অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা
বাংলাদেশ সরকার অবশেষে সমূদ্র উপকূলবর্তী এলাকার তিনটি ব্লকে তেল গ্যাস অনুসন্ধান এবং উত্তোলনের অধিকার দিয়ে টেন্ডার পাশ করেছে। এবং সেই টেন্ডারে অংশগ্রহনকারী ৩ বিদেশী সংস্থাকে এই কাজ করবার অনুমতি দিয়েছে।
সেখানের প্রাথমিক টেন্ডারের শর্ত ছিলো, কোম্পানী লাভের ন্যুনতম ৫৫ শতাংশ পেট্রোবাংলাকে প্রদান করতে বাধ্য থাকিবে। উত্তোলন ব্যয় এবং আনুসাঙ্গিক খরচ কোম্পানীর নিজস্ব, যদি কোম্পানী নির্দিষ্ট ব্লকে গ্যাস খুঁজে পায় তবে তার এইসব খরচ তারা উত্তোলিত গ্যাস থেকে কেটে নিতে পারবে।
এবং এরজন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আমদানী করতে তাদের কোনো শুল্ক দিতে হবে না।
এমন বিভিন্ন বিধি রয়েছে সেখানে।
সেখানে অন্য একটা বিধি আছে, উত্তোলনযোগ্য গ্যাস পেট্রোবাংলার অনুমোদন সাপেক্ষে উত্তোলনকারী সংস্থা রপ্তানী করতে পারবে, এবং পেট্রোবাংলা যদি চায় তার লভ্যাংশ বাবদ প্রাপ্ত অর্থ এই রপ্তানিযোগ্য গ্যাস থেকে কেটে নিতে পারবে তবে সেটা মোট রপ্তানীযোগ্য গ্যাসের ২০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশের বেশী হবে না।
সুতরাং মায়াকান্না শুরু হয়েছে , দেশ ও এর খনিজ সম্পদ বিদেশীদের হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্ত করছে ক্ষমতাসীন সরকার, এদের প্রতিহত করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ পাবে মাত্র ২০ শতাংশ, এ চুক্তি অবশ্যই দেশ বিরোধী- এমন প্রচারণায় মানুষের স্থিমিত দেশপ্রেম পুনরায় সবল হয়েছে, জেগে উঠেছে প্রচন্ড ভাবে।
অন্তর্জালে কথার ফোয়ারা ছড়ানো সহজ সুতরাং সহজেই অনেকে সহিংস হয়ে উঠেছে কিবোর্ড আর মনিটরে থুতু ছেটানোর মতো বালখিল্যতাও ঘটছে।
সমস্যার শুরু কোথায়?
বাপেক্সের পূঁজি নেই, বাপেক্সকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন, তাকে উত্তোলনের ক্ষমতা দেওয়া প্রয়োজন, সেটাও অনেক দক্ষ একটা প্রতিষ্ঠান- সেই দক্ষ প্রতিষ্ঠানকে সবল করবার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না, হয় নি গত ৮ বছরে। সরকারী প্রতিষ্ঠান বলেই এটা অদক্ষ এবং জনগণের আস্থা নেই এই প্রতিষ্ঠানের কতৃপক্ষ এবং কর্মকর্তাদের উপরে, এটা একটা বাস্তব সত্য-
এই আস্থাহীনতার জায়গাটা রাতারাতি কেটে যাবে না। বাপেক্স নিজেও যদি এটা উত্তোলন করতে শুরু করে তখনও একটা আন্দোলন শুরু হবে, বাপেক্স যেহেতু নিজের কারিগরী দক্ষতায় এটা এখনও করতে পারবে না, সুতরাং তাদের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের সাথে সহযোগী হিসেবে এটা করতে হবে এবং সেখানেও পেট্রোবাংলার বিডিংএর ধারাটা বলবত থাকবে- এটা সকল অংশগ্রহনকারীর জন্য সত্য একটি বক্তব্য-
তখনও আন্দোলনটা শুরু হবে, দেশের গ্যাস রপ্তানী করবার চক্রান্ত শুরু হয়েছে, সেটা কারা করবে এবং কিভাবে করবে এটা এত দিনে পরিস্কার হয়ে যাওয়ার কথা।
প্রতিটা তেল কোম্পানীকে প্রতিদিনের আয় ব্যায়ের হিসাব পেট্রোবাংলাকে দিতে হয়, তাদের কোনো বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করার কথাও পেট্রোবাংলাকে জানাতে হয়, সুতরাং একটা উত্তোলন এবং অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান কখন কোন খাতে কত অর্থ বরাদ্দ রেখেছে এবং কিভাবে খরচটা হচ্ছে সেটার একটা ধারণা পেট্রোবাংলার আছে- এবং পেট্রোবাংলার যেকোনো মুহূর্তে কোনো কারণ দর্শানো ব্যতিতই যেকোনো চুক্তিকে অসম্মান করে স্থগিত করবার ক্ষমতাও আছে। এ জন্য তাদের কোনো ক্ষতিপুরণও দিতে হবে না।
বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন রকম অঙ্ক কষে যা দেখিয়েছে তা হলো বাংলাদেশ মোট উত্তোলিত গ্যাসের ২০ শতাংশ মুফতে পাবে, বাকি ৮০ শতাংশ তাদের আন্তর্জাতিক দামে কিনতে হবে- এবং এখানেও একটা শর্ত আছে- যদি কোনো কারণে গ্যাসের আন্তর্জাতিক বাজার দর কমতে থাকে তবে একটা নিম্নসীমা নির্ধারণ করা আছে, যার নীচে বাংলাদেশ সরকার কিনতে পারবে না গ্যাস, এবং এই নির্ধারিত মূল্য হচ্ছে ৭০ ডলার, সুতরাং আন্তর্জাতিক বাজারে যদি গ্যাসের ক্রয়মূল্য ৭০ ডলার থেকে নীচে চলে যায় তাহলেও বাংলাদেশকে ৭০ ডলারে গ্যাস কিনতে হবে-
এবং অন্য অংশ হলো, যদি গ্যাসের মূল্য অতিরিক্ত চাহিদার জন্য কখনও ১৮০ ডলারের বেশী হয়ে যায় তাহলেও উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সরকারের সাথে চুক্তিবদ্ধ তারা যতই দাম হোক না কেনো ১৮০ ডলারেই এটা বিক্রয় করবে।
এক হবু বিশেষজ্ঞ ও কর্মী দাবি করছে এটাই নির্ধারিত মূল্য, এই ইন্টেলেকচ্যুয়াল মাস্টারবেশনের কোনো অর্থ নেই। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের বিক্রয় মূল্য ১৪০ কিংবা ১৬০ ডলার যাই হোক না কেনো, বাংলাদেশ সরকার সেই নির্ধারিত মূল্যেই কিনবে, কিন্তু যখন সেটা ২০০ ডলার হয়ে যাবে তখন বাংলাদেশ সরকার চুক্তির শর্ত অনুসারে কিনবে ১৮০ ডলারে- সেই উল্লেখিত ধারার মর্তবা এই, সেটা মূল্যের একটা উর্ধসীমা ধার্য করে দেওয়া।
তেমন ভাবেই যদি গ্যাসের আন্তর্জাতিক বাজার দর কমে ৫০ ডলার হয়ে যায় তাহলে বাংলাদেশ সরকারকে ৭০ ডলার দিতে হবে কোম্পানীকে। এটা ঝুঁকি শেয়ার করা, ভবিষ্যতে কি হবে সেটা না জেনে একটা নির্ধারিত সীমানা বেধে দেওয়া।
বলিভিয়ার গ্যাস ব্যবহারের ৯৫ শতাংশই বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং কল কারখানায় ব্যবহৃত হয়, বাংলাদেশেও অনুপাতটা এমনই ৭৫ শতাংশ গ্যাস ব্যবহৃত হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে, গেরোস্থালী বাজে ব্যবহৃত হয় ৫ শতাংশের কম গ্যাস-
সুতরাং গ্যাসের অপ্রতুলতার মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিল্পায়ন এবং শিল্পায়ন ক্ষতিগ্রস্ত হবে দু ভাবে, পর্যাপ্ত বিদ্যুতের অভাবে এবং পর্যাপ্ত গ্যাসের অভাবে- বিদ্যুৎ সংকট বিষয়ে তেমন বলা লাগবে না, বাংলাদেশের যে মজুত তাতে ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের ভেতরে সকল সিএনজি চালিত যানবাহন রাস্তায় অচল হয়ে থাকবে, সেটা একটা বাস্তব সত্য- আমাদের মজুত গ্যাসের পরিমাণ নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে, বিকল্প শক্তির সন্ধান করতে হবে, বিদ্যুতের যোগান দিতে হবে, এবং সেটার চাহিদা ২০১৯ সাল নাগাদ হবে ১৯ হাজার মেগাওয়াট, বর্তমানের চাহিদা এবং উৎপাদনের ৫ থেকে ৬ গুণ। এই বাড়তি বিদ্যুৎ বিতর্ক করে উৎপাদন করা সম্ভব নয়, গ্যাস কিংবা কয়লা কিংবা তেল কিংবা পানি কিংবা বায়ু কিংবা সৌর শক্তিকে ব্যবহার করে এটা উৎপাদন করতে হবে।
যদি গ্যাসভিত্তিক হয়- তবে বাংলাদেশের গ্যাসের চাহিদা ক্রমশ বাড়বে, এবং গভীর সমুদ্র থেকে পাইপ দিয়ে গ্যাস বাংলাদেশে নিয়ে আসবার জন্য পেট্রোবাংলা নিজেই মরিয়া হয়ে থাকবে। সুতরাং গ্যাস রপ্তানী হবে এমন কোনো সম্ভাবনা নেই। এবং সেই সাথে চুক্তির বাধা আছেই- পেট্রোবাংলা সম্মতি না দিলে কোনো কোম্পানীই এই গ্যাস রপ্তানীর অনুমতি পাবে না।
এবং একই সাথে যখন গ্যাস উত্তোলিত হবে তখন কোম্পানিগুলো বেলুনে গ্যাস ভরে সেগুলো বাতাসে উড়াবে না, তাদেরও ব্যবসা করতে হবে। কোনো না কোনো একটা মধ্যবর্তী ব্যবস্থা আমাদের খুঁজে নিতে হবে।
কোনো রকম অগ্রিম ঘোষণা ব্যতিত একটা হিসাব শুনলাম উত্তোলন ব্যয় এবং অবকাঠামো জনিত ব্যয় হবে উত্তোলিত গ্যাসের ৫৫ শতাংশ- এটা ঠিক এই অনুপাতে হতে হবে কারণ যারা বিজ্ঞ মতামত দিচ্ছে এবং মিছিল মিটিং রাজনীতি করছে বিদ্যমান ন্যুনতম ৫৫ শতাংশ লভ্যাংশের হিসাব থাকলেও সেটাকে ২০ শতাংশ ৮০ শতাংশ অনুপাত করতে এই ম্যাজিক নাম্বারের প্রয়োজন আছে।
চুক্তির ধারাগুলো না পড়ে ইন্টেলেকচ্যুয়াল মাস্টারবেশন চলছে, স্টিকি পোস্টে বিপ্লব হচ্ছে- পেট্রোবাংলার উপরে আমাদের আস্থা নেই, তাদের প্রশাসনিক কর্মকান্ডের উপরে আমাদের আস্থা নেই, আস্থা নেই বিদ্যমান রাজনীতি এবং সরকারের উপরে, সুতরাং তারা যে সিদ্ধান্তই গ্রহন করে সেটাকেই আমাদের দেশ বিরোধী গণবিরোধী মনে হয়। এবং মুলত অনাস্থাটা যারা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করে এবং এর নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো গ্রহন করে তাদের উপরে, এইসব প্রতিষ্ঠিত, শিক্ষিত এবং দক্ষ মানুষের উপরে আমাদের ভরসা নেই, আমরা নতুন মানুষ পাবো কোথায়? জান্নাতুল ফেরদৌস থেকে ফেরেশতা ভাড়া করে আনবো? তারা নিজেদের নূরের শরীর এবং বিচক্ষনতা এবং আনুগত্য দিয়ে সরকারী প্রতিষ্ঠানের উপরে বিদ্যমান অনাস্থা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করবে?
পেট্রোবাংলাকে কিভাবে আরও জনকল্যানমুখী করা যায় সেটা নিয়ে প্রস্তাবনা আসুক, সরকারের নীতিনির্ধারনী মহলে এটা উপস্থাপনের পরিবেশ তৈরি হয়ে যাবে, আগে এমন কোনো ফিজিবল প্রস্তাবনা আসুক।
বাংলাদেশের বিভিন্ন কল-কারখানার উৎপাদন ক্ষমতা কমেছে অদক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং ম্যানেজমেন্ট ও ম্যানেজারিয়াল সংকটে, এর বিকল্প হিসেবে এসেছে প্রাইভেটাইজেশনের আইডিয়া, সেটা খুব বেশী ফলপ্রসু হয় নি, বরং সরকারী প্রতিষ্ঠান এবং কলকারখানাকে দক্ষ এবং উৎপাদনশীল করে তুলবার এই উদ্যোগ ব্যকফায়ার করেছে। উৎপাদন সংকট কমে নি, বরং বেড়েছে বহুগুণ।
সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ, যেখানে সরকারের হাতে ৫১ শতাংশ শেয়ার থাকবে এমন প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের কথাও নীতিনির্ধারণী মহলে চলছে- সেটাও যে খুব বেশী ভালো ফলাফল বয়ে আনবে এমন মনে হয় না আমার।
সমস্যাটা শিক্ষিত এবং নীতিনির্ধারক মহলের সমস্যা সম্ভবত, সেটাকে আরও বেশী জনকল্যানমুখী করে তুলতে পারলে তারা প্রতিটা চুক্তি থেকেই আরও বেশী ভালো ফলাফল বয়ে আনতে পারতো।
এখন পেট্রোবাংলার নির্ধারিত ক্ষমতা অক্ষুন্ন রেখে এটাকে প্রাইভেট কোম্পানি করে আনু মুহাম্মদের তত্ত্বাবধানে ছেড়ে দিলে কি মনে হয় আনু মুহাম্মদ এর চেয়ে ভালো কোনো ফলাফল বয়ে নিয়ে আসতে পারবে?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।