আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

২য় কিস্তি: মেরিল-প্রথম আলো চলচ্চিত্র ‘সমালোচক পুরস্কারের’ রাজনৈতিক অর্থনীতি



রাতের ট্রেনে সোহেল ও তার মা শিরিন ঢাকায় ফেরে। পথে শিরিন ছেলেকে ডেকে কাছে বসায়। রফিক প্রসঙ্গে দীর্ঘ নীরবতার অবসান ঘটে। মা ছেলেকে বলে কেন সে এতোকাল সোহেলকে বাবার সংস্পর্শ থেকে দূরে রেখেছে। সোহেলকে হারানোর ভয় পেয়েছে।

সেকারণে নিজে বিয়ে করেনি। সোহেলকেও তার বাবার কাছে আসতে দেয়নি। বলে এই স্বার্থপর ভালোবাসা তাকে সারাজীবন তারা করেছে। আর তার এখন মনে হয়, সে আবার বিয়ে করলেই ভালো করতো, হয়তো সে-ঘর সুখের হতো না। কিন্তু সোহেল তার স্বার্থপর ভালোবাসার শেকল থেকে মুক্ত হতে পারতো।

এসব কথাবার্তার মধ দিয়ে মা-ছেলের ভিতরের দূরত্ব ঘোঁচে। মা ঘুমিয়ে পড়েন। সোহেল জানালা খুলে ভোরের প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার ভাবনা প্রসারিত হয়, ‘বাবার মৃত্যু হয়তো আমাকে নয় মাকেও তার কাছে নিয়ে এসেছে...স্মৃতি ছাড়া কি মানুষ হয়...আমাকে এখানে ফিরে আসতে হবে বার বার...’। ট্রেন চলতে থাকে, ভোরের কুয়াশা ল্যাম্পপোস্টের আলো ঘিরে রাখে...।

সে গাড়ির জানালায় মুখ রেখে বসে থাকে...ভোরের সূর্য তাকে স্পর্শ করে। এককথায় বলা যায়, সিনেমাটির টার্গেট অডিয়েন্স বাংলাদেশের গণমানুষ নয়- বাংলাদেশের অভিজাত শ্রেণী এবং পশ্চিমা ‘মানবতাবাদী’ দর্শকদের জন্যই এই কাহিনী। যাদের সহায়তায় ফিল্মটি নির্মিত হয়েছে সেই নাম থেকেই কিছুটা আন্দাজ করা যায়। এ-আন্দাজ পোক্ত হবে যখন জানবেন যে প্রাযুক্তিক উৎকর্ষতার কারণে (ডলবি ডিজিটাল সাউন্ড সিস্টেম) প্রথম সপ্তাহে অন্তর্যাত্রা কেবল স্টার সিনেপ্লেক্স-এ মুক্তি দেওয়া সম্ভব হয়, এবং পরে চাইলে ঢাকার বলাকা ও মধুমিতা হলেই কেবল মুক্তি দেয়া সম্ভব। বাংলাদেশের আর কোথাও প্রেক্ষাগৃহে এটি চালানো সম্ভব নয়।

শুধু এই নয়, সিনেমার ন্যারেটিভ থেকেও বোঝা সম্ভব এর টার্গট অডিয়েন্স কারা হতে পারেন। ‘আদিগন্ত প্রসারিত সবুজ’ উন্মোচিত হতে থাকা, দাদার বৃটিশপ্রীতি, কিংবা ‘ফিউশন মিউজক ব্যান্ড’ বাংলার আনুশেহ ও বুনোর খাপছাড়া উপস্থিতি খটকা তৈরি করে। তবু, নিটোল কাহিনী, দৃশ্যায়নের উৎকর্ষতা, মিউজিকের ব্যবহার, সম্পাদনা এবং সর্বোপরি বিকাশমান মাল্টিকালচারাল পরিবেশে বেড়ে ওঠা উন্মুল মানুষের মূলে ফেরার তাগাদা, তা সে কাল্পনিক হলেও, অন্তর্যাত্রাকে একটি তাৎপর্যময় চলচ্চিত্র করে তোলে। সিনেমার নাম আয়না আয়না ছবিটি বাংলালিংক নিবেদিত ও ইমপ্রেস টেলিফিল্ম প্রযোজিত। কাহিনী, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা এককালের জনপ্রিয় নায়িকা কবরী সরোয়ারের।

ছবিতে কবরী একটা কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়ও করেছেন - উন্নয়ন ডিসকোর্সে ‘চেঞ্জ এজেন্ট’-এর যে ভূমিকা থাকে এই চলচ্চিত্রে কবরীর ভূমিকাও তদ্রুপ - তার মাধ্যমেই কাহিনীর সূত্রপাত ঘটে, তিনিই কাহিনীর সমাপ্তি টানেন। এককথায় এই চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু নারী নির্যাতন, যেখানে একটা কেন্দ্রীয় অনুসঙ্গ হিসেবে নারীদের মুখে এসিড নিক্ষেপ, তার চিকিৎসা ও বিচার-প্রক্রিয়া উপস্থিত। নির্যাতনের ইস্যুগুলো একে একে প্রস্ফুটিত হয়েছে কাহিনী ধরে। আমি উল্টোদিক থেকে, ইস্যুগুলোকে নির্দেশক ধরে কাহিনীর গড়ে-ওঠা ও চরিত্র নির্মাণ দেখবো। ইস্যু ১: নারী-নির্যাতন প্রতিরোধকারী এনজিও-কর্মী ও দোররা আয়নার প্রথম দৃশ্যেই আমরা দেখি এক যুবক নৌকায় আসছে, ট্রেন ধরে শহরে ফিরবেন- এটাকে নদী বলা যাবে কিনা সে-সন্দেহ জাগা খুবই স্বাভাবিক, কোনো স্রোত নাই, শ্যাওলা ও পদ্মফুলে ঠাসা।

তার নাম শুভ্র, গ্রামবাংলার ওপর এগজিবিশন করবে, তাই গ্রামে গ্রামে ঘুরছে। আঁকিয়ে। আর দুঃস্থ মহিলাদের জন্য সেবামূলক সংগঠন অঙ্গনা-পরিচালক আফরোজা একজন মহিলা-কর্মী নিয়ে চলেছেন বৌডুবি গ্রামের উদ্দেশ্যে, কারণ ‘কিছু ফতোয়াবাজ এক মহিলাকে দোররা মেরেছে’। তিনি ওই ‘ইনসিডেন্ট’-এর ব্যাপারে খোঁজ নিতে চলেছেন। নদীর ঘাটে তাদের দেখা, তারা পূর্বপরিচিত।

আলাপচারিতা থেকেই তাদের পরিচয় ও কর্মক্ষেত্রের এই আন্দাজ পাওয়া যায়। আলাপ শেষে আফরোজারা নৌকায় ওঠে। দৃশ্যান্তর ঘটে, দেখা যায়, সুপ্রচুর তালগাছ-ঘেরা গ্রামের পথ দিয়ে শুভ্র হেঁটে চলেছেন। সূর্য অস্তাচলে। এসময় এ-ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র কুসুমের দেখা মেলে তালগাছের মাঝে, সেও সূর্যাস্ত দেখছে।

কুসুমকে দেখে শুভ্র মুগ্ধ হয়, কুসুমও। কিন্তু তাদের কথা হয় না, কুসুম নৃত্যের ভঙ্গিতে হেঁটে-দৌড়ে ফিরে যেতে থাকে গ্রামের দিকে, শুভ্র মুগ্ধ-দৃষ্টিতে চলে যাওয়া দেখে। কুসুমকে ঘিরেই আয়না ছবির এগিয়ে চলা। ছবিতে কুসুম নির্যাতিত নারীর প্রতিনিধিত্ব করে। তার বাবা গায়েন।

বাবা-মেয়ে মিলে দুজনের সংসার- হতদরিদ্র। পরের দৃশ্যটিতেই, সে গ্রামের অন্য বাড়িতে ফুটফরমাশ খেটে চাউল নিয়ে বাড়িতে ফিরে দেখে তার বাবা হাটে চলেছেন কাঁঠাল বেচতে, কারণ ঘরে কিছুই নাই। তার কাঁধে দোতারা ঝুলানো। মেয়ে বলে, ‘তোমার তো খাওয়া হয় নাই। চারটা ভাত ফুটাইয়া দিই’।

বাবা বলেন, ‘আমি খাইছিরে মা, তুই যে পান্তাভাত আর সুটকি রাইখ্যা গিছিলি ওইটা খাইছি। ’ এই বলে সে ঢেকুর তোলে খাওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করতে এবং অস্বাভাবিক নাটকীয় মূদ্রায় হাতের তালুতে কাঁঠালের ঝুড়ি নিয়ে হাঁটা দেয়, হাঁটা না-বলে বরং বলা যায়, দৌড়-হাঁটার মাঝামাঝি একটা ছন্দোময় গতিতে সে রওয়ানা দেয়। এরকম নাটকীয়তা আমরা পুরো সিনেমাতেই দেখতে পাবো, দৃশ্যায়ন ও কাহিনী বর্ণন উভয় বিচারেই। ইস্যু ২: কালো মাইয়া কেউ নিতে চায়না, অনেক টাকা চায়... এ-গ্রামের মেয়ে তুলির বিয়ে, কালো বলে বেশ কয়েকবার তার বিয়ে ভেঙ্গে গেছে। এবার বরপক্ষ রাজি হয়েছে, তবে টেলিভিশনসহ অনেককিছু দাবি মেটাতে হবে কনে পক্ষকে।

চার সখিসহ কুসুম তুলিদের বাড়িতে হাজির হয় পরিস্থিতি জানতে। সবার কোমরে শাড়ি পেঁচিয়ে বাঁধা, হাতায় কুঁচি দেওয়া ব্লাউজ পড়া, আর নাকে নাকফুল। গ্রামীণ নারীর এ এক ইস্টিরিওটাইপ ইমেজ। আজকাল গ্রামের অল্পবয়স্ক মেয়েরা কী পোশাক পরে, আর গ্রামের মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে সেদিকে পরিচালক যথাযথভাবে নজর দেননি। নাটক, গল্প এবং বিশেষত ঢাকাই সিনেমা গত কয়েক দশক এই ইমেজই পুনরুৎপাদন করে চলেছে।

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা চলছে, কুসুমরা নাচছে, তার বাবা গান গাইছে, এসময় বরের বাবা চিৎকার করে গান থামাতে বলেন। ছেলেকে সে উঠে আসতে নির্দেশ দেন, কারণ মেয়ের বাবা টেলিভিশন দেবে বলে কথা দিয়েছিল। মেয়ের বাবা কয়েকদিন সময় চায়। ছেলের বাবা রাজী নয়, তিনি বলেন, মহল্লার মানুষকে বলে এসছেন টিভি নিয়ে যাবেন, এখন টিভি না-পেলে মুখ দেখাবেন কী করে ... টিভি পাওয়ার জন্যই তো কালো মেয়ের সাথে ছেলেকে বিয়ে দিতে রাজী হয়েছেন। কুসুম প্রতিবাদ করে, ‘ইহ্! বিয়া যেন কুরবানীর গরুর হাট, পোলারে বিয়ার বাজারে বেচতে আসছে’।

ছেলের বাবা আরও চেতে ওঠে, ‘ওই মাইয়্যা তুমি কেডা? বড় মাইনষের কথার মধ্যে বাম হাত ঢুকাইতে আহো, বিয়াদ্দপ কোথাকার, লাজশরম কি ধুইয়া খাইছ!’ এ-পরিপ্রেক্ষিতে কুসুম মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, ‘তালুই সাব, লাজশরম ধুইয়া খাইছেন আপনে ... আমাগো গেরামের মাইয়ারে কালো বইলা গালাগালি করতেছেন, তারে কালো বানাইছে কেডা? তার বাপ-মায় নাকি আল্লায়? নিজের পোলার দিকে চাইয়া দ্যাহেন...কোন সাবান মাখাইয়া তারে ধলা বানাইবেন?’ এসময় গ্রাম্য মাস্তান ড্রাগ-ব্যবসায়ী রমিজ উপস্থিত হয়। তার হস্তক্ষেপে বিয়েটা সুসম্পন্ন হয়। এ-দৃশ্যে ছেলের বাবা চরিত্রের অভিনয় ভীষণভাবে দুর্বল; তার অঙ্গসঞ্চালন ও বচন দুটোই অসঙ্গত ঠেকে, ক্লিশে লাগে। একইভাবে, কুসুমের বাবা চরিত্রে অভিনয়কারীর অতিনাটকীয়তা, মুখের অভিব্যাক্তিতে বারবার শহুরে অভিজাতপনা প্রকটিত হয়ে ওঠে। এখানে কুসুমের একটা দৃঢ় ইমেজ আমরা পাই।

কিন্তু এই বলিষ্ঠতা সিনেমাজুড়ে অটুট থাকে না। বরং ‘মেয়েলিপনা’র যে ইস্টিরিওটাইপ ইমেজ দেখে দর্শক অভ্যস্ত এবং দেখতে চায় বারবার, কুসুম চরিত্র সেইসব চাহিদা পূরণ করে। ইস্যু ৩: চাঁদাবাজি চলছেই, যারা আবার নারী নির্যাতক, দালাল, ড্রাগ আশক্ত ও ড্রাগ ব্যবসায়ী গঞ্জের হাটে একদল যুবক চাঁদাবাজি করছে, নেতৃত্ব দেয় রমিজ। একজন বিক্রেতা বলেন, ‘এই হাটেও আর আইতাম না, রক্ত পানি কইরা দুইটা পয়সা কামাই করি, সেইহানেও থাবা মারে। ’ পাশের জন বলেন, ‘না আইস্যা যাইবা কই? এসব উৎপাত অহন সবখানেই আছে।

’ একারণেই ‘সামাজিক অবক্ষয়’ রোধকল্পে আমাদের কিছু মিডিয়া ও ‘সুশীল সমাজ’ নিচুতলার-মধ্যতলার এসব ছিঁচকে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিল দু’দশক আগে। রাজনৈতিক দলভিত্তিক শাসকগোষ্ঠীর কাছে এ-সমস্যার সমাধান না-পেয়ে তারা দলভিত্তিক রাজনীতির ওপরেও ক্ষিপ্ত হন, ফলে চাঁদাবাজের বর্গ স¤প্রসারিত হয়। তারা ‘রাজনৈতিক দল’ ও দলের সমর্থকদেরকেও চাঁদাবাজের বর্গে ঠেলে দেয়। এবার তারা ‘সেনা-সমর্থিত’ আপাত-স্থায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আগমনকে স্বাগত জানায়- যে সরকার তাদের কাঙ্ক্ষিত জিহাদ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে ‘দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির’ কলুষমুক্ত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিতে। দুর্নীতি-চাঁদাবাজির কাঠামোগত কারণগুলো তারা এড়িয়ে যান এবং উপরতলার কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের প্রকাশ্য ডাকাতিকে ‘বাণিজ্যিক সাফল্য’ নামে আখ্যায়িত করেন।

আয়না ছবিতেও এরূপ বর্গকরণের কৌশল ব্যবহৃত হয়। রমিজ চাঁদার টাকা ও চাঁদা তোলার এলাকা ভাগ করে দিয়ে তালেব চাচার দোকানে গিয়ে বসে। সেখানে আগে থেকেই কুসুম ও তার সখি করিমন তেল কিনতে হাজির ছিল। রমিজ হা-করে ওদেরকে দেখে এবং দোকানের কর্মচারিকে তিন কাপ চায়ের অর্ডার দেয়। রমিজ বলে, ‘তোমাগোরে একটু খাতির করতে চাই, তরতাজা তেজী মানুষগোরে সম্মানকরণ লাগে।

’ যাহোক ওরা চা না-খেয়ে চলে যায়। রমিজ ‘প্রেমী ও প্রেমী দেখা দিলে তুমি...’ গাইতে গাইতে ওদের চলে যাওয়া রসিয়ে-রসিয়ে দেখে- বস্তুত পরিচালক রমিজের মাধ্যমে দেখান, ক্যামেরার চোখ স্থির হয় কুসুমের পশ্চাদ্দেশে। দোকানের মালিক তালেব এলে রমিজ জানায়, বাঁধা চাকরি তার ভালো লাগে না তাই গার্মেন্টসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসেছে। তালেব তাকে বিয়ে করে সংসারী হওয়ার পরামর্শ দেয়। সে জানায়, সংসারী হওয়ার কথাই ভাবছে।

গাঁয়ের গায়েন আজম আলী চাচার মেয়েকে, মানে কুসুমকে, তার মনে ধরেছে। তালেবকে সে প্রস্তাব নিয়ে যেতে অনুরোধ করে। এখানে দৃশ্যান্তরে যেতে সম্পাদক যেভাবে কাঁচি চালিয়েছেন তা কেবল অদক্ষ সম্পাদকের পক্ষেই সম্ভব। পরের দৃশ্য: রাত নেমেছে। আজম আলী গান গেয়ে দেড়শ টাকা রোজগার করে মেয়ের জন্য ইলিশ কিনে বাড়ি ফিরছেন।

পথে তালেব কুসুমের বিয়ের কথা পাড়ে। আজম আলী চূড়ান্ত কথা না-দিয়ে মেয়ের সাথে আলাপ করে সিদ্ধান্ত জানাবেন বলে বাড়ি ফেরেন। মেয়ের সামনে ইলিশটা ঝুলিয়ে চমকে দেন। বড় সাইজের ইলিশ। বলেন ‘তর কথা মনে পড়লো তাই নিয়া আইলাম...মাত্র ৫০ টাকায় দিয়া দিল’।

গ্রামে যাদের নিয়মিত যাতায়াত আছে তারা জানেন, গ্রামের হাটে আজকাল ইলিশ অনুপস্থিত। নদীতে যখন ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ে তখনও গ্রামে কেবলমাত্র জাটকা গিয়ে পৌঁছায়। আর অত্তো বড় ইলিশ পাওয়াতো সম্ভবই নয়- তাও পঞ্চাশ টাকায়। স্বপ্নে অবশ্য পাওয়া যেতে পারে, কিংবা গণিতের খাতায় ‘একটা বড় ইলিশের দাম ৫০ টাকা ধরলে...’ হিসেব মেলানো সম্ভব! বিয়ের প্রস্তাবে কুসুম ভাবনায় পড়ে। পরের দিন সে ঘনিষ্ট সখি কমিরনের সাথে পরামর্শ করে, বলে, ‘শালার কপাল! একটা প্রস্তাব আইলো তাও ওই ভাদাম্যা চাঁন্দাবাজের লগে।

মাইনসে কইব চাঁন্দাবাজের বউ। ’ করিমন হাসতে হাসতে বলে ‘অতো বাছাবাছি করিসনাতো। মাইয়া মাইনষের জীবন হইল ক্ষ্যাতের মতো, ফসলের গুণেই ক্ষ্যাতের নামডাক। কোন ব্যাটাই লাঙ্গল দিল সেইসব ভাবনের দরকারটা কি?’ উত্তরে কুসুম বলে, ‘লাঙ্গলের লাইগা বেচাইন হইয়া গেছস মনে হইতাছে, তাইলে ক ওই চাষারে তর ক্ষ্যাতে নামাইয়া দিতাছি। ’ এরূপ রূপক দর্শককে সুরসুরি দেয়, এবং এ-উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত।

এরকম কথাবার্তা আরও কিছুক্ষণ চলে। দুই বান্ধবী মাঠে-ঘাটে নাচতে থাকে, কুসুম গান ধরে - বস্তুত স্টুডিওতে রেকর্ডকৃত গানে গলা মেলায় - আর গানের মধ্যেই কয়েকবার তাদের পোশাক-বদল ঘটে। এই উপমহাদেশে, বাংলাদেশেও রেকর্ডকৃত গানের সাথে মুখ মিলিয়ে নৃত্য সিনেমার বিশেষ অঙ্গ হয়ে উঠেছে। বাজারি সিনেমার রুপালি পর্দাতেই কেবল এরকম ঘটে, বাস্তবে নয়। ফর্মুলা দাঁড়িয়ে গেছে, ছবি ‘বক্স-অফিস হিট’ হতে হলে কিছু ভালো গান এবং দৃষ্টিসুখ মেটাতে কিছু নাচের দৃশ্য অবশ্যই থাকতে হবে।

নায়িকাকে রূপসী হতে হবে। আয়নাও এ ফর্মুলা অনুসরণ করে। কুসুমের বাবা আজম আলীকে রমিজ গলায় গামছা পেঁচিয়ে খুন করে। নাহার নামের একটা মেয়েকে ঢাকায় গার্মেন্টস-এ চাকরি দিতে নিয়ে যাবে রমিজ। রাত একটায় ট্রেন।

সে মেয়েটিকে আটটার মধ্যেই আসতে বলে। মেয়েটি আসে। এদিকে রমিজের সাথে বিয়ের প্রস্তাবে কুসুম রাজি হয়েছে- রমিজের ‘লাঙ্গলের’ জন্য ‘ফসলের ক্ষেত’ হতে রাজি হওয়া কুসুমের পূর্বোল্লেখিত বলিষ্ঠতার সাথে মানায় না। আমরা দেখবো গার্মেন্টসকর্মী হিসেবেও তাকে মানায় না। যাহোক, ‘শুভকাজে দেরি করতে নাই’ বলে আজম আলী রমিজের বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয়।

দরোজার কাছে এসেই আজম আলী ধ্বস্তাধ্বস্তি শুনে থমকে দাঁড়ায়। এসময় নাহার কোনোভাবে মুক্তি পেয়ে আজম আলীর সামনে দিয়ে দরোজা খুলে অন্ধকারে দৌড়ে পালায়। রমিজ দরোজায় মুখ বাড়িয়ে দেখে আজম আলী দাঁড়িয়ে। অপ্রস্তুত হয়ে বলে, ‘কিছু কইবেন চাচা? আজম আলী বলে, ‘যা দ্যাখলাম আর যা বুঝলাম, আমার আর কিছু কওনের নাই। মাইয়াডা রাজি হইছিল।

আল্লাই বাঁচাইছে। তোমার মতো একটা ইতরের হাতে আমি আমার মাইয়ারে তুলে দিতে পারি না। ছি!’ স্থানীয় লোকভাষা আর বইয়ের ভাষা মানে ভদ্দরলোকের ভাষা আজম আলীর মুখে একাকার হয়ে যায়। ধিক্কার জানিয়ে সে ফিরতি পথ ধরে। রমিজের মাথায় আগুন ধরে যায়, সে প্রথমে বসে পড়ে, তারপর এক ঝটকায় উঠে দৌড়ে গিয়ে আজম আলীর গলায় গামছা পেঁচিয়ে হত্যা করে।

চারদিকে তাকিয়ে অনুসন্ধান করে কেউ দেখে ফেললো কিনা। তারপর ঘরে ফিরে যায়। তবে অন্ধকারে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে নাহার হত্যাকাণ্ড দেখে ফেললেও মুখ খোলে না। সবাই ভেবে নেয় বয়স্ক বৃদ্ধের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। শোকবিহ্বল কুসুম সন্ধ্যারাতে বাবার কবরের পাশে বসে থাকে।

এসময় রমিজ সেখানে হাজির হয়। সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করে। বলে, আমার সাথে তো তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল, চলো দুজনে মিলে চাচার শেষ ইচ্ছা পূরণ করি। এতো রাতে এখানে থাকা ঠিক না, চলো ঘরে যাই বলে সে কুসুমের হাত ধরে। কুসুম হাত ছাড়িয়ে নেয়, চিৎকার করে বলে, ‘হাত ছাড় জানোয়ার... ববার কবরের মাটি শুকাইতে না শুকাইতেই... তর মতো লুচ্চার আমি ঘর করি না’।

রমিজ ক্ষিপ্ত হয়ে বলে, ‘ছাইড়া দেওনের জন্য রমিজ কারো হাত ধরে না’। কুসুম: ‘আমি চিৎকার করুম’ রমিজ: ‘কোনো লাভ নাই। তর বাপেও চিৎকার করতে চাইছিল, আমি সুযোগ দেই নাই। ’ রমিজ কুসুমকে ধর্ষণ করতে জাপটে ধরে মাটিতে ফেলে দেয়। কুসুম হাতের কাছে পাওয়া কাঁটা-ঝোপ দিয়ে রমিজের মুখে আঘাত করে নিজেকে মুক্ত করেই গ্রামের পথ দিয়ে দৌড়াতে থাকে।

একটা ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে চলে যায়। এরপর ঢাকা শহরের একটা মাস্টার শর্ট। বুঝানো হয় কুসুম ঢাকায় চলে এসেছে। এখন কাহিনীও শহরকেন্দ্রিক হয়ে পড়বে। বাংলা সিনেমার এ এক নিয়মিত ইমেজ।

গ্রামে কোনো একটা সংকট দেখা দেয়। সিনেমার চরিত্র গ্রাম ছাড়ে ...ট্রেন চলে যায় হুইসেল বাজিয়ে...ঢাকা শহরের একটা মাস্টার সর্ট, তারপর সিনেমার কাহিনী ব্যতিক্রমহীনভাবে ঢাকার রাস্তা ধরে এগিয়ে চলে। কিন্তু বাস্তবতা এরূপ সিনেমাটিক সরল-সিধা নয়। ভাগ্যের বদল ঘটাতে ট্রেনের ঝিকঝিক গতির ছন্দে অনেক সঙ্কটাপন্ন ব্যক্তিরই ঢাকায় চলে যাওয়া হয়ে ওঠে না, আর একজন সদ্য যুবতীর জন্য তো নয়ই। চাঁদাবাজ-চোকারবারীর কুসঙ্গ-কু-রঙ্গের সবটুকু একসাথে পাওয়া যায় পরের দিকের দুটো দৃশ্যে।

রমিজ এসেছে ঢাকায়, খালেকের সাথে দেখা করতে গার্মেন্টসে যায়। খালেক রমিজকে খালার দোকানে বসতে বলে। রমিজ খালার দোকানে বসে, চা খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করে: ‘ব্যবসাপাতি কেমন চলতেছে খালা। ’ খালা: ‘চলতাছে টাইটাই, বাকি খাওন মাইনষের খাসলত হইয়া গেছে, বুঝচস। ’ রমিজ: ‘হ খালা, দিনকাল যানি কেমন হয়া গেছে, কোনো ব্যবসাতেই যুইত নাই।

সাদা ব্যবসায় পয়সা নাই, কালা ব্যবসায় ম্যালা ধকল। ’ খালা: ‘তা এদ্দিন গায়েব হইয়া ছিল্যা কই?’ রমিজ: ‘গেরামে গেছিলাম। ডাইলের চালান পার করতে গায়া [ভুল উচ্চারণ] পুলিশের দাবরানি খাইছিলাম গো খালা ...। ’ খালা: চোখের নিচে খোঁচার উপর দিয়ে পার পাইয়া গেছ, পুলিশের হাতে ধরা পড়লে বাপের নাম ভুলাইয়া দিত। ’ রমিজ সিগারেট ধরায়।

এসময় কুসুম দোকানের পাশ দিয়ে বাসায় ফিরে। রমিজ জিজ্ঞাসা করে: ‘খালা, নীল ছিটের সালোয়ার কামিজ পরা মাইয়াটা কি এই ফ্যাক্টরিতে ঢুকছে?’ খালা: ‘হ ওর নাম কুসুম, ...ওর দিকে চোখ বিন্দাইলা ক্যা? কুসুম ভালো মাইয়া। ’ এর পরের দৃশ্যে খালেকের বিছানায় রমিজ গা এলিয়ে শুয়ে আছে। খালেক পোশাক বদল করছে। খালেক: ‘হেলালের লগে দেহা হইছে, তর কথা কইচি, আইতাছে।

কিরে ঝিম মাইরা রইলি ক্যান?’ রমিজ: আমি আর তগো ধান্দাই নাই...ঐদিন পুলিশে খবর দিছিল বইল্যা, পুলিশ রেইড দিছিল। ’ খালেক: ‘তর কাউরে সন্দেহ হয়?’ রমিজ: ‘...মনে হয় ঐ মাস্টারের পোলা সগীর পুলিশের ইনফর্মার। ’ ...খালেক: ‘কিরে তর চোখের কোনে গাতা হইল ক্যামনে?’ রমিজ: ‘গাতায় পইড়া গেছিলাম দোস্ত। ’ খালেক: ‘নেশার ঘোরে পথ চললে তো গাতায় পড়ন লাগবই। ’ রমিজ: ‘হ দোস্ত, ওই নেশা আমার জিন্দেগিতেও কাটবো না, আর গাতার থেক্যাও আর উঠতে পারবো না।

’ খালেক: ‘কী উল্টাপাল্টা কথা কস, এহনওতো প্যাটে মালপানি পড়ে নাই। ’ রমিজ: কুসুম তোগো ফ্যাক্টরিতে কবে জয়েন দিছে রে?’ খালেক বেশ রসিয়ে অস্বাভাবিকরকম টেনে টেনে বলে: ‘ওওও ওই জয়েন দিছে দ্যাড় মাস হইল? আরে ওইযে স্টোররুমের দোলন আছে না..ওই হালার পুতে আমার লগে টেক্কা মাইর‌্যা ওরে জয়েন দেওয়াইছে। অহন আবার দুইজনের মধ্যে ইস্টিকুলুকুলু চলতাছে। ’ রমিজ: ‘কুসুম আমাগো গ্রামের মাইয়া, আমার জানের জান। ওর লগে কেউ ভাঁজ খাইলে ওরে দুনিয়া থেইক্যা আমি সরাইয়া দিমু।

’ খালেক বলে: ‘দোস্ত আমিও তোমার লগে আছি। ওই পুঙ্গির পুতের ওপর...অর লাইগ্যা আমি কোনো ধান্দাফিকির ঠিকমতো করতে পারতাছি না। ’ এসময় হেলাল ঘরে ঢোকে বিদেশী ‘মাল’ ও একজন মেয়ে সাথে। সারারাত ‘দিল্লাগি’ করবে। রমিজকে দেখেই মেয়েটি উত্তেজিত হয়ে ওঠে, সে রমিজের কলার চেপে ধরে বলে, ‘...পাইছি তরে আজ, অই গোলামের পুত আমার ট্যাকা দে।

’ বাজারী মন-ভোলানো সংস্কৃতির সিনেমাগুলোতে নায়ক চরিত্রে সমাজস্বীকৃত সব ভালো গুণের সমাবেশ ঘটানো হয়। আর নায়িকা চরিত্রের দেহজ রূপ বিপুলভাবে প্রদর্শিত হয় প্রধানত পুরুষ দর্শকের দৃষ্টিসুখ মেটাতে, কোনো গুণ থাকলেও সেটাকে ছাপিয়ে ওঠে শরীর। আয়না ছবিতেও এর ব্যতিক্রম দেখা যায় না- কুসুম চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তোলার বদলে তাকে ‘নায়িকাসুলভ’ রূপ প্রদর্শনেই বেশি মনোযোগী দেখা যায়। দারিদ্র ও শারীরিক শ্রম রূপকে আড়াল করে, শরীরে ছাপ রেখে যায়। কিন্তু কুসুমের শরীর তার নামের সাথে বেশ মানানসই, তার কপোলে রুজ, চোখে মাসকারা সবসময় দেখা যায়।

রূপ প্রদর্শনের জন্য এগুলো আবশ্যক হলেও, চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। এ-ধরনের সিনেমার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, ‘ভিলেইন’ চরিত্রে সামাজিকভাবে ঘৃণিত যাবতীয় বদগুণের আছর দেখানো হয়। যদিও চাঁদাবাজির সঙ্গে, ধর্ষকামিতা বা এসিড নিক্ষেপ বা ড্রাগ-আসক্তি বা চোরাচালান বা বহুনারী-গমনের আবশ্যিক কিংবা অনিবার্য কোনো সম্পর্ক নাই। কিন্তু এই সিনেমায় রমিজ চরিত্রে এই সকল কু-গুণের সমাবেশ ঘটানো হয়। একজন এসিড নিক্ষেপকারী আবশ্যিকভাবে একজন চাঁদাবাজ নাও হতে পারে।

আবার একজন চাঁদাবাজ হয়তো বাস্তবে এসিড নিক্ষেপকে অত্যন্ত ঘৃণার চোখেও দেখতে পারে। কিন্তু আয়না সিনেমার ভিলেন চরিত্র বাজার-চলতি ফর্মুলা ভেঙ্গে বেরোতে পারে না। সব দেশেই বাণিজ্যিক ছবির ভিলেন চরিত্রের একটা বদল এখন চোখে পড়ে। ৮০/৯০ এর দশকে মারদাঙ্গা ছবির ভিলেনের সাথে এখনকার ভিলেনের একটা অমিল প্রায়শই দেখা যায়। সেসময়ের ভিলেনরা হতো বিপুলদেহী-রক্তচক্ষু-চড়া মেজাজের, এর উদাহরণ হতে পারে বাংলাদেশের জাম্বো বা হিন্দি সিনেমার অমরেশ পুরী।

আর এখনকার ভিলেন অনেক ক্ষেত্রেই কোমল ভাষায় কথা বলে, হ্যাংলা-পটকা শরীর হলেও মানিয়ে যায়। ভিলেনের শরীর ও ডায়ালগের এই বদল আরও বড় ধরনের সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত। আমরা আজকাল তথ্য-মহাসড়কের যাত্রী, এখন আমজনতাও বুঝে গেছে যে তথ্য/জ্ঞানই শক্তি, তথ্য/জ্ঞানই ক্ষমতা। ইন্টারনেট, স্যাটেলাইট, সেলফোনের এই যুগে আমাদের বাংলাদেশেও একটা বড় অংশের মানুষের শরীরের চেয়ে মনোজগত বেশি সক্রিয়। এখন রাষ্ট্রযন্ত্র, বহুজাতিক পণ্যবিক্রেতা, বিজ্ঞাপনদাতা কিংবা জিহাদওয়ালা সকলেই মানুষের মনোজগতকেই প্রধানত টার্গেট করে- তাদের উদ্দেশ্য নিপীড়ন চালানো, পণ্য বিক্রি, মতাদর্শে দীক্ষিতকরণ যা-ই হোক না কেন।

ভিলেন চরিত্রও তাই, বৃহত্তর পরিবর্তনের অন্তর্গত হয়ে, বিপুল শরীর ও কর্কষ-চড়া মেজাজ থেকে সরে এসেছে বলে আমি মনে করি। ইস্যু ৪: নারী-শিশু নির্যাতন একটা রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ঢাকা শহরের মাস্টার শর্টের পরেই সেবামূলক সংগঠন অঙ্গনার পরিচালক আফরোজা সাংবাদিকের কাছে সাক্ষাৎকার দিচ্ছে: ‘পুরুষ শাসিত সমাজে নারীর অবস্থা নিয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে বহু গান, ছড়া, কবিতা রচিত হয়েছে...মেয়েরা যেন বৃষ্টির ফোটা, কেউ জানে না পড়বে কোথায়। ’ সাংবাদিক তার কাছে নারীর পাশাপাশি শিশুদের অবস্থাও জানতে চান, তিনি বলেন, ‘...শিশুরাও বঞ্চিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিটা আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্যই একটা চ্যালেঞ্জস্বরূপ। ’ আমাদের মিডিয়া, এনজিও, মানবাধিকার কর্র্মী মিলিয়ে গঠিত টলায়মান ‘সুশীল’ সমাজ এদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য বহু চ্যালেঞ্জ আবিষ্কার করেছেন।

কিন্তু বহুজাতিক কোম্পানির কাছে দেশকে উদোম করে দেওয়া, শক্তিশালী বিদেশী রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ, ওয়ার্ল্ডব্যাংক-আইএমএফ-এডিবি’র জাতীয় নীতিনির্ধরণে হস্তক্ষেপ কিংবা জাতীয় জীবনে সম্পদ ও উৎপাদনের উপায়গুলোর অসম বণ্টন নিয়ে কোনো চ্যালেঞ্জ কখনোই আবিষ্কার করতে পারেনি। আমাদের ‘সুশীল সমাজ’ একটা জাতীয় বা জাতীয়তাবাদী চরিত্র পায়নি। এর কারণ প্রধানত, বর্তমান বৈশ্বিক আর্থরাজনৈতিক ক্ষমতাতন্ত্রে সেরূপ সুশীল সমাজ কাক্সিক্ষত নয়। তাই আমাদের সুশীল সমাজের ক্ষতমাশালী বড় অংশটি একটা বুর্জোয়া মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ গঠনের দিকেও না গিয়ে, বরং ‘সুযোগের হাতছানিতে’ সাড়া দিয়ে ‘নয়া-উদারনৈতিক বাজারব্যবস্থায়’ ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীতে পরিণত হয়েছে। এই সুশীল সমাজের পরিগঠন ও বিকাশ এখানে বিচার করা সম্ভব নয়, তাই শুধু পর্যবেক্ষণ পেশ করছি।

সামাজিক সমস্যার কাঠামোগত দিকগুলো সবসময়ই তারা উপেক্ষা করেছে। এই চলচ্চিত্রেও কোনো সমস্যারই কাঠামোগত কারণ ও সমাধানের পথ সন্ধানের প্রয়াস নাই। ইস্যু ৫: গার্মেন্টস জীবন ও মহানুভব গার্মেন্টস কর্তা গ্রাম থেকে পালিয়ে কুসুম আশ্রয় পেয়েছে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে কাজের বুয়া হিসেবে। কিন্তু এ-আশ্রয় কুসুমের জন্য দীর্ঘস্থায়ী হয় না। গৃহকর্তা এক রাতে তার গায়ে হাত দেয়...কুসুম চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘কী করেন খালুজান!’ খালুজানের আর বেশিদূর অগ্রসর হওয়া হয় না।

কুসুমের চিৎকারে গৃহকত্রী দরোজায় এসে উদয় হন। লোকটা আর কিছু না করতে পেরে কুসুমের গালে একটা শক্ত থাপ্পর কষে ফিরে যায়। পরদিন গৃহকত্রী কুসুমের হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে অন্য কোথাও গিয়ে কাজ জুটিয়ে নিতে বলেন। কুসুম মিনতি জানায়, তার কোথাও যাওয়ার নাই। সংসার বাঁচানোর জন্য তখন গৃহকত্রী বলেন, ‘তোকে আমি সাহায্য করতে চেয়েছিলাম।

কিন্তু আমিও তোর মতো অসহায় রে। তাই পারলাম না। ’ মধ্যবিত্ত নারীর সঙ্কট ও সমস্যা নিয়ে আর কিছু সিনেমাটিতে দেখা যায় না, মধ্যবিত্ত কর্তাদের সুযোগ-সন্ধানী চরিত্রও আর উন্মোচিত হয় না- যদিও ছবির নাম আয়না। রেললাইন ধরে অনেক লোক হেঁটে যেতে দেখে কুসুম দলে ভিড়ে যায়। একজন জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কবে জয়েন দিছ?’ কুসুম: ‘আমি তো কোথাও জয়েন দিই নাই।

’ মেয়েটি, ‘তুমি আমাগো গার্মেন্টসে কাম কর না?’ কুসুম: ‘না। ’ মেয়েটি, ‘তাহলে আমাদের সঙ্গে কোই যাইতেছ?’ কুসুম: ‘জানিনা। ’ আরেক মেয়ে: ‘কামে জয়েন দেও নাই, কই যাইবা জান না, তাহলে তো এই শহরে লুটাইয়া যাইবা। ’ ‘এই শহরে জোয়ান মাইয়াগো কতো কদর তখন টের পাইবা!’ কান্নাজড়িত কুসুম: ‘না আপা, আমি খুব বিপদে পইরা ঢাকা শহরে আইছি। এইখানে আমার কেউ নাই।

থাকনের কোনো জায়গা নাই। ’ মেয়েটির জন্য তাদের দয়া হয়। কাজের সময় হয়ে যাচ্ছে বলে তারা কুসুমকে সাথে নিয়ে গার্মেন্টসের উদ্দেশ্যে হাঁটা দেয়। অচেনা কুসুমকে গার্মেন্টসের ভিতরে থাকতে দেবে না। তাই পার্শ্ববর্তী দোকানে বসিয়ে রাখে।

সিনেমাটি জুড়ে একের পর এক কাকতালীয় ঘটনা ঘটে- কাহিনী ও কল্পনাশক্তির দুর্বলতার কারণে পরিচালককে বস্তুত জোড়াতালি দিয়ে এসব ঘটাতে হয় নারী নির্যাতনের কথা বলার জন্য। কুসুম দোকানে বসে থাকে, এক মেয়ে গার্মেন্টস-কর্মী পাশে এসে বসে, ‘কড়া কইরা এককাপ চা দ্যাও খালা। ’ পাশে বসা কুসুমের দিকে তাকিয়ে বলে ‘তুমিও লেট!’ এসময় ঝাঁকড়া চুলের এক ছেলে সিগারেট ধরিয়ে পাশে বসে বলে, ‘ও খালা গার্মেন্টসের মাইয়া বাইরে বইসা ঝিমাই ক্যা? ডিউটি নাই?’ মেয়েটি জবাব দেয়, ‘লেট হইয়া গেছে, ঢুকতে পারি নাই। ’ ছেলেটি: ‘ডিউটি করতে চাইলে লও আমার সাথ, খালি খালি দিনটা বরবাদ করবা ক্যান। ’ মেয়েটি: ‘তোমাগো লগে বিজনেস নাই।

তোমার ওই মফস্বলের দোস্ত আমার এক হাজার টাকা বাঁকি রাইখ্যা গায়েব হইয়া গেছে। ’ ছেলেটি জিজ্ঞেস করে, ‘এখন আমার লগে যাইবা নাকি কও?’ মেয়েটি হাত বাড়িয়ে বলে: ‘ট্যাকা এডভান্স’। ছেলেটি টাকা দেয়। মেয়েটি ওর সাথে যেতে যেতে বলে, ‘চলো হ্যান্ডসাম, অহন আমি তোমার ডার্লিং। ’ এই ছেলেটির নাম হেলাল, আর তার মফস্বলের বন্ধু হলো রমিজ।

একটু পরেই আরেকজন ছেলে গার্মেন্টস-কর্মী এসে বলে, ‘খালা, জলদি এক কাপ চা আর এক প্যাকেট সিগারেট দ্যাও। ’ ওর নাম খালেক, গার্মেন্টসের সুপারভাইজার, রমিজের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। সে টাকার বিনিময়ে মেয়েদের গার্মেন্টসে কাজের সুযোগ করে দেয়। বসদের সাথে তার ভালো যোগাযোগ। কাকতালীয় সাক্ষাৎ! কুসুমের মূল আশ্রয়দাতা ফাতেমা।

তার স্বামী প্রাইভেট গাড়ির ড্রাইভার। অন্য দুজন মেয়ে আগে থেকেই থাকা-খাওয়ার টাকা দিয়ে ফাতেমাদের সাথে থাকতো। এখন কুসুম এসে জুটলো। অভাবের সংসার, কুসুমের চাকরির কথা ওঠে। তবে খালেকের কাছে তারা ধর্ণা দেয় না।

কারণ দুই হাজার টাকার কথা বলে সে পাঁচ হাজার টাকা ‘ফিস’ আদায় করে নেয়। ফাতেমা বরং কুসুমকে নিয়ে সেরাতেই স্টোর সুপারভাইজার দোলনের কাছে যায়। কারণ সে ভালো মানুষ, মালিকের বিশ্বাসী লোক। দোলন একই বস্তির বাসিন্দা। কুসুমকে দোলনের মনে ধরে।

ফাতেমা আগামীকালই মালিকের কাছে কুসুমের জন্য চাকরির কথা পাড়তে অনুরোধ জানায়, বেকার বসে থেকে কী লাভ। দোলন বলে, বসে থাকবে কেন তার পাকসাক করে দেবে। এ প্রস্তাবে ফাতেমা-কুসুম দুজনেই সাই দেয়। পরদিন দোলন স্টোরের মালামালের হিসেব করছে। একজন খবর দেয়, ‘স্যার বড় স্যার আপনারে ডাকছে’।

দোলন তার সহকারীকে বলে, ‘কাজ শেষ করে আমার রুমে দেখা করবেন, ওকে। সে এমনভাবে ‘ওকে’ শব্দটি উচ্চারণ করে যা অন্তত দোলনের পর্যায়ের চাকুরের মুখে বেমানান। মালিক তাকে সমাদর করে বসিয়ে বলেন, ‘আপনাকে ডেকেছি একটা জরুরি প্রয়োজনে। আমাদের পার্চেজ ডিপার্টমেন্টে বেশ কিছুদিন ধরে কিছু অনিয়ম চলছে। ... এ্যডমিন সেকশনে আপনাকে পাঠাতে চাই।

’ অনেক বড় পোস্ট, বেশ কয়েকটা ইনক্রিমেন্ট দেওয়ার কথাও তিনি বলেন। এসময় দোলন কুসুমের চাকরির কথা পাড়েন এবং তখনই মালিক সুপারভাইজার খালেককে ফোন করে খোঁজ নেন কোনো পোস্ট খালি আছে কিনা। তিনি তখনই দোলনের হাতে একটা নিয়োগপত্র দিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। কাকতালীয় বটে! এ-নিয়ে খালেকের সাথে দোলনের এক চপট ঝগড়াও হয়। কারণ ওই পোস্টের জন্য খালেকেরও একজন ক্যান্ডিডেট ছিল, ইতোমধ্যেই সে এক হাজার টাকা আগাম নিয়েছে চাকরি দেবে বলে।

দোলন হুমকি দেয়, খালেক যেন ভবিষ্যতে আর এরকম দুইনম্বরি না-করে। মালিকের বিচক্ষণতা ও মহানুভবতা দেখে আমরা মুগ্ধ হই। তাঁর মহত্বের আরও পরিচয়: দোলনের স্ত্রী এসিডদগ্ধ হলে, অনির্দিষ্টকালের ছুটি দেয়া হয়। মালিক নিজে এসে দোলনের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘দোলন সাহেব যতোদিন আপনার স্ত্রী সুস্থ না হচ্ছে ওকে হাসপাতালে এ্যটেন্ড করুন। আপনার চাকরি ঠিক থাকবে।

’ আবার স্ত্রীর প্লাস্টিক সার্জারির জন্য দোলন মালিকের কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকা ধার করতে যায়। মহান মালিক বরং দোলনকে পঞ্চাশ হাজার টাকা অনুদান দেন। দোলনের মতো ভালো কর্মীর পাশাপাশি খালেকের মতো বজ্জাত কর্মীর দেখা মিললেও, সিনেমাতে মহৎ মালিকের বিপরীত চরিত্রের কোনো মালিকের দেখা মেলে না। যদিও বাস্তবে বেশিরভাগ মালিক শ্রমিকদের অধিক খাটিয়ে নেয়, লাঞ্ছিত করে এবং বেতন-ভাতা দিতে ঠকায় বলেই জানা যায়। এরূপ নির্মাণ আবশ্যই স্বেচ্ছাকৃত- গার্মেন্টস ইসুতে প্রথম আলোর কাভারেজও এরূপ নির্মণকেই ন্যায্যতা দেয়।

ইস্যু ৬: এসিড নিক্ষেপ ও প্লাস্টিক সার্জারি কুসুম চাকরিতে যোগ দিয়েছে দেড়মাস হলো। এরমধ্যে একদিন সে গার্মেন্টস থেকে বেরিয়ে খালার দোকানে চা খেতে দাঁড়ায়। এসময় রমিজ উপস্থিত হয়ে চেয়ারটাতে বসে, হ্যালহ্যাল করে কুসুমের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং ভারী-গলায় বলে, ‘খালা এককাপ কড়া কইরা চা দ্যাওতো। ’ রমিজের দিকে কুসুমের চোখ পড়ে। ফ্লাশ-ব্যাকে বাবার কবরের পাশে রমিজের ধর্ষণ-প্রচেষ্টা আবারও দেখানো হয় এবং কুসুম ভয়ে-আতঙ্কে দৌড়ে পালায়।

রমিজ কুৎসিতভাবে হাসতে থাকে। বস্তির মালিকের ঘরজামাই চানমিয়া আর তার স্ত্রী ফরসা খাতুন বসে ভাড়াটিয়াদের লেনদেনের হিসাব মেলাচ্ছে। এ-সময় উকিল আপা ও তার এক সহকর্মী এসে হাজির। আলাপচারিতা দেখে বুঝা যায় তিনি পূর্বপরিচিত। আয়নার প্রথম দৃশ্য শুরু হয়েছিল সেবামূলক প্রতিষ্ঠান অঙ্গনার পরিচালক আফরোজাকে দিয়ে- এখানে তিনিই হলেন উকিল আপা।

তিনি এসেই বলেন ‘এলাম নারী নির্যাতনের কেস নিয়ে’। তিনি বুঝিয়ে বলেন, এটা তার প্রতিষ্ঠানের একটা প্রজেক্ট: ‘ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্তরের কর্মজীবী মহিলারা বাড়িতে, রাস্তাঘাটে, বিভিন্ন জায়গায় যেসব নির্যাতনের শিকার তার উপরে আমরা একটা জরিপ চালাচ্ছি। ’ আট/দশটা বস্তিতে এ-কাজ সেরেও ফেলেছেন। ‘আপনার বস্তির মেয়েদেরকেও আমরা ফর্ম পূরণ করতে দেব। কাজটা করবে ও, আমাদের প্রতিষ্ঠানের স্টাফ সানজিদা’ বলে তিনি পাশের মেয়েটিকে দেখিয়ে দেন, এব্যাপারে চানমিয়া ও ফরসা খাতুনকে সহযোগিতা করতে বলে সহকর্মীসহ চলে যান।

পরের দৃশ্যে আমরা দেখি রাত হয়েছে, কুসুম কাজে না-গিয়ে বস্তিতে বসে আছে। সে গার্মেন্টসে যেতে চায় না রমিজের ভয়ে, ফাতেমা ও অন্যরা কাজ থেকে ফিরে এলে সে একথা জানায়। পর মুহূর্তেই আমরা দেখি রমিজ চারজনের একটা দল নিয়ে এসে হাজির। ফাতেমা ও কুসুম ঘর থেকে উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে। রমিজ বলে, ‘কেমন আছ কুসুম? আমি তোমারে নিয়া যাইতে আসছি, চলো লক্ষিসোনা।

’ জহুরা দোলনকে খবর পাঠায়। রমিজের সাথে-আসা খালেক বলে, ‘আমরা কোনো অন্যায় কাম করতে আসি নাই। আমার দোস্ত রমিজ, ও আইছে ওর বিয়ে করা বউ কুসুমরে লইয়া যাইতে। ’ কুসুম: ‘মিছা কথা ফাতেমা বু, সব মিছা কথা। ’ এসময় বস্তির মালিক চানমিয়া বেড়িয়ে আছে, এতো রাতে কে মাস্তানি করতে এসেছে এটা সে মেনে নেবে না।

সে হম্বিতমি করে, কুসুমকে বলে, ডরাইস না। এসময় গাড়ির হর্ন বাজিয়ে কাকতালীয়ভাবে উকিল আপাও দৃশ্যপটে হাজির হন। চানমিয়া বলে, ‘আহেন উকিল আপা আহেন, তামশাটা দ্যাহেন। এ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।