বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
প্রাচীন সুমেরিয় সাহিত্য থেকে আমরা এক বিচিত্র কাহিনী জানতে পারি। আজ থেকে ৪০০০ বছর আগেকার কথা। প্রাচীন ইরাকের কিশ নগর।
সে কালে নারীরাও পুরোহিত হতে পারত। উচ্চবর্ণের এক নারী পুরোহিত প্রেমে পড়েছিল কিশ নগরের এক হতদরিদ্র উদ্যান মালির । তাদের মিলনে একটি পুত্র সন্তান জন্মে । লোকলজ্জ্বার ভয়েই সম্ভবত সেই উচ্চবর্ণের নারী পুরোহিতটি নবজাতক শিশুটিকে একটি ঝুড়িতে রেখে ঝুড়িটি ডালপালা দিয়ে ঢেকে ইউফ্রেতিস (ফোরাত) নদীতে ভাসিয়ে দিল । কথায় বলে, রাখে আল্লা মারে কে।
প্রাচীন ইরাকের প্রধানা দেবী ছিলেন ইশতার; তারই আর্শীবাদে নাকি নবজাতকটি রক্ষা পায়; কিশ নগরের উদ্যানের সেই হত দরিদ্র মালি -মানে, নবজাতকের বাবাই নাকি শিশুটিকে উদ্ধার করে লালনপালন করে।
সেই মা পরিত্যক্ত শিশুটিই পরবর্তীকালে প্রাচীন ইরাককে ঐকবদ্ধ করে সম্রাটের সর্বময় ক্ষমতাকে প্রাধান্য দিয়ে বিশ্বসভ্যতার প্রথম কেন্দ্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত এবং ঐক্যবদ্ধ একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন-যে সাম্রাজ্যটি ইতিহাসের পাতায় আককাদিয় সাম্রাজ্য নামে পরিচিত।
সেই মা পরিত্যক্ত নবজাতকের নাম সারগন।
সময়কাল?
খ্রিস্টপূর্ব ২৩৩৪-২২৭৯।
কিশ নগরের রাজার নাম ছিল উর-যাবাবা।
দেবী ইশতারের আর্শীবাদে রাজা উর-যাবাবা সারগন কে পেয়ালাবাহক (কাপবেয়ারার) নিযুক্ত করেন। কারও কারও মতে, রাজা তাকে খাল-পরিদর্শক হিসেবে নিযুক্ত করেন। খাল পরিদর্শনকালে সারগন একদল একনিষ্ট পরিশ্রমী কৃষকের সান্নিধ্যে আসে। এরাই পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছিল সারগনের অনুগত সৈন্য। যা হোক।
রাজা উর-যাবাবাকে সিংহাসনচ্যূত করে সারগন কিশ নগরের রাজা হন। কিন্তু কী কারণে যেন কিশ নগরকে কেন্দ্র করে রাজ্যবিস্তার করেননি সারগন বরং কিশ নগরের উত্তরে আগাদে নামে এক নগর প্রতিষ্ঠিত করলেন ।
আগাদে নগরের নাম পরে হয়ে যায় আককাদ। সেকালে ইরাকের দজলা ও ফোরাত নদী দুটি যে জায়গায় খুব নিকটবর্তী ছিল আককাদ নগরটি ছিল ঠিক সেখানেই অর্থাৎ, এখনকার বাগদাদ-এর আশেপাশে। কালক্রমে আককাদ নগরটি হয়ে উঠেছিল প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রাচীন নগর।
আককাদ নগরটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল সুবিশাল আককাদিয় সভ্যতা।
সময়টা খ্রিস্টপূর্ব ২৩৩০। নতুন নগর নির্মানের পর সামরিক অভিযানে বের হলেন সারগন। কিশ ও আককাদ বাদেও সে সময়কার প্রাচীন ইরাকে আরও কটি নগর ছিল। যেমন: নিপপুর সুসা লাগাশ উর এবং উরুক।
সারগন একে একে এসব নগর পদানত করেন। চারবার সিরিয়া ও কেনান আক্রমন করে এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন।
সারগন কেবল বিশাল সাম্রাজ্যই গড়ে তুলেননি, সাম্রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় গ্রহন করেছিলেন অভিনব নানা পদক্ষেপ । যেমন: সেই সময়কার চন্দ্রদেবতার নাম ছিল নানা এবং আকাশ দেবতা ছিলেন আন। এনহেদুয়ানা নামে এক মেয়ে ছিল সারগন-এর ।
উর নগরের চন্দ্রদেবতা নানা-র উপাসনালয়ে এবং উরুক নগরের আকাশ দেবতা আন- এর উপাসনালয়ে এনহেদুয়ানা কে প্রধান (নারী) পুরোহিত নিযুক্ত করেন সারগন । এভাবেই সমগ্র অধিকৃত অঞ্চল সারগনের দখলে তো আসেই, সেই সঙ্গে শান্তিও প্রতিষ্ঠিত হয়।
এবং এনহেদুয়ানাই মানবসভ্যতার প্রথম সাহিত্যিক যার নাম আমরা জানি। কেননা, এনহেদুয়ানা অসংখ্য প্রার্থনাসংগীত লিখেছেন। পিতার পক্ষে প্রোপাগান্ডা করে লিখেছেন: পিতার সাম্রাজ্যটি ঐক্যবদ্ধ থাকলে অত্র অঞ্চলের সকলের জন্যই মঙ্গলজনক।
যা হোক। সূদীর্ঘ ৫৬ বছর আককাদ শাসন করেছিলেন সারগন। আককাদই ছিল প্রাচীন ইরাকের প্রথম সেমেটিক রাজবংশ । তো সেমেটিক কারা? নুহ নবীর তিন ছেলের এক ছেলের নাম ছিল শেম। সেমিটিক বলতে প্রাথমিক ভাবে বোঝানো হয় মধ্যপ্রাচ্যের শেমের বংশধর এবং পরবর্তীকালে মধ্যপ্রাচ্যের ভাষা পরিবার।
কেবল সেমেটিক রাজবংশের প্রতিষ্ঠাই নয়; প্রাচীন ইরাকের সামরিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সারগনই করেছিলেন। সাম্রাজ্যের ভিত্তিকে মজবুত করার লক্ষ্যে নানা বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন সারগন। যেমন, সারগন এর আগে শাসক নির্বাচিত করা হত ধনীক গোষ্ঠীর মধ্য থেকে । সারগনের সময় থেকেই প্রথম জ্যেষ্ঠ পুত্রকে সিংহাসনের বৈধ উত্তরাধিকার করার উদ্যেগ নেওয়া হয়। এতে সাম্রাজ্যের সংহতি দৃঢ় হয়।
আককাদিয় সভ্যতায় কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত পরিকল্পিত অর্থনীতি প্রচলিত ছিল। রাজকর্মচারীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কৃষিকাজ সম্পন্ন করা হত। শষ্যের বন্টন করা হত। তবে, অধিকৃত রাজ্যের ওপর জুলুম করা হত। অধিকৃত রাজ্যের গ্রামসমূহ জ্বালিয়ে সমতল ভূমিতে করা হত কৃষিকাজ ।
পন্য বাজারে কিংবা অন্য এলাকায় পরিবহনের জন্য আককাদিয় সাম্রাজ্যে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল উন্নতমানের। সেই সঙ্গে গতিশীল ডাকব্যবস্থাও প্রচলিত ছিল।
সারগন
আককাদিয় সাম্রাজ্যের রাজকীয় আয়ের অন্যতম খাত ছিল রাজস্ব, যে কারণে গড়ে উঠেছিল একটি শক্তিশালী ও দক্ষ রাজস্ব বিভাগ। সারগন-এর নামাঙ্কিত কাদার তৈরি সিলমোহর ব্যবহার করত রাজকর্মচারীরা । আককাদিয় সম্রাট নারাম সিন ছিলেন সারগনের দৌহিত্র; তার একটি সীসার তৈরি মূর্তি পাওয়া গিয়েছে।
এছাড়া আককাদিয় কারুশিল্পীরা ব্রোঞ্জ গলন পদ্ধতিও জানত; একসময় ভাবা হত পদ্ধতিটির উদ্ভাবক বুঝি গ্রিকরা, আসলে আককাদিয় শিল্পীরাই ব্রোঞ্জ গলনের পদ্ধতি গ্রিকদের বহু আগেই রপ্ত করেছিল।
সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও প্রাচীন ইরাকে আককাদিয় সভ্যতার অবদান অনেক। যেমন, আককাদিয় ভাষার প্রাচীন ইরাকের কথ্য ভাষা হয়ে উঠেছিল। যেমন সুমেরিয় ভাষাটি হয়ে উঠেছিল সাহিত্যের ভাষা। পরবর্তী ১০০০ বছরে ঐ অঞ্চলে সেমেটিক ভাষার ভিত গড়ে দিয়েছিল আককাদিয় ভাষা ।
এবং আমরা মনে করতে পারি সারগনের কন্যা এনহেদুয়ানা আককাদিয় ভাষায় লিখেছেন অসংখ্য প্রার্থনাসংগীত ।
এক কন্যা ছাড়াও সারগনের দুই পুত্র ছিল। এদের নাম যথাক্রমে রিমুশ এবং মানিশটুসু। সারগনের মৃত্যুর পর তারা পর্যায়ক্রমে আককাদ সাম্রাজ্যের সম্রাট হন। প্রথমে রিমুশ পরে মানিশটুসু।
দুভার্গ্যজনকভাবে এরা দুজনই আততায়ীর হাতে অত্যন্ত নৃশংসভাবে খুন হয়েছিলেন।
মানিশটুসু এর এক ছেলে ছিল; নাম: নারাম সিন। পিতার মৃত্যুর পর নারাম সিন আককাদের সম্রাট হন। একেক জনের ভাগ্য একেকরকম। নারাম সিন-এর ভাগ্যে অপঘাতে মৃত্যু লেখা ছিল না; তিনি সুদীর্ঘ ৫৬ বছর আককাদ শাসন করেছিলেন ।
নারাম সিন-এর শিলালিপি
নারাম সিন-এর সময়ে আককাদ সাম্রাজ্যটি ভূমধ্যসাগরের পূর্ব তীরের লেবানন, উত্তরে তুরস্ক এবং দক্ষিণে পারস্য উপসাগর অবধি বিস্তার লাভ করেছিল ।
নারাম সিন-এর প্রাসাদ
নারাম সিন-এর মৃত্যুর পর আককাদের সম্রাট হলেন তার ছেলে শার কালি শাররি । তার সময়ে রাজ্যের নানা স্থানে বিদ্রোহ সংঘটিত হতে থাকে। যা হোক। ২১০০ খ্রিস্টপূর্বে আককাদ সাম্রাজ্যটি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
পুবের জাগ্রস পাহাড় থেকে বুনো ট্রাইব এসে আক্রমনের পর আক্রমন করতে থাকে আককাদ। তারপর প্রতিবেশি সুমেরিয়রা যা কিছু আককাদিয় অর্জন গ্রাস করে নিতে থাকে। সারগন রিমুশ মানিশটুসু নারাম সিন এবং শার কালি শাররি সর্বমোট ১৪২ বছর আককাদ শাসন করেছিলেন। মনে রাখতে হবে আককাদিয় সভ্যতার উত্থান সারগন এর প্রতিভার স্পর্শে যেমন দ্রুত হয়েছিল তেমনি বিস্ময়কর ঐ সভ্যতাটির পতন ঘটতেও বিলম্ব হয়নি ...
সারগন ও আককাদিয় সভ্যতা: ফটো গ্যালারি।
সারগন
নারাম সিন-এর সামরিক অভিযান
পাথরের দেওয়ালের কারুকাজ
মানচিত্রে আককাদ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।