আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যশোর ভবদহ অঞ্চলরে জলাবদ্ধতা : প্রাকৃতকি ও মানবকি সংকট



প্রতিবেদক= ড:অনুপম হীরা মণ্ডল ১.ভূমিকা ভবদহ একটি স্থান নাম। যশোর জেলার মনিরামপুর, অভয়নগর এবং খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার সীমান্তে স্থানটির অবস্থান। দহ******** অতীতে এখানে যে স্রোতের ঘূর্ণি তৈরী হতো তা অতীত কালদর্শী প্রবীন ব্যক্তিদের জবানীতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই অঞ্চলে ভবদহের ন্যায় আরো অনেক স্রোতের ঘূণির নিদর্শন পাওয়া যায়। যেমন, দহকুলা।

এটি ভবদহের ৩ কিলোমিটার ভাটিতে অবস্থিত। জনশ্রুতি এই যে, ভবদহে স্রোতের যে ঘূণি তৈরী হতো তার শব্দ পার্শ্ববর্তী ৪/৫ কিলোমিটার দূরের লোক শুনতে পেতো। জোয়ারের সময় তো বটে ভাটির সময়ও কোনো মাঝি এই দহের উপর দিয়ে নৌকা নিয়ে যেতে সাহস করতো না। এমনকি এসব ঘূণির উপর দিয়ে যখন পাখি উড়ে যেতো তখন ভয় পেয়ে ঘূণির মধ্যে এসে পড়তো এবং সলিল সমাধি ঘটতো। তবে, বর্তমানে সেখানে প্রমত্তা সে সব স্রোস্বিনীর নাব্যতা এবং প্রচণ্ডতা লক্ষকরা যায় না।

তার বদলে সেখানে এখন শ্রী, হরি, হরিহর, ভদ্রা, টেকা, মুক্তেশ্বরী প্রভৃতি নদীর অকাল মহাপ্রায়াণ ঘটে চলেছে। প্রমত্তা নদীগুলো এখন ক্ষীণধারা নালায় পরিণত। চারিদিকে ছোট-বড় অসংখ্য নদীর বন্ধ্যাবস্থা। মরা নদীর বুক জুড়ে চরা। নদীর পাঁড় ধরে স্তূপাকৃতির চরা মাটি।

সংকুচিত নদীগর্ভে বিশাল বিশাল বেড়িবাঁধ আর সেসব বাঁধের উপর শোভাবর্ধনকারী নানা জাতের বিদেশি বনজ বৃক্ষ। এছাড়া মরা নদীগুলোর দু’ধারে অজস্র স্লুইসগেট, যার সিংহভাগ চরার মধ্যে নিমজ্জিত। মৃত স্রোতস্বিনীর উজানে এর বিপরীত অবস্থা। সেখানে শুধু পানি আর পানি। পানির অস্বাভাবিক স্ফীতাবস্থা গ্রাম, খাল, পুকুর, বিল, মাঠ, রাস্তা সবকিছুকে ডুবিয়ে দিয়ে এই জনপদকে বসবাস অনুপোযুক্ত করে ফেলেছে।

এই বাসিন্দগণ থেকে-থেকে প্রায় তিন দশক ধরে ভোগ করছে সীমাহীণ দুর্ভোগ। এই প্রবন্ধ; ভবদহ এলাকার জলাবদ্ধতার কারণ, মানুষের দুর্দশার বিবৃতি ও এই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে দুর্দশাগ্রস্থ মানুষের ভাবনা ও প্রস্তাবনাগুলো উপস্থাপনের প্রয়াস মাত্র। সমীক্ষার ক্ষেত্র হিসেবে যশোর জেলার ভবদহ জলাবদ্ধ এলাকা তথা অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর থানার জলাবদ্ধ এলাকে নির্বাচন করা হয়েছে। সমীক্ষা কাজে প্রত্যক্ষ অংগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির আওতায় সাক্ষাৎকার গ্রহণ, কেচস্টাডি, ওডিও-ভিজুয়াল, ফোকাসগ্রুপ ডিসকাশন ও সমন্বিত মতবিনিময়সভা বিষয়ক একাধিক কৌশলকে আশ্রয় করা হয়েছে। সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে দুর্ধশাগ্রস্ত এলাকার মানুষের ভাবনাকে তুলেধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

সাধারণ মানুষের বক্তব্য ও ভূয়োদর্শনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ভুক্তভোগী মানুষের বক্তব্যের সমন্বয় সাধন করে তাদের নিকট থেকেই ভ্রান্ত-অভ্রান্ততা পরীক্ষিত হয়েছে। এছাড়া সহায়ক প্রবন্ধ-গ্রন্থ ও পত্র-পত্রিকার সাহায্য নেওয়া হয়েছে। ৩.ভবদহ অঞ্চলের মানুষ ও জনবসতি ভবদহ তথা বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকুল অঞ্চলের বাসিন্দাদের নৃতাত্ত্বি পরিচয় অনেকটাই অজ্ঞাত। কারণ এই অঞ্চলের ভূ-ভাগ বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল অপেক্ষা পরবর্তীকালে জনবসতির উপযুক্ত হয়ে ওঠে।

এছাড়া অন্যান্য স্থান থেকে এখানে যেসকল জনগোষ্ঠী এসে বসতি স্থাপন করে তাঁরা ভাগ্য বিড়ম্বিত কায়িক শ্রমিকের দল। এঁদের বসতি গড়ে ওঠে উপকূলের নবঊ™ভূত বিল-বাওড়-নদী অধ্যুষিত পাললিক ভূমিকে কেন্দ্রকরে। এই জনপদগুলো অপেক্ষাকৃত প্রান্তীয়, শাসককূলের অবজ্ঞাযুক্ত ও উন্নয়ন বিযুক্ত অবস্থার মধ্যদিয়ে বিবতির্ত হয়েছে। এখানকার মানুষ বরাবরই গ্রামীণ অর্থনীতি ব্যষ্টিত জন্মনির্ভর পেশাজীবী সমাজ কাঠামোর মধ্যে বির্বতিত হয়েছে। ধর্মীয় পরিচয়ে তাঁরা হিন্দু-মুসলমান দু’ভাগে বিভক্ত।

সা¤প্রতিক কালে খ্রিস্টান মিশনারীদের চেষ্টায় কিছু লোকের জাত্যান্তর না ঘটলেও ধর্মান্তর ঘটেছে। হিন্দু ও মুসলমান উভয় স¤প্রদাযের সিংহভাগ জনগোষ্ঠী কৃষিজীবী। ভবদহ জলাবদ্ধ এলাকার কৃষকেরা বরাবরই সুবিধাবঞ্চিত। সমাজ ব্যবস্থায় তারা প্রাচীনকাল হতেই নিম্ন থাকের বাসিন্দা। উচ্চবর্গের সুবিধাভোগীদের কৌতূহল, পান্ডিত্য কোনো কিছুর মধ্যে তাদের স্থান হয়নি।

শাসক কিংবা মধ্যসত্ত্বভোগীগণ কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর সাথে সহাবস্থান এড়িয়ে চলেছে। ফলে সামাজিক বঞ্চনার সাথে এই জনপদের বাসিন্দাদের আত্মপরিচয় ধোঁয়াশাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। আবার পলল গঠিত নদী অববাহিকার ভূমি হওয়ায় এখানকার কোনো স্থাপত্যও দীর্ঘদিন স্থায়িত্ব লাভ করেনি। তবে কিছু কিছু ঐতিহাসিক তাঁদের স্বজাতির পরিচিতি দানকালে প্রান্তীয় এই জনসাধারণের কথাও প্রসঙ্গক্রমে যৎসামান্য উল্লেখ করেছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন, বর্তমানের রাজশাহী, মালদহ, পূণিয়া, দিনাজপুর, রংপুর অপেক্ষা যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, বরিশাল(বাখরগঞ্জ), নোয়াখালি, চব্বিশ পরগনা প্রতৃতি স্থান সমুদ্র গর্ভ হতে পরর্বীকালে জেগেছে।

সমুদগর্ভ হতে উৎপন্ন এসকল নব্য দ্বীপাঞ্চলকে সাধারণত ‘অনুপদেশ’ বলা হতো। এই অনুপদেশে সাধারণত চণ্ডাল জাতীয় লোকেরা বাস করতো। তবে এসব অলোচনায় চণ্ডাল বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে বা এখানে শুধুমাত্র চণ্ডালেরা বাস করতো কিনা, অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর কোনো নিদর্শন ছিল কিনা এসব বিষয়গুলো পরিষ্কার নয়। প্রচলিত একটি মত এই যে, দ্বাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে নদীয়া জেলার কোনো নমঃশূদ্র অধ্যুষিত এলাকা এবং অন্যান্য কোনো দূরবর্তী অঞ্চল থেকে রাজশক্তি কর্তৃক অত্যাচারিত নমঃশূদ্র স¤প্রদায়ের কৃষিজীবী মানুষেরা দলে দলে বাস্তুত্যাগ করে এসে যশোর-খুরনা-ফরিদপুর-বরিশাল জেলার নদী-নালা-কুড়-বিল-হাওড়-জঙ্গলে আকীর্ণ দুর্ভেদ্য ও দুর্গম নিম্নাঞ্চলে বসতি স্থাপন করে বসবাস করতে শুরু করে। এই অঞ্চলের মানুষের পরিচয় দানের ক্ষেত্রে এই আলোচনাও খন্ডিত।

কারণ, এখানে নমঃশূদ্র ছাড়া আর কারো পরিচয় পাওয়া যায় না। আবার নমঃশূদ্ররাই এখানকার আদিবাসিন্দা কিনা, এদের পূর্বে কারো বাস ছিলো কিনা, কিংবা পরবর্তীতে আর কারা এখানে বসতি গড়ে তোলে; প্রাসঙ্গিক এই আলোচনাও এখানে অনুপস্থিত। অনেক ঐতিহাদিসক মনে করেন, যাদের স্থানীয় ভাষায় ‘পোদ’(পৌণ্ড্রক্ষত্রিয়) নামে অভিহিত করা হয় তাঁরা পুণ্ড্রবর্ধনের আদিম অধিবাসী। তাঁদের যুক্তির সমর্থনে ব্যাখ্যা এই যে, পৌণ্ড্র রাজা বাসুদেব (যিনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৌরবদের সমর্থন করায় শ্রীকৃষ্ণের হাতে নিহত হন) তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই কপিলকে পৌণ্ড্র রাজ্য থেকে বিতাড়িত করেন। কপিল ভ্রাতা কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে সুন্দরবন অঞ্চলের দুর্গম বনভূমি ও নদী উপকূলে এসে অশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন।

কপিলের সহযাত্রী হয়ে সমসাময়িক কালে কিংবা তার আগমন উত্তর কালে পুণ্ড্রবর্ধন থেকে আরো অনেক মানুষ ভাটি অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করতে থাকে। বর্তমানের খুলনা জেলার পাইকগাছা থানার অন্তর্গত কপিলমুনি বাজারই হলো কপিল প্রতিষ্ঠিত আশ্রমস্থল যা তাঁর নামানুষারে গড়ে ওঠে এবং আজও ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। সা¤প্রতিক কালে আবিষ্কৃত বুড়িভদ্রা নদীর অববাহিকায় ভরতভায়না নামক স্থানের রাজা ভরতের দেউল মন্দির যা স্থানীয় ভাষায় ‘ভরতের দেল’ নামে পরিচিত, স্থাপনাটি প্রাচীন এই জনপদের অনেক অজানা তথ্য উদ্ঘাটনে সহায়তা করে। পুরাতাত্ত্বিকদের ধারণা খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দী বা তাঁর সমসাময়িক কালে এই দেউল মন্দির বর্তমান ছিল। এর অবকাঠামো বগুড়ার মহাস্থানগড় ও নওগাঁর পাহাড়পুরের স্থাপনার স্বগোত্রীয় বলে পন্ডিতদের অভিমত।

এই স্থ্পনা এ অঞ্চলে এককালে গড়ে ওঠা বৌদ্ধসভ্যতার পরিচয় বহন করে। ধারণা করা হয় এটি হিউয়েংসাং বর্ণিতসমতটের ৩০ টি সংঘরামের একটি। এই মন্দির বা ঢিবির দুই কিলোমিটার দক্ষিণে গৌরিঘোনা নামক গ্রামে রাজা ভরতের বাড়ি ছিল বলে ধারণা করা হয়। এবং পাশ্ববর্তী কাশিমপুর গ্রামে ডালিয়াঝাড়া নামক আর একটি ঢিবি আছে। এটিকে রাজা ভরতের একজন আমত্যের বাসভূমি বলে অনুমান করা হয়।

পণ্ডিতদের অনুমান এই ভরত ভায়নায় একসময় একসময় পরিখা পরিবেষ্টিত বৌদ্ধ সংঘরাম ছিল। পণ্ডিতদের বরাত দিয়ে বলা যায় যে এখানে এক সময় বৌদ্ধদের যথেষ্ট প্রতাপ-প্রতিপত্তি ছিল। যদিও এই অঞ্চলটিতে এখন আর কোনো বৌদ্ধধর্মানুসারীকে দেখতে পাওয়া যায় না। যশোর-খুলনা অঞ্চলের নমঃশূদ্রদের পরিচয় দিতেগিয়ে অনেক ঐতিহাসিক এঁদেরকে এ অঞ্চলের অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করেন। তাঁদের মতে, যশোর-খুলনা অঞ্চলের নমঃশূদ্রেরা পূর্বে বঙ্গদেশে (ঢাকা প্রদেশে) বাস করত এবং পরবর্তীতে তাঁরা আর্যগণের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে সে দেশ ত্যাগ করে সমুদ্রোত্থিত নতুন উৎপন্ন স্থানগুলোতে বাস করতে থাকে।

নমঃশূদ্র,পণ্ড্রক্ষত্রিয় ছাড়াও এই অঞ্চলে কাপালি কৃষকদের বসতি যথেষ্ট। প্রখ্যাত সাহিত্যিক বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘কপালকুণ্ডলা’ রচনা করেন খুলনা জেলায় অবস্থান কালে। এ উপন্যাসের পটভূমি নির্মিত হয়েছে সুন্দরবন এলাকার কাপালিক সাধকদের কেন্দ্র করে। বঙ্কিম চন্দ্রের ভাষ্যে কাপালিক চরম ধর্মীয় কৃত্য পালনকারী, নরবলী প্রদায়ী। কিন্তু বঙ্কিম চন্দ্রের কাপালিক স্ধুদের সঙ্গে ভবদহ অঞ্চলের কাপালি কৃষক গোষ্ঠীর পরিচয় মিলিয়ে দেখা কঠিন।

কারণ, কাপালি শ্রেণী অত্যন্ত নম্রস্বভাবি। পেশায় কৃষিজীবী। কাপালিক সাধুদের অস্তিত্ত্ব থাকলেও এই কাপালি কৃষিজীবী গোষ্ঠীর সাথে কোনো মিল নেই। ঐতিহাসিকেরা ধারণা করেন কাপালিদের আদিনিবাস কাশ্মির। দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে তাঁরা দেশ ত্যাগ করতে বাধ্যহয়।

এই অঞ্চলে এসে তারা প্রথমে বৈশ্য বৃত্তি গ্রহণ করণেও পরবর্তীতে কৃষিকে স্থায়ী পেশাহিসেবে গ্রহণ করে। এককালে তারা বৌদ্ধ ধর্মানুসারি হয়ে এক-একটি স্থানে সীমাবদ্ধ জীবনযাপন করতো। বর্তমানে তারা নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন এই জাতিগোষ্ঠী হিন্দু প্রভাবে হিন্দু ধর্মানুসারি। ভবদহ অঞ্চলের কাপালি কৃষকেরাা নমঃশূদ্রদের মতো পেশাগত কারণে বিপর্যয়ের সম্মুখিন।

ভবদহ অঞ্চলে ‘বাগদি’ শ্রেণীভুক্ত কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর যৎসামান্য উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। তবে তারা অন্য কোনো এলাকা হতে এসে বসতি সআপন করেছে বলে মনে হয়। কারণ এদের বসতি এতোই সামান্য যে তাঁদের আলাদাভাবে চিহ্নিত করা কঠিন। জাতিতে কৃষক এই গোষ্ঠী নমঃশূদ্র ও কাপালি কৃষকদের প্রতিবেশী। হিন্দু জেলে, কামার, কুমার, নরসুন্দর, তাঁতি, স্বর্ণবেনে স¤প্রদায়গুলোও বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো যৎসামান্য সংখ্যায় তাদের উপস্থিতি জানান দেয়।

মুসলমান কৃষকদের পাশাপাশি আরো দু‘একটি গোত্রের উপস্থিতি দেখা যায়। যেমন, হাজাম, তাঁতি বা কারিগর ইত্যাদি। এক সময় এখানে ঘরামী, বাওয়ালী, ঢালী, করাতি(স্থানীয় ভাষায় ধাওইদার), মাঝি, কাহার বা বেহারা, কাঠমিস্ত্রী বা ছুতার, গাড়োয়ান প্রভৃতি পেশার মানুষ থাকলেও সেসকল এখন কেবল অতীত দিনের স্মৃতি। মাত্র তিন দশকের ভয়াবহতায় বিচিত্রমুখি পেশা স্টিমরোলারের মতো সমান হয়ে গেছে। ভবদহ অঞ্চলের জাত পরিচয় তথা পেশা এখন একটাই, মৎস্যজীবী।

এ অঞ্চলের প্রায় দুই লক্ষ পরিবার কোনো না কোনো ভাবে মৎস্যজীবী। বাকি জনগোষ্ঠীর অনেকে কার্গোশ্রমিক, মৌসুমি ব্যাবসার ফড়িয়া কিংবা শহরের মৌসুমি শ্রমিক। আর যারা এসব কাজের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারেনি তারা বাসতুলে অন্য কেথাও অভিবাসন গ্রহণ করেছে। তবে জাতি হিসেবে ভবদহ এলাকার মানুষ এখন বড়বেশি সমধর্মী। তারা এখন প্রায় সকলেই মৎস্যজীবী।

৪.ভবদহ অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি গাঙ্গেয় পলি দ্বারা গঠিত বাংলাদেশেদক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল অঞ্চলের একটি অংশ হলো ভবদহ অঞ্চল। পুরাতন গাঙ্গেয় প্লাবন দ্বারা গঠিত এই ভূ-ভাগ বর্তমানে গঙ্গা বা পদ্মার প্রবাহের স্পর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন। মাথাভাঙ্গা, গড়াই, মধুমতি, কপোতাক্ষ, ভৈরবের প্রবাহে প্লাবিত ভূমির অংশ হলো কপোতাক্ষ, ও ভৈরবের মধ্যবর্তী অঞ্চল। এঅঞ্চলের উজান ও ভাটি দ্বারা বিভক্ত অংশের মধ্যবর্তী অঞ্চল হলো ভবদহ জলাবদ্ধ অঞ্চল। বাংলাদেশের দক্ষিন-পশ্চিম উপকূলীয় জলাবদ্ধ এলাকার সবচেয়ে ভয়াবহ অঞ্চল এটি।

বিলবোকড়, বিলকেদারিয়া, বিলভায়না, বিলখুকশিয়া, বিলআড়পাতা, বিলদহকূলা, বিলদামুখালি, বিলবরুনা প্রর্ভতি বিল ও নিম্নাঞ্চল ভবদহ অঞ্চলের ভূ-গাঠনিক প্রধান বৈশিষ্ট্য। অতীতে এখানে যেমন নদীর প্লালাবন দ্বারা ভূ-ভাগ স্নাত হতো তেমনি জোয়ার-ভাটা বাহিত লবনাক্ত পানিও তার পদধৌত করতো। এঁটেল মাটি এখানকার নিম্ন ভূমির ভূ-গঠনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে। জৈব পদার্থের পচন দ্বারা সৃষ্ট অগঠিত নরম মাটি (স্থানীয় ভাষায় জুবারমাটি বলে খ্যাত) হাজার বছর ধরে বিলগুলোর তলদেশ পূর্ণ করেছে। নদীর তীর ও দাঁড়ি আকৃতির বিভিন্ন গ্রামগুলোতে বালুমিশ্রিত দোঁআশ মাটি দেখা যায়।

তরে মাটিতে কালো রঙের অধিক্য লক্ষনীয়। এ অঞ্চরের ভূমির গাঠনিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অনেকের মতে, ভূমির অবনমন বা ভূমিধ্বসের জন্য নিম্নভূমিগুলো সৃষ্টি হয়েছে। তাঁরা মনে করেন, ভূমিকম্প জনিত ভূমির ধ্বসে এই অঞ্চলের বিল ও নিম্নভূমি তৈরির অন্যতম কারণ। আবার ভূমিগঠনের পক্ষে অন্যযুক্তি হলো, এসকল বিল নদীর ভাঙা-গড়া আর প্লাবনের ফলশ্রুতি বৈ আর কিছু নয়।

তাঁদের মতে, নদীর প্লাবনের সময় দু’পাড়ে পলি ছড়ায় পলি পড়ে পাড় উঁচু হয়। নদীবাহিত পলির এই অবক্ষেপন নিকটবর্তী পাঁড়ে দূরবর্তী ভূমির থেকে বেশি হয়। ফলে নদীর তীরবর্তী অঞ্চল দূরবর্তী অঞ্চল অপেক্ষা বেশি উঁচু হয়। বর্ষায় বা প্লাবনে নিম্নভূমিতে পানি জমতে থাকে এবং খরস্রোতা নদীর অববাহিকা ধরে এই ধরনের বিলের সৃষ্ট্ িহয়। উল্লেখ্য যে, যশোরের কেশবপুর, মনিরামপুর থেকে শুরু করে খুলনা জেলার উত্তর-পূর্বাঞ্চল পর্যন্ত একের পর এক বড় বিলগুলো অবস্থিত।

উত্তর-পূর্ব সীমান্ত থেকে এই বিলশ্রেণী মধুমতি পার হয়ে ফরিদপুর ও মাদারিপুর পর্যন্ত বিস্তৃত। মধুমতির উত্তরাঞ্চলের বিলগুলো পশ্চিমে বিস্তৃত হয়ে পুনরায় মধুমতি পার হয়ে নড়াইলের লোহাগড়া ও কালিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে বিলগুলো অনেকটা বলয়ের রূপধারণ করেছে। এই বলায়াকৃতির বিলশ্রেণী দেখে মোঃ নূরুল ইসলাম এগুলো মিঃ ফৌকাস (ঋধপিঁং)-এর গবেষণার সাথে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন। মি:ফৌকাসের পর্যবেক্ষনের উপর নির্ভর করে মি: ইসলাম বলেন, ‘প্রশন্ত মহাসাগরীয় অগ্নিবলয় প্রাকৃতিক কারণেই সৃষ্টি। এই বিলবলয় অতীতে তেমন কোনো প্রাকৃতিক কারণে সৃষ্টি হলেও হতে পারে।

’ ভবদহ অঞ্চলের বিল, নদী, খাল, গ্রাম সমস্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ ভূমি এখন সমধর্মী। এখানকার গ্রাম ও জলাশয় দুটোই এখন সমান। এই জনপদের হাট-বাজার, খেলার মাঠ, গোচারণ ভূমি সবই দীর্ঘদিন ধরে জলাবদ্ধ। কখনো কখনো স্থলভাগের সন্ধান করা দূরুহ হয়ে যায়। কঠিন হয়ে পড়ে বসতির নিদর্শন নিরূপন করা।

জলাবদ্ধতার সমস্যার জন্য ধ্বংস হতে চলেছে এখানকার বৈচিত্র্যপূর্ণ ভ-ূপ্রকৃতিসহ পুরো জনপদ। ৫.জলাবদ্ধতা সৃষ্টির কারণ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলটি অপেক্ষকৃত নবীন; নদী বিধৌত অঞ্চল। অবাধ জোয়ার-ভাটা সৃষ্ট ভূমি গঠন গত শতাব্দির মধ্যভাগ পর্যন্ত এখানে অব্যাহত ছিল। পলল গঠিত এসকল ভূমি অত্যন্ত উর্বর, তাই স্বাভাবিক ভাবেই এখানে কৃষিনির্ভর জনগোষ্ঠীর বসতি গড়ে ওঠে। ভূমি-ব্যাবস্থাপনায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তো’র পর রায়তি কৃষকগণ স্থানীয় জমিদারদের নিকট থেকে ভূমি বন্দোবস্ত নিতে থাকে।

তখন এখানকার কৃষিজমি বন্দোবস্ত ব্যবিস্থায় অন্যান্য স্থান থেকে ভিন্ন মাত্রা লাভ করে। কারণ, জলোচ্ছ্বাস, জোয়ারবাহিত লবন পানি প্রভৃতি কারণে ফসল উৎপাদন ছিল অনিয়মিত। তাই রায়তগণ উঠবন্দি বন্দোবস্ত নামে যে বছর ফসল হতো সে বছর কেবল ভূ-স্বামীকে কর প্রদান করতো। এঅঞ্চলের কৃষকরা লবন পানি সহনশীল, দ্রুতবর্ধনশীল ও অগভীর পানিতে উৎপাদনক্ষম দেশিয় নানা জাতের ধান চাষ করতো। তবুও উপকূল অঞ্চল হওয়ায় জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা কিংবা বর্ষার পূর্বেই নদীবাহিত লবন পানির অতিমাত্রিকতায় ফসলের ক্ষতি হতো।

ফলে কৃষকগণ স্থানীয় পদ্ধতিতে ছোট ছোট বাঁধ দিয়ে জলোচ্ছ্বাস ও লবন পানির তীব্রতা থেকে ফসলকে রক্ষা করতে থাকে। উজানের মিষ্টি পানির স্রোত আর জোয়ার বাহিত পলি পতনের কারনে ছোট ছোট বাঁধগুলো ভূমির সাথে মিলিয়ে যেতো। ফলে এই বাঁধগুলো ভূমি গঠনে প্রক্রিয়ায় কোনো রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতো না। তবে কৃষকের ফসলকে প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে রক্ষার বিষয়ে এই অঞ্চলের জমিদারদের যথেষ্ট অবদান ছিল বলে জানা যায়। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে জমিদাররা এই অঞ্চলে স্থানীয় উদ্যেগে নিচু বাঁধ ও কাঠের জলদ্বার তৈরী করতেন।

এগুলো ফসল রক্ষার জন্য যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা রাখতো। কিন্তু সমস্যা দেখাদেয় জমিদার প্রথার বিলুপ্তির পর। জমিদার প্রথা বিলুপ্তি-উত্তরকালে ভূমি ব্যাবস্থাপনা সহ এই ধরনের পানি নিষ্কাশন ব্যাবস্থা অরক্ষিত হয়ে পড়ে এবং নিয়মিত রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে কৃষকের ফসল উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতির সম্মুখিন হতে থাকে। ভারত সরকারের নদী ব্যাবস্থাপনা নীতি এই অঞ্চলের বিপর্যয়ের আর একটি অন্যতম কারণ। বাংলাদেশের উপরদিয়ে প্রবাহিত বৃহৎ নদীগুলোর কোনোটিরই উৎপত্তিস্থল বাংলাদেম সীমান্তের অভ্যন্তরে নয়।

ভারত সরকার তার অভ্যন্তরীণ সুবিধার কথা মাথায় রেখেই অজস্র নদীতে বাঁধ, ব্যারেজ নির্মাণ করে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এর ফলে অপেক্ষাকৃত ভাটি অঞ্চলের অর্থাৎ বাংলাদেশের স্রোতস্বিনীগুলোর নাব্যতা হারাচ্ছে। ভারত সরকার গত শতাব্দীর পঁঞ্চাশের দশকে মেহেরপুর সীমান্ত থেকে ভারতের তিন কিলোমিটার অভ্যন্তরে পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলাধীন করিমপুর থানার হাগনা নামক স্থানে বাঁধ নির্মাণ করে। ভারত সরকার এই বাঁধ নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় বাংলাদেশর বেশ কয়েকটি নদী যেমন, ভৈরব ও এর শাখা কপোতাক্ষ, হরি, শ্রী, হরিহর, ভদ্রা, মুক্তেশ্বরী, টেকা প্রভৃতি স্রোতহীন হয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে মৃত নদীতে পরিণত হয়। অবার মুর্শিদাবাদ জেলায় গঙ্গার উপরে ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মানের ফলে পদ্মা, মধুমতি নদীপ্রণালীর অধীন সমস্ত নদীগুলোই ধীরে ধীরে শুকিয়ে যেতে থাকে।

এতে নদীগুলোতে পাহাড় গলা মিষ্টি পানির চাপ হারিয়ে যায় এবং জোয়ারের সময় অতিরিক্ত লবন পানি উপরের দিকে উঠে ফসলি জমিতে পতিত হয়ে ফসলের মারাত্মক ক্ষতি করতে থাকে। যদিও কৃষকেরা লবন পানি সহিষ্ণু দেশিয় জাতের ধানের চাষ করতো কিন্তু জলোচ্ছ্বাস দেখা দিলে সে বছর ফসল রক্ষা করা কঠিন হয়ে যেতো। এই বিপর্যয় থেকে ফসল রক্ষার জন্য যে প্রকল্প গ্রহণ করা হয় তা ছিল আত্ম হত্যার সামিল। তৎকালীন সরকার মার্কিন পরামর্শকে কাজে লাগিয়ে উপকূল অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করে। এই উদ্দেশ্যে গত শতাব্দীর ষাটের দশকে ভবদহ এলাকায় তিনটি পোল্ডার, ১০৫৬৬ কিলোমিটার বেঁড়িবাঁধ, ২৮২ টি স্লুইচ গেট নির্মাণ করে।

প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল উপকূলীয় অঞ্চলকে জলোচ্ছ্বাস ও জোয়ারের পানিকে বাঁধা প্রদান করে ফসল রক্ষা করা এবং শুষ্ক ভূমি তৈরী করে উপকুল অঞ্চলে সবুজ বিপ্লব ঘটানো। তৎকালীন সরকারের গৃহীত এই প্রকল্পের ফলে অজস্র নদীর সংযোগ স্থলে বাঁধা পড়ে। এমনকি বৃহৎ বৃহৎ নদীকে শাসন করে তার উপর স্লুইসগেট নির্মণ করা হয়। জোয়ারের পানি বাহিত পলি নিম্ন ভূমি বা বিলগুলোতে পড়তে বাঁধাঁর সৃষ্টি করায় বাংলাদেশের স্বাভাবিক ভূমি গাঠনিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। ফলে নদীর তলদেশে পলি অবক্ষেপন হতে হতে এবং জোয়ার-ভাটা ও সমভূমির অবনমনের মধ্যে ব্যাপক অসামঞ্জস্যতা তৈরী হওয়ায় ঝলাবদ্ধতা সৃষ্টি ত্বরান্বিত হয়।

নদী শাসন-উত্তরকালে অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা, পুল, কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। এর ফলে এক-একটি নিম্নাঞ্চল বা বিল বহুধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। এমনকি এই অঞ্চলে শত শত কিলোমিটার সুউচ্চ রাস্তা নির্মাণ করা হলেও পানির স্বাভাবিক প্রবাহকে অব্যাহত রাখার জন্য কোনো প্রকার পুল নির্মাণ না করারও নজির যথেষ্ট। উপরন্তু যেখানে পানি প্রবাহের ব্যাবস্থা ছিল সেগুলোও বন্দ করে দেওয়া হয়েছে বলে স্থানীয় অধিবাসীদের অভিমত। আবার পুল-কালভার্ট নির্মাণ করলেও সেগুলো এতো ছোট যে তা রাস্তার দু’পাশের নিম্নভূমির পানি নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত নয়।

এই প্রক্রিয়া স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, পানিউন্নয়ন বোর্ড প্রভৃতি বিভাগ উন্নয়নের নামে জোরে সোরেই করতে থাকে। আর এইসকল উন্নয়ন প্রক্রিয়া এতোই অপরিকল্পিত ছিল যে এর প্রায় সবগুলোই বর্ষাকালে পানি নিষ্কাশনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। নদী সংকোচন ও স্লুইচগেট নির্মাণ করে জোয়ার বাহিত পলি নিম্নাঞ্চলে অবক্ষেপনে বাঁধা প্রদান করায় নদীর তলদেশ উচু হয়ে যায়। মাত্র ১৪/১৫ বছরের মধ্যে এই অবস্থা ভয়াবহ আকার ধারণ করে । পানি উন্নয়ন বোর্ডে’র হিসাব মতে, সা¤প্রতিক সময়ে জমা হওয়া পলির পরিমাণ ভবদহ স্লুইচগেটের ভাটিতে ৫ দশমিক ৫০ আর.এল. এবং উজানে ১ দশমিক ৫০ আর,এল.।

এছাড়া আশির দশকে উপকূল এলাকায় চিংড়ি চাষের ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্যকরা যায়। এসময় অর্থ ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বিল এলাকাগুলোতে কৃষকের জমি দখল করে স্থানীয় ভাবে জলাধার তৈরী করে চিংড়ি চাষ করতে থাকে। এমনকি তারা নদীর অভ্যন্তরে বাঁধ দিয়েও জলাধার তৈরী করে, স্থানীয় ভাষায় এটাকে পকেট ঘের বলা হয়। এই পকেট ঘের নির্মাণ করে চিংড়ি চাষ করায় নদীর স্বাভাবিকতা নষ্ট হতে থাকে। একদিকে রাজনৈতিক প্রভাব আর অন্যদিকে বিভিন্ন সন্ত্রাসী ব্যক্তি গোষ্ঠীকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ায় সাধারণ কৃষকরা কৃষির অনুকূলে কোনো পরিকল্পিত সুবিধা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়।

অন্যদিকে বাঁধ দেওয়ায় বিভিন্ন সংযোগখাল, ছোট নদী, জলাভূমি ইত্যদি বিভিন্ন প্রকার খাসজমি জবর দখল হয়ে যায় এবং অবৈধ স্থাপনা গড়ে ওঠে। তার ফলে বর্ষা মৌসুমে পানি নিষ্কাশন ব্যাহত হয়। একারণে বর্ষা মৌসুমেও নদীগুলোতে উজানের দিক হতে স্রোতের কোনো চাপ না হওয়ায় নদীবাহিত পলি নদীতে অবক্ষেপনে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় না। ফলে ধীরে ধীরে নিম্নভূমি ও বিলে জমে থাকা পানির সাথে বর্ষা মৌসুমের পানি মিশে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় যা এখন নদী দ্বারা নিষ্কাশনের পথ একেবারে রুদ্ধ হয়ে গেছে। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের শেষার্ধে যশোর জেলার নিম্নাংশ থেকে জলাবদ্ধতার সূত্রপাত হয়।

অশির দশক হতে এই জলাবদ্ধতার পরিধি বাড়তে থাকে এবং নব্বই-এর দশকে সেটি ভয়াবহ অকার ধারণ করে। বর্তমানে জলাবদ্ধতা ক্রমশ ভাটির দিকে স¤প্রসারিত হচ্ছে এবং ধীরে ধীরে এর পরিধি সমগ্র খুলনা ও সতক্ষীরা জেলা, যশোর জেলার নিম্নাংশ এবং বাগেরহাট জেলার একাংশ নিয়ে বিস্তার লাভ করেছে। ১৯৯৬ সালে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালিত ক্ষেত্র সমীক্ষা নির্ভর প্রতিবেদনে দেখা যায় এঅঞ্চলের ৪৭.৫৫০ হেক্টর এলাকা জলাবদ্ধ। সেসময় প্রতিবেদনটিতে আশঙ্কা করা হয় এই জলাবদ্ধতা নিরসনে যথাযথ ব্যাবস্থা গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে আরো ৬৫.৭০০ হেক্টর এলাকা জলাবদ্ধ হবার সম্ভাবনা অছে। ঐ প্রতিবেদনে আরো জানানো হয় প্রতিবছর ১০/১২ হেক্টর এলাকা নতুন করে জলাবদ্ধতায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং এই হার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ভবদহের সা¤প্রতিক সময়ের জলাবদ্ধতায় মানুষের দুর্যোগের সর্ব্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করে গেছে। এই জলাবদ্ধতায় পানির উচ্চতা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। অভূক্ত মানুষেরা সহয় সম্বল হীন ভাবে নিজেদের বাড়ি ঘর ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। গার্হস্থ্য জীবনের এই করূণ পরিণতি ভূমি মালিক আর ভূমিহীনকে একই কাতারে এনে দাঁড় করিয়েছে। একারণে সা¤প্রতিক সময়ের জলাবদ্ধতার কারণ ও ভয়াবহতা সম্পর্কে আলোচনা সঙ্গত বলে মনে হয়।

৬.সা¤প্রতিক সময়ের জলাবদ্ধতা ২০০৫ সালের আগষ্ট মাসে অতিবর্ষণ দেখাদিলে পানি নদী দিয়ে নিষ্কাশিত না হওয়ায় ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে জুন-জুলাইয়ের অতিবর্ষণে জলাবদ্ধতা আরো মারাত্মক আকার ধারণ করে। ফলে জলাবদ্ধ মানুষ সীমাহীন বিপর্যয়ের সম্মুখিন হয়। সা¤প্রতিক জলাবদ্ধতার জন্য ভবদহ এলাকার জলাবদ্ধ মানুষ কতিপয় ব্যক্তিকে দায়ী করেন। জলাবদ্ধতার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দৈনিক সমকাল Ñএর প্রতিবেদক ইফতেখার মাহমুদ মাঠ পর্যায়ে একটি সমীক্ষা সম্পন্ন্ করেন।

তার সমীক্ষার উপর ভিত্তি করে ১২ আগস্ট ২০০৬ দৈনিক সমকাল পত্রিকায় ভবদহ স্লুইস গেট এক ‘নর্মদা বাঁধ’ শিরোণামে একটি সরেজমিন প্রতিবেদন ছাপা হয়। সাধারণ মানুষের বরাত দিয়ে প্রতিবেদক উল্লেখ করেন, সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলামের ভাগ্নে পরিচয়দানকারী বিএনপি নেতা মাসুদুজ্জামান মাসুদ, কেশবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাশেম, মনোহরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিন্টু, সুফলাকাঠি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুস সামাদ উদ্যোগী হয়ে তৎকালীন জেলাপ্রশাসক (যশোর) জনাব আবদুল ওয়াজেদ মহোদয়ের নিকট ৪০০ লোকের সম্মতি স্বাক্ষর সংবলিত একটি দরখাস্ত দিয়ে ভবদহ স্লুইচগেট বন্দের দাবি জানান। অতপর জেলাপ্রশাসক পানিউন্ন্য়ণ বোর্ডকে ব্যাবস্থা গ্রহণের জন্য বলেন। পানিউন্ন্য়ণ বোর্ড সে সময় সাধারণ জনগণের বাঁধাকে উপেক্ষাকরে তড়িৎ গতিতে স্লুইচ গেট বন্দ করে দেয়। ২০০৫ সালের মার্চ ও এপ্রিল মাসের মাত্র ২৯ দিন স্লুইস গেট বন্দ রাখাতেই ১৭ কিলোমিটার নদী পলি পড়ে ভরাট হয়ে যায়।

স্থানীয় মানুষের অভিযোগ জেলা প্রশাসকের নিকই ৪০০ লোকের স্বাক্ষর সংবলিত যে দরখাস্ত দেওয়া হয় তাতে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া বাকি লোকদের স্বাক্ষর জাল। তাদের অভিযোগ গেট বন্দের আবেদনকারীদের সাথে পানিউন্ন্য়ণ বোর্ডের দুরভিসন্ধি যুক্ত। তারা আরো অভিযোগ করেন, পানিউন্নয়ণ বোর্ডের কর্মকর্তাগণ স্লুইচ গেট বন্দ রাখার ব্যাপারে যতোটা আগ্রহী, খুলে রাখার বিষয়ে ততোটা নয়। এমনটি গেটের উজানে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেলেও গেট খুলে রাখা হয় না। বিগত ২০০৫ সালের আগস্ট থেকে পরবর্তী বছর জুলাই পর্যন্ত গেটের মুখের পলি অপসারণ করে পানি নিষ্কাশণের ব্যবস্থা করা হয়নি।

নিরুপায় হয়ে ভুক্তভোগী জনগণ ২০০৫ সালের নভেম্বরে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে নদী থেকে পলি অপসারণ ও ভবদহ স্লুইস গেট দু’টির মধ্যবর্তী সংযোগ রাস্তা কেটে দিতে চাইলে ৯ নভেম্বর বুধবার একটি গুজবকে কেন্দ্র করে এক রক্তক্ষয়ী সংঘষের্র সৃষ্টি হয়। এই সংঘর্ষ নিয়েও স্থানীয় মানুষের মধ্যে রয়েছে মিশ্র অনুভূতি। তাদের মত, ভবদহ গেটের উজানে ভাটির পাশ অপেক্ষা দুই থেকে আড়াই ফুট পানির উচ্চতা ছিল এবং গেই দিয়ে পানি নিষ্কাশিত হচ্ছে না দেখে স্থানীয় জনগণ গেটের মধ্যবর্তী রাস্তা কেটে পানি নিষ্কাশনের চেষ্টা করে। কিন্তু গেট সংলগ্ন বিল এলাকার মানুষের নিকট তাদের বেড়ি বাঁধ কেটে দেওয়ার গুজব প্রচার করা হয়। এতে ভাটি ও উজানের মানুষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয় এবং সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়।

স্থানীয় মানুষের অভিযোগ সেদিন রাস্তাকেটে পানিনিষ্কাশনের চেষ্টা সফল হলে ভবদহ গেট যে অকার্যকর হয়ে আছে এবং জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ যে গেটের অব্যবস্থাপনা সেটি প্রমাণ হয়ে যেতো তাই পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু দূনীতিবাজ কর্মকর্তা ও তাদের নিকট থেকে সুবিধাভোগী মানুষেরা পরিকল্পিত ভাবে সংঘর্ষের সৃষ্টি করে। স্থানীয় জনগণের অভিযোগ পানি উন্নয়ন বোর্ড সরকারি অনুদান পাওয়ার জন্য পরিকল্পিত ভাবে গেট বন্দ করে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। তাদের আরো অভিযোগ বার বার গেটের কপাট অবমুক্ত করার দাবি জানালেও বিগত দিন গুলোতে পানি উননয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাগণ কোনো ব্যাবস্থা গ্রহণ করেনি, উপরন্তু তারা বার বার গেটে কোনো সমস্যা নেই বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। তবে ২০০৬ সালের শেষের দিকে সেনা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে পানি নিষ্কাশনের কাজ শুরু হলে গেটের মধ্যকার পলি অবমুক্ত করা হয় এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের মিথ্যাচার স্পষ্ট হয়ে যায়। ভবদহ স্লুইচ গেট দিয়ে পানি নিষ্কাশিত না হওয়ায় ভবদহ সংলগ্ন ৩ টি থানার ৭৯ টি বিলে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।

গত ২০০৫ সালের আগস্ট মাস থেকে বিল এলাকাসহ প্রায় আড়াইশো গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে যায়। জলাবদ্ধতার শিকার ৩ টি পৌরসভা ও ২৩ টি ইউনিয়ন হলো নওয়াপাড়া, মনিরামপুর ও কেশবপুর পৌরসভা। এছাড়া ইউনিয়নগুলো হলো অভয়নগর উপজেলার সুন্দলী, চলিশিয়া, মহাকাল, পায়রা,বাগদা, প্রেমবাগ। মনিরামপুর উপজেলার কুলটিয়া, হরিদাসকাঠি, নেহালপুর, মনোহরপুর, খানপুর, ঢাকুরিয়া ও দুর্বাডাঙ্গা এবং কেশবপুর উপজেলার পাঁজিয়া, সুফলাকাঠি, গৌরীঘোনা, মঙ্গলকোট, বিদ্যানন্দকাঠি,সাগরদাঁড়ি ও ত্রিমোহিনী। প্রায় দশ লক্ষ মানুষ জলাবদ্ধতার কারণে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।

এই অবর্ণনীয় দুর্ভোগ তাদের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভিত্তিকে ভেঙেদিয়ে সর্বশান্ত করে তুলেছে। অভাবি মানুষগুলোর বছরের আট মাস কোনো কাজ থাকেনা তাই খাদ্য সংকট লেগে থাকে। দীর্ঘদিন জলাবদ্ধ থাকায় গৃহপালিত পশুগুলো মড়কে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। অবশিষ্ট গরু-ছাগল, হাঁসমুরগি খাদ্য সংকট আর বাসযোগ্য স্থানের অভাবে কৃষকেরা বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। কাঁচা ঘর-বাড়ি সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে।

পাঁকা ঘরগুলোতে মেঝের মধ্যে মাসের পর মাস এক থেকে দেড় ফুট পানি জমে থাকে। যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম হয়ে ওঠে নৌকা। যাদের নৌকা নেই তাদের দুর্ভোগের সীমা থাকে না। অজস্র মানুষের ঘর-বাড়ি ভেঙে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাওয়ায় তারা দূরের উচু রাস্তা, স্কুল-কলেজের ভবনে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সরকারি হিসাব মতে সা¤প্রতিক জলাবদ্ধতার ফলে দুই শতাধীক স্কুল-কলেজের ভবন পানিতে ডুবে যাওয়ায় শিক্ষা কার্যক্রম স্থবির হয়ে যায়।

কোথাও কোথাও রাস্তার উপর খোলা আকাশের নিচে শিক্ষকেরা শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেও শিক্ষার্থীগণ জল-জঙ্গল পাড়ি দিয়ে আসতে পারেনি। আবার কোথাওবা একই স্থানে আশ্রয় শিবির এবং বিদ্যানিকেতনের কাজ যৌথভাবে চলেছে। শিশু ও বৃদ্ধদের নিয়ে পরিবারের সদস্যদের আতঙ্ক ছিল সবচেয়ে বেশি। একই স্থানে বসে থাকতে থাকতে বৃদ্ধদের অনেকেই পক্ষাঘাতে অক্রান্ত হয়েছেন। কয়েকটি শিশু পানিতে পড়ে মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

মৃতের সৎকারে মানুষকে অসহনীয় দুর্দশার সম্মুখিন হতে হয়েছে। দাফন বা দাহন কোনো কাজের জন্যই স্থলাংশ বা শ্মশান, গোরস্থানের অস্তিত্ব ছিল না। একই পানিতে চলেছে গোসল, খাওয়া, মূত্রত্যাগ। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও খাদ্যাভাবে নানা রকম রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। মানুষ দিনের পর দিন শাপলা, কচুড়ি, ঢ্যাপ, শালুক সেদ্ধ করে খেয়ে জীবিকা নির্বাহ করে।

কিছু স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান খাদ্র ও ওষুধ সরবরাহ করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় ছিল অপ্রতুল। সরকারি সাহায্যের মধ্যে সামান্য কিছু ভিজিএফ কার্ড ছাড়া আর কিছ’ পাওয়া যায় নি। জনগণের দুর্ভোগের ভয়াবহতার চিত্র তুলে ধরে দৈনিক যুগান্তর-এর একটি ব্যুরো রিপোর্টে বলা হয়— ভবদহের জলাবদ্ধতার কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমের তিন জেলায় পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। বছরের পর বছর পানি জমে থাকার ফলে যশোর-খুলনা ও সাতক্ষীরার ৭টি উপজেলার তিনশত গ্রাম বিধ্বস্ত জনপদে পরিণত হয়েছে। এসব গ্রামে অন্তত ৬ লাখ মানুষ অর্ধাহারে-অনাহারে দুর্বিসহ জীবন যাপন করছে।

এছাড়া ঘরবাড়ি ফসলের ক্ষতিসহ মরে যাচ্ছে নানা ধরনের ফলজ বৃক্ষ। জলাবদ্ধতা দূরিকরণে শত শত কোটি টাকা বরাদ্ধ দেওয়া হলেও জনগণের দুর্ভোগ লাঘব হয়নি। দুর্গত মানুষের পক্ষ থেকে সড়ক পথ, রেল পথ অবরোধ, স্মারকলিপি প্রদান বিভিন্ন আবেদন নিবেদন করা হলেও জনপ্রশাস।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।