বুদ্ধদেব গুহের "মাধুকরি" উপন্যাসের পৃথু ঘোষ আমি
শহিদ সামসুদ্দিনের স্ত্রী আনোয়ারার দিন কাটে তো-রাত কাটে না, রাত কাটে তো ভোর দেখে না-এভাবে অনাহার-অর্ধাহারে চলছে তার জীবন। তীব্র দহন যন্ত্রনায়-স্বামী হারা আনোয়ারার থকথকে ক্লেদাচ্ছন্ন বুকের ভেতর গড়ে উঠেছে একটা ব্যথার পাহাড়। গত ৩৮টি বছর ব্যথার সেই পাহাড় বুকে নিয়ে আনোয়ারা কোন রকম বেঁচে আছেন। বাল্য বিবাহিতা আনোয়ারার বয়স এখন কতোই আর হবে ? ৫২ কী ৫৩ বছর। সাদা কাশফুলে ঢেকে গেছে চোখের জমিন আর গায়ে এসেছে বৃদ্ধার বলিরেখা।
শহিদ মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দিন আহমেদ যে পথে যুদ্ধ করতে বেরিয়ে গিয়েছিলেন তিনি আবার ফিরে আসবেন এই মিছে আশায় আনোয়ারা এখনও সেই পথে অপলক তাকিয়ে থাকেন একা! এ প্রতীক্ষার কোনো শেষ নেই-শেষ হবার নয়। কেউ দেখেনা-বুঝেনা তার ভেতরের কষ্ট। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাত্র ২ বছর আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার সিংগার দিঘী গ্রামের জাহেদ আলী পুত্র দরিদ্র কৃষক সামসুদ্দিন আহমেদ পার্শ্ববর্তী আক্তাপাড়া গ্রামের সিদ্দিক আলীর ১৩ বছরের কন্যা আনোয়ারার সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের মাত্র ১ বছরের মাথায় এক পুত্র সন্তান আসে তাদের সংসারে। সেই পুত্রের মুখ দেখে দারিদ্রের কষাঘাতকে ভুলে থাকতেন সামসুদ্দিন দম্পতি।
শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। তুমুল যুদ্ধ চলছে। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ের কথা এটা। আদরের মানিক দুই বছরের শিশু পুত্র মাহবুবুল আলম বুলু আর প্রাণের চেয়ে প্রিয় স্ত্রী আনোয়ারার ভালোবাসা হার মানে দেশের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসার কাছে। পুত্র বুলুর কপালে শেষ চুমু দিয়ে সামসুদ্দিন বেরিয়ে যান যুদ্ধে।
ঘরে কোন সম্বলই রেখে যাননি তিনি। প্রবল আশা ছিলো দেশ স্বাধীন হবে-স্বাধীন দেশের নাগরিক হবে তাঁর সন্তান। কিন্তু, ভেচ্চে যায় তাঁর সেই লালিত স্বপ্ন। তিন নম্বর সেক্টরে যুদ্ধরত অবস্থায় নভেম্বরের শুরুর দিকে সিলেটের আখাউড়ার কোন এক স্থানে শহিদ হন সামসুদ্দিন। তাঁর লাশটি পাওয়া যায়নি আজও।
পিতৃহারা বুলুর কাছে মনে হয় পুরো বাঙলাদেশটি তার বাবার কবরস্থান। আনোয়ারার চারদিক অন্ধকার-সেই যে শুরু গগন বিদারী সেই কান্না থামেনি ৩৮ বছরেও।
স্বামীর ভালোবাসা না পাওয়ার ক্ষতচি?হ্ন নিয়েই আনোয়ারার কেটে গেলো এতোগুলো বছর। অর্থের অভাবে পুত্র বুলুকে পড়াশোনা করাতে পারেনি। তিনি এখন ধীরে ধীরে এগোচ্ছেন মৃত্যুর দিকে।
অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে প্রাপ্ত অর্থ আর বাপের বাড়ি থেকে প্রাপ্ত সামান্য ওয়ারিশের টাকায় তিনি ১৯৭৬ সালে পুত্র বুলুর নামে মাওনা মৌজাস্থিত আর.এস ১১৪৩ ও ১১৪৭ খতিয়ানে ৬১ শতাংশ জমি ক্রয় করেন। ৩৩ বছর ধরেই শহিদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের দখলে রয়েছে ওই জমি। রয়েছে খাজনা খারিজ পরিশোধ সহ তার বৈধ সকল কাগজপত্র। কিন্তু সম্প্রতি কথিত এক সমাজপতির লোলুপ দৃষ্টি পড়ে বিধবা আনোয়ারা ও পিতৃহারা বুলুর দখলে থাকা ওই জমির ওপর। অসহায় এই পরিবারের জমিটুকু জবর দখলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেছে প্রভাবশালী একটি মহল।
একই গ্রামের হাজী ইউসুফ আলীর পুত্র ভূমিদস্যু খ্যাত আইয়ুব আলী আনোয়ারার ঘামের টাকায় কেনা ওই জমি জবর দখল করে ফেলেছে বলে তিনি এক সাংবাদিক সম্মেলনে লিখিত অভিযোগ করেছেন। ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে সিরাজগঞ্জের এস.পি মোশাররফ হোসেনের পিতা ইব্রাহীম হোসেনের কাছে আইয়ুব আলী ওই জমি বিক্রি করে ফেলে। এখন জমিটুকু জবর দখলের জন্য নানা কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে তারা । ক্ষমতার দাপট শক্তি আর অর্থের নিচে চাপা পড়ছে আনোয়ারার জমি উদ্ধারের করুণ আর্তনাদ। পিতৃহারা বুলু আর আনোয়ারা কুঁজু হয়ে জমি উদ্ধারের জন্য ঘুরছেন মানুষের দ্বারে দ্বারে।
প্রতিপক্ষের শারীরিক আর মানষিক নির্যাতনে পরিবারটি দিশেহারা এখন। জাতির গর্বিত সন্তান শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সামসুদ্দিনের স্ত্রী আনোয়ারা অবশেষে প্রাণনাশের হুমকিতে দিনাতিপাত করছেন। পিতাকে হারিয়েছন যুদ্ধে-মাতাকে প্রতিপক্ষ মেরে ফেলবে এ রকম ভয়ে পুত্র বুলু মুখ বুজে সহ্য করছেন সব অত্যাচার। সত্যের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন শ্রীপুর উপজেলার সকল মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু অদৃশ্য শক্তির কাছে হার মানতে হচ্ছে সকলকে।
শহিদ মুক্তিযোদ্ধা সামসুদ্দিনের স্ত্রী আনোয়ারা তার জমি উদ্ধারে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হচ্চক্ষেপ কামনা করে সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন। তার শেষ সম্বলটুকু যদি একটা অপশক্তি নিয়ে যায়-তবে তার আর বেঁচে থাকা কী দরকার ? এমন প্রশ্নের জবাব দেয়ার ভাষা জানা আছে কারো?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।