকাশের বিভিন্ন বস্তুÑ গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র কিভাবে একে অন্যকে আকর্ষণ করে এবং কিভাবে তারা আবর্তন করে এ বইটিতে নিউটন শুধু সেগুলোর ব্যখ্যাই দিলেন না, অঙ্কের মাধ্যমে তা বিশ্লেষণ করলেন এবং প্রমাণ করে দেখালেন। নিউটন উপলব্ধি করলেন তার মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব অনুসারে নক্ষত্রগুলো একে অন্যকে আকর্ষণ করবে সুতরাং ওগুলোর স্থির থাকাধ সম্ভব নয়। স্থির পৃথিবীর ধারণা চিরতরে বিলীন হলো। এরও কয়েক শতক পরে ১৯১৫ সালের দিকে আইনস্টাইন আবিষ্কার করলেন সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব (General Though Of Relativity)।
এর মাধ্যমে সময় এবং স্থানের সাপেক্ষে নিউটনের মাধ্যাকর্ষণের ধারণাকে নতুনভাবে উপস্থাপন করলেন তিনি। মহাবিশ্বের বস্তুগুলোর যে আবর্তন সে সম্পর্কে আরো স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া গেল। তবে, এর সবকিছুই ছিল তাত্ত্বিক। মহাবিশ্ব সম্পর্কে একটি আধুনিক ও বাস্তব সম্মত ধারণা পাওয়া গেল আমেরিকার জ্যোতির্বিদ এডউইন হাবলের কাছ থেকে। মহাবিশ্ব আয়তনে বাড়ছে, ফুলে ফেপে উঠছে এমন কথা বললেন হাবল।
গ্যালাক্সিগুলো পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেÑ টেলিস্কোপের মাধ্যমে হাবল দীর্ঘ দিন ধরে এ ব্যাপারটি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। এ পর্যবেক্ষণের ওপর নির্ভর করে তিনি ১৯২৯ সালে মহাবিশ্বের আয়তন বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছিলেন। আইনস্টাইনের তত্ত্বের সঙ্গে মিলে গেল হাবলের পর্যবেক্ষণ। এর মানে হলো মহাকাশের সব বস্তু কোনো এক সময় একটি বিন্দুতে অবস্থান করছিল। এ থেকে আরো পাওয়া গেল মহাবিশ্ব সৃষ্টিতে মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাংয়ের ধারণা।
টেলিস্কোপের আবিষ্কার, উত্তরোত্তর এর মান বৃদ্ধি, মহাকাশেনভোযান পাঠানো এবং হাবল টেলিস্কোপের স্থাপনা মহাকাশ সম্বন্ধে মানুষের ধারণা আরো পাল্টে দিতে লাগলো। এ ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত হাবল টেলিস্কোপ। এর নামকরণ করা হয়েছে জ্যোতির্বিদ হাবলের নামানুসারে। এ টেলিস্কোপটি ১৯৯০ সালের ২৪ এপ্রিল নাসা এবং ইওরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির যৌথ উদ্যোগে মহাকাশে পৃথিবীর কক্ষপথে বসানো হয়েছে। তখন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত মহাকাশের ব্যাপারে অপরিসীম তথ্যের যোগান দিয়ে চলেছে হাবল।
হাবলের কক্ষপথ পৃথিবীর ৬০০ কিলোমিটার উপরে। এ কারণে হাবলের ছবি বায়ুম-ল দ্বারা প্রভাবিত হয় না। জ্যোতির্বিদ্যার জগতে অনেক কিছু উদ্ভাবন, বিশ্লেষণ ও সমস্যার সমাধানে সহায়তা দিয়ে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে হাবল টেলিস্কোপ। হাবলের পাঠানো তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এ পর্যন্ত ৪,০০০ এরও বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। মহাকাশ গবেষণায় প্রচলিত অপটিকাল টেলিস্কোপের সঙ্গে বিগত শতকে নতুন যোগ হয়েছে রেডিও টেলিস্কোপ বা ডিশ এন্টেনা।
মহাকাশের বিভিন্ন বস্তু শুধু আলোই নিঃসরণ করে না বরং নক্ষত্র, পালসার, কোয়েসার, গ্যালাক্সি, নেবুলা এমনকি গ্রহগুলোও রেডিও ওয়েভ নিঃসরণ করে। ডিশ এন্টেনার সাহায্যে এসব রেডিও ওয়েভ গ্রহণ করে সেগুলো বিভিন্নভাবে বিশেষণ এবং ছবি তৈরির মাধ্যমে ওসব বস্তুর আকার, আকৃতি, গঠন সম্পর্কে বিভিন্ন রকম তথ্য পাওয়া যায়। ১৯৫৭ সালে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারের কাছে জর্ডেল ব্যাংকে প্রথম বড় আকারের ডিশ বসানো হয়েছিল। এর ব্যাস ছিল ৭৬ মিটার বা ২৫০ ফুট। এটি এখন আর ব্যবহার করা হয় না।
ভার্জিনিয়ার গ্রিন ব্যাংক টেলিস্কোপের ব্যাস ছিল ৩০০ ফিট। এটি একসঙ্গে ৬৫,০০০ চ্যানেলের মাধ্যমে সিগনাল সংগ্রহ করতে পারতো। ক্যালিফোর্নিয়ার গোল্ডস্টোন, স্পেনের মাদ্রিদ এবং অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায় অবস্থিত নাসার তিনটি ডিপ স্পেস নেটওয়ার্কে ব্যবহৃত হচ্ছে অনেকগুলো ডিশ। এসব ডিশের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা ছাড়াও পাইওনিয়ার, ভয়েজারসহ অন্যান্য স্পেস ক্রাফটের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ডিশটির অবস্থান পুর্টোরিকোর উত্তর-পশ্চিমে এরেসিবো নামক স্থানে।
এর বিস্তার ২৬টি ফুটবল মাঠের সমান। অন্যদিকে এরেসিবোর মতো বড় ডিশের পরিবর্তে ছোট ছোট হাজারো ডিশের সমন্বয়ে তৈরি ডিশের এ্যারে অনেক ফলপ্রসূ প্রমাণিত হওয়ায় স¤প্রতি মহাকাশ গবেষণার জন্য নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে এলেন টেলিস্কোপ এ্যারের। মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠায় অন্যতম ভূমিকা রেখেছেন পল এলেন। তিনি এ প্রকল্পের অর্থের যোগান দিয়েছেন বলে তার নামানুসারে এমন নাম রাখা হয়েছে। তুলনামূলকভাবে কম দামি উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এ এন্টেনাগুলো।
এর এক একটির ব্যাস মাত্র ছয় মিটার। প্রতিটি এন্টেনার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে মোটর যা পৃথিবী ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে এন্টেনাকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে। সান-ফ্রানসিসকোর ৫০০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে একটি গ্রামীণ পাহাড়ি এলাকায় ১ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে নির্মিত হয়েছে এ এন্টেনা সারি। মানুষের তৈরি ইলেকট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ যাতে বিঘœ ঘটাতেনা পারে সে জন্য বেছে নেয়া হয়েছে এমন নির্জন জায়গা। এ যেন এন্টেনার সারি দিয়ে তৈরি একটি নির্জন বাগান।
শুধু টেলিস্কোপের গ-ির মধ্যেই থেমে থাকেনি মহাকাশ গবেষণা। মানুষের প্রথম মহাকাশ উড্ডয়নের পর এ পর্যন্ত অসংখ্য মহাকাশ অভিযান সফলতার সঙ্গে শেষ হয়েছে। মানুষবিহীন অভিযানের সাফল্য আরো অনেক বেশি। এসব অভিযান মহাকাশ সম্পর্কে সর্বদাই নতুন নতুন তথ্যের যোগান দিচ্ছে। টেলিস্কোপের চোখ দিয়ে মহাশূন্যের দিকে তাকানোর পরপরই বিজ্ঞানীরা বুঝে গিয়েছিলেন, আমাদের নিত্যদিনের জীবনে ব্যবহৃত কোনো পরিমাপের একক দিয়ে মহাশূন্যকে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
দৈর্ঘ্যরে ক্ষেত্রে মিটার, কিলোমিটার, মাইল আর সংখ্যার ক্ষেত্রে শতক, হাজারের ব্যবহার এখানে অকেজো। দূরত্ব মাপার জন্য তারা ব্যবহার করলেন আলোর গতি। সেকেন্ডে আলো ১,৮৬,০০০ মাইল বা ৩০০,০০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে। এ দূরত্ব পৃথিবীর চারদিকে ৭ বার ঘুরে আসার সমান। মাত্র আট মিনিটে ৯ কোটি ৩০ লাখ মাইল পথ অতিক্রম করে আলো সূর্য থেকে পৃথিবীতে চলে আসে।
আলোর গতির সাপেক্ষে এর মানে হলো সূর্য আমাদের কাছ থেকে ৮ আলোক-মিনিট দূরে অবস্থিত। এমনিভাবে এক বছরে আলো অতিক্রম করে প্রায় ১০ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার বা ৬ ট্রিলিয়ন মাইল। এক বছরে আলো যে দূরত্ব অতিক্রম করে তাকে বলা হয় এক আলোক-বর্ষ। সুতরাং আলোক-বর্ষ কোনো সময়ের একক নয়, দূরত্বের একক। সূর্যের পরে আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টাওরি।
এ নক্ষত্রটি পৃথিবী থেকে ৪.৩ আলোক-বর্ষ দূরে অবস্থান করছে। অর্থাৎ তা আমাদের কাছ থেকে ৪.৩´১০১২ বা ৪,৩০০,০০০,০০০,০০০ মাইল দূরে রয়েছে। আসলে মহাবিশ্বের বয়স এবং ব্যাপ্তি আমাদের সাধারণ চিন্তাভাবনার বাইরে। আবার এতে গ্রহ, নক্ষত্রের সংখ্যারও কোনো হিসাব নেই, অগণিত। তা সত্ত্বেও গোটা মহাবিশ্বটাই ফাকা।
একটি নক্ষত্র থেকে অন্যটি বিলিয়ন মাইল দূরে অবস্থিত। আমাদের পৃথিবীকে যদি হঠাৎ করে মহাবিশ্বে ফেলে দেয়া সম্ভব হতো তবে অন্য একটা গ্রহের উপরে গিয়ে পৃথিবী পড়বে সেই সম্ভাবনা ১,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০ ভাগের এক ভাগ। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে কতোটা ফাকা আমাদের মহাবিশ্ব। মহাবিশ্বের ব্যাপ্তি কতো তা এখনো সঠিকভাবে জানা যায়নি।
আদৌ তা কোনোদিন জানা যাবে কি না সে ব্যাপারেও বিজ্ঞানীরা সন্দিহান।
জানার জন্য তাদের প্রচেষ্টায় ঘাটতি ছিল না, আজো নেই। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে ডাচ জ্যোতির্বিদ ক্যাপ্টেন মহাশূন্যের ব্যাপ্তি নির্ণয়ের চেষ্টা করেছিলেন। তার ধারণায় মহাশূন্য ছিল নক্ষত্রের তৈরি একটা থালার মতো। হিসাব-নিকাশ কষে তিনি এর ব্যাস বের করেছিলেন ২৫,০০০ আলোক-বর্ষ বা ১৪৬,৬৪২,৪০০,০০০,০০০,০০০ মাইল। তখন মহাশূন্যের ধারণা শুধু মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি পর্যন্ত সীমিত ছিল।
এর বাইরে কিছু ভাবা মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তার মানে ক্যাপ্টেন শুধু মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ব্যাস বের করেছিলেন। তাও ভুল। বর্তমান হিসাবে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ব্যাস ক্যাপ্টেনের ধারণার চেয়েও চারগুণ বেশি। আধুনিক বিজ্ঞানীরাও মহাশূন্যের বিস্তৃতি নিয়ে কথা বলছেন।
তবে তাদের মধ্যে এটা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ধারণা রয়েছে। কেউ বলছেন, আড়াআড়িভাবে মহাশূন্যের বিস্তৃতি হতে পারে ট্রিলিয়ন আলোক-বর্ষ কেউ আবার বলছেন এটা অসীম (ইনফিনিট)। ২০০৩ সালের এক গবেষণাপত্র দাবি করছে, মহাশূন্যের বিস্তৃতি ৭৮ বিলিয়ন আলোক-বর্ষ। এর কোনোটির ওপরই বিশ্বাস করার যথার্থতা নেই। এসব দাবি কেবল ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত।
মহাবিশ্বের পুরোটা হয়তো আমরা দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু আমাদের পৃথিবী থেকে যতোটুকু দেখা যাচ্ছে তার কিনারা ৪৬.৫ বিলিয়ন আলোক-বর্ষ দূরে বলে অনেক গবেষক মনে করছেন। পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্র ধরে এ হিসাবে মহাবিশ্বের ব্যাস দাড়াবে ৯৩ বিলিয়ন আলোক-বর্ষ। এটা নিয়েও গবেষকদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। কেউ বলছেন, দৃশ্যমান মহাবিশ্বের ব্যাস ১৩.৭ আলোক-বর্ষ আবার কেউবা বলেছেন তা ১৮০ বিলিয়ন আলোক-বর্ষ পর্যন্তও হতে পারে।
এতো বড় তারতম্য থেকে বোঝা যাচ্ছে, শুধু দৃশ্যমান মহাবিশ্বের বিস্তৃতির ব্যাপারেও মোটামুটি সঠিক কোনো ধারণা দেয়ার ব্যাপারে বিজ্ঞান কতোটা দূরে রয়েছে। অন্যদিকে মহাবিশ্বের বয়সও আরেক রহস্যপূর্ণ ব্যাপার। ঠিক কতোদিন আগে মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছিল সে ব্যাপারে শুধু মোটামুটি একটা ধারণা করতে পারছেন গবেষকরা। বিজ্ঞানের হিসেবে বিগ ব্যাংয়ের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যতোটুকু সময় অতিবাহিত হয়েছে সেটাই মহাবিশ্বের বয়স। অন্যদিক থেকে মহাবিশ্বের সবচেয়ে পুরনো বস্তুর বয়স যতো মহাবিশ্বের বয়স হবে তার সমান বা কাছাকাছি।
মহাবিশ্বের বিভিন্ন পুরনো বস্তু যেমন সবচেয়ে শীতল সাদা বামুন (হোয়াইট ডয়ার্ফ) নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ থেকে জ্যোতির্বিদরা হিসাব কষে বের করেছেন মহাবিশ্বের বর্তমান বয়স ১৩.৭ বিলিয়ন বছর। যদিও এ ধারণাটি ২০০ মিলিয়ন বছর কম বেশি হতে পারে। অজানা বিস্তৃতির মহাশূন্যে শূন্যতা ছাড়া আর কিছু আছে কি? সে ব্যাপারে অবশ্য একটু বেশি তথ্য জানাতে সমর্থ হয়েছে বিজ্ঞান। মহাবিশ্বের যতোটুকু আমাদের কাছে দৃশ্যমান তার শতকরা ৭৩ ভাগ অন্ধকার শক্তি (ডার্ক এনার্জি), ২৩ ভাগ ঠা-া কালো বস্তু (কোল্ড ডার্ক ম্যাটার) এবং মাত্র ৪ ভাগ পরমাণু। ডার্ক এনার্জি এবং কোল্ড ডার্ক ম্যাটারের ধারণা সম্পর্কে এখনো কিছু জানা যায়নি।
মহাবিশ্ব সৃষ্টির পর প্রথম নক্ষত্র সৃষ্টির আগে ডার্ক এনার্জি এবং কোল্ড ডার্ক ম্যাটার ছাড়া মহাকাশের অন্যসব মোট বস্তুর শতকরা ৭৫ ভাগ ছিল হাইড্রোজেন, ২৪ ভাগ হিলিয়াম এবং বাকি ১ ভাগ হাইড্রোজেন এবং হিলিয়ামের আইসোটোপ। সে সময়ে পুরো মহাবিশ্বে কোনো ভারি মৌল যেমন লোহা, নিকেল, কার্বন ইত্যাদির অস্তিত্ব ছিল না। নক্ষত্রের ভেতরের জ্বালানি হাইড্রোজেন পুড়তে পুড়তে বিভিন্ন পর্যায়ে এসব ভারি মৌলের সৃষ্টি হয়েছে এবং কিছু কিছু বড় নক্ষত্রের সুপারনোভার (বিস্ফোরণের) ফলে এসব মৌল মহাকাশে ছড়িয়ে পড়েছে।
মহাশূন্যে তুলনামূলকভাবে দৃশ্যমান বস্তুর পরিমাণ খুব কম। যতোটুকু রয়েছে তার ধারণা করার সামর্থও আমাদের নেই।
একমুঠি বালিতে মোটামুটি ১০,০০০ এর মতো বালুকণা থাকে। কোনো পরিষ্কার রাতে আকাশের দিকে তাকালে আমরা এর চেয়েও বেশি নক্ষত্র দেখতে পাই। আর আমাদের জ্ঞাত মহাবিশ্বে যতো নক্ষত্র রয়েছে তার সংখ্যা পৃথিবীর সব সমুদ্র সৈকতের বালুকণার সংখ্যার চেয়েও অনেক বেশি। যে মহাবিশ্বে আমরা বাস করছি সেটাই কি একমাত্র মহাবিশ্ব? না কি এ রকম আরো মহাবিশ্ব রয়েছে? এ আরেক রহস্য। অনেকগুলো মহাবিশ্ব থাকতে পারে বলে অনেক গবেষক মত দিয়েছেন।
তাদের ধারণা এগুলোর প্রত্যেকটির সৃষ্টি হয়েছে আলাদা আলাদা বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে। জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, দর্শন, বৈজ্ঞানিক কল্প-কাহিনী, ধর্ম সব কিছুতেই অনেক মহাবিশ্ব থাকার ব্যাপারে একটা প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে। আমাদের মহাবিশ্বে বিদ্যমান ব্ল্যাকহোল থেকে বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে আলাদা নতুন মহাবিশ্ব সৃষ্টির সম্ভাবনার কথা বলেছেন কোনো কোনো বিজ্ঞানী। সে তো আবার নতুন করে নতুন রহস্যের শুরু।
ক্রাব নেবুলা বা নীহারিকা।
গ্যালাক্সির ভেতরের ধুলাবালি, হাইড্রোজেন এবং প্লাজমার মেঘকে বলা হয় নিহারিকা। পৃথিবী থেকে ৬,৩০০ আলোকবর্ষ দূরে এ নেবুলাটি আবিষ্কৃত হয় । এর ব্যাসের দৈর্ঘ্য ১১ আলোকবর্ষ। প্রতি সেকেন্ডে নেবুলাটির ব্যাস প্রায় ১৫০০ কিলোমিটার করে বেড়ে যাছে সবচেয়ে বড় মহাকাশীয় সংগঠনের নাম গ্যালাক্সি এস্কিমো নীহারিকা : মহাকাশে অতি ভারি নক্ষত্রের জীবনেরশেষ পর্যায়ে মহাবিস্ফোরণের ফলে নীহারিকার সৃষ্টি হয় দৃষ্টিনন্দন ঈগল নীহারিকা এ পর্যন্ত মহাকাশে প্রায় ১০০,০০০টি কোয়েসার আবিষ্কৃত হয়েছে উদ্ভটভাবে গঠিত একটি প্ল্যানেটারি নেবুলার দৃশ্য। নেবুলাটির গঠন উপাদানগুলো এ রকম হওয়ার কারণ এখনো অজানা।
হাবল স্পেস টেলিস্কোপের সাহায্যে এ ছবিটি তোলা হয়। ছবি : নাসা গ্যালাক্সি গ৮৩। এ গ্যালাক্সিটিও আকারগতভাবে অনেকটা আমাদের নিজস্ব গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ের অনুরূপ। মিল্কিওয়ের ব্যাস এক লাখ আলোক-বর্ষের কাছাকাছি, যা মোটামুটিভাবে আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র সূর্যের ব্যাসের ৭০০ কোটি গুণ বেশি। আমাদের পরিচিত কাঠামো উইন্ডমিলের (ডরহফসরষষ) সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে এমন একটি পেচানো গ্যালাক্সি।
গ্যালাক্সিটির নাম গ১০০। এর কেন্দ্রীয় অংশটি অপেক্ষাকৃত ঘন ও স্ফীত। এ অংশ থেকেই গ্যালাক্সির প্যাচানো বাহুগুলো কু-লী পাকিয়ে বাইরের দিকে বেরিয়ে এসেছে। এ গ্যালাক্সিটির সঙ্গে আমাদের নিজস্ব অস্বাভাবিক আকারের একটি গ্যালাক্সি। গ্যালাক্সিটি ঊঝঙ ৫১০-১৩ নামে পরিচিত।
হাবল টেলিস্কোপ দিয়ে এ ছবিটি তোলা হয় ২০০১ সালে। অভিকর্ষ বলের প্রভাবে গ্যালাক্সিটি এ ধরনের অদ্ভুত আকার পেয়েছে বলে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তত্ত্ব দিয়েছেন। তাদের মত অনুযায়ী আরেকটি ছোট গ্যালাক্সিকে অঙ্গীভূত ক ওরিয়ন (ঙৎরড়হ) নক্ষত্রপুঞ্জে অবস্থিত দি গেট নেবুলা। নেবুলাটি বিপুল পরিমাণ গ্যাস ও ধূলিবালির পুঞ্জ। এ পুঞ্জটি ওরিয়নের ক্ষেত্রে কুয়াশাচ্ছন্ন অঞ্চল হিসেবে দৃশ্যমান।
এ ছবিটিতে নেবুলাটির কেন্দ্রীয় উজ্জ্বল অংশটি দেখানো হয়েছে। ফটো : ন্যাশনাল অপটিকাল অ্যাস্ট্রোনমি অবজারভেটরিস সবচেয়ে বড় মহাকাশীয় সংগঠনের নাম গ্যালাক্সি। মহাকাশীয় ধুলা, গ্যাস আর নক্ষত্র নিয়ে এরা গঠিত। ধারণা করা হচ্ছে, আমাদের জানা মহাবিশ্বে কমপক্ষে একশ বিলিয়নের বেশি গ্যালাক্সি রয়েছে। গড়ে প্রতিটি গ্যালাক্সিতে রয়েছে একশ বিলিয়ন নক্ষত্র।
আমাদের সৌরজগৎ রয়েছে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে। পৃথিবী থেকে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের দূরত্ব ৪০ হাজার আলোক-বর্ষ। আমাদের অবস্থান এ গ্যালাক্সির এক পাশে, দূরবর্তী এক স্থানে। মিল্কিওয়ের আশপাশে রয়েছে ছোট-বড় ৩০টির মতো গ্যালাক্সি। এদের বলা হয় গ্যালাক্সিদের স্থানীয় দল বা লোকাল গ্রুপ।
এরা কয়েক বিলিয়ন আলোক-বর্ষ জুড়ে বিস্তৃত। এর মধ্যে একটি হলো গ৩১। এটি এন্ড্রোমিডা পুঞ্জে অবস্থিত। একে এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিও বলা হয়। এটি একটি পেচানো গ্যালাক্সি।
এর দুটো ছোট উপ-গ্যালাক্সি রয়েছে। এরা উপবৃত্তাকার। মহাকাশের এক দৃষ্টিনন্দন বস্তু নেবুলা বা নীহারিকা। কোনো গ্যালাক্সির ভেতরের ধুলাবালি, হাইড্রোজেন এবং প্লাজমার (পদার্থের গ্যাসীয় আয়নিত অবস্থা মেঘকে বলা হয় নীহারিকা। এক সময় মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির বাইরে মহাবিশ্বে যে কোনো ছড়ানো এবং বিস্তৃত মহাকাশীয় বস্তুকেই নীহারিকা বলা হতো।
যেমন এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিকে বলা হতো এন্ড্রোমিডা নীহারিকা। এডউইন হাবল গ্যালাক্সি আবিষ্কারের পর এ ধারণায় পরিবর্তন আসে। গ্যালাক্সির ভেতরে থাকে নীহারিকা আর নক্ষত্রের সৃষ্টি হয় নীহারিকার ভেতরে। কোনো কারণে নীহারিকার গ্যাসে আন্দোলন সৃষ্টি হলে নক্ষত্রের জন্ম প্রক্রিয়া শুরু হয়। নীহারিকার কোনো কোনো অংশে একত্রে অনেক নক্ষত্রের জন্ম প্রক্রিয়া শুরু হতেপারে।
এ জন্য আমরা আকাশে তারকাপুঞ্জ দেখতে পাই। নীহারিকার কোনো সুনির্দিষ্ট সীমানা থাকে না। বিভিন্ন প্রকারের নীহারিকা রয়েছে মহাকাশে। এদের সৃষ্টিও হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ায়। বেশির ভাগ নীহারিকাই ডিফিউস নীহারিকা।
গ্যালাক্সিদের ভেতরের ধুলা, হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম গ্যাস মাধ্যাকর্ষণজনিত আকর্ষণে একত্রে সন্নিবেশিত হয়ে সৃষ্টি করেছে এসব নীহারিকা। এছাড়া রয়েছে প্লানেটারি নীহারিকা এবং সুপারনোভা থেকে সৃষ্ট নীহারিকা। জীবনের শেষ পর্যায়ে লাল দানব নক্ষত্রের (রেড জায়ান্ট) ভেতরে নিজের ভর বইতে পারার মতো যথেষ্ট শক্তি উৎপন্ন না হওয়ায় মহাকাশে বেশির ভাগ বস্তু সামগ্রী ছড়িয়ে দিয়ে এরা সাদা বামুন (হোয়াইট ডয়ার্ফ) নক্ষত্রে রূপান্তরিত হয়। এভাবে বিচ্ছুরিত বস্তু সামগ্রী যে নীহারিকার জন্ম দেয় তার নাম প্লানেটারি নীহারিকা। চিত্রের এস্কিমো নীহারিকাটি একটি প্লানেটারি নীহারিকা।
মহাকাশে অতি ভারি নক্ষত্রের জীবনের শেষ পর্যায়ে মহাবিস্ফোরণ বা সুপারনোভার ফলেও সৃষ্টি হয় নীহারিকা। দি ক্রাব নেবুলা সুপারনোভার ফলে সৃষ্ট একটি নীহারিকা। নক্ষত্রের মূল গঠন উপাদান হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম। নতুন সৃষ্ট নক্ষত্রে হাইড্রোজেনের পরিমাণ থাকে বেশি। এটা জ্বালানি হিসেবে পুড়ে হিলিয়ামে এবং তা থেকে আরো ভারি মৌল যেমন লৌহ, নিকেল ইত্যাদিতে পরিণত হয়।
জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমেই নক্ষত্রগুলো আলো ও তাপ ছড়ায়। নক্ষত্রজগৎ বড় বিচিত্র। কোনোটি আমাদের সূর্যের মতো নিঃসঙ্গ একক নক্ষত্র। আবার অনেকের রয়েছে সাথী। বেশির ভাগ নক্ষত্রের সাথী একটি।
এদের বলা হয় বাইনারি বা যুগল নক্ষত্র। এ ক্ষেত্রে একটি সাধারণ ভরকেন্দ্রকে কেন্দ্র করে একটি অন্যটির চারদিকে ঘুরতে থাকে। কোনো নক্ষত্রপুঞ্জে থাকে তিনটি বা তার চেয়ে বেশি নক্ষত্র। সূর্য থেকে বৃহস্পতি যতোটা দূরে রয়েছে সে রকম দূরত্ব বজায় রেখে যুগল নক্ষত্রপুঞ্জে একটি নক্ষত্র অন্যটির চারদিকে ঘুরতে থাকে। অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে এরা এতোটা কাছ দিয়ে ঘুরছে যে একটি অন্যটিকে স্পর্শ করছে।
নক্ষত্রগুলোর উজ্জ্বলতায়ও থাকে অনেক পার্থক্য। কোনো কোনো নক্ষত্র যেমনÑ সুপারনোভা এতোটাই উজ্জ্বল যে, তা পুরো গ্যালাক্সির উজ্জ্বলতাকে ঢেকে ফেলে, ম্লান করে দেয়। আবার কোনোটি এতোটাই অন্ধকারাচ্ছন্ন যে তা দেখাই যায় না, যেমন ব্ল্যাক হোল। কিছু কিছু নক্ষত্র অপরিবর্তিতভাবে জ্বলতে থাকে আর কোনোটি জ্বলে মিটমিট করে। বেশির ভাগ নক্ষত্র থেকেই দৃশ্যমান আলো এবং ইনফ্রারেড রশ্মি বিকিরিত হয়।
তবে কিছু নক্ষত্র এক্সরে এবং রেডিও ওয়েভ বিকিরণ করে। নীল রঙের নক্ষত্রগুলো খুব উত্তপ্ত এবং কম বয়সী, হলুদ বর্ণেরগুলো মাঝ বয়সী আর লালগুলোর বয়স সবচেয়ে বেশি, এরা মৃত্যুপথের যাত্রী। অপেক্ষাকৃত ছোট, সাদা এবং কালো নক্ষত্রগুলো মৃত্যুর শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আমাদের সূর্যের মতো অনেক নক্ষত্রের গ্রহ আছে। গ্রহগুলো একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থান করে নক্ষত্রের চারপাশে আবর্তন করতে থাকে।
নক্ষত্রের কাছের গ্রহগুলো শিলাময় এবং উত্তপ্ত আর দূরের গ্রহগুলো গ্যাসীয় ও প্রচ- ঠা-া। কোনো গ্রহ যদি নক্ষত্র থেকে এমন দূরত্বে অবস্থান করে যে, এর তাপমাত্রা এবং পরিবেশ আমাদের পৃথিবীর মতো তবে সেখানে জীবনের উদ্ভব বা এলিয়েন সভ্যতার বিকাশ ঘটতে পারে। আমাদের সৌরজগতের রয়েছে আটটি গ্রহ। সূর্য থেকে দূরত্বের ক্রম অনুসারে এরা হলো বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস এবং নেপচুন। গ্রহের আধুনিক সংজ্ঞা অনুসারে প্লুটোকে আর গ্রহ মনে করা হয় না।
এর আকার এতোটাই ছোট যে, এটিকে গ্রহের পর্যায়ে ফেলতে নারাজ জ্যোতির্বিদরা। বুধ, শুক্র, পৃথিবী এবং মঙ্গল সূর্যের কাছাকাছি অবস্থান করায় এরা শিলাময় গ্রহ। অন্যদিকে দূরের গ্রহ বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস এবং নেপচুন গ্যাসীয়। গ্রহদের চারপাশে ঘুরতে থাকে উপগ্রহ। সব গ্রহের উপগ্রহ থাকে না।
আবার অনেকের একাধিক বা অনেক উপগ্রহ থাকতে পারে। বুধ এবং শুক্রের কোনো উপগ্রহ নেই। চাদ আমাদের পৃথিবীর উপগ্রহ। নাসার প্রদত্ত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী মঙ্গলের দুটি, শনির ৬০টি, বৃহস্পতির ৬২টি, ইউরেনাসের ২৭টি এবং নেপচুনের ১৩টি উপগ্রহ রয়েছে। গ্রহ এবং উপগ্রহ নক্ষত্র সৃষ্টির সময়ই সৃষ্টি হয়ে থাকে।
উপগ্রহগুলোর মাতৃ-গ্রহের সঙ্গে গঠন বৈশিষ্ট্যে খুব মিল থাকে। যেমন পৃথিবী এবং চাদের গঠন উপাদানে রয়েছে বেশ মিল। নক্ষত্রের গ্রহগুলোর মধ্যে বিদ্যমান বিশাল ফাকা জায়গায় থাকে নানা রকম বস্তু। কোনোটি শিলাময়, কোনোটি ধাতব, কোনোটি গ্যাসীয় আবার কোনোটি জৈব অণুর সমন্বয়ে গঠিত। গঠন এবং বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এরা গ্রহাণু (এস্টরয়েড), উল্কা (মেটিওরয়েড) বা ধূমকেতুর (কমেট) পর্যায়ে পড়ে।
গ্রহাণুগুলো আকারে গ্রহদের চেয়ে ছোট, কিন্তু উল্কার চেয়ে বড় আবার গঠন বৈশিষ্ট্যে এরা ধূমকেতুর মতো নয়। এদের ছোট গ্রহও বলা হয়ে থাকে। গ্রহদের মতো এরা সূর্যকে কেন্দ্র করে আবর্তনশীল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এরা ধূমকেতুর ভাঙা বা বিচ্ছিন্ন অংশ হতে পারে। আমাদের সৌরজগতে মিলিয়ন মিলিয়ন গ্রহাণু রয়েছে এবং প্রতি মাসে কমপক্ষে ৫,০০০ করে নতুন গ্রহাণু আবিষ্কৃত হচ্ছে।
মঙ্গল এবং বৃহস্পতির মধ্যে অসংখ্য গ্রহাণু সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। এ অঞ্চলকে বলা হয় এস্টরয়েড বেল্ট। মেটিওরয়েড আসলে গ্রহাণু। তবে আকারে আরো ছোট। রয়াল এস্ট্রোনমিকাল সোসাইটির সংজ্ঞা অনুসাওে মেটিওরয়েডগুলো আড়াআড়িভাবে ১০০ মাইক্রোমিটারের চেয়ে ছোট নয়, আবার ১০ মিটারের চেয়ে বড় নয়।
১০০ মাইক্রোমিটারের চেয়ে ছোট হলে এদের বলা হয় মহাকাশীয় ধুলা আর ১০ মিটারের চেয়ে বড় হলে গ্রহাণুর পর্যায়ে পড়ে। এরা পৃথিবীর বায়ুম-লে ঢুকলে বায়ুম-লের সঙ্গে ঘর্ষণে জ্বলে ওঠে তখন এদের বলা হয় মেটিওর বা উল্কা। রাতে আকাশে অনেক সময় মেটিওর দেখা যায়। কোনো কোনো রাতে উল্কা বৃষ্টি হয়। লাখো- কোটি ক্ষুদ্র উল্কা পৃথিবীর দিকে ধাবিত হয়।
আমাদের সৌভাগ্য যে, পৃথিবীতে পৌছার আগেই বায়ুম-লের সঙ্গে ঘর্ষণে এরা জ্বলে শেষ হয়ে যায়। খুব বড় আকারের হলে এরা পৃথিবীতে পৌছতে পারে। কদাচিৎ এমনটা হয়ে থাকে। এদের বলা হয় মেটিওরাইট। উল্কার মতো ধূমকেতুগুলোও আঘাত হানতে পারে আমাদের পৃথিবীর ওপর, তবে এদের হামলার আশংকা অপেক্ষাকৃত কম।
১৯০৮ সালে সাইবেরিয়ার তুঙ্গুসকায় আঘাত হেনেছিল ধূমকেতুর একটি ছোট অংশ। আর তাতেই ২,০০০ বর্গ কিলোমিটার জঙ্গল পুড়ে ছারখার। ১৯৯৪ সালে বৃহস্পতির সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছিল সুমেকার লেভি-৯ ধূমকেতুর। পৃথিবীর সমান আয়তনের গর্ত সৃষ্টি হয়েছিল বৃহস্পতির গ্যাসীয় দেহে। পানি, মিথেন এবং অ্যামোনিয়ার বরফ আর ধুলাবালির সমন্বয়ে গঠিত হয় ধূমকেতু।
এদের একটি মাথা এবং ঝাটার মতো একটি পুচ্ছ থাকে। এরা সূর্যকে উপবৃত্তের কেন্দ্রে রেখে খুব দূর দিয়ে আবর্তন করে। সূর্যের কাছাকাছি চলে এলে সহজেই টেলিস্কোপ দিয়ে এদের দেখা যায় আর হ্যালি কিংবা হেইল-বপের মতো বড় ধূমকেতু খালি চোখেই দেখা যায়। এরা বেশ দৃষ্টিনন্দন হয়ে থাকে। লেজের অংশটা গঠনে খুব হালকা হওয়ার কারণে মাঝে মধ্যে সূর্য কিংবা গ্রহ, উপগ্রহের আকর্ষণে অংশ বিশেষ ছিড়ে যায়, আকার পরিবর্তন হয় ধূমকেতুর।
সূর্যের তাপে ধূমকেতুর বরফ গলেও এমনটা হতে পারে। মহাকাশের আরো অজস্র রহস্যের মধ্যে কোয়েসার একটি। অত্যন্ত উজ্জ্বল অতি দূরের সক্রিয় গ্যালাক্সির কেন্দ্র বিন্দুর বা নিউক্লিয়াসের নাম কোয়েসার। তবে রশ্মি বিকিরণের দিক থেকে এরা গ্যালাক্সির মতো নয়, নক্ষত্রের মতো। নক্ষত্রের মতো এরা রেডিও ওয়েভ এবং সাধারণ আলো বিকিরণ করে।
এ পর্যন্ত প্রায় ১০০,০০০ কোয়েসার আবিষ্কৃত হয়েছে। এরা আমাদের পৃথিবী থেকে খুব দূরে অবস্থান করছে। পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের কোয়েসার ৭৮০ মিলিয়ন আলোক-বর্ষ দূরে অবস্থিত আর সবচেয়ে দূরেরটার দূরত্ব ১৩ বিলিয়ন আলোক-বর্ষ। কোয়েসার থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে এতো বেশি সময় লাগার কারণে আমরা পৃথিবীতে বসে এখন যে কোয়েসার দেখছি তারা খুব আগে এ রকম অবস্থায় ছিল। কোয়েসার প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৯৫০-এর দশকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।