আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
যা বুঝলাম তা হল কতগুলো পথের ছোট ছেলে চতুষ্পদ জন্তুর মত হাটু গেড়ে বসে আছে। ওদের মুখে গায়ে পশম লাগা, দেখতে অনেকটাই ছোট ছোট বিলাতি কুত্তার মত। চারিদিকে অনেক মানুষ খেলা দেখছে। কিছুলোক ওদের গায়ে পশমগুলো লাগাচ্ছে। অদ্ভুত মনে হওয়ায় চ্যানেলটা ঘুরালাম না।
কিছুক্ষণ পরে বুঝতে পারলাম, এটা একটা গেম শো চলছে ইটিভিতে।
অনুষ্ঠানের নাম ভবঘুরে ডট কম। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে উপস্থাপিকা নাবিলা পাবলিককে দিয়ে বিভিন্ন খেলা খেলায়। আজকের খেলাটার নিয়ম ছিল অনেকটা এই রকম, ছোট ছেলেগুলো চারপেয়ে প্রানীর মত বসে থাকবে। আর প্রতিযোগীরা ওদের গায়ে পশম লাগিইয়ে পরিপূর্ণ ভেড়া বানাবে।
নির্দিষ্ট সময় পরে যে ব্যক্তি কোন ছেলেকে সবচাইতে বেশি ভেড়ার মত বানাতে পারবে সেই পাবে বিজয়ীর গিফট হ্যাম্পার। প্রতিযোগীতা শেষে উপস্থাপিকা ছেলেগুলোকে দেখে বিজয়ী খুঁজছিল, বলছিল, কোনটা ভাল হয়েছে, এইটা নাকি ঐটা। ভাবটা এমন যেন শিশুগুলো মানুষ নয় কোন জড় বস্তু বা আসলেই গরু ভেড়া জাতীয় প্রানী।
প্রথম খেলাটা তারা খেলে জিঞ্জিরা এলাকায়। এরপর তারা যায় বুড়িগঙ্গার তীরে সদরঘাট এলাকায়।
সেখানের খেলাটাও বিশ্রী। চারটা ব্যাগে কতগুলো পাঁপড় ভাজা রাখা আছে। প্রতিযোগীদের প্রথমে বুড়িগঙ্গার ময়লা, দুর্গন্ধময় বিষাক্ত পানিতে ঝাঁপ দিতে হবে তারপর সেখান থেকে উঠে একটা পাঁপড় নিয়ে নদীতে নামতে হবে। নদীতে নেমে তাদের সেই পাপড় খেতে হবে। যে পানিতে যত বেশি পাপড় খেতে পারবে সে বিজয়ী।
ইটিভি তার ওয়েব সাইটে এই অনুষ্ঠান সম্পর্কে লিখেছে, "একুশে টেলিভিশনের ষ্ট্রিট শো ‘ভবঘুরে ডট কম’। শুধুমাত্র দর্শকদের অংশগ্রহণে মজার-মজার গেম নিয়ে সাজানো এই অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করবেন লাক্স তারকা উর্মি (আজকের অনুষ্ঠানের মেয়েটার নাম ছিল নাবিলা)। ২২ মিনিটর্র এই অনুষ্ঠানটির প্রতি পর্বে উপস্থাপক কোন একটি স্থানে গিয়ে সেখানকার মানুষের সঙ্গে বিভিন্ন বিনোদনমূলক কর্মকান্ডে অংশ নেবেন। যার প্রাণ থাকবেন মূলত দর্শকরাই। তবে এই অনুষ্ঠানে যে-সব গেম থাকবে তা প্রচলিত কোন গেম নয়।
নতুন উদ্ভাবিত এই গেমগুলো দর্শকদের আনন্দ দেয়ার জন্য শুধু এই অনুষ্ঠানেই প্রদর্শিত হবে। "
প্রযোজকের নাম আলভি হায়াত রাজ। অনুষ্ঠানের মূল ভাবনা জনৈক আবদুস সালামের। আমি বুঝি না মজার গেম বলতে তারা কি বোঝে! প্রথম গেমটিতে তারা পথের সেই শিশুগুলোকে অপমান করল। আমি সন্দিহান, ঢাকার কোন ভাল স্কুলের ছেলেমেয়েদের দিয়ে তারা এইসব গেমটা করবার অনুমতি পেত কিনা।
অন্যদিকে বুড়িগঙ্গার নোংরা পানিতে যেখানে মানুষকে নানা রোগ বালাইয়ের জন্য গোসল করতে বা নামতে নিষেধ করা হয় সেই পানিতে ডুবিয়ে ডুবিয়ে পাপড় খাওয়ার মত নোংরামিকে যারা গেম বলতে পারেন তাদের সচেতনতা নিয়ে আমার প্রশ্ন জাগে। অনেকেই প্রতিযোগীদের বা অংশ নেওয়া শিশুদের দোষ দেবেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে তারা হয় কারখানার কর্মি, পথ শিশু সমাজের নিম্নবিত্ত গোষ্ঠির কেউ। টেলিভিশনে চেহারা দেখা যাবে এই কথাটুকু তাদের আত্মমর্যাদা নিয়ে না ভাবানোর জন্য যথেষ্ট।
কিন্তু যারা এই অনুষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত তারা কারা? তারা শিক্ষিত হবার দাবীদার, অনেক ক্ষেত্রে তাদের বসদেরই গলা শোনা যায় মানবাধিকার সম্পর্কে।
আজ না হয় ইটিভির অনুষ্ঠানটা চোখে পড়ল, অন্য টিভি চ্যানেলগুলোতেও নিশ্চয়ই এরকম অনুষ্ঠান প্রচারে কোন বাঁধা নাই।
দুঃখজনক হল, এটাই আমাদের দেশে বাস্তবতা। আমাদের সমাজের বৈষম্য এতটাই প্রকটভাবে আমাদের মানসিকতাকে ছাপিয়ে গেছে যে, সঠিক বেঠিক পরিমাপের ক্ষমতা লোপ পেয়েছে। আমি যা লিখলাম অনুষ্ঠানের সাথে সম্পর্কিত বা আমার আশে পাশের অনেকের কাছেই আলোচনার কোন বিষয় নয়। ব্যাপারটা তাদের কাছে নিশ্চয়ই স্বাভাবিক একটা ঘটনা।
এরকারন একটাই, সেটা হল সেই পথ শিশুদের এখন আর মানুষ হিসেবে দেখা হয় না। পথের কুকুর আর ওদের ফরাকটা খুব একটা বেশি নয় অনেকের কাছে। মুখে যাই বলি এটাই বাস্তবতা। দেশের উন্নতি নিয়ে আমরা অনেক গবেষণা, আলোচনা, পরিকল্পনা করি। কিন্তু কখনও কি নিজেদের দিকে তাকিয়ে ভেবেছি দেশের নাগরিক বলতে কাদের কথা বলছি।
বাজি রেখে বলতে পারি, আমরা তথাকথিত শিক্ষিতরা দেশের মানুষ বলে যাদের উল্লেখ করি, এই দেশে সিংহ ভাগ নাগরিকই সেই মানুষের অন্তর্গত নন। এটাই আমাদের বাস্তব প্রতিচ্ছবি।
(পোস্টটা একটা গ্রুপেও দিয়েছিলাম। পরে সেই গ্রুপ থেকে সরাতে গিয়ে দেখি গ্রুপে নাই কিন্তু প্রথম পাতায় গ্রুপের লিংক দেখাচ্ছে। বাগটাগ হবে হয়ত।
যাই হোক, এখন মুছে আবার দিলাম। মন্তব্যগুলো কপি করে রেখেছিলাম, তাই আবারো দিয়ে দিলাম)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।