আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কাব্বালাহ: সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
সময়টা ১৩০০ খ্রিস্টপূর্ব । মিশর থেকে অবরুদ্ধ হিব্রুদের উদ্ধার করে মুসা নবী মুক্তাঞ্চল সিনাই উপত্যকায় নিয়ে এলেন ... তারপর ইয়াওয়ে বা ঈশ্বরের সঙ্গে হিব্রুদের একটি চুক্তি (covenant) করিয়ে দিলেন-এসব আমরা জানি। এবং এসব বিস্ময়কর ইতিহাস নিয়েই পরবর্তীকালে রচিত হলো হিব্রু বাইবেল বা ওল্ড টেস্টামেন্ট-যার প্রথম পাঁচটি অধ্যায়কে বলা হয় ‘তোরাহ’ ।

কালক্রমে তোরাহই হয়ে উঠেছিল সেই খ্রিস্টপূর্ব যুগের প্রাচীন ইহুদি জীবনধারার অনিবার্য দিকনির্দেশ। অবশ্য স্বল্পসংখ্যক অনুসন্ধিৎসু ব্যাক্তি ঠিক অতটুকুতে সন্তুষ্ঠ থাকলেন না- তারা তোরাহর শ্লোকগুলিকে রহস্যময় মনে করে সেই সমস্ত শ্লোকের নানাবিধ ব্যাখা-বয়ান করতে লাগলেন। এভাবে গড়ে উঠল ইহুদিধর্মের গুপ্ত মরমীবাদী শাখা- যার নাম: কাব্বালাহ ...শব্দটির মানে, ‘গ্রহন করা’ বা ‘মেনে নেওয়া’। কি গ্রহন করা হল? কি মেনে নেওয়া হল? ঐশ্বরিক শক্তি গ্রহন করা হল। ঐশ্বরিক শক্তি মেনে নেওয়া হল।

কাব্বালাহর অন্য অর্থ ‘ ট্র্যাডিশন’ বা ঐতিহ্য। এক কথায়, Kabbalah হলো ইহুদি ধর্মের মরমীবাদী শাখা এবং কাব্বালাহর বিষয় ঐশ্বরিক পবিত্রতার সরুপ, সৃষ্টিতত্ত্ব, আত্মার উৎপত্তি ও পরিনতি এবং অনিবার্যভাবে মানুষের ভূমিকা । একইসঙ্গে কাব্বালাহ অনুধ্যানশীল, ভক্তিমূলক, মরমী এবং ঐন্দ্রজালিক ক্রিয়াকর্মের সমষ্টি। ওল্ড টেস্টামেন্ট বা হিব্রু বাইবেলে তোরাহর গুরুত্ব সবচে বেশি । তার কারণ আছে।

ঐ পাঁচটি অধ্যায়েই স্বয়ং নবী মুসা উপস্থিত । কাব্বালাহর উদ্ভব তোরাহর ব্যাখ্যা বয়ান থেকেই। আর, তোরাহকে যেহেতু পবিত্র গন্য করা হয়-কাজেই, তোরাহ হতে উদ্ভুত গুপ্ত জ্ঞান কাব্বালাহও পবিত্র । তোরাহ কে পবিত্র জ্ঞান করা কাব্বালাহপন্থি ঐহিত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য । কাজেই কাব্বালাহয় পবিত্র শক্তি নিহিত এবং এটি সাধনা করলে সৃষ্টিরহস্যকে জানা যাবে।

তখন আমি বলেছি যে- কাব্বালাহর অন্য অর্থ ট্র্যাডিশন বা ঐতিহ্য। তোরাহ কেন্দ্রীক ব্যাখ্যাই হল ইহুদি ঐতিহ্য । তোরাহ মানে আইন। ইহুদি ঐতিহ্য মতে জগৎ সৃষ্টির পূর্বেই তোরাহর সৃষ্টি হয়েছে এবং তোরাহই নাকি মানুষ সৃষ্টি করার জন্য ঈশ্বরকে অনুরোধ করেছে! যে কারনে তখন আমি বলছিলাম যে- ওল্ড টেস্টামেন্ট বা হিব্রু বাইবেলে তোরাহর গুরুত্ব সবচে বেশি । যখন ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বে সিনাই উপত্যকায় মুসা নবী ঈশ্বর কর্তৃক লিখিত আইন (টেন কমান্ডমেন্টস) লাভ করলেন তখন-বিশ্বাস করা হয় যে- তিনি ঈশ্বরের তরফ থেকে মৌখিক নির্দেশাবলীও (ওরাল ল) পেয়েছিলেন যা কিনা লিখিত হয় নাই।

তারপর কালক্রমে বংশ পরম্পরায় সেই ওরাল ল বা মৌখিক নির্দেশাবলী বাহিত হয়েছে । এসব মৌখিক বিধানসমূহের নামই হল কাব্বালাহ। যে কারণে কাব্বালাহর অন্য অর্থ ট্র্যাডিশন বা ঐতিহ্য। কাব্বালাহ সাধকগন বিশ্বাস করেন, মানুষের প্রতিটি ধারনা বা চিন্তা উত্থিত হয় ঈশ্বরের ভিত্তিমূল থেকেই। এটিই কাব্বালাহ চর্চার কেন্দ্রীয় বিশ্বাস।

কাব্বালাহয় ঈশ্বরকে বলা হয়েছে সকল ভিত্তির ভিত্তি- সমস্ত প্রজ্ঞার স্তম্ভ। একমাত্র ঈশ্বরের জন্যই সমূদয় অস্তিত্ব সম্ভব হয়েছে। ‘ঈশ্বরের অস্তিত্বের সত্য’ থেকে স্বর্গ ও মত্যের জীবন ও প্রাণিকূল সম্ভব হয়েছে। (‘ঈশ্বরের অস্তিত্বের সত্য’ -এই বাক্যটি বিশেষ ভাবে লক্ষ করুন) ... তবে কথা আছে। কাব্বালাহর বিরুদ্ধে দ্বৈতবাদের অভিযোগ আছে।

কাব্বালাহয় ঈশ্বরের এক সুপারনেচারাল কাউন্টার পার্টের কথা বলা হয়েছে-যা স্পষ্টতই একেশ্বরবাদ বিরোধী। সেই চিরকালীন শুভ আর অশুভ শক্তি আর কী! ইহুদিরা এককালে পারস্যে ছিল। পারস্যের প্রধান ধর্র্ম ছিল জরথুশত্রবাদ । ইহুদি মরমীবাদের ওপর নিশ্চয়ই জরথুশত্র ধর্মের প্রভাব পড়ে থাকবে। কাব্বালাহ সাধকগন বিশ্বাস করেন, মানুষের আত্মা তিনটি ভিন্নধর্মী উপাদানে গঠিত।

নেফেস রুআক, এবং নেশামাহ সব মানুষের ভিতরেই নেফেসটা বিল্ট-ইন থাকে। জন্মমুহূর্তেই দেহে প্রবেশ করে নেফেস । তারপর নেফেস হয়ে ওঠে মানুষের শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্যের উৎস। রুআক আর নেশামাহ শরীরে থাকে না। এ দুটো উপাদান অর্জন করতে হয়।

সেই অর্জন নির্ভর করে মানুষের বিশ্বাস ও কার্যাবলীর ওপর। যারা আধ্যাত্মিকভাবে সচেতন কেবলই তারাই রুআক আর নেশামাহ হাসিল করতে পারে। কাজেই - নেফেস হল (নিচু স্তরের পাশবিক সত্তা) রুআক হল (মধ্যবর্তী স্পিরিট। নৈতিকত। ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতা) নেশামাহ হল (উচ্চতর আত্মা।

এটিই মানুষকে অন্যান্য জীবনরুপ থেকে পৃথক করে দেয়। এটি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে জড়িত। বুদ্ধিমত্তা সৎকাজ করে পরলোকের লাভালাভ অর্জন করে। আত্মার এই উপাদানটি জন্ম লগ্নেও থাকে। নইলে- কাব্বালাহ সাধকগনের মতে ঈশ্বরের নৈকট্য অনুভব সম্ভব না।

) ২ কাব্বালাহ সাধকগন বিশ্বাস করেন, কাব্বালাহর উদ্ভব অনেক পুরনো- সেই আদম থেকে। ইহুদি মরমীবাদীদের পক্ষে এরকম চিন্তা স্বাভাবিক। তবে বিশ্বাস বাদেও ইতিহাস বলে একটা কথা আছে। আমরা এখন কাব্বালাহর উদ্ভবের ইতিহাসটি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব। তোরাহর ব্যাখ্যা-বয়ানের ওপরই কাব্বালাহ গড়ে উঠলেও আরেকটি গ্রন্থকে বা গ্রন্থাবলীকে কাব্বালাহর উৎস বলে মনে করা হয়।

গ্রন্থটির নাম: ‘ জোহার। ’ এখানে বলে রাখি-জোহার একটি গ্রন্থ নয়, বরং অনেকগুলি বইয়ের সমষ্টি। জোহার শব্দটি হিব্রু-এর অর্থ, জ্যোতি। জোহার এর ইতিহাসও বিস্ময়কর। খুলেই বলি।

খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দী। ইজরেলে তখন রোমান শাসন। সেই সময়টায় ইজরেলের লোকে কথা বলত হিব্রু ভাষায় নয়- ইজরেলের লোকে কথা বলত আরামিক ভাষায়। স্বয়ং যিশুখ্রিস্টের মাতৃভাষা ছিল আরামিক । জোহার লিখিত হয়েছিল ঐ আরামিক ভাষাতেই।

সেটা খ্রিষ্টিয় ২য় শতকের ঘটনা। ইজরেলজুড়ে ইহুদিদের ওপর চলছিল ভয়ঙ্কর রোমান নির্যাতন; রোমান শাসনের বিরুদ্ধেও ইহুদিদের বিদ্রোহসংগ্রাম চলছিল। সে সময় শিমোন বার য়োচাই নামে একজন রাব্বি (ইহুদি মৌলানা) রোমান নির্যাচন এড়াতে গুহায় লুকিয়ে থাকবেন ঠিক করলেন। সঙ্গে ছেলে। সে ছেলের নাম এলাজার।

ছেলের সঙ্গে শিমোন বার য়োচাই প্রত্যহ তোরাহ পাঠ করতেন। সেই সঙ্গে তোরাহর মরমী তফসির বা টীকা। যার বিষয় ছিল-ঈশ্বরের প্রকৃতি, মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও কাঠামো, আত্মা, পাপ, মোক্ষ, শুভ-অশুভ, মানুষ ও ঈশ্বরের সম্পর্ক -ইত্যাদি । এভাবে ১৩ বছর কাটল গুহায় । সে সময়ই নাকি একদিন প্রোফেট এলিজাহ গুহায় এসে শিমোন বার য়োচাই কে তোরাহর নতুন একটি টীকাভাষ্য লিখতে অনুপ্রাণিত করেন।

অনুপ্রাণিত শিমোন বার য়োচাই তখন ঐ আরামিক ভাষাতেই তোরাহর নতুন একটি টীকাভাষ্য রচনা করেন। রচনা শেষ করে রচনার নাম দেন, ‘জোহার। ’ আমি আগেই বলে ছিলাম জোহার মানে- ‘জ্যোতি’ এবং এটি একটি গ্রন্থ নয়। রোমান সাম্রাজ্য। দক্ষিণ-পুবে ইয়েররুষহালাইম বা জেরুজালেম।

এরপর বহুকাল কেটে গেছে। রোমান সম্রাট কর্তৃক প্রাচীন ইজরেল থেকে বহিস্কৃত হয়ে ইহুদিদের ওপর অনেক বিপদ-আপদ গেছে। যাই হোক। এবার আমাদের চোখ ফেরাতে হবে তেরো শতকের স্পেনে। ওখানকার এক ইহুদি পন্ডিত-নাম- মেজেস দি লেওন: তিনিই শিমোন বার য়োচাই রচিত ‘জোহার’ সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন।

তারপর থেকেই জোহার-এর ওপরই কাব্বালাহর ধ্যানধারনা গড়ে উঠতে থাকে। জোহার ছাড়াও অবশ্য কাব্বালাহর অন্যান্য আকরগ্রন্থ রয়েছে। সেগুলো হল: সেফের যেটযিরাহ, বাহির, সেফের রাজিয়েল হামাললাখ। এখানে বলে রাখি। কাব্বালাহর চর্চায় মুসলিমদের প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ অবদান আছে! ১৩ শতকের পূর্বে স্পেনেই ইহুদিরার ব্যাপক সংখ্যায় বাস করত।

স্পেনের খ্রিস্টান রাজা ইহুদিদের বহিস্কার করলে ইহুদিরা সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় উদার ভাবাপন্ন তুর্কি সুলতান বহিস্কৃত ইহুদিরে আশ্রয় দেন। কাজেই, কাব্বালাহ চর্চা অব্যাহত রইল। তুর্কি সুলতান নাকি সে সময় স্পেনের খ্রিস্টান রাজাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন-‘আজ আমি ধনী হলাম; আর আপনি ভিখেরি হলেন!’ এজন্যই বলছিলাম-কাব্বালাহর চর্চায় মুসলিমদের প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ অবদান আছে! কাব্বালাহর বিকাশে যেমন তেরো শতকের মেজেস দি লেওন এবং খ্রিষ্টিয় ২য় শতকের রাব্বি শিমোন বার য়োচাই-এর অবদান ছিল-তেমনি আব্রাহাম বেন সামুয়েল আবুলাফিয়া (১২৪০-১২৯৫) এর অবদান অপরিসীম । আব্রাহাম বেন সামুয়েল আবুলাফিয়া ছিলেন স্পেনের বিশিষ্ট ইহুদি পন্ডিত।

যিনি বিশ্বাস করতেন -ঈশ্বরকে বর্ননা করা সম্ভবপর নয় এবং নিত্যদিনের ব্যবহার্য প্রতীক দিয়েও ঈশ্বরকে কনসেপচুয়ালাইজ করাও সম্ভবপর নয়। আব্রাহাম বেন সামুয়েল আবুলাফিয় আব্রাহাম আবুলাফিয় আরও বিশ্বাস করতেন হিব্রু বর্ণমালার রয়েছে স্বর্গীয় বৈশিষ্ট্য। এই বর্ণমালার করে ধ্যানের গভীরতা বাড়ানো যায় ও দীর্ঘক্ষণ তুরীয় আচ্ছনতায় অবস্থান করা সম্ভব। হিব্রু বর্ণমালার বিমূর্ত অক্ষরের পারমুটেশন- কম্বিনেশনই হল মানবচৈতন্যের রুপান্তরিত পর্যায়ের পৌঁছবার চাবিকাঠি। (যারা গঞ্জিকা সেবন করেন তারা এই কথার মানে ভালো বুঝবেন! ) কাব্বালাহ সাধকদের কাছে মরমে পৌঁছবার এটি একটি মরমিয়া পন্থা ।

আব্রাহাম আবুলাফিয়া ধ্যানের বিভিন্ন পর্যায় সম্বন্ধে বিস্তারিত লিখে গেছেন। রহস্যময় (!) হিব্রু বর্ণমালা ... কাব্বালাহপন্থিরা বিশ্বাস করেন- কোনওভাবেই চল্লিশ বছরের নীচে কাব্বালাহচর্চা সঙ্গত নয়। নারীরা কাব্বালাহ চর্চা করতে পারবে না। এখন অবশ্য অবস্থা অনেকখানি বদলে গেছে। কাব্বালাহর আকর্ষন এতই যে, অ-ইহুদিরাও কাব্বালাহ চর্চা করছে।

গত ৫০০ বছর ধরে এটি ঘটছে। অ-ইহুদি নারীরা আজ কাব্বালাহ চর্চা করছে। অবশ্য ইহুদি নারীরা আজও কাব্বালাহ চর্চার অধিকার পায়নি। (বিপ্লব আসন্ন?) আরেকটা কথা। কাব্বালাহচর্চা করতে হলে হিব্রু ভাষাটি জানতেই হবে-নইলে এর মূল প্রদেশে ঢোকা যাবে না।

যদিও কাব্বালাহর ওপর ইংরেজিতে প্রচুর বই আছে। আছে ঠিকই। তবে সে বই পড়ে কাব্বালাহ সম্বন্ধে জ্ঞান হবে ভাসা ভাসা। কেননা, কাব্বালাহ এখনও গুপ্ত, গূহ্য ও গোষ্ঠীগত একটি মরমীবিদ্যা। কাবালা সেন্টার বর্তমানে কাব্বালাহ চর্চাকে বিশ্বময় প্রচার করে যাচ্ছে।

। ১৯৬৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রটি স্থাপিত হয়। তরুণ-তরুণীরা ওদের মতো করে কাব্বালাহ কে গ্রহন করেছে। মনে থাকার কথা, কাব্বালাহ শব্দটির মানে, ‘গ্রহন করা’ বা ‘মেনে নেওয়া’। উৎসর্গ: আকাশ অম্বর ও শয়তান।


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.