আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সৃষ্টিদর্শন : মানুষের জন্ম



সৃষ্টিতত্ত্ব বা আত্মপরিচিতিমূলক জ্ঞান সকলের জন্যেই একটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যন্ত জরুরী বিষয়। কেননা প্রতিটি ব্যক্তি তার নিজের অবস্থান, ক্ষমতা, সূচনা এবং শেষ পরিণতি বা গন্তব্য সম্পর্কে জ্ঞান না রাখলে সে নিজের কল্যাণ ও অকল্যাণ সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্তই নিতে পারবে না। তাই আমাদেরও নিজ সত্তার অস্তিত্ব সম্পর্কে কোন ধরণের সিদ্ধান্ত নিতে হলে আমাদের সর্বপ্রথম দায়িত্ব হল তার সম্বন্ধে যথাযথ জ্ঞান লাভ করা। একইভাবে আমরা এই বিশাল সৃষ্টিজগতের একটি সৃষ্টজীব যে নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করিনি বরং সৃষ্টি করা হয়েছে। আমি যদি নিজেকে সৃষ্টি করতাম তাহলে অবশ্যই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হতাম।

অথচ আমি তেমনটি নই। শুধু তাই-ই নয় আমার বর্তমান অস্তিত্বকে যদি আমিই সৃষ্টি করে থাকতাম তাহলে আমার এই সৃষ্টির পূর্বে আমার অস্তিত্ব অনিবার্যবশত থাকতে হবে; যা সম্পূর্ণরূপে একটি অসম্ভব কল্পনা। এমনকি আমরা যদি মনে করি আমাদের মত কোন সৃষ্টি আমাকে অস্তিত্ব দান করেছে সেক্ষেত্রেও ঐ একই প্রশ্নের সম্মুখীন হব। যে সত্তা আপন অস্তিত্ব লাভে অন্যের মুখাপেক্ষী সে কিভাবে তার মত অন্য একটি অস্তিত্বকে সৃষ্টি করবে? আর যদি এমনটি ধারণাও করি যে অন্য একটি সৃষ্টি তাকে অস্তিত্ব দান করেছে; এভাবে সৃষ্টি পরম্পরায় অপর সৃষ্টিকে অস্তিত্ব দান করে আসছে। তাহলে প্রথম সৃষ্টিকে কে অস্তিত্ব দান করলো; এ প্রশ্ন থেকেই যাবে।

এভাবে এই সৃষ্টিচক্র এক পর্যায়ে যেয়ে অবশ্যই সমাপ্ত হতে হবে নতুবা এটা হবে একটি দুষ্টচক্র যা দর্শনে বাতিল যুক্তি বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আর এ ছাড়া সৃষ্টি অর্থই হচ্ছে যা এক সময় ছিল না এবং এক সময় আবার থাকবে না। তাই এই অস্তিত্ব প্রদানে এমন এক মহাশক্তির প্রয়োজন যে এই সৃষ্টিসমূহের পূর্বে থাকবে এবং সৃষ্টিসমূহের স্থায়িত্বকালব্যাপীও তাকে থাকতে হবে। এমন কি যদি বস্তুবাদীদের মত ধারণাও করি যে মানুষ প্রকৃতির সৃষ্টি। তাহলে আমরা যে প্রশ্নগুলোর সম্মুখীন হব তাহল প্রকৃতিকে কে অস্তিত্ব দান করলো? এক্ষেত্রে আরও একটি প্রশ্ন হচ্ছে সৃষ্টির বৈশিষ্ট্যগুলো স্রষ্টার মধ্যে অবশ্যই পূর্ণরূপে অবস্থান করতে হবে।

অথচ মানুষের মধ্যে যে বৈশিষ্ট্যগুলো আছে তার অধিকাংশই প্রকৃতির মধ্যে নেই। প্রকৃতি হল সম্পূর্ণরূপে বস্তুসত্তা আর মানব প্রকৃতিতে বস্তুসত্তা বর্হিভূত অনেক বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। প্রকৃতি বা বস্তু অর্থ আধার/ আড়াল তাই বস্তুর বৈশিষ্ট্য হল সে তার নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত নয়। আর এক্ষেত্রে মানুষকে বলা হয় স্বজ্ঞেয় সত্তা যে তার নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত আছে বা জ্ঞান রাখে। 'বিগ ব্যাং' বা বিরাট বিস্ফোরণের সূত্রও আরেকটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক কল্পনা বৈ কিছু নয়।

এটা বস্তুবাদী জ্ঞানের চুড়ান্ত ফল হিসেবে প্রতিফলিত হয়েছে। এ বিষয়টি এমন একটি তথাকথিত বুদ্ধিমান মানুষদের ধারণা যারা নিজেদেরকে বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারক বলে মনে করেন। তাদের সূত্রের সংক্ষিপ্ত রূপ হল বিশ্বে কোন কিছুই ছিল না হঠাৎ মহা বিস্ফোরণ ঘটে এই মহা জগতের সৃষ্টি হয়েছে। এ ধরণের যুক্তিশূন্য কথা রাজার নতুন পোশাকের মত জ্ঞানীদেরও বোকা বানিয়ে দিয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথম প্রশ্ন হল, মহাশূন্য কথাটির কোন বাস্তব রূপ আছে কি? বা মহাশূন্যের কোন অস্তিত্ব আছে কি? বস্তুজগতে [বস্তুবাদী চিন্তায়] কোন মহাশূন্য কল্পনা করা সম্ভব কি? আদৌ সম্ভব নয়।

কেননা তাদের ধারণা অনুযায়ী বস্তুর বাইরের কোন অস্তিত্ব সমান অনস্তিত্ব । তাই এ ধারণা অনুযায়ী 'কিছুই ছিল না' থেকে 'সব কিছু হয়েছে' এটা ঘোড়ার ডিমের মত বিষয় যে, ঘোড়া কখনো ডিম পাড়ে না; কিন্তু একবারই একটা ডিম পেড়েছে। আরো মজার ব্যাপার হলো তাদের কথা অনুযায়ী কোন কারণ ছাড়া কার্য সংঘটিত হয় না। অথচ এক্ষেত্রে তারা বোকার মত গ্রহণ করে নিয়েছেন যে এই একটি ঘটনায় কোন কারণের প্রয়োজন পড়েনি। অতএব বস্তুবাদীদের বস্তুর সীমানায় সৃষ্টিজগতের সূত্র নিয়ে এর বেশী ব্যাখ্যা প্রদান আদৌ সম্ভব নয়।

এমনকি যদি ধরেও নেয়া হয় যে বর্তমান বিশ্ব একটি বিরাট বিস্ফোরণের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে তাতে ইসলামী ধারণার কোন অসুবিধা নেই। কেননা ইসলামী চিন্তায় যে বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে তা হল বিস্ফোরণ হোক আর যাই হোক না কেন এর পিছনে স্রষ্টার পরিকল্পিত শক্তি কাজ করেছে। তাই একটি বিষয় আমাদের কাছে স্পষ্ট যে এই বিস্ফোরণ সংঘটিত হওয়ার পূর্বে এমন কোন অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকতে হবে যে অস্তিত্ব তার বিজ্ঞ পরিকল্পনার ভিত্তিতে এ বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। শেষের এই ধারণাটুকু উপরের ধারণার সাথে সংযুক্ত করলে বিষয়টি সম্পূর্ণ যুক্তির ছকে দাঁড় করানো সম্ভব। নতুনা বিস্ফোরণের সূত্র রাজার নতুন পোশাক গল্পে ছোট শিশুর মতো ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের মানুষরাও এই সূত্রের তথাকথিত জ্ঞানীদের মুখোশ উন্মোচন করতে সক্ষম।

অবশ্য শেষোক্ত ধারণাটুকু তাদের কাছে প্রত্যাশা করা চলে না। কেননা এটা সম্পূর্ণ বস্তুবাদী বিশ্বের বাইরের কথা তাই এই কথায় তাদের আসতে হলে বস্তুর সীমানা পাড়ি দিয়ে আসতে হবে। এ কথাগুলো উল্লেখ করার একমাত্র উদ্দেশ্য হল মহান স্রষ্টা অতি সুন্দর পরিকল্পনায় এ বিশ্বকে সাজিয়েছেন। আর এই বিশ্বের রাজমুকুট স্বরূপ সৃষ্টি করেছেন মানুষকে। এজন্য আল্লাহ বলেছেন আমি ভূ-পৃষ্ঠে আমার প্রতিনিধি পাঠাতে চাই।

অতএব এই মানুষের প্রকৃত অবস্থান হল 'মাকামে খালিফাতুল্লাহ্' অর্থাৎ সে সৃষ্টিজগতে মহান স্রষ্টার প্রতিনিধিত্ব করবে। সৃষ্টিজগতের মানগত স্তর সৃষ্টি জগতকে তার মানগত স্তরের দিক থেকে চারটি স্তরে শ্রেনীবিন্যাস করা হয়। এই স্তরগুলোর ধারাবাহিক ক্রমপর্যায়ের ভিত্তিতে উপরের চিত্রটি সাজানো হয়েছে। এখন মানুষ যদি পাশবিক স্তর অর্জনের জন্য দিনরাত চেষ্টা করে তাহলে সে নিজকেই অবমূল্যায়ন করলো। কেননা পাশবিক স্তর হল তার স্তর থেকে নিম্ন পর্যায়ের অবস্থানের সৃষ্টি।

আর এজন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি তার যথার্থ অবস্থান সম্পর্কে অবগত আছে সে মুক্তি পাবে। মহান আল্লাহ বলেন : আমি ভূ-পৃষ্ঠে আমার প্রতিনিধি পাঠাতে চাই। সৃষ্টিকুলের শ্রেষ্ঠ জীব মানুষকে মহান আল্লাহ্ তায়ালা অত্যন্ত সম্মান এবং ভালবাসার পরশে সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেন : নিশ্চয় আমি আদম-সন্তানকে অতি মর্যাদা দান করেছি। [বনি ইসরাইল : ৭০] ।

তিনি আরো বলেন : আমি স্বহস্তে তোমাকে সৃষ্টি করেছি [সুরা সোয়াদ : ৭৫] এই মানুষকে পৃথিবীতে চলার সকল উপযুক্ত উপকরণ তিনি দান করেছেন। তাকে দিয়েছেন শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও অন্তর। যাতে সে এ ধরাতে যথাযথভাবে বসবাস করতে পারে এবং ন্যায়-অন্যায় সত্য মিথ্যাকে পৃথক করে তার উন্নতির পথে যাত্রা করতে পারে। এই মানুষের জন্যই মহান স্রষ্টা পৃথিবীকে এত সুন্দর করে সুসজ্জিত করেছেন। যার মাথার উপরে অবস্থান করছে বিস্ময়কর চন্দ্রসূর্য ও নক্ষত্রখচিত বিশাল আসমান আর পদতলে সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা আবাদ ও বাসযোগ্য তৃণভূমি।

আর আসমান ও জমীনের মাঝখানে অবস্থান করছে বিভিন্ন স্তরের এক মহাবায়ূমন্ডল। এসব কিছুই মানবজাতির প্রতি মহান স্রষ্টার অসীম অনুগ্রহ ও সম্মানেরই প্রকাশ যা শুধু তার সকল চাহিদা পুরণের জন্যই প্রস্তুত করা হয়নি বরং মানুষের অস্তিত্বগত মর্যাদার কারণেই এ বিশাল আয়োজন করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটি কুদসী হাদীসে এভাবে বর্ণিত হয়েছে : 'হে মানব সন্তান আমি যা কিছু সৃষ্টি করেছি সবই তোমার জন্য আর তোমাকে সৃষ্টি করেছি কেবল আমার জন্য। ' আবার এই মানব জাতিকেই তার উন্নতির পথে চরম পূর্ণত্ব লাভের জন্যই মহান আল্লাহ যুগে যুগে অসংখ্য মহাপুরুষ পাঠিয়েছেন। এই মহাপুরুষগণ সকল প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে অসহনীয় কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে নিজ জীবনকে উৎসর্গ করে গিয়েছেন একমাত্র মানব জাতির জীবনে কল্যাণকামী ও উন্নয়নমুখী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে।

পবিত্র কুরআনে মানুষ সৃষ্টির মৌলিক ও চূড়ান্ত লক্ষ্য সম্পর্কে মহান স্রষ্টা বলেন : আমি জ্বীন ও মানবকে একমাত্র আমার বন্দেগী করার জন্যই সৃষ্টি করেছি। [সুরা যারিয়াত : ৫৬] ইবাদত শব্দটির আবদ্ শব্দ থেকে উৎপত্তি ঘটেছে আর আবদ্ শব্দের অর্থ হলো দাসত্ব করা। ঐ ব্যক্তিকে আবদ্ বলা হয় যে তার সমগ্র অস্তিত্বকে আপাদমস্তক তার প্রভুর আদেশ পালনে সদাপ্রস্তুত রাখে এবং সে তার মালিকের ইচ্ছার বাইরে নিজ ইচ্ছায় কোন কিছু করে না। অতএব মহান স্রষ্টা জ্বীন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এজন্যই যে তারা সকলক্ষেত্রে তাদের প্রভুর ইচ্ছার প্রকাশ ঘটাবে। আর এই দাসত্ব বা নিজ ইচ্ছাকে স্রষ্টার ইচ্ছায় রূপান্তর করার মাধ্যমে জ্বীন ও মানব তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্যে উপনীত হয়ে থাকে।

কেউ যদি আল্লাহর ইচ্ছার সম্মুখে অবনত হয় তাহলে আল্লাহ সমগ্র অস্তিত্বকে তার ইচ্ছাধীন করে দেন। যখন বান্দা তার প্রভুর ইচ্ছার সম্মুখে নিজ ইচ্ছাকে বিলীন করে দেয় তখন এই বান্দা তার প্রভুর প্রভুত্ব প্রকাশের মাধ্যমে পরিণত হয়ে যায়। আর এভাবে বান্দা তার প্রভুর ইচ্ছানুযায়ী সমগ্র সৃষ্টিজগতে প্রতিনিত্বের মাকামে অধিষ্ঠিত হতে পারে। বান্দেগী এমন এক ব্যাপার যার হক্বীকত হল প্রভুত্ব তাই বান্দেগীতে যা বিলীন করা হয়, প্রভুত্বে তা অর্জিত হয় আর প্রভুত্বে যা কিছু গোপন থাকে তা ইবাদতের মাধ্যমে হাতে আসে। আর এজন্যই বান্দার সিজদাবনত অবস্থাকে বান্দেগী প্রকাশের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম স্বরূপ পরিচয় দেয়া হয়েছে।

মানব সৃষ্টি লক্ষ্য হল মহান স্রষ্টার দাসত্ব করা আর এই দাসত্বের মাধ্যমেই সে তার স্রষ্টার অনুমতিক্রমে প্রতিনিধি স্বরূপ সৃষ্টি জগতে প্রভুত্ব করতে শেখে। কামালে মুতলাক-এর ইবাদত করার অর্থ হল নিজকে সেদিকে ধাবিত করা বা কামালে মুতলাকের দিকে নিজের যাত্রাকে নিবদ্ধ করা। প্রভুর নৈকট্য লাভের অর্থ এই নয়, যে মানুষ তার প্রভুর সাথে স্থানগত বা দৈহিক নৈকট্য লাভ করবে। না, আদৌ এটা লক্ষ্য নয় বরং প্রভুর বৈশিষ্ট্যসমূহ অর্জন করে নিজকে [হাদীস অনুযায়ী খোদায়ী বৈশিষ্ট্যে নিজকে শোভিত কর] ঐশী গুণে গুণাম্বিত করার মাধ্যমে আমরা প্রভুর প্রকৃত নৈকট্য লাভ করতে পারবো। ইবাদতের ফলে অর্জিত হয় 'ইয়াকীন'।

পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে সুরা হিজর্ -এর ৯৯ নম্বর আয়াতে তোমার প্রতিপালকের ইবাদত করো ফলে তিনি তোমাকে ইয়াক্বীন দান করবেন। আর এই ইয়াক্বীন অর্জিত হলে বান্দা আসমান এবং জমীনের 'মালাকুত' দর্শন করতে সক্ষম হবে। মহান আল্লাহ পবিত্র সুরা তাকাসুরে এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। মানব সৃষ্টি দর্শন পবিত্র সুরা যারিয়াতের ৫৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন : একমাত্র আমার বান্দেগী করার জন্যই আমি জ্বীন ও মানবকে সৃষ্টি করেছি। আসলে কি মহান আল্লাহ আমাদের ইবাদতের মুখাপেক্ষী? আর আমরাই বা কী লক্ষ্যে ইবাদত করবো? এগুলো প্রতিটি মানুষের মৌলিক প্রশ্ন ।

এ প্রশ্নগুলোর উপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে প্রতিটি ব্যক্তির ভবিষ্যত জীবন অবকাঠামো। তাই সহজে এ প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যাওয়া ঠিক নয়। অসংখ্য হাদীসে খোদার মারেফাতের উপর অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বিশেষ করে স্রষ্টার মারেফাত বা পরিচিতি লাভের ক্ষেত্রে। ইসলামী চিন্তাচেতনায় এই পরিচিতি লাভের জন্য চিন্তাভাবনাকে ইবাদতের চেয়েও অধিক মূল্যবান বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। এমন কি এক ঘন্টা চিন্তা করাকে এক বছর ইবাদতের সমান হিসাবে তুলনা করা হয়েছে।

তাই সকল ইবাদতের শ্রেষ্ঠ ইবাদত হল স্রষ্টার পরিচিতি। কেননা যাকে চিনি না তার নৈকট্য লাভ বা বৈশিষ্ট্যসমূহ অর্জন করাও আমাদের জন্য সম্ভব নয়। আর এজন্য স্রষ্টাতত্ত্বকে ইসলামী দর্শনশাস্ত্রে বা আধ্যাত্মিক শাস্ত্রে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আল্লামা ফেইজে কাশানী আপন গ্রন্থ 'কালিমাতুল মাকনুয়া মিন উলুমে আহলুল হিকমাতে ওয়াল মা'রিফাহ্'-এর ৩৩ নম্বর পৃষ্ঠায় নিম্নের প্রসিদ্ধ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন : 'আমি এক গোপন রহস্যপুরী ছিলাম অতপর ইচ্ছা করলাম পরিচিত হতে তারপর অস্তিত্বের সূচনা করলাম যাতে পরিচিত হতে পারি।

' উক্ত হাদীসটিতে মহান আল্লাহ সৃষ্টিজগত সূচনার লক্ষ্য সম্পর্কে বলেন, তিনি তার সৃষ্টির মাধ্যমে পরিচিত হতে চান। তাই মহান আল্লাহর পরিচিতি লাভই সৃষ্টির মুখ্য লক্ষ্য আর এটাই হল মহান ইবাদত। সৃষ্টিজগত ও স্রষ্টা সম্পর্কে যথাযথ ধারণা পোষণ মানুষকে প্রকৃত বান্দায় পরিণত করে দেয়। অস্তিত্ব জগতের সমস্ত কল্যাণের একমাত্র উৎস আল্লাহ্ তা'য়ালা। তাই মহান প্রভুই সৃষ্টির সকল কল্যাণমুখী যাত্রা বা কামাল অর্জনের একমাত্র মাধ্যম।

আর এজন্য পবিত্র কুরআনে অসংখ্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন : সমস্তকিছুর প্রত্যাবর্তন আল্লাহর দিকেই। কেননা সমগ্র সৃষ্টিজগত পূর্ণত্বের দিকে ধাবমান। তবে কেউ কেউ সীরাতে মুস্তাক্বীমের উপর ধাবমান আর কেউ কেউ মাগদুব বা ভ্রান্তির পথে যাত্রা করছেন। অর্থাৎ মহান স্রষ্টা চেয়েছেন তার অনুগ্রহ সর্বব্যাপী হোক এবং সকলে এ পথেই যাত্রা করুক। তাই এজন্য সৃষ্টির সূচনা করেছেন।

কেননা তাঁর পরিচিতি বা মারেফাত অনুধাবনই তাদের ইনসানে কামেল-এ পৌছানোর চাবিকাঠি। মহান আল্লাহ বলেন : 'ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহির রাজিউন' স্রষ্টাই সকল অস্তিত্বের উৎস, পরিশেষে তার দিকেই সকলকে ফিরে যেতে হবে। একবার অবতরণমুখী যাত্রায় মানুষ পৃথিবীতে অবস্থান নিয়েছে আরেকবার আরোহণমুখী যাত্রায় সে প্রভুর সান্নিধ্যে উপস্থিত হবে। অবতরণমুখী যাত্রায় তার স্বইচ্ছা ছিল নিষ্ক্রিয় তবে আরোহণমুখী যাত্রার সকল উপকরণ তাকে দেয়া হয়েছে বিধায় আপন ইচ্ছার ভিত্তিতে তাকে যেতে হবে। তাই এ যাত্রার পথ ও পাথেয় হল খোদাপরিচিতি।

আর এই প্রকৃত খোদাপরিচিতিই তাকে মাকামে মাহমুদ-এ পৌছে দিবে। আমাদের সমাজে মারেফাত কথাটির ব্যাপক প্রচলন রয়েছে । তবে এর অর্থকে দারুনভাবে অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। ফলে আমরা এক বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে ডুবে আছি। আসলে আমরা প্রতিটি ইবাদতের প্রথমে যে নিয়াত করে বলি কুরবাতান ইলাল্লাহ্ অর্থাৎ আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য করছি।

কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছি যে এই নৈকট্যটা কী নৈকট্য; দৈহিক নৈকট্য? মনের নৈকট্য? স্রষ্টার হুকুম পালনের নৈকট্য? আবার হয়ত আমরা অনেকেই এই বিষয় নিয়ে চিন্তা করার সময়ও পাই না। যখন জনৈক শিক্ষক একজন ছাত্রকে বলবেন যে তোমার নিকটের ছেলেকে একটু ডেকে দাও। সে সাথে সাথে তার পাশের ছেলেকে ডেকে দেবে। এটা তার বস্তুগত নৈকট্য। আর যখন একজন শিক্ষক বলবেন এই সংখ্যাগুলোর মধ্যে [২.৮.৫.০.৯] ৯-এর নিকটতম সংখ্যা কোনটি? তখন ঐ ছাত্র কিন্তু পূর্বের মতো আর পাশের সংখ্যা খোঁজ করবে না।

বরং মান যাচাই করে দেখবে। সে এখন আর অবস্থানগত নৈকট্য দেখবে না। ইসলামী দর্শনে গণিতকে বলা হয় মধ্যম দর্শন কারণ গণিতের প্রকাশিত রূপ বস্তুগত হলেও তার বিষয়বস্তুর বস্তুগত কোন রূপ নেই। তাই গণিতের একাংশ বস্তুগত বিষয় আরেকাংশ অবস্তুগত। যা হোক ঐ সংখ্যার ক্ষেত্রে তার অবস্তুগত মান যাচাই করতে হবে।

ঠিক একইভাবে যদি আমরা কোন রংয়ের কথা কল্পনা করি সেক্ষেত্রেও ঐরকম ঘটনাই ঘটবে। ০ কোন সংখ্যা নয় তাই তার কোন মানও নেই। আছে কি? এখন যদি এই ০-কে বলা হয় তুমি ৯-এর নিকটবর্তী হও। তাহলে তার কি কি কাজ করা প্রয়োজন পড়বে? তার প্রথম কাজ হল তাকে সংখ্যায় রূপ লাভ করতে হবে। অতএব তাকে অন্ততপক্ষে সর্বনিম্ন মান এক লাভ করতে হবে।

তারপরে সে ক্রমপর্যায়ে ৯-এর মান লাভ করতে সক্ষম হবে। সৃষ্টিজগতে যাকিছু আছে সবই ০ [সৃষ্টিজগত কিভাবে শূন্য? এর আলাদা আধ্যাত্মিক আলোচনা রয়েছে আপাতত সেদিকে যেতে চাচ্ছি না] তাই তারা কেউ কখনো ৯-এর মান অর্জনের যাত্রায় অংশগ্রহণ করতে পারে না। একইভাবে সৃষ্টিজগতে যা কিছু রয়েছে স্রষ্টার সম্মুখে তাদের মান হল ০। এই ০ থেকে বের হওয়ার কোন পথ কারো নেই। একমাত্র মানুষ [ও জ্বীন] স্রষ্টার অনুমতিক্রমে এই ০ থেকে বের হয়ে আসার অনুমতি পেয়েছে।

আর এই অনুমতির উপর ভিত্তি করে সে স্রষ্টার সকল গুণ অর্জন করতে সক্ষম। এই গুণাবলীসমূহের নৈকট্য লাভের বা তা অর্জনের জন্য আমরা আজীবন সাধনা করে আসছি। কিন্তু এই হতভাগা একবারও আপন জীবনে ঐ গুণার্জনের চেষ্টা করেনি এবং ঐশী গুণলাভের কথাও ভাবেনি। সে নৈকট্য লাভের পদ্ধতিও জানতে চেষ্টা করেনি। তাই কলুর বলদের মত মানব জাতির অনেকেই ঐ ০ অবস্থায় আজীবন থেকে যায়; সে তার এ যাত্রায় এককদমও অগ্রসর হতে পারে না।

আর এ জাতীয় মানুষদেরকে পবিত্র কুরআন নিকৃষ্টতম পশুর সাথে তুলনা করেছে। [ সুরা আনফালের ২২ নম্বর আয়াতে]। আত্ম ও লক্ষ্য পরিচিতির অভাবই হল এর মুলত কারণ । সে যদি জানতো যে এই সৃষ্টি 'মাকামে মাহমুদ' লাভ করার উপযোগী করে তৈরী করা হয়েছে এবং তাকে অবশ্য প্রভুর দিকে প্রত্যাবর্তন করতেই হবে। ঐ ০ হল আমাদের পাশবিক স্তর।

পশু কখনো এ [অবস্তুগত] পথ পাড়ি দিতে পারে না। এপথ পাড়ি দেয়ার উপযোগী করে মহান আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তাই খোদা পরিচিতি মানে আত্মোন্নয়নের পথ পরিচিতি; খোদা পরিচিতি মানে পাথেয় পরিচিতি; খোদা পরিচিতি মানে পথিক পরিচিতি। এই খোদা পরিচিতির মধ্যে সবকিছুই লুকিয়ে আছে। এখন প্রশ্ন হল আসলে এই মারেফাত কী? এবং কিভাবে লাভ করা যায়? মারেফাত হল প্রতিটি জিনিসের আসল রূপ দর্শন করা।

কোন আড়াল বা আচ্ছাদনমুক্ত অবস্থায় কাঙ্ক্ষিত বিষয় দর্শন লাভ করা। এ রূপ দর্শন লাভের জন্য সকল প্রকার উপকরণ মহান স্রষ্টা মানুষকে দিয়েছেন। কিন্তু মানুষ তার পাশবিক বৈশিষ্ট্যসমূহের বশ হয়ে ঐ উপকরণগুলোকে অকেজো করে দেয়। ফলে সে মানুষের যাত্রা পথ থেকে বিচ্যুত হয়। তাই মারেফাত হল বিশেষ জ্ঞান যা অর্জনের একমাত্র পথ হল 'তাকওয়া'।

পবিত্র কুরআন যেহেতু পথ, পাথেয় ও পথিক পরিচিতির উৎস তাই এখানে সকল বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া আছে। মহান আল্লাহ বলেন : তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর আল্লাহ তোমাদের [জ্ঞান] শিক্ষা দান করবেন। [সুরা বাকারা ২৮২ নম্বর আয়াত]।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.