আদর্শটাকে আপাতত তালাবন্ধ করে রেখেছি
লুম্বিনী বনে অশ্বত্থ বৃক্ষের নিচে হাঁটুমুড়ে বসার সময় চোখের সামনে দিয়ে হঠাৎ করে তীরাকৃতি ধরে পাখিটা চলে যায়। পঞ্চরাত্রি একটানা ভুলে থাকার কঠোর তপস্যার পর চোখের সামনে ঘোর ধরে; লুম্বিনী বনের প্রতিটা পাখি আস্তে আস্তে অ্যারোপ্লেন হতে থাকে- সাত সমুদ্র ধারে কাছে নেই, সাত বন পার হয়ে কথিত ম্লেচ্ছদের বটবৃক্ষে বসে বটফল খায় পাখিগুলো।
সিদ্ধার্থের মনে প্রতিটা বারই প্রথমবার, তাই আবারও প্রথমবারের মতো চোখ দিয়ে পানি পড়ে। আস্তে আস্তে পুষ্করিণী গড়ে উঠতে থাকে লুম্বিনী বনের মাঝবরাবর- ম্লেচ্ছদের দেশ থেকে পাখপাখালিরা এসে সেখানে বিকিনি পড়ে সাঁতার শিখে; গাঢ় চোখে তাকায় একে-অপরের মাংসল উরুতে।
গভীর রাতে সিদ্ধার্থের গলা বেয়ে অজগর সাপ নামে।
কখনো পায়ের উপর দ্বিখণ্ডিত জিভ ছুঁয়ে সিদ্ধার্থের চামড়ার গন্ধ নিয়ে কুঁচকে যাওয়া মনের অভিশাপ টের পায়- কিছুপরে সিদ্ধার্থের গলায় মালা হয়ে ঝুলে পড়ে। প্রতিবারই অজগরের মুখের সামনে থাকে সিদ্ধার্থের কণ্ঠনালী- মানবিক স্বার্থপরতার জন্য অসংখ্যবার ক্ষমা চাওয়া কণ্ঠ কখনো নীল হয় না বলে অজগরের লোলুপ দৃষ্টি মাঝে মাঝে ঝলসে উঠে!
একটানা তেইশ ঘণ্টা পাখির ডানায় চড়ে নিজের কৌপিনমাখা দেহটাকে ভারি পুলিন্দার মতো মনে হয় সিদ্ধার্থের- জগতের দুঃখ দূর করার বাসনা খানিকটা হলেও নিজের উপর চড়ে বসতে থাকে- নিজেকে জগতের চেয়ে আলাদা কিছু মনে হয় না। জলক্রীড়ার সাথে রোদেলা বাতাস পোহানো মানুষগুলো সিদ্ধার্থের কৌপিনতাকে ভিনবাসীর মতো স্বাগত জানায়, আস্তে আস্তে সিদ্ধার্থের শুষ্ক গলা থেকে কর্কশ শব্দের মতো ওম্ ধ্বনি ভেসে আসে- আমি ওইদেশে যাবো!
মানুষগুলো টের পায় সিদ্ধার্থের মায়াবতী রক্তপ্রবাহ, কিন্তু তা ভিনদেশের রক্তপ্রবাহ- লুম্বিনীর মতো নয়। আস্তে আস্তে পাখিদের আনাগোনা কমতে থাকে, সরতে থাকে পুকুরের ওপর থেকে আসা বাতাসের দুলুনি। নেট কানেকশনের উৎসাহী তারগুলো মাটির ব্যাকটিরিয়ার সাথে গলা জড়াজড়ি করে ঘুমাতে যায়।
সিদ্ধার্থ ফিরে আসে আপনভুবনে।
আবার থিতু হয় ওই গাছতলাতেই, অ্যারোপ্লেনের ন্যায় পাখির গতিপথ দেখলে চোখ অবাধ্য হয়, পুষ্করিণীর উপর থেকে ভেসে আসা বাতাসে আর্দ্র হয়, কিন্তু সিদ্ধার্থ অনুভব করে পুষ্করিণীর বাতাস দিকভুলে মাঝে মাঝে লুম্বিনীর উপর দিয়ে যায়। পাথুরে মাটি যেভাবে পাললিক শিলায় পরিণত হয়, সিদ্ধার্থের দেহ তেমনি লৌকিকতায় সিদ্ধিলাভ করতে থাকে- খুব আস্তে আস্তে। এ সময় তার ধ্যান ভাঙায় না কেউ- গতির জগতে সিদ্ধার্থ নামক জড়প্রাণী অচল।
হাঁটুর বাটে শুকনো পাতা ঝরে পড়ার সাথে সাথে সিদ্ধার্থ নিজের পরিবর্তন নিয়ে আনন্দিত হয়- জলকেলী থেকে উঠে আসা গতিময় মানুষ দেখে অনড় পিণ্ডটাকে- নাম দেয় 'সিদ্ধিলাভ করেছেন যিনি'।
গৌতম বুদ্ধের যুগে মিডিয়া ছিলো না- মিডিয়া এসে লুম্বিনী বনকে ওপারে বিলাতেও পাঠিয়ে দেয়- নিঃশব্দে যমুনাবাসী উপলব্ধি করে, এ যুগের সিদ্ধার্থরা গৌতম বুদ্ধ হতে পারে না, বড়জোড় কল্পনাবিলাসী রোবটের আস্তরণ গায়ে জড়াতে পারে।
হৃদয়কম্পহীন রোবট দেখে নিঃশব্দবাসিনী আনন্দনয়নে পায়চারী করে, দীর্ঘশ্বাসের কোনো শব্দও রোবটের কানে যায় না- কারণ, দুঃখ নয়, দীর্ঘশ্বাস। দীর্ঘশ্বাসকেই ধারণ করতে হয় একালের সিদ্ধার্থদের।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।