সবাইকে সাথে নিয়ে এগুতে চাই।
পবিত্র হজ্ব ইসলামের একটি মৌলিক ইবাদত। এটি ইসলামের পঞ্চ ভিত্তের একটি এবং ফরয। মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মীয় সম্মেলন ও বটে। এই মহাসম্মেলন একতা সাম্যের এক মোহিনী চিত্র।
মহান আল্লাহ রাববুল আ’লামীনের সান্নিধ্য লাভের এক মহা মিলন অনুষ্ঠান। ইসলামের সবচেয়ে বৃহত্তম ঐক্যের তথা বিশ্বভ্রাতৃত্বে উৎকৃষ্ট নিদর্শন হচ্ছে হজ্বের বিশ্ব সম্মেলন। হজ্বের শাব্দিক অর্থ জিয়ারতের সংকল্প। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল হতে মুসলমানগন খানায়ে কাবায় তওয়াফ বা জিয়ারতের সংকল্প নিয়ে ছুটে আসেন বলেই এর নাম হয়েছে হজ্ব। পবিত্র হজ্ব সম্পর্কে কুরআনে এরশাদ হয়েছে, ”মানুষের উপর বাইতুল্লার হজ্ব ফরজ করা হয়েছে যারা সে পর্যন্ত সামর্থ রাখে।
আর যারা অস্বীকার করবে তাদের স্মরণ রাখা উচিত আল্লাহ তায়ালা বিশ্ববাসীর মুখাপেক্ষী নন। (আল ইমরান-৯৭) আবু সাঈদ (রা) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সাঃ) আমাদেরকে লক্ষ্য করে বলেন আল্লাহ তায়ালা তোমাদের উপর হজ্ব ফরজ করেছেন । সুতরাং তোমরা হজ্ব কর। (মুসলিম)
প্রিয় নবী করীম (সাঃ) হজ্বের ফজিলত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন একটা বিশুদ্ধ ও মকবুল হজ্ব পৃথিবী এবং পৃথিবীর যাবতীয় বস্তু অপেক্ষা উত্তম। জান্নাত ব্যতীত আর কোন কিছু এর প্রতিদান হতে পারে না অন্য বর্ণনায় রয়েছে , যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে হজ্ব করবে হজ্ব পালন কালে স্ত্রী মিলন কিংবা ঐ সম্পর্কে আলোচনা এবং কোন প্রকার গুনাহর কাজেও লিপ্ত হয় না (হজ্ব শেষে ) সদ্য জাত শিশুর মত নিস্পাপ অব¯স্থায় গৃহে প্রত্যাবর্তন করবে।
(বুখারী মুসলিম) আসলে হজ্ব মহান রাব্বুল আ’লামীন প্রদত্ত একটি বিশেষ নেয়ামত। তাই উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য হজ্ব একটি দুর্লভ প্রাপ্তি।
প্রবর্তনের সময় ও কালঃ আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর পূর্বে আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইব্রাহীম আঃ সর্বপ্রথম হজ্ব অনুষ্ঠানের প্রবর্তন করেন। এরপর থেকে নবী রসুল পরম্পরায় চলে আসছে হজ্ব পালনের অনুষ্ঠান। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সামর্থবান মুসলমানদের উপর হজ্ব অবশ্য করনীয় কর্তব্য বলে পুনঃ নির্দেশ দিয়ে এর গুরুত্ব ও মর্যাদা আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন।
আল্লাহতায়ালা পবিত্র কালামে সুরা বাক্বারা ১২৫ নং আয়াতে কা’বাঘর নির্মান সম্পর্কিত বিষয় এভাবে প্রকাশ করেছেন ”আর আমি যখন কা’বা গৃহকে মানুষের ইবাদতের স্থান এবং নিরাপত্তার স্থান করলাম আর বল্লাম মাকামে ইব্রাহীমকে নামাজের স্থান বানিয়ে নাও। আর আমি ইব্রাহীম (আঃ) ও ইসমাইল (আঃ) কে আদেশ করলাম তোমরা আমার গৃহকে তওয়াফ কারী, অবস্থানকারী,ও রকু সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখ। হজ্ব প্রবর্তনের পূর্বে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে পুত্র ইসমাইল (আঃ) কে সংগে নিয়ে পুনঃ নির্মান করেন পবিত্র খানায়ে কা’বা। উল্লেখ্য হযরত আদম (আঃ) ফেরেস্তাদের সহায়তায় সর্বপ্রথম খানায়ে কা’বা নির্মান করেন। হযরত নূহ (আঃ) এর সময়ে মহাপ্লাবনে তা নিঃশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
ইব্রাহীম (আঃ) জিব্রাইলের সাহায্যে অবস্থান জেনে নিয়ে একই স্থানে এর পূনঃ নির্মান করেন। নির্মান কাজ শেষ হওয়ার পর হযরত ইব্রাহীম আঃ এর প্রতি নির্দেশ হল হজ্বব্রত পালনের। আল্লাহতায়ালা জিব্রাইল আঃ মারফত তাকে হজ্বের সকল আহকাম সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন। হযরত ইব্রাহীম আঃ তার পুত্র ইসমাইল (আঃ) কে নিয়ে খানায়ে কা’বা সাত বার তওয়াফ করেন। চুন্বন করেন হযরে আসওয়াদকে এবং একে একে সম্পন্ন করেন হজ্বের সকল আহকাম।
এরপর নির্দেশ এলো বিশ্ববাসীকে হজ্বের দাওয়াত পৌছে দেয়ার। ইবনে আবি হাতিম কর্তৃক হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত যখন ইব্রাহীম আঃ কে হজ্ব ফরজ হওয়ার কথা ঘোষনা করার আদেশ দেয়া হয় তখন তিনি আল্লহর কাছে আরজ করলেন এটাতো জনমানবহীন প্রান্তর। ঘোষনা শুনার মত কেউ নেই। যেখানে ঘনবসতি আছে সেখানে আমার আওয়াজ কিভাবে পৌছবে? আল্লাতায়ালা বললেন তোমার দায়িত্ব শুধু ঘোষনা দেওয়া । সারা বিশ্বে পৌঁছানোর দায়িত্ব আমার।
একথা শুনে ইব্রাহীম (আঃ)মাকামে ইব্রাহীমে দাড়িয়ে ঘোষনা দিলেন । আল্লাহ তায়ালা তা উচ্ছ করে দেন। কোন কোন রেওয়ায়াতে আছে তিনি আবু কুবায়েস পাহাড়ে আরোহন করে ঘোষনা দিয়েছিলেন।
বর্ণিত আছে আল্লাহর খলীল হযরত ইব্রাহীম (আঃ)এর সেই আহবান জড় জগতের সীমা অতিক্রম করে রুহানী জগতে পৌঁছে ছিল এবং ”লাব্বাইক” বলে যে সমস্ত রুহ সেই আহবানে সাড়া দিয়েছিল কিয়ামত পর্যন্ত তারাই পর্যায়ক্রমে আরাফাতের প্রান্তরে সমবেত হবে।
এভাবে খানায়ে ক্বা’বা পরিনত হলো হজ্বব্রত পালনের ক্ষেত্রস্থল হিসাবে।
এই হজ্ব দ্বারা স্থাপিত হল বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর মহামিলনের কেন্দ্রস্থল তথা বার্ষিক মহামিলনের আদর্শ প্রশিক্ষন কেন্দ্র। প্রতি বছর চন্দ্র মাসে ৮ই জিলহজ্ব
থেকে ১২ই জিলহজ্ব পর্যন্ত হজ্বের এই মিলন অনুষ্ঠানে খানায়ে ক্বা’বা মুখরিত হয়ে উঠে লাখো লাখো মুসলমানের কণ্ঠের লাব্বায়েক ধ্বনিতে।
ব¯ু—তঃ আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের নির্দেশে হজরত ইব্রাহীম (আঃ) এই কা’বাকে কেন্দ্র করে হজ্বের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর ঈমানী অভিযাত্রা শুরু করেন এবং আজ পর্যন্ত তা অব্যাহত আছে। স্মর্তব্য একটা জীবন বিধান তথা আদর্শকে বাস্তবায়ন করতে সাংগঠনিক তৎপরতা অপরিহার্য। আর এই তৎপরতা সুষ্টভাবে পরিচালনার জন্য একটি কেন্দ্রীয় অফিস থাকা প্রয়োজন।
মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় বিধান তথা জীবন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় অফিস খানায়ে ক্বা’বাকেই বুঝানো হয়।
হজ্বের উদ্দেশ্যঃ আল্লাহর আনুগত্যকে স্বীকার করে সব মুসলমান ভাই ভাই নীতিতে প্রেম প্রীতি সৌহার্দ-সহানুভূতি ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য প্রভৃতি দ্বারা এক সুুত্রে বেঁধে এই সুন্দর পৃথিবীকে আরো সৌন্দর্যমন্ডিত করে তোলা। হজ্বের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো আত্মশুদ্ধি এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে বান্দার নিঃশর্ত আত্মসমর্পন। হজ্বের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি কাজের মধ্যে সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠে। এ সম্মেলনের প্রধান শিক্ষাই হলো সমগ্র বিশ্ব মানুষের মধ্যে অবিচ্ছদ্য এক ভ্রাতৃত্ব বন্ধন গড়ে তোলার জন্য ব্রতী হওয়া।
হজ্বের প্রশিক্ষনঃ সামাজিক প্রয়োজন ও চাহিদা পুরন করার উদ্দেশ্যে ইসলামে বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টিকারী বিষয়গুলোর মুলউৎপাটন করে বৃহত্তর জনগুষ্টিকে ঐক্যবদ্ব করতে চায়। সেই লক্ষ্যে নামাজ, রোযা প্রভৃতির ন্যায় হজ্ব পালনও মূলতঃ একটা ট্রেনিং বা প্রশিক্ষন। সমগ্র বিশ্বের সকল তাওহীদবাদীর সমন¦য়ে এক মহাজাতীর তথা মুসলিম জাতীর এক সুদৃড় ভিত গড়ে তোলার এক বাস্তব অনুশীলন হচ্ছে এই হজ ¡অনুষ্ঠান। দুনিয়ার জীবনে যেমন অর্পিত দায়িত্ব পালনে দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গকে দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য প্রশিক্ষন দেয়ার লক্ষ্যে নির্দিষ্ট মেয়াদে প্রশিক্ষন কেন্দ্র ডাকা হয় তেমনি আল্লাহর জমিনে একমাত্র আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে যোগ্য দক্ষ ও সচেতন করে তোলার জন্য সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি বর্গকে প্রশিক্ষন দানের উদ্দেশ্যে আল্লাহতায়ালা জীবনে অন্ততঃ একবার তার খানায়ে ক্বা’বায় তথা প্রশিক্ষন কেন্দ্রে আহবান করেন। প্রতিটি প্রশিক্ষনরই একটি কর্মসুচী থাকে।
হজ ¡ প্রশিক্ষনের ও কর্মসুচী আছে। তা হচ্ছে ঃ ১) এহরাম বাঁধা ২) বাইতুল্লাহ তওয়াফ করা ৩) সাফা মারওয়া সাঈ করা ৪) আরাফাতে অবস্থান করা ৫) মিনায় রাত্রি যাপন করা ৬) মুজদালিফাতে রাত্রি যাপন করা ৭) রমিয়ে জেমার করা বা কংকর নিক্ষেপ করা ৮) ক্বোরবানী করা ৯) বিদায়ী তওয়াফ করা।
প্রত্যেকেরই স্মরন রাখা উচিত যে হজ্ব কর্মসুচি গুলো নিছক প্রথাগত কোন কর্মকান্ড নয় বরং এর প্রতিটি কর্মকান্ডের মধ্যে নিহিত আছে বহু শিক্ষনীয় বিষয়। এক্ষেত্রে দৈহিক কর্মকান্ডের সাথে মৌখিকভাবে উচ্ছারিত হয় কিছু দোয়া। আসলে হজ্ব কর্মসুচীটা কোন মানব রচিত নয় বরং আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে জিব্রাইল (আঃ)কর্তৃক শিখানো কর্মসূচি বিধায় দোয়াগুলো যথাসময়ে যথাস্থানে পাঠ করলে যে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যান সাধিত হবে তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই।
কেননা এর মধ্যে আরবী ভাষায় কিছু অংগিকার ও কিছু প্রার্থনা করা হয়েছে মহান আল্লাহর দরবারে।
পরিশিষ্টঃ বিভেদ অনৈক্য সৃষ্টিকারী বিষয়গুলোর মূলোৎপাটন করে বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্টিকে এক সূত্র্রে বন্ধন করাই হজ্বের এ মহা সম্মেলনের অন্যতম উদ্দেশ্য। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, হজ্বের এই মহান উদ্দেশ্য আধুনিক ঋণতান্ত্রিক স্বার্থসর্বস্ব দুনিয়ায় দুঃখজনকভাবে ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। কেননা আমরা আজ স্বার্থের মোহ কাটিয়ে উঠতে পারছি না, স্বার্থের বশবর্তী হয়ে আমরা ধর্মীয় আদর্শ তথা হজ্বের উদ্দেশ্য বিস্মৃত হয়ে আজ আমরা হজ্বকে অনুষ্ঠান সর্বস্ব ইবাদতে পরিনত করেছি। নতুবা আজ মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান হজ্ব পালন করে এসে কি করে দেশের মধ্যে অনৈসলামীক কর্মকান্ড করতে পারে? কেমন করে একজন হাজী সাহেব হজ্ব পালন করে এসে হাত গুটিয়ে ঘরে নিষক্রিয় বসে থাকতে পারে? কেমন করে তাদেরই সামনে দেশময় দ্বীনহীন গাফেল পরিবেশ সৃষ্টি হয়?
কেমন করে হাজার হাজার মানুষ ঈমান হারা হয়ে কাফের মুশরিকদের মত মৃত্যু বরন করে ? ইসলামের সোনালী যুগে সাহাবায়ে কেরামগন ও আল্লাহর প্রিয় বান্দারা আল্লাহর সন্তুষ্টি চেয়েছিলেন বলেই বিদায় হজ্বের ময়দান থেকে ফিরে এসে তারা নিষক্রিয় হয়ে ঘরে বসে থাকতে পারেন নি।
তারা সমস্ত শান্তি , ভোগ বিলাস মায়া মমতা পরিবার পরিজন ঘরবাড়ি সব কিছু ত্যাগ করে আল্লাহর দেয়া জান মাল ও সময় আল্লাহর পথে উৎসর্গ করে ছিলেন। কাজেই আজ আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। তাদের মত আমরা ও যেন হজ্বের শিক্ষাগুলিকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করে স্বীয় জীবনের সাথে সাথে পারিবারিক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বাস্তবায়িত করে এই সুন্দর পৃথিবীকে আরো সৌন্দর্যমন্ডিত করতে পারি। এই হোক আমাদের ঐকান্তিক কামনা।
আমীন।
। ইয়া রাব্বাল আ’লামীন। ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।