গরীবের নুন আনতে পান্ত ফুরানোর গল্পঃ
সামনে বোর মৌসুম। বোর ধানের উৎপাদন লক্ষ্য মাত্র ধরে রাখতে অত্যাবশকীয় ইউরিয়া সারের পর্যাপ্ত মুজুদ (২৯.৫১ লক্ষ মেট্রিক টন) ও সরবরাহ নিশ্চৎ করা- যা এই মুহুর্তে শিল্প মন্ত্রী দিলিপ বড়ুয়ার মাথা ব্যথার অন্যতম কারণ। তিনি আরও উদ্বিগ্ন কারণ.......গ্যাস স্বল্পতার কারণ গত ২৬ এপ্রিল ২০০৯ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত অন্যতম ইউরিয়া সারকারখানা 'চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা'(CUFL) এর উৎপাদন বন্ধ করে রাখা হযেছে । CUFL এর গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে পেট্রোবাংলা সে গ্যাস মূলতঃ সে গ্যাস সরবরাহ করেছে রাউজানের বিদ্যুৎ কেন্দ্রে । ইউরিয়া উৎপাদনের লক্ষমাত্রায় পৌছাতে শিল্প মন্ত্রী প্রয়োজনে বিদ্যুৎ উপাদান বন্ধ করে CUFL চালুর করা প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব দিযেছেন।
যে গ্যাস টুকু এখন প্রতি দিনপাওয়া যাচ্ছে তা নিযে এহন টানাটানি ' গরীবের নুন আনতে পান্ত ফুরানোর কাহিনী' মনে করিয়ে দেয়।
গ্যাস সংকটে শুধু শিল্প মন্ত্রী উদ্বিগ্ন নন কিংবা শুধু CUFL বন্ধ হযে ৫ মাসে ২০০ কোটি টাকা লোকসান গুনছে না। গ্যাস নিয়ে আমরা সকলেই খুব উদ্বিগ্ন। সার কারখানার উৎপাদন বন্ধ কারণ গ্যাস নেই। বিদ্যুৎ নাই, ঘন ঘন লোড শেডিং , সাধারণের ওষ্ঠগত প্রাণ, উৎপাদন ব্যবস্থা স্থবির ;কারণ গ্যাস নাই।
সে দিন দেখলাম 'স্যান্ডার সিরামিক' তাদের অর্ধ প্রস্তুত তৈজসপত্র স্তুপ করে রেখেছে , নকশা করা যাচ্ছে না, কারণ তাদের গ্যাস নেই। চট্টগ্রামে আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ। শিল্প ক্ষেত্র গ্যাস সরবরাহ বন্ধ বহু যুগ।
পেট্রোবাংলার দূর্ভাবনাঃ
গ্যাস সংকট / স্বল্পতা নিয়ে আমরা সকলে যখন এত চিন্তিত তখন সরকারের এ সংক্রান্ত কর্তাব্যক্তিরা বিষয় টি নিযে আসলে কত টুকু চিন্তিত আসুন সে টা খোজ নিয়ে দেখা যাক। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ-জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রানলয়ের অধীনস্ত 'পেট্রোবাংলা ' নামক প্রতিষ্ঠান টি গ্যাসের উৎপাদন -ব্যবহার - সরবরাহ যাবতীয় বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে ।
সুতরাং এই প্রতিষ্ঠানের এই মুহুর্তে প্রধান এবং প্রথম দুশ্চিন্তার বিষয় হওয়া উচিৎ - কিভাবে দেশের গ্যাস স্বল্পতার মোকাবেলা করা যায়। কিন্তু , প্রতিষ্ঠান টির MIS REPORT JULY 2009 (মাসি প্রতিবেদন -জুলাই ২০০৯) এ ''আগামী দুই মাসে বড় রকমের কোন সমস্যা/সংকটের আশঙ্কা করা হলে তার বিবরণঃ '' শীর্ষক পাতায় সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি প্রসঙ্গ এক নম্বব সমস্যা হিসাবে হাজির হযেছে।
''১। পেট্রোবাংলাঃ
ক) উৎপাদন বন্টন চুক্তির আওতায় আইওসি কোম্পানীসমূহের উৎপাদিত গ্যাস সরকারের পক্ষে আন্তর্জাতিক মূল্যে পেট্রোবাংলা ক্রয় করে যাহার প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের মূল্য বাংলাদেশী মূদ্রায় প্রায় ২১০·০০ টাকা। অথচ, ক্রয়কৃত এই গ্যাস সরকার নির্ধারিত অতন্ত কম মূল্যে তথা প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাস গড়ে মাত্র ৯২·৮৪ টাকা হারে বিক্রয় করা হইতেছে।
ক্রয় মূল্য ও
বিক্রয়মূল্যের এই পার্থক্যের কারণে পেট্রোবাংলার তহবিল ঘাটতির পরিমান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতেছে। উল্লেখ্য, আন্তুর্জাতিক কোম্পানীসমূহের বর্ণিত বিলসমূহ সুদ ব্যতীত ৩০-৪৫ দিনের মধ্যে পরিশোধের ব্যর্থতায় Libor+১% হারে বৈদেশিক মূদ্রায় সুদ Payment Obligationপরিশোধের বাধ্যবাধকতা রহিয়াছে। এই অবস্থায় পেট্রোবাংলার Payment Obligation মিটানো, বৈদেশিক মূদ্রায় সুদ পরিশোধের বিষয়টি পরিহার তথা দেশের গ্যাস সরবরাহের সামগ্রিক ব্যবস্থা সচল রাখিবার নিমিত্তে বর্ণিত ইনভয়েসসমূহ পরিশোধের
জন্য সরকারের নিকট বিভিন্ন সময়ে আর্থিক মঞ্জুরী চাওয়া হয়। সর্বশেষ গত ৪-১১-২০০৮ তারিখে সর্বমোট ২৩৬৮·৪৩ কোটি টাকা ক্রমপুঞ্জিভূত ঘাটতির বিপরীতে ১৫০০·০০ কোটি টাকা ভর্তুকি মঞ্জুরী চাওয়া হইয়াছে। এই অর্থের পরিমান ক্রমানয়ে বৃদ্ধি পাইতেছে।
এই অবস্থায় আগামী মাসগুলিতে আর্ন্তুজাতিক তেল কোম্পানী সমূহের বিল পরিশোধে পেট্রোবাংলার Payment Obligation মিটানো খুবই দুরূহ হইয়া পড়িবে। সেই ক্ষেত্রে গ্যাস সরবরাহকারী বর্ণিত কোম্পানী সমূহ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিল পরিশোধে ব্যর্থতায় সুদ আরোপ সহ গ্যাসের সরবরাহ বন্ধের বিষয়টিও হুমকির সন্মুখীন হইয়া পড়িবার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে।
পেট্রোবাংলার বক্তব্য থেকে বোঝা যায় বাংলাদেশের ক্রিয়াশীল আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানী গুলোর কিভাবে কঠিন ফাঁস হিসাবে পেট্রোবাংলা তথা জাতির গলায় চেপে বসেছে । পেট্রোবাংলা যখন দেশের চলমান গ্যাস স্বল্পতা মোকাবেলা নিযে উদ্বিগ্ন থাকার কথা' তখন প্রতিষ্ঠানটি 'আই ও সি' র পুঞ্জিভুত গ্যাসের মূল্যে দায়ভার বা Payment Obligation নিযে বিচলিত। তাদের বক্তব্যে এ রকম আভাসও রয়েছে ক্রিয়াশীল আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানীগুলোর যে কোন সময় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে সমগ্র জাতিকে জিম্মি করে ফেলতে পারে।
একটি বিশ্লেষন প্রয়াস ঃ
পি এস সির আওয়তায় ক্রিয়াশীল আই ওসি গুলো সংক্ষিপ্ত কর্মকান্ডের বিশ্লেষণ।
বাংলাদেশের স্থলভাগ ও সংলগ্ন সমূদ্র সীমায় ২৩ টি ব্লকের মাঝে ১৯৯৩/৯৪ সালের ইজারা প্রক্রিয়ার আওতায় ৮ টি ব্লক এবং মডেল পিএস সি ১৯৯৭ এর আওতায় আরও ৪ টি সর্বমোট ১২ টি ব্লক ১৯৯৪ সাল হতে ২০০০ সাল পর্যন্ত উৎপাদন বন্টণ চুক্তির নামে অনৈতিক ভাবে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানীর নিকট তুলে দেওয়া হয়। সর্বমোট ১২ ব্লক আন্তজাতিক তেল কোম্পানীসমূহের নিকট ইজারা দেওয়া হলেও অদ্যাবধি এ গুলোর মাঝে মাত্র ৫ টি ব্লকে (শেভরণ ব্লক-১২,১৩ ও ১৪; কেয়ার্ণ ব্লক-১৬ এবং টাল্লো -৯) সীমিত আকারে উৎপাদস কার্যক্রম চালাছে। ( বিস্তারিতঃ সাগর বক্ষে গ্যাস ব্লক ইজারার উদ্দেশ্য গ্যাস সংকট মোকাবেল না রফতানি?)
আই ও সি ও রাষ্ট্রয়াত্ত গ্যাস উৎপাদক কোম্পানীত্রযের তুলামূলক উৎপাদন চিত্র
জুলাই ২০০৯ এর পেট্রোবাংলার রিপোর্টে দেখা যায় বর্তমানে দেশের দৈনিক মোট উৎপাদনের৫৩% আসে আই ওসি গুলো ( শেভরণ-কেয়ার্ণ-টাল্লো- নাইকো) এর পরিচালিত গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর থেকে । অপর দিকে ৩ টি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব গ্যাস উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের ( বাংলাদেশ গ্যাস ফ্লিড- সিলেট গ্যাস ফিল্ড - বাপেক্স) নিকট হতে অবশিষ্ট ৪৭% শতাংশ আসে।
মাত্র ৪/৫ বছর আগে এই চিত্র টি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত । ২০০৪-২০০৫ অর্থ বছরে আই ও সি গুলোর সরবরাহ করেছিল ৩৭ % আর রাষ্ট্রায়ত্ত্ব গ্যাস উৎপাদক প্রতিষ্ঠানত্রয়ের ৬৩%। অর্থাৎ গ্যাসের জন্য আমরা দিন দিন আন্তজাতিক তেল কোম্পানীসমূহের নিকট অধিক মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পরছি।
আন্তজাতিক তেল কোম্পানীসমূহের নিকট হতে গ্যাস ক্রয়ের চালচিত্রঃ
শুধু ২০০৮-২০০৯ অর্থ বৎসরে ৩ টি আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানী ( শেভরণ-কেয়ার্ণ-টাল্লো) নিকট হতে তাদের উৎপাদিত গ্যাসের Cost Recovery ও Profit Share অংশ ১৫৯.৯৬ বিসি এফ গ্যাস সর্বমোট ৩০০০.৭০ কোটি টাকায় ক্রয় করা হয়। অর্থাৎ প্রতি হাজার ঘন ফুট গ্যাসের ক্রয় মূল্য দাড়ায় ১৮৮.৭৮ টাকা।
পূর্বেই উল্লেখ করা হযেছে যে প্রতি হাজার ঘন ফুট গ্যাস ৯২.৮৪ টাকায় গ্যাস ব্যবহারকারীদের নিকট পেট্রোবাংলা তথা সবকারবিক্রয় করে।
আই ও সি নিকট হতে ক্রয় কৃত প্রতি হাজার ঘন ফুট গ্যাসে (১৮৮.৮৭-৯২.৮৪=) ৯৫.৯৪ টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। অর্থাৎ ২০০৮-২০০৯ সারে আন্তর্জাতিক কোম্পানীগুরো থেকে ক্রয়কৃত গ্যাসে মোট ভর্তৃকি পরিমাণ দাড়ায় ১৫৩৪.৬৫ কোটি টাকা।
উল্লেখ্য যে রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস উৎপাদক কোম্পানীত্রয় এর নিকট হতে প্রতি হাজার ঘন ফুট গ্যাস গড়ে ৬৫ টাকায় ক্রয় করা হয়, যে বিক্রয় লব্দ অর্থের সিংহ ভাগ টাকা কোম্পানী ত্রয় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ভ্যাট-ট্যাক্স হিসাবে জমা দেয়।
ভর্তুকির টাকা কে যোগায়?
২০০৮-২০০৯ অর্থ বৎসরে গ্যাস সেক্টরের ক্রয়াশীল পেট্রোবাংলা ও তার অধীনস্ত ৯ টি রাষ্ট্রায়াত্ত প্রতিষ্ঠান আবগারী শুল্ক/ভ্যাট-সাপ্লিমেন্টারি কর- আয়কর - লভ্যাংশ হিসাবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে সর্বমোট ৩৩৬০.৫২ কোটি টাকা জমা প্রদান করেছে যার মাঝে শুধু ৩ টি গ্যাস উৎপাদক কোম্পানির রাষ্ট্রীয় কোষাগারে প্রদেয় ২১৩৩.১৮ কোটি টাকা।
অর্থাৎ , সরকার আইওসিগুলোর কাছ থেক উচ্চমূল্য গ্যাস ক্রযে এখন পর্যন্ত অন্য সেক্টর হত উপার্যিত অর্থের উপর নির্ভর করতে হয় না। এবং এখনও সেক্টর ভিত্তিক অর্থে যোগান থাকায় জনগণের উপর গ্যাসে মূল্যেবৃদ্ধি জনিত সরকার তরফের চাপ তত প্রকট নয়।
কিন্তু, এক দিকে যে ভাবে গ্যাস উৎপাদনে আইওসিগু্লোর উপর সরকার নির্ভরশীল হযে পরছে ও অপর দিকে সরকারে অবহেলায় রাষ্ট্রায়ত্ত্ব গ্যাস উৎপাদক কোম্পানীত্রয়ে উৎপাদন ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে ; সেই অবস্থায় অদূর ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলো হতে ক্রয়কৃত গ্যাসের মূল্য পরিশোধের জন্য সরকার কে গ্যাস্যের মূল্যবৃদ্ধি মাধ্যমে সম্পূর্ণ বোঝা জনগণের কাঁধে সরাসরি চাপানো ছাড়া আর কোন বিকল্প থাকবে না।
মডেল পিএস সি ২০০৮ এর বোঝা কে বইবেঃ
জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ' তেল-গ্যাস-বন্দর-বিদ্যুৎ রক্ষায় জাতীয় কমিটি'র সাথে আলোচনায় বলেছেন, কোন গ্যাস বিদেশে রফতানি হবে না'। আমি তাদের এ উক্তি সরল মনে মেন নিলাম।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ,এই গ্যাসের সিংহ ভাগ ( ৮০%) ইজারা চুক্তিবদ্ধ আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানির নিকট হতে বাংলাদেশ কে ক্রয় করতে হবে কিনা? আর যদি ক্রয় করতে হয় তবে কত টাকায় আমাদের নিজেদের গ্যাস অপরের নিকট হতে ক্রয় করতে হবে?
মডেল পিএসসি -১৯৯৭ অনুসারে গ্যাস ক্রয়ের সিলিংকৃত প্রতি হাজার ঘন ফুটের সর্বোচ্চ মূল্য ছিল ৩ মার্কিন ডলার বা ২১০ টাকা (প্রতি মেট্রিক টন হাই সালফা ফুয়েল তুল্যমূল্য ১২০ মার্কিন ডলার) আর মডেল পিএসসি -২০০৮ এ তা দাড়াবে ৪.৫ ডলার বা ৩১৫ টাকা (প্রতি মেট্রিক টন হাই সালফা ফুয়েল তুল্যমূল্য ১৮০ মার্কিন ডলার)।
২১০ টাকায় পূর্বতন ইজারা চুক্তির সীমিত গ্যাস ক্রয়ে সরকারের কী র্দূর্গতি তা সরকারের নিজ ভাষায় আমরা আগেই পড়েছি পেট্রোবাংরার মাসিক প্রতিবেদন জুরাই ২০০৯ এ। তাহলে অদূর ভবিষ্যতে ৩১৫ টাকা মূল্যের বিপুল পরিমাণ গ্যাস ক্রয় করে কিভাবে সরকার দেশের উন্নয়নে ব্যবহার করবে সে বিষয়ে জনগণ কে কোন চুক্তি চুড়ান্ত স্বাক্ষরের আগে আজ এখনই জানাতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।