মন তুমি কৃষিকাজ জানো না, এমন মানবজমিন রইলো পতিত; ফলালে ফলতো সোনা
২৪ বছর পরের একদিন - ১
আমার এনএসইউতে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হয়ে যাওয়ার পরে একদিন কি কাজে বুয়েটের ঐদিকে গিয়েছিলাম। সাখাওয়াতকে কল দিতে ও বললো আর্কিটেক্চার ডিপার্টমেন্টের দিকে আয়। যাওয়ার পরে দেখি ও ক্লাস ফেলে একটা মেয়েকে নিয়ে বের হয়ে আসলো। আমাদের স্যাক প্রেম করে এরকম একটা কথা কানাঘুষায় শুনছিলাম, তখন বুঝতে পারলাম ঘটনা কি। এমনিতে ওর মতো চাপা ছেলের কাছ থেকে কথা বের করা বেশ কঠিন।
এরমধ্যে আমি চাকরী নিয়ে চিটাগাং চলে আসি। ও ছুটিতে আসলে হঠাৎ হঠাৎ যোগাযোগ হতো। এরপরে ও যখন পড়াশুনা শেষ করে চিটাগাং চলে গেলো নিজের ফার্ম খোলার জন্য, তখন আমি আবার ঢাকা ফেরত এসেছি চাকরী ছেড়ে দিয়ে, এমবিএ করার জন্য। একদিন চট্টগ্রামে ছুটিতে গিয়ে দেখি আমার মা বাসার ভিতরে কিছু ভাংচুর করতে চান। আমি গিয়ে সাখাওয়াতকে ধরে নিয়ে আসলাম।
ও আম্মুর সাথে বসে প্ল্যান করে করে আমাদের রান্নাঘর দেখলাম পাল্টে ফেললো। আমি তখন চাকরীর ঝামেলা ছেড়ে দিয়ে আবার পড়াশুনায় ঢুকে রীতিমত মৌজে আছি। ক্লাস, ফুটবল খেলা, হোস্টেলে ল্যানে গেইম খেলা, সারারাত মুভি দেখা। এর মধ্যে একদিন খবর পেলাম ওর বাবার অবস্হা খুব খারাপ, ক্যান্সার। ওর বাবা-মা তখন দেশের বাইরে থাকেন।
সাখাওয়াতকে দেখলাম খুব সুন্দরভাবে সব সামলে নিয়েছে। চাকরী করছে, কয়েকজন মিলে আর্কির ফার্মটা দাঁড় করিয়ে ফেলেছে, ভালো ভালো কাজ করছে, বাসার কনস্ট্রাকশনের কাজ করছে, গ্রামের বাড়ীতে মসজীদ-মাদ্রাসার জন্য কাজ করছে, ছোট ভাই-বোনদের দেখাশুনা করা - সব যেভাবে করছে, রীতিমত মুগ্ধ করার মতো ব্যাপার। আমার বন্ধুদের মধ্যে এত তাড়াতাড়ি এতো ম্যাচিউরিটি আর কারো মধ্যে দেখিনি। এর কিছুদিন পরে ওর বাবা মারা যান। আমি ওর বাসায় গিয়ে দেখলাম ও ক্লান্ত হয়ে সোফায় বসে আছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে ধীরস্হির, ঠান্ডা মাথায় কিভাবে কি করতে হবে সব ঠিকঠাক করতে দেখলাম ওকে। নিজের এরকম অস্হির, খামখেয়ালীপনার পাশে এরকম দায়িত্ববান একজন বন্ধুকে দেখে বেশ গর্ববোধ করলাম।
মাঝখানে আবার কিছুদিন যোগাযোগ কম, একদিন ক্লাস থেকে নেমে আইবিএর ছোট মাঠে ফুটবল খেলছিলাম, এমন সময়ে সাখাওয়াতের ফোন পেলাম। ও বললো, "দোস্ত, আমার এনগেজমেন্ট কালকে। ডিসেম্বরের ৭ তারিখে বিয়ে।
" আমি হাসতে লাগলাম, এক-দেড় বছর পরে হয়তো দেখা যাবে ওর বাচ্চা-কাচ্চাও হয়ে গেছে। মাঝখানে আরো ২/১ বার ফোনে কথা হয়েছিলো। এরমধ্যে চাকরী পেয়ে বিশাল বিপদে পড়ে গেলাম। লাস্ট সেমিস্টার ইভনিং এ ক্লাস হতো, কিন্তু সারাদিন অফিস করে ৫টা কোর্সের ক্লাস করা, এরমধ্যে আবার রোজা শুরু হলো। পুরান নাম্বার ফেলে দিয়ে অফিসের নাম্বার, আমি মোটামুটি সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম।
এমনকি ঈদের সময় দেখি আমার নতুন মোবাইলে প্রায় কারোর নাম্বারই নেই। কাকে জানি বললাম সাখাওয়াতের নাম্বারটা পাঠা, আমার কাছে কারো নাম্বার নাই। সে পাঠালো না, আমার আর ঈদে সাখাওয়াতকে কল দেয়া হলোনা। সামনের সপ্তাহে খালাতো বোনের বিয়েতে ছুটি নিব, নতুন চাকরী এইসব চিন্তা করে ইদের পরেরদিন ঢাকা ফেরত আসলাম।
১৮ অক্টোবর, ২০০৭।
আমি সকালে খালাতো বোনের বিয়ের জন্য ছুটি নিয়ে চট্টগ্রাম আসার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ফজু ফোন দিলো, দেখি কাঁদতেছে, "দোস্ত, সাখাওয়াতকে ছুরি মারছে "। আমার অনেকক্ষন লাগলো বুঝতে সাখাওয়াতের মতো ছেলেকে কে ছুরি মারতে পারে! ঘটনা যা বুঝলাম, ও ঢাকা এসেছিলো। চিটাগাং এ ফিরে ভোরে বাসার কাছাকাছি পৌছানোর পরে ওকে ছিনতাইকারীরা ধরে। বাসার সামনে, ও হয়তো ছিনতাইকারীদের চিনে ফেলেছিলো।
ও বাধা দিতে গেলে ছুরি মেরে দেয়। ওর অবস্হা নাকি এখন খুবি খারাপ। আমি সারা রাস্তা বাসে ছটফট করতে থাকলাম। আমার বোন তখন চিটাগাং মেডিক্যালে, ওকে ফোন দিলাম। ও অপারেশন থিয়েটার ঘুরে এসে বললো, "অবস্হা খুবি খারাপ।
মিরাকল না ঘটলে আশা কম। " আমি চিটাগাং কিভাবে পৌছলাম আমার মনে নেই। ব্যাগ নিয়ে ছুটতে ছুটতে হসপিটাল পৌছলাম। অনেককে দেখলাম হসপিটালে। সবার মুখ থমথমে।
আমার বোন বললো, আর্টারি কেটে যাওয়াতে ওর ব্লাড সার্কুলেট করতে পারছেনা। ৬০/৭০ ব্যাগ অলরেডী দেয়া হয়েছে, কোন লাভ হচ্ছেনা, উল্টো পুরো শরীর ফুলে উঠছে। এখন পুরাপুরি আল্লাহর হাতে। কে জানি বললো, অপারেশন থিয়েটারের বাইরে আছে, দেখতে যাবি? আমি বললাম, না। কিছুক্ষন পরে কে জানি তাও নিয়ে গেলো।
দূর থেকে দেখে বুকে একটা ধাক্কা লাগলো। এত সুন্দর চেহারার একজন মানুষের এই অবস্হা? বাসায় চলে আসলাম। সবাই গায়ে হলুদে গেছে, আম্মা আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো। বললো, হসপিটালে নিয়ে যেতে। আমরা বের হওয়ার আগের মুহূর্তে সিং প্রু ফোন করলো, সাখাওয়াত আর নেই।
আমি কিছু বলতে পারলামনা। কিছু নরাধম, নর্দমার কীট জানতেও পারলোনা তারা দেশের কত বড় একটা ক্ষতি করে ফেললো।
পরদিন সকালে চিটাগাং মেডিক্যালের মর্গের সামনে দেখলাম স্কুলের, ক্যাডেট কলেজের, ওর বুয়েটের বন্ধুরা সব এসে হাজির। অনেকের সাথে অনেকদিন পরে দেখা। খন্দু বললো, 'ফিউনারেল ইজ দ্য বেস্ট রিইউনিয়ন ইউ কেন এভার হ্যাভ।
' ওর গ্রামের বাড়ীতে দাফনের সময়টা বুকের ভেতরটা কেমন যেন খালি খালি লাগছিলো, ঠিক যেন বুঝতে পারছিলামনা কি হচ্ছে। পরে দেখলাম সবাই আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। আসিফের কি এক অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে সবাই খুব হাসলাম, ওর দাফন শেষে ফেরত আসবার পথে বাসে কি একটা নিয়ে লোকজনের তুমুল তর্কও হলো। নিজেদের এত সহজে স্বাভাবিক হয়ে যাওয়া দেখে আমার কেমন জানি অস্বস্তি লাগছিলো, কেন আমরা শোকে ভেঙ্গে পড়ছিনা? তুমুল দু:খ কেন আমাদের পাথর করে দিচ্ছেনা? আমাদের মাঝখান থেকে একজন হারিয়ে গেলো আর আমরা এত অল্প সময়ে স্বাভাবিক হয়ে গেলাম? জীবনটাই কেমন অদ্ভুত! এর কিছুদিন পরে সাখাওয়াতের ছোটভাই আমার আইবিএ হোস্টেলের রুমে আসে। ও কোন একটা সাইটে ওর ভাইকে নিয়ে কিছু লিখেছে সেটা দেখাতে চাচ্ছিলো।
ঠিকমতো পারলোনা, আমার সামনে চেয়ারে বসে কাঁদলো, পরে চলে গেলো। এরপরে একরাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখলাম, আমি কোন একটা গভীর অতলে পড়ে যাচ্ছি। হাত দিয়ে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করলাম, ধরতে পারছিনা। দেখলাম সাখাওয়াত আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। গভীর রাতে আমি ঘুম থেকে জেগে উঠলাম, আমার চোখ ভেজা।
আমার ভিতরটা হাহাকার করে উঠলো, আমার মনে হলো আমি সাখাওয়াতকে আর কখনো দেখবোনা।
সাখাওয়াত, দোস্ত তোকে আমি এখনো দেখি। মাঝেমধ্যে অনেক রাতে ব্যর্থ ঘুমের চেষ্টা করতে করতে চোখের সামনে তোর ছবি ভেসে উঠে। কখনো তোর ক্লাসরুমে জানালার পাশের সীটে গালে হাত দিয়ে বসে খাতায় আকিবুকি কাটা, কখনো তোর সেই একটু বেশী আকাশী স্লিপিং ড্রেসটা পড়ে তোদের হাউসের সামনে, কখনো বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে তোর খরগোশের মতো স্কোর করার চেষ্টা, ছেড়া দ্বীপের বালির মধ্যে তোর সেই সোয়েটার মাথায় দিয়ে রোদ থেকে বাঁচার চেষ্টা আবার কখনোবা চন্দনপুরায় তোদের বাসায় আংকেল মারা যাওয়ার পরে তোর সেই ক্লান্ত ভঙ্গীতে বসা থাকা। এখনো আমার মনে হয় তোর সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে যাবে অথবা তোর কল পাবো হঠাৎ একদিন।
তোদের বাসার সামনে দিয়ে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় কেমন জানি হাত পা ভারী হয়ে আসে। ২ বছরে অনেককিছু পাল্টে গেছে, তারপরেও মনে হয় এই রাস্তায় তুই রক্তাক্ত হয়ে পড়েছিলি। ঈদের পরে তোর বাসায় গিয়েছিলাম, আন্টি বললেন, "তোমরা সেই বৃহস্পতিবারেই আসলে?"....আমি স্যরি দোস্ত তুই খোঁজ করছিলি, তারপরেও ঐ ঈদে তোকে ফোন করা হলো না। এই একটা কল না করার আক্ষেপ আমার কখনো যাবেনা। এখন চারপাশের লোকজনকে কেমন আছে জানার জন্য হলেও প্রচুর কল করি, তারপরে মাস শেষে মনে হয় একটা কল কম করা হলো।
...দোস্ত, আমি স্যরি....সাখাওয়াত, তুই কি শুনতে পাচ্ছিস?????
[আমার বন্ধু সাখাওয়াত (জুয়েল) এর ২য় মৃত্যুবার্ষিকী ছিলো ১৮ই অক্টোবর। ওর স্মরণে এই লেখা। আল্লাহ ওকে বেহেশতে নসীব করুন। ]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।