আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চুয়ান্নের বাইশে অক্টোবরঃ কবি!

চতুর্মাত্রিক.কম (choturmatrik.com)

০. আর কিছুদিন যাক না এমন আরো একটু আশা এই পৃথিবীর মানুষগুলো বুঝবে আমার ভাষা। এমন একটা গান আছে। ১. মাঝে মাঝে কাকতালীয় ঘটনা ঘটে আমাদের জীবনে। কেন ঘটে সেটা আমরা বুঝতে পারি না বলেই হয়তো সেগুলো কাকতালীয়। আমার বিশ্বাস, সবকিছুই একটা বৃহত্তর নকশার অংশ।

এখানে 'বিশ্বাস' কথাটা বলার কারণ এই যে এটা আমি প্রমাণ দেখাতে পারবো না। অসংখ্য ঘটনা তুলে আনতে পারি যেগুলো কাকতালীয় ঘটনার পেছনে কারণটাকে ব্যাখ্যা করবে। এবং এটা বুঝিয়ে দিবে যে এগুলো ঘটেছে একটা বৃহত্তর উদ্দেশ্যসাধনে। তবে তাতে পুরোপুরি বিষয়টা প্রমাণ হয় না। কেবল একটা কুযুক্তির উদাহরণ হয়ে ঠা ঠা করে হাসতে থাকে।

আমি প্রায়ই আজে বাজে উপমা ব্যবহার করি। এটা নিয়ে আমাকে অনেক কথা আর প্রশ্ন শুনতে হয়। এরকম উদ্ভট উপমা কেনো খাপ-না-খাওয়া চেহারা নিয়ে ঝুলতে থাকবে। বেশিরভাগ সময়েই আমি নিজের কাজকর্মের ব্যাখ্যা দিতে পারি না, লেখার তো আরও পারি না। তবে উপমার ব্যাপারে আমরা একজন বেখাপ্পা কবিকে চিনি যিনি অনায়াসেই আমাদের কাছে অনুমতি পেয়ে যান বিদঘুটে উপমা যথেচ্ছা বসিয়ে দেবার... তার সাথে আমার পরিচয়ের শুরুতে আমি তাকে খুব বেশি পছন্দ করি নি।

শৈশবের অভ্যাস মানুষ সহজে ছাড়তে পারে না, সেটা পাঠের অভ্যাসের বেলায় আরো বেশি খাটে। ছড়াটে-ছন্দ আর মাপা মাপা মাত্রা মাথায় কাঁথার মত সেলাই হয়ে গেছে। যখন বৃষ্টি পড়তো তখন 'জল পড়ে, পাতা নড়ে' -এভাবেই ভাবতাম আমি। গ্রামে বেড়াতে গেলে নদীর পাড়ে বসে "আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে" ভুস করে শুশুকের মতো ভেসে উঠতো। তারপরে আমি বাংলা মাস হিসেব করে মেলানোর চেষ্টা করতাম-- এখন আসলে বৈশাখ, তাই নদীতে হাঁটু জল।

তারপরে আরেক কবি এসে বললেন, সবাই বেশ সমান, নর এবং নারী। আমি ছোট ছোট কিশোর চোখে বোঝার চেষ্টা করি, কেন আমার পাতে বড়ো মুড়োটা পড়ে আর বোনের পাতে লেজ! এভাবে আমি অভিযোজিত হই, আমার সামাজিকীকরণ ঘটে। এই পর্যায়ে আমার সাথে সেই বেখাপ্পা কবির পরিচয় হয়। তিনি বেশ মৃদুমন্দ, মোটেও সুরেলা নন। আর নিদারুণ দারুণ কাঠখোট্টা।

তার নদীটার নাম ধানসিঁড়ি, তার পাখিটি হলো কালো শালিখ! আর বিদঘুটে উপমায় তার জুড়ি নেই- মাঠের ঘাসের মাঝে তার প্রেমিকার চুল আর ঘাম মিশে থাকে, প্যাঁচার ডাকের ভেতরে জীবন (নাকি মরণ) থরে থরে জমে আছে নাকি! এতোটা বিক্ষুব্ধ রচনায় স্বভাবতই মন বসেনি, হাতে পেতে দুয়েকটা কবিতা যা পড়লাম, ছন্দ মেলে না ঠিকঠাক। তারপরে দেখি মাত্রার নাম সনেট (এ কি বিদেশি গোলোযোগ!)। দূরে সরে গেলেন ম্রিয়মাণ কবি চুপিচুপি। দোর্দণ্ড প্রতাপে ফিরে এলেন ছাড়পত্র নিয়ে অভিযাত্রিক কবিগণ। তার সাথে আমার ফের দেখা আরো অনেক বছর পরে।

... কাকতালীয় নিয়ে বলছিলাম, আসলেই সবকিছু একটা নির্দিষ্ট ছকেই ঘটে বুঝি। তিনি যখন আবার ফিরে এলেন, তার সাথে পরিচয়ের উদ্ভাসে আমিই ভেসে গেলাম। চোখের ওপরে যেন রঙিন কাচ আটকে ছিল, যা দেখছিলাম সব সেপিয়া-পয়েন্টে ঈষৎ বাদামি হয়ে ছিলো। তিনি এসে সেই কাচ ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিলেন। এই কাজটি তিনি খুব সুচারুভাবেই করেছেন, বেশ "সহজ" উপায়ে।

আসলেই এটি সোজাসরল-- আমি বুঝলাম। "আমার এ গান কোনোদিন শুনবে না তুমি এসে- আজ রাত্রে আমার আহবান ভেসে যাবে পথের বাতাসে- তবুও হৃদয়ে গান আসে!" বয়ঃসন্ধি কেটে গেলে যেভাবে ঘুম ভেঙে যায়, দুই বেণি ছেড়ে ক্লাসের শীর্ণ মেয়েটি যখন একটা বেণি করে আসলো প্রথম সেটা আমার নজর এড়ায়নি। চোখ খোলাই ছিল, সেখানে মেয়েটির ওড়নার প্রান্ত হু হু করে মগজে সেঁধিয়ে গেলো। সেসময় কানের পাশে তিনি মৃদুস্বরে বললেন এই মেয়েটি তোমার গান কোনোদিনই শুনবে না। তবু তুমি পৃথিবীর কানে, নক্ষত্রের কানে কানে গান গাইবে।

এ যেন এক মহান নিরুপায় শাস্তি-- তোমাকে এই গান গাইতেই হবে। সেদিন রাতে আমার ঘুম হলো না, তিনি বড়ো জ্বালালেন। দু'চোখে মণিমুক্তোর মতো দৃশ্যগুলো ভরে দিতে লাগলেন। দেখলাম পঁচিশ বছর পরে আবার আমাদের দেখা হয়েছে। মেয়েটি মধ্য চল্লিশের ভারি শরীর, পাতলা হয়ে আসা চুল নিয়ে সেদিন সামনে দাঁড়ালো।

আমিও বুড়িয়ে গেছি, হাতের উল্টোপিঠের দাগগুলো মুখের ভাঁজে ভাঁজে, চোখের কোনায় কোনায় উঠে এসেছে। আমাদের মাঝে কোনো ভণিতা নেই- কৈশোরের নির্মলতা হারালে মানুষ কেমন অথর্ব আর ক্ষয়াটে হয়ে যায়, সেই চেহারা নিয়ে কবি দাঁড়ালেন সামনে, আমাদের মাঝখানে। হলদে তৃণ আর কুয়াশা ভরা মাঠের মাঝে আমি মেয়েটির মুখোমুখি দাঁড়ালাম। কবির চোখে দিব্যি দেখলাম, ম্রিয়মাণ মুখে কী তীব্র জ্বলজ্বলে আলো! ২. এই কবির জীবন এবং কবিতা নিয়ে বহু বহু কথা হয়েছে। গত সত্তুর বছরে কবি বুড়িয়ে গেছেন, মরেও গেছেন অন্যমনস্ক হাঁটতে হাঁটতে।

তার কবিতাগুলো বার বার বইয়ে বাঁধাই হয়ে সকলের বাসার শেলফে জায়গা করে নিয়েছে। তার কবিতার সবচেয়ে বেশি ব্যবচ্ছেদ হয়েছে, খাতায়, পাতায়, পত্র-পত্রিকায়, আড্ডায়, আলোচনায়, ভাষণে, বক্তৃতায়। কবি বেঁচে থাকলে কী করতেন? অথবা তিনি যখন বেঁচে ছিলেন, তখন কি ভাবতেন তিনি মরে গেলে তাঁকে নিয়ে এমন মেতে উঠবে পুরো একটা জনপদ? তার জন্যে কাতর রাতগুলো নির্ঘুম কাটবে কোনো কিশোরের। মধ্যবয়েসী একজন কেউ প্রবল হতাশ রাতে ঘরের বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাবে, আর সেই গনগনে ফুলকিতে দেখবে একটা প্যাঁচা তীক্ষ্ণ তাকিয়ে আছে! তখন তার মনে পড়বে একজন কবি ছিলেন যার কাছে এই প্যাঁচা কত অবলীলায় মানুষের উপমা হয়ে গেছে! আমার সাথে তার পরিচয়ের পর থেকে বারবারই আমার মনে হয়েছে এই কথাগুলো তিনি ভাবেন নি। এমন অসীম কল্পনাপ্রবণ মানুষটি হয়তো কখনোই ভাবেন নি যে তিনি কতজনের মনের কান্না আর চোখের হাসির ঝিলিকগুলো হুট করেই বাইরে নিয়ে আসতে পারবেন তার লেখা কবিতাগুলো দিয়ে।

কবিতাগুলো নিরীহ এবং আড়ম্বরহীন সাজ নিয়ে অনেকদিন কাউকে নাড়া দেয় নি সেভাবে। অনেকেই বোঝেন নি হয়তো, এরকম নিভৃতে বসে এমন কবিতাও লেখা যায়। মৃত্যু খুব প্রিয় বিষয় ছিলো কবির। ঘুরে ফিরে বারবার তার লেখায় চলে এসেছে গহীন কালো শীতল মৃত্যু। এবং তিনি কাতর হন নি।

তিনি কখনই বলেন নি, 'মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভূবনে'। আবার মৃত্যুকে আহ্বানও করেন নি। তারপরেও মৃত্যু তার কাছে প্রিয় ছিলো। এবং প্রিয় জিনিসের ব্যাপারে আমাদের একটা বাই-ডিফল্ট আবেগ কাজ করে। অনেক ভীড়ের মাঝে আমরা যেমন হুট করেই আপনজনের চেহারা খুঁজে পাই, তেমনি তার কবিতায় খুঁজলে তিনি কেবল মৃত্যুর চেহারাই দেখতেন।

একটা বিষয় খুব বেশি ঘনঘন আমাদের জীবনে ঘটতে থাকলে সেটার অসাধারণত্ব মিইয়ে যায়। আটপৌরে হয়ে পড়ে বার বার তার আসা-যাওয়া। অতিথিকে আমরা যেভাবে আদর-আপ্যায়ন করি, সে বসার ঘরে খাটিয়া পেতে ঘুমুতে শুরু করলে সেটা অচিরেই ম্যাড়মেড়ে হয়ে যায়। সে কারণেই মৃত্যুর মত বিশাল বিনাশী ব্যাপারটিকে তিনি ভেঙে চুরে কাঁথা-বালিশ বানিয়ে ফেললেন। ঘাস, পাতা, জানালা, দেয়াল, শিশির, জোছনা, এমন হাজারো অসংখ্য উপাদানের মাঝে টুকরো টুকরো করে মৃত্যু মিশিয়ে দিলেন।

আমরা পড়ার সময়ে খেয়ালও করি না, সর্‌সরে ময়াল সাপের মতো মৃত্যুছায়া পুরো পঙ্‌ক্তিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এভাবে মৃত্যুকে টেবিল-চেয়ার বানিয়ে ফেলার আরেকটা সুবিধা আছে। অপার্থিব অনুভূতিগুলো খুব সহজেই এই সব উপাদানের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। মনে হয় সবাই মিলে একটা স্ট্র দিয়ে মিষ্টি জুসের মতো মৃত্যুকে শুষে খেয়ে ফেলছে! কী অদ্ভুত কল্পনা, তাই না? জীবনের সকল উপাদান যখন তুচ্ছ হয়ে যাবে, আমাদের দপ্‌দপিয়ে দৌড়ে চলা কণিকা যখন ক্লান্ত হয়ে গতি থামিয়ে দিবে, ধুকপুকে হৃৎপিণ্ড অতি ধীরে স্তব্ধ হবে আর শৈত্যের প্রবল থাবা এগিয়ে আসবে, তখন হুট করেই আমার কবিকে মনে পড়বে। মৃত্যু খুব কঠিন কিছু তো নয়! জন্মানোর পরমুহূর্তেই হেঁচকি তুলে চিৎকার করে কেঁদে ওঠার চাইতেও সহজ শ্লথগতিতে চোখের তারার আলো ফুরিয়ে যাওয়া।

এলোমেলো হাঁটতে গিয়ে হুট করেই ট্রামের সাথে ধাক্কা খাওয়া। এভাবেই মৃত্যু আসে। আমাদের স্তব্ধ করে দিতে, আমাদের জীবনের সবটুকু আলো নিভিয়ে দিতে। কবির সাথে প্রথম পরিচয়ে মনে হয়েছিলো তিনি বেশ ম্রিয়মাণ। এই চিন্তাটা কতটা অপরিপক্ক ছিলো, তা এখন মনে পড়লে হাসি পায়।

আমি একটা নতুন তথ্য জেনেছিঃ অনেক সময় খুব মৃদু স্বরে বলা কথাগুলো সবচেয়ে জোরালো শোনায়, আর উচ্চকিত স্লোগানের চাইতেই তীব্র অনুরণন তৈরি করতে পারে। কবিতায় যতো নিয়ম কানুন বানানোর চেষ্টা হয়েছে, এই কবির লেখার পরে সেগুলো মোটামুটি হাস্যকর প্রস্তাবনা হয়ে গেছে। সবারই মনে হয়েছে এভাবেও কবিতা লেখা যায়। চমক কাটতে সময় লাগেনি, তারপরের সময়টুকু কেবল এই কবির জন্যেই স্তবকে স্তবকে ভরে গেছে। পরে জানলাম এই অনুভূতিটার নাম- আধুনিকতা।

প্রথা, সংস্কার এবং জোয়ালের মতো চেপে বসা সমাজে আমরা প্রতিনিয়ত যেভাবে ক্ষয়ে যাই, যেভাবে আমাদের ভেতর থেকে মৃত্যুর চেয়েও নিষ্ঠুরভাবে জীবন চুরি হয়ে যায়, সেখানে এই কবিই পথ দেখালেন। তার কথাগুলো আমার কাছে নতুন সত্যের মতো ধরা দিলো। অন্ধকার প্রবল হলেও আমার মনে হয়, সেখানে তিনি পাশেই আছেন। আমার কানের কাছে মৃদুস্বরে বলছেনঃ "আবার আকাশের অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছে : আলোর রহস্যময়ী সহোদরার মতো এই অন্ধকার। যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে অথচ যার মুখ আমি কোনদিন দেখিনি, সেই নারীর মতো ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়েছে উঠছে।

... ...ময়ূরের পেখমের মতো রঙিন পর্দায় পর্দায় কক্ষ ও কক্ষান্তর থেকে আরো দূর কক্ষ ও কক্ষান্তরের ক্ষণিক আভাস - আয়ুহীন স্তব্ধতা ও বিস্ময়। পর্দায়, গালিচায় রক্তাভ রৌদ্রের বিচ্ছুরিত স্বেদ, রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদ! তোমার নগ্ন নির্জন হাত; তোমার নগ্ন নির্জন হাত। " কবি মারা গেলেন চুয়ান্নের বাইশে অক্টোবর। আজকে থেকে ঠিক পঞ্চান্ন বছর আগে। ট্রামের চাকার সাথে যেই চিত্রকল্পগুলো হারিয়ে গেলো, যে পঙ্‌ক্তিগুলো নির্বাসনের নির্দেশ পেলো, সেগুলোর জন্যে আমার অনেক রাতেই মন খারাপ হয়ে যায়।

তারপরে অন্ধকারেই কল্পনা করি, কবির হাত মৃদু আমার কাঁধে এসে বন্ধুর মতো ছড়িয়ে আছে। তার মুখ অস্পষ্ট এবং ঘোলা। আমার চোখে অশ্রু। আমার মুখে একচিলতে হাসি। কেউ দেখছে না।

কারণ ঘর অন্ধকার। *** ২২.১০.৯

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.