মাহবুব লীলেন
একদিন যারা মেরেছিল তারে গিয়ে
রাজার দোহাই দিয়ে
তারাই আবার ফিরিয়া আসিছে আজি
মন্দিরেতে বসিছে ভক্ত সাজি...
কথাগুলো এদিক সেদিক হবার ভয় থাকলেও যীশুকে নিয়ে লেখা গানটা রবীন্দ্রনাথের। সংস্কৃতি নিয়ে কোথাও আলাপ শুনলে কেন যেন বারবার এই গানটার কথাই আমার মনে পড়ে যায়। যে রোমানরা যীশুকে হত্যা করল তক্তা ফিটিং দিয়ে; কিছুদিন পরে তারাই হয়ে গেলো যীশুর সোল এজেন্ট। যদিও অনুমান করি কথাগুলো রবীন্দ্রনাথ ক্ষোভ থেকেই বলেছিলেন। কিন্তু আমার ধারণা সব সময় সবখানেই নতুনকে বুড়োদের পিটানো ক্ষেদানো আর নতুনকে নতুনদের মাথায় তুলে রাখা কিংবা গলায় ঝুলিয়ে হাঁটার ইতিহাস পুরোটাই যেন রবীন্দ্রনাথ বেখেয়ালে ঢুকিয়ে দিয়েছেন এই চারটা লাইনে...
পৃথিবীতে বোধহয় এমন কোনো পরিবর্তন কিংবা মোড় নেই যা বুড়োদের লাঠির বাড়ি খায়নি।
আর বোধহয় এমন তরুণ খুবই কম আছে যে নিজে বুড়ো হবার পর আরেকটা নতুনের সামনে লাঠি তুলে দাঁড়ায়নি
বিষয়টা অনেকটা জন্মের পর থেকে মায়ের হাতের রান্নায় অভস্থ মুখে নতুন বৌয়ের রান্না পছন্দ করতে না পারা আবার বছরের পর বছর বৌয়ের রান্না খেতে খেতে ছেলে বৌয়ের রান্নায় অস্বস্তি লাগার মতো ব্যক্তিমানুষের অভ্যাস কিংবা সীমাবদ্ধতা বদলাতে না পারার মতো নৈমিত্তিক ঘটনা। তা হোক ধর্ম- ভাষা- বিপ্লব। হোক পোশাক আচরণ ঘরবাড়ি ফার্নিচার টেকনলজি কিংবা খাবার...
কিন্তু মানুষের বোধহয় বিশাল একটা মানবিক ঝামেলা হচ্ছে নিজেকে আনফিট ভাবতে পছন্দ না করা কিংবা করতে না পারা। আর এরকম ঘটলেই সে হেডমওয়ালা হলে লাঠি উঠায় আর হেডম না থাকলে হাউকাউ করে গেলো গেলো জাত গেলো বলে...
আশপাশে প্রায়ই নাক সিটকানি শুনি- নতুন পোলাপান ভাষা বদলে দিচ্ছে এটা ঠিক না। গান বদলে দিচ্ছে এটা উচিত না।
পোশাক চেঞ্জ করে ফেলেছে এটা খুবই খারাপ। জাতে বেজাতে বিয়ে শাদি করে জাতিধর্ম নাশ করে দিচ্ছে এটা অন্যায়...
তখন তাদেরকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে পৃথিবীতে এমন কোনো জাতি ভাষা আচরণ পোশাক কি আছে যা না বদলে জাদুঘরের বাইরে কোথাও টিকে? অথবা তারা কি মনে করে যে যদি বদলাতে না পারে তাহলে কি আদৌ টেকার কোনো সম্ভাবনা আছে কোনো জাতি কিংবা ভাষার?
বাঙালি জাতিটা একটা বারো মিশেল রক্তের উত্তরাধিকার। বাংলা ভাষাটা নিজস্ব ব্যাকরণের ভেতর শতশত ভাষার একটা সমন্বয়। বাঙালি শাড়ি লুঙ্গি ধুতি গামছা নেংটি ব্লাউজ কোনটা কোন জাতি থেকে এসছে কয় বাঙালি তার হিসাব করে? কয়টা গায়েন হিসাব রাখে একতারা দোতারা বেহালা হারমোনিয়াম তবলা বায়া নাকাড়া কোনটা কোন সংস্কৃতি থেকে ধার করা?
ওসব হিসাব করে না কারণ বাপ দাদারাও এসবে অভ্যস্থ ছিল। তার একটু খটকা লাগে আপত্তি লাগে অনভ্যস্থ লাগে ইলেকিট্রক ঢোল কিংবা হারমোনিয়ামে।
তখন সে মিনমিন করে বলে- বাউল গানে সঙ্গে ড্রাম যায় না; কীবোর্ড বাজানো ঠিক না...
এখন প্রত্যন্ত গ্রামের দাদি নানীরাও ব্লাউজকে শাড়ির সাথের অনিবার্য অংশ মনে করেন। অথচ একশো বছরও হয়নি বাঙালিদের মধ্যে যখন ব্লাউজের প্রচলন হয় তখনকার ছি ছি আমরা জানি। কাটা লুঙ্গি আর সেলাই করা লুঙ্গির মারামারি পঞ্চাশ বছর আগেও ছিল
আমরা ওদিকে কিন্তু তাকাই না। কারণ ওগুলোতে জন্ম থেকে আমরা অভ্যস্থ। আমরা হৈচৈ করে উঠি যেগুলোর সাথে তাল মেলাতে পারি না।
যে নতুন ভাষা বোঝে না সে ফতোয়া দেয়- ভাষার মধ্যে বিদেশি শব্দ ঢোকানো না জায়েজ। যার নিজের কান নতুন সুর বুঝতে পারে না সে বিধান দেয়- এইগুলান অপসংস্কৃতি...
গল্পকার মহসিন হাবিব একবার সৈয়দ শামসুল হককে বলেছিলেন- হক ভাই। কম্পিউটারে কবিতা গল্প লিখতে গেলে আমার অস্বস্তি লাগে। মনে হয় কম্পিউটার ক্রিয়েটিভ লেখার জন্য না
সৈয়দ হক উত্তরে বলেছিলেন- কালিদাসের হাতে ফাউন্টেনপেন ধরিয়ে দিলে তিনিও কিন্তু একই কথা বলতেন...
আমার মনে হয় পরিবর্তনের সাথে মানুষের ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতার বিষয়্টা এক বাক্যে বলে দিয়েছেন সৈয়দ হক। আসোলে আমরাই পারি না।
প্রতিদিনই আমরা একদিন করে প্রাচীন হই আর একটা করে শিশু পরিবারের সীমানা ছাড়িয়ে স্বতন্ত্র তরুণে পরিণত হয়। স্বতন্ত্র হয় তার নিজের ভাষায় নিজের যোগ করা শব্দে। নিজের শরীরে নিজের ডিজাইন করা পোশাকে; সে স্বতন্ত্র হয় তার নিজের তোলা সুরে তালে লয়ে... এবং একদিন আবার সেই তরুণ তার স্বাতন্ত্রের মধ্যেই প্রাচীন হয়ে আটকা পড়ে যায় নিজের সীমারেখায় আর তখন কোনো নতুন তরুণ সেই সীমারেখা ভেঙে স্বতন্ত্র হতে গেলেই পুরোনো তরুণটা তার বাপদাদার কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে উঠে- সামলাও সামলাও গেলো। ডুবিয়ে দিলো সব...
বাংলাভাষায় বুদ্ধিদীপ্তভাবে সংযোজন করা শব্দগুলোর মধ্যে আমার কাছে সবচে অর্থবহ শব্দ মনে হয় সংস্কৃতি শব্দটাকে। ইংরেজি কালচার শব্দটার প্রতিশব্দ হিসেবে তখন ব্যবহার করা হতো কৃষ্টি।
ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় এর প্রতিশব্দ করলেন সংস্কৃতি। আর এর ব্যাখ্যা দিলেন- যা সংস্কার করে গৃহীত হয়েছে তাই সংস্কৃতি। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো আমরা সংস্কৃতি শব্দটাকে ব্যবহার করেই সংস্কৃতির সংস্কার বিরোধীতার মতো গোাঁড়ামি করে বসি হামেশাই...
ইংরেজিতে বিন্দুমাত্র দখল না থেকেও সাম্প্রতিককালে আমার ভাত খেতে হয় ইংরেজি ভাষা বিক্রি করে। এই ফেরিওয়ালাগিরি করতে গিয়ে অবাক হয়ে খেয়াল করলাম মাত্র গত দশ বছরে মোবইল এসএমস আর নেটচ্যাট ইংরেজির শব্দ-বানানতো অবশ্যই; বৃটিশদের তৈরি অত বছরের গ্রামারের মূল ভিতটাও নাড়িয়ে দিয়েছে ভয়ানকভাবে...
ভাষা মানুষের সাথে যোগাযোগের জন্য। ভাষা দিয়ে মানুষকে বোঝাতে পারলে- যোগাযোগ করতে পারলে বাকি সব গ্রামার বানান নিয়ম সবকিছুই ফালতু বিষয়...
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্য সব পথ প্রায় বন্ধ হয়ে য্ওায়া বৃটিশরা এখন উঠেপড়ে লেগেছে বিদেশে ইংরেজি বিক্রি করে কিছু আয় ইনকাম বাড়াতে।
কিন্তু তার জন্য ইংরেজ ভাষা বিজ্ঞানীরা গুগলে ঢুকে ইংরেজি শিখছে নতুন করে। নেট থেকে চুরি করছে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের নিজস্ব ইংরেজির চ্যাট আর ইমেইল রেকর্ড। ইউরোপে সিম্পল ম্যান বললে গরিব লোক বোঝালেও বাংলাদেশে এসে তারা শিখে নিচ্ছে সিম্পল ম্যান মানে সহজ সরল শ্রদ্ধা করার মতো মানুষ। তারা শিখে নিচ্ছে ইউরোপে পাবলিক মানে সম্মানীত জনগণ বোঝালেও বাংলাদেশে পাবলিকের মানে তুচ্ছ আমজনতা। শিখে নিচ্ছে ইউরোপের পাবলিক সার্ভিসের বাংলাদেশি ইংরেজি হলো গভমেন্ট সার্ভিস...
এবং বাংলাদেশে এসে বাঙালিদের কাছ থেকে ইংরেজি শিখে ইংরেজরা বাঙালিদের শেখাচ্ছে ইংরেজি ভাষা।
সম্ভবত এটাই ভাষার মূল বৈশিষ্ট্য। ভাষা কোনোদিনও একটার সাথে আরেকটা মিশে যায় না। বরং বছরে বছরে অঞ্চলে অঞ্চলে আলাদা হতেই থাকে। বর্তমান অনেকেই বাংলার সাথে ইংলিশ মিশেল দিলেও কোনোদিনও বাংলাভাষার ইংরেজি হয়ে যাবার কোনো সম্ভাবনা দেখি না আমি। বাংলিশ হবারও না।
বাংলাই থাকবে। ঠিক যেমন রবীন্দ্র লালন বাউল নতুন সুরে নতুন যন্ত্রে গাইলেও থেকে যাবে বাংলার গান; নতুন মানুষের জন্য নতুনভাবে
হয়তো সেই ভাষা সেই সুর আমি বুঝব না; বাতের ব্যথা আক্রান্ত মগজ আর অত দৌড়াতে পারবে না নতুন গতির সাথে। কিন্তু আমার কি কোনো অধিকার আছে কোনো বাঙালিকে বলার যে তোমরা পেছনে তাকিয়ে হাঁটো?
২০০৯. ০৯. ২৭ রোববার
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।