আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছো বসি আমার ব্লগখানি কৌতুহল ভরে
বারাক ওবামার ভাষণের পর ১৫ মিনিট বরাদ্দ ছিল লিবীয় প্রেসিডেন্ট কর্ণেল মুয়াম্মার গাদ্দাফীর জন্য । এরপর পালা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনের । কিন্তু গর্ডন ব্রাউনের অপেক্ষার পালা যেন ফুরোতেই চায় না । ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ঘটল এই ঘটনা।
অবশেষে যখন গর্ডন ব্রাউনের সুযোগ মিলল , ততক্ষণে পেরিয়ে গেছে ৯৬ টি মিনিট।
পুরো সময়টা জুড়ে কিছুই যেন বাদ রাখেননি গাদ্দাফি । আবেগাপ্লুত হয়ে সোমালী জলদস্যুদের পেছনে কলকাঠি নাড়ছে
কারা সেটা থেকে শুরু করে জন এফ কেনেডির মৃত্যু নিয়ে আলোচনা
করে ফেলেছেন । তাঁর কথার তীক্ষন বাণে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত করেছেন বিশ্বের জাঁদরেল সব নেতৃবৃন্দকে , নিরাপত্তা পরিষদকে অকার্যকর দাবী করে একে তুলোধুনো করেছেন , সোয়াইন ফ্লুকে আখ্যা দিয়েছেন
পশ্চিমা সামরিক স্বার্থে উৎপাদিত গুজব এবং ভাইরাস হিসেবে।
(সবেমাত্র জাতিসংঘ সনদ ছিঁড়ছেন গাদ্দাফী , বক্তৃতা তখনও অনেএএক বাকি)
মার্কিন মুল্লুকে উড়ে আসতে জেট ল্যাগে আক্রান্ত হয়ে কি ভীষণ ঝক্কি গেছে তার সে কথাও বাদ থাকেনি । সারা বিশ্বে সময়ের পার্থক্য নিয়ে তাই অভিযোগ করে বসেছেন ।
জাতিসংঘ সনদ ছিঁড়ে টুকরো
করেছেন , ছুঁড়ে ফেলেছেন। শেষমেশ নিজের ওয়েবসাইটের প্রচারণাতেও
কাজে লাগিয়েছেন সাধারণ পরিষদের ডায়াস।
লম্বা কথার লম্বা ইতিহাস :
এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় গর্ডন ব্রাউন যদি হতাশ হয়ে পড়েন , তবে বলতেই হবে ব্রাউন যথেষ্টই ভাগ্যবান । অন্য অনেকের তুলনায় গাদ্দাফী যে নিতান্তই শিশু ।
(কাস্ট্রোর কথা শুরু হত , কিন্তু শেষ হত না)
১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই ডায়াস থেকে বক্তৃতা শেষ করে কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিডেল ক্যাস্ট্রোর সময় লেগেছিল পুরো ৪ ঘন্টা ২৯ মিনিট।
তবে , ইতিহাস বলে , ক্যাস্ট্রো সেদিন কথা অনেক কমই বলেছিলেন । টানা ঘন্টার পর ঘন্টা বক্তৃতা দিয়ে যাওয়ায় তার জুড়ি মেলা
ভার। ১৯৮৬ সালে কিউবান কমিউনিস্ট পার্টি কংগ্রেসে ক্যাস্ট্রো
একনাগাড়ে ৭ ঘন্টা ১০ মিনিট উচ্চকন্ঠে বক্তব্য দিয়েছিলেন। এত বেশি
উত্তেজিত ছিলেন যে , মাঝে খাবার বিরতিও দেয়া হয়নি ।
ভারতীয় রাজনীতিবিদ ভিকে কৃষ্ঞমেনন তো আরেক কাঠি বাড়া ।
কাশ্মীরের উপর ভারতের কর্তৃত্বকে বৈধ প্রমাণ করতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে একটানা আট ঘন্টা গলা চড়িয়েছিলেন তিনি।
লম্বা কথার একাল/সেকাল :
গণতান্ত্রিক দেশে লম্বা ভাষণের ঘটনা আজকাল তুলনামূলকভাবে কমই ঘটে থাকে । আগে যেখানে লম্বা চওড়া বক্তৃতাকে বক্তার বিচক্ষণতা মনে
করা হত , এখনকার দিনে আজকাল বক্তার রাজনৈতিক দূর্বলতা হিসেবেই চিহ্নিত করা হয় ।
উদাহরণস্বরুপ , গর্ডন ব্রাউনের নামেই অভিযোগ আছে , তিনি অতিরিক্ত শব্দ ব্যবহার করে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে ফেলেন। অথচ তার হ্যারল্ড ম্যাকমিলান পর্যন্ত পূর্বতন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীরা যখন ঘন্টার ঘন্টার পর ঘন্টা বলে যেতেন , তখন লোকে তাদের আরও বেশি সমীহ করত ।
বাঘে ধরলে ১৮ ঘা , ঠিকমত বক্তৃতা না শুনলে , তালি না দিলে ৩৬ ঘা :
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রুশ বিভাগের অধ্যাপক এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন যে , শ্রোতারা উঠে চলে যাবে না , এমন নিশ্চয়তা পেলেই অনেকে লম্বা বক্তৃতা দেয়ার অভ্যাস গড়ে তোলেন । গাদ্দাফির বেলায় নিঃসন্দেহে তাঁর বাগ্মীতা শ্রোতাদের ধরে রাখে না , জাতিসংঘ সাধারণ
পরিষদে কূটনৈতিক রীতি আর ভদ্রতার কারণেই সবাই নিঃশব্দে তার ভাষণ শুনে গেছে , তবে দেশে তার অনুসারীদের সামনে বক্তৃতা শুরু করেন , তখন নিজেদের গা বাঁচানোর স্বার্থেই সবাইকে বক্তৃতা শুনে
যেতে হয় ।
(বক্তৃতাকালে দাঁড়িয়ে সম্মান বা তালি সব বক্তাই পছন্দ করেন ... তবে ...)
লম্বা বক্তব্য দেয়ার পর সবাই যদি তালি দিতে কার্পন্য করে , সেটা বক্তার জন্য বিরাট অপমানজনক । সাবেক সোভিয়েত নেতারা এই ব্যাপারটি
ভালভাবেই মাথায় রাখতেন বলে , তাদের বক্তৃতার পর অনুসারীদের
দীর্ঘ সময় ধরে ছন্দ মিলিয়ে তালি দিয়ে যেতে হত । কেউ যদি তালি
দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে যেত , তবে তার কপালে বিরাট দুর্ভোগ নেমে
আসত ।
বিখ্যাত রুশ লেখক আলেকজান্ডার সোলঝেনিৎসিনের সাথে সাইবেরিয়ার বন্দীশিবিরে দেখা হয়েছিল এমনই এক হতভাগার। রাশিয়ার স্থানীয় এক কমিউনিস্ট পার্টি কনফারেন্সে কেউ একজন স্ট্যালিনের সুস্বাস্থ্য কামনা
করে বসতেই শ্রোতারা দাঁড়িয়ে তুমুল করতালি শুরু করে । স্ট্যালিন যদিও অনুপস্থিত , তারপরও কেউ তালি থামাতে , বা তালির তীব্রতা থামানোর সাহস পেল না । ১১ মিনিট একটানা ঝড়ের বেগে তালি দিয়ে সেই হতভাগার হাতের তালু লাল হয়ে যায় , কাঁধ যেন খুলে আসতে থাকে । বাধ্য হয়ে সেই হতভাগা পার্টি নেতা বসে পড়েন তার আসনে , পরের দিন তাকে গ্রেফতার করে সাইবেরিয়ার বন্দী শিবিরে চালান করে দেয়া হয় ।
(স্ট্যালিনের বক্তৃতা , বা বক্তৃতায় স্ট্যালিনের নাম ...... মানেই ভীষণ বিভীষিকা)
স্ট্যালিনের লম্বা ভাষণের এক চতুর্থাংশ শুধু তালিময় হয়ে থাকত । সেসব ভাষণ এমনিতেও ভয়াবহ রকমের লম্বা হত । সামাজিক , অর্থনৈতিক , সামরিক , পররাষ্ট্র সবকিছু নিয়ে বিস্তারিত ভাবে বলতে ভালবাসতেন স্টালিন। শুধু বর্তমানের কথা বলেই তিনি ক্ষান্ত হতেন না , আগামী ১০ থেকে ২০ বছরে কোন ক্ষেত্রে কি ঘটতে যাচ্ছে সেসবও বলতে গিয়ে শুরু
হত আরেক ভাষণ ।
পরবর্তী সময়ের সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভও কম যাননি ।
এমনিতেই তার বক্তৃতার কপিগুলো হত পুস্তিকার মত , তার উপর ভীষণ উত্তেজিত হয়ে তিনি বহু পৃষ্ঠা দু'বার করে পড়তেন ।
লম্বা বক্তৃতা দিয়ে ধমক খাওয়া :
তবে , লম্বা বক্তারা জায়গা মত গিয়ে ধাতানিও খেয়েছেন ,সবচেয়ে
উল্লেখযোগ্যটা ঘটেছিল চিলিতে ।
(এত কথা বলে কাস্ট্রো ডোবাবে নাকি , ভীত হয়ে গেলেন সালভাদর আয়েন্দে)
১৯৭০ এর চিলিয়ান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সমাজতন্ত্রী সালভাদর আলেন্দের সমর্থনে প্রচারণা চালাতে চিলি গিয়েছিলেন কিউবান প্রেসিডেন্ট ফিডেল ক্যাস্ট্রো । আলেন্দের সমর্থনে চিলির বিভিন্ন জায়গায় যখন কাস্ট্রো লম্বা
লম্বা বক্তৃতা । দিতে শুরু করেন , তখন স্বয়ং আলেন্দে শংকিত হয়ে
পড়েন ।
তার ধারণা হয় , কাস্ট্রোর এত লম্বা বক্তৃতায় অধৈর্য হয়ে চিলির জনগণ উল্টো আলেন্দের বিপক্ষে ভোট দিয়ে বসতে পারে । কাস্ট্রোকে
তাই কঠোরভাবে তিনি সতর্ক করে দেন কম কথায় কাজ সারতে ।
দীর্ঘ বক্তব্যের জনক কে ?
গাদ্দাফি বা কাস্ট্রো হয়ত আধুনিক কালে ঘন্টার পর ঘন্টা বক্তৃতা দিয়ে
বেড়াচ্ছেন , তবে প্রাচীনকালের দিকে যদি তাকানো হয় ,তবে তাঁদের
গুরু ছিলেন গ্রীক শিক্ষক ক্লিওন , যিনি মনে করতেন লম্বা চওড়া বক্তৃতা
দিয়েই কেবল জনগণের মন জয় করা সম্ভব।
পেলোপনিশিয়ান যুদ্ধে যেসব এথেন্সবাসী নিহত হয়েছিলেন , তাদের শৌর্য বীর্যের প্রশংসা করতে গিয়ে শেষকৃত্য অনুষ্ঠানকে অসম্ভব রকমের প্রলম্বিত করে ফেলেছিলেন ক্লিওন , যে মৃতদেহ নিয়ে অনেকেই শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন ।
শেষের গল্প :
(আতাতুর্ক ......কাল আবার বাকিটুকু ..... )
এখানেই শেষ করা যেত , তবে কামাল আতাতুর্কের গল্প না বললে
বক্তৃতাবাজীর গল্পটা মনে হয় অসমাপ্তই রয়ে যায় ।
১৯২৭ সালে তার একটা বক্তৃতার দৈর্ঘ্য ছিল ৩৬ ঘন্টা ৩১ মিনিট । প্রতিদিন বক্তব্য শুরু করতেন কামাল পাশা , এভাবে পুরো বক্তব্য শেষ হতে সময়
লেগে গেল ৬ টা দিন !!
বিবিসি অবলম্বনে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।