আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

টিপাইবাঁধ নিয়ে বাদ-প্রতিবাদ ও ভারত রাষ্ট্রের চরিত্র বিচার - ২

"আকাশে নক্ষত্র দেখে নক্ষত্রের মতন না হয়ে পারিনি আমি / নদী তীরে বসে তার ঢেউয়ের কাঁপন, / বেজেছে আমার বুকে বেদনার মত / ঘাসের হরিৎ রসে ছেয়েছে হৃদয়"। _আহমদ ছফা
আজ ২৮ জুলাই, আহমদ ছফার অষ্টম প্রয়াণ দিবসের প্রথম ভাগে ভারত রাষ্ট্রের চরিত্র বিচারে প্রবৃত্ত হইলাম। আমার প্রথম লেখাটি ছিল মূল লেখার মুখবন্ধ। Click This Link অর্থাৎ পাঠকদের (ব্লগে আমার লেখার পাঠক হাতে গোনা ৮/১০ জন) মুখ বন্ধ রাখাই ছিল উদ্দেশ্য। কিন্তু মনজুরুল হক শুরুতেই প্রশ্ন তুলে আমাকে পেরেশানিতে ফেল দিয়েছেন।

মনজুরুল হক বলেছেন: "আপনার লেখাটি বেশ আগ্রহভরে পড়তে শুরু করেছিলাম। কয়েক বার হোঁচট খাবার পর ভাবলাম পরের পর্ব আসুক। ভারত রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় চরিত্র বিশ্লেষণ জরুরী, তবে এতটা নয় যে তাতেই টিপাইমুখ বাঁধের পক্ষে তাদের অবস্থান পরিষ্কার হবে। " আমি তার জবাবে বলেছি, এবং আমার প্রথম লেখায়ও এটাই বলার চেষ্টা করেছি যে ভারত রাষ্ট্রের চরিত্র বিচার করে টিপাইবাঁধ নিয়ে ভারতের অবস্থান পরিস্কার হবে কিনা, সেটা আমার কাছে যতটা জরুরি তার চেয়ে জরুরি আন্দোলনকারীদের অবস্থান পরিস্কার করা। আপনি যে শত্রুর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন তার চরিত্র আপনার কাছে স্পষ্ট না হলে আপনি লড়াই করবেন কিসের ভিত্তিতে? সেই সঙ্গে এও তো সত্য যে শত্রুকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করার ওপর যুদ্ধের ফল অনেকটাই নির্ভর করে।

শত্রু নির্ধারণ সঠিক হলে মিত্র নির্ধারণও সহজ হয়ে যায়। যাক, এসব কথা থাক, এখন ভারত রাষ্ট্রের চরিত্র বিচারে নামা যাক! পেছন পানে দেখা : ভারতের বুকে পুঁজি গড়ে ওঠার ইতিহাস আজকের ভারতের অবস্থান বোঝার জন্য পেছনের দিকে একটু চাইতে হবে, ভারতের বুকে পুঁজি গড়ে ওঠার ইতিহাসটা জানতে হবে। এমনিতে আমরা সাধারণভাবে জানি যে ভারতের সাথে আরবদের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। সেটা সমুদ্র পথে এবং খাইবারপাস হয়ে স্থল পথেও। আরব বণিকদের হাত হয়ে ভারতের পণ্য, বিশেষত মসলিন, তাঁতসহ বিভিন্ন বস্ত্রসামগ্রী, মশলা ইত্যাদি ইউরোপ পর্যন্ত যেত।

এসব পণ্যের খুব কদর ছিল ইউরোপে। যে কারণে ইউরোপ ভারতে আসার সমুদ্রপথ আবিষ্কারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। এর বাইরে জাভা, সুমাত্রা ইত্যাদি অঞ্চলের সাথেও সমুদ্রপথে ভারতের সওদাগরি বা বাণিজ্য চলত। এসব অনেক আগের কথা। কিন্তু এসব তথ্য থেকে যে বিষয়টি বেরিয়ে আসে তাহল ভারতের বুকে বণিক (merchent capital) পুঁজির বিকাশ ঘটেছিল।

তৎকালীণ ভারতবর্ষে সুদিপুঁজিরও (User capital) বিকাশ ঘটেছিল। ওই সুদিপুঁজি-ওয়ালারা আজকের ব্যাংকের যে আদি রূপ, মহাজনী কারবার এবং মহাজনী পুঁজি (User Bank) তা গড়ে তোলে। খুব সাম্প্রতিক ইতিহাসে, অর্থাৎ ভারতবর্ষ ব্রিটিশের পদানত হওয়ার সময়ে, নবাব সিরাজের আমলে আমরা জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ, রাজভল্লব ইত্যাদি যাদের নাম পাই তারা সবাই তাদের পুঁজি সুদিপুঁজি হিসাবে লগ্নি করত, বণিক পুঁজি হিসাবে বাণিজ্যে খাটাত। এমনকি নবাবরাও নানা প্রয়োজনে তাদের কাছ থেকে সুদের বিনিময়ে টাকা ধার করত। এদের সম্পদের হিসাব অনেক গবেষকই বের করেছেন।

ইতিহাসের ছাত্ররা জানেন যে এরা প্রায় কেউ-ই বাংলা অঞ্চলের ছিলেন না, ছিলেন মাড়োয়ারী বা গুজরাটি। এদের সাথে নবাবের যে দ্বন্দ্ব ছিল তার মূলে ছিল ব্যবসায়-বাণিজ্যে সুবিধা পাওয়া না-পাওয়ার দ্বন্দ্ব। এই সুবিধা লাভের আশাতেই তারা নবাবের বিরুদ্ধে ঘোঁট পাকায় এবং ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানিকে এ আঁতাতে যুক্ত করে। এ চক্রের হাতে এক সময় নবাব পরাজিত হন। কিন্তু জগৎশেঠ-মীরজাফর চক্র আর ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্র আকার ধারণ করে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের প্রভাব খাটিয়ে ইংরেজ বণিকদের ট্যাক্স মওকুফ করিয়ে নেয়। এদিকে টালমাটাল পরিস্থিতির মুখে মীর কাসিম নবাব হলেন। তিনি স্থানীয় বণিকদের স্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট হলেন। চেষ্টা করলেন নবাবী আমলের সুবিধাটুকু যাতে দেশী বণিকরা পায়। অন্ততপক্ষে যাতে ইংরেজের মতো ট্যাক্স মওকুফের সুবিধা যাতে তারা পায়।

কাসিম সে আইন করেছিলেন। কিন্তু তাতে বিরোধ আরো তীব্র আকার ধারণ করে। ইংরেজরা কাসিমকে সরানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে; বক্সারের যুদ্ধে কাসিমের পরাজয় ঘটে। বস্তুতপক্ষে এ পরাজয় মীর কাসিমের ব্যক্তিগত পরাজয় ছিল না, এ ছিল ব্রিটিশ পুঁজির হাতে ভারতীয় পুঁজির চূড়ান্ত পরাজয়। ভারতীয় বণিকী পুঁজি ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনস্ত হয়ে গেল।

যদিও ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির পুঁজির সাথে অন্যান্য ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় পুঁজিরও দ্বন্দ্ব ছিল, তারাও ভারতের বাজারে ঢুকতে চাইছিল। সে প্রসঙ্গ এখানে আলোচ্য নয়। পরাধীন ভারত ঔপনিবেশিক ভারতে কীভাবে পুঁজি গড়ে ওঠেছিল তার বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন গবেষক লেভকভস্কি (A. I. Levkovsky) তার ‘Capitalism in India : Basic Trends and Its Development’ (People Publishing House-1966) বইটিতে। বাংলায় যেমন জগৎশেঠরা ছিল, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও এ ধরনের বণিকী বা সুদি পুঁজির মালিকরা ছিল। যেমন পশ্চিম ভারতে ছিল আরিয়ানজি, নাথজি, সুরাটে আত্মারাম ভকত, আহমেদাবাদে নাগর শেঠ ইত্যাদি।

এবং এদের অনেকেরই ছিল মহাজনী সুদি ব্যবসায়। তাদের ব্যাংকিং ছিল সুবিদিত। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের পর একদিকে ভারত ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে খোদ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের করতলে চলে গেল, অন্যদিকে সিপাহী বিপ্লবে দিল্লীর মুসলমান নবাব ও তার অনুসারী ছোট ছোট মুসলমান রাজা-বাদশাদের সম্পৃক্তা ব্রিটিশদের সাথে মুসলমানদের দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়। ব্রিটিশরা মুসলমানদের সন্দেহের চোখে দেখত, তাদের প্রতি অধিক বিমাতাসূলভ হয়ে উঠল, যার প্রভাব পড়েছে মুসলমান বণিকদের ভাগ্যে। ব্রিটিশের হিন্দু-মুসলমান বিভাজন নীতির ফলে শিকে ছিঁড়ল হিন্দু ব্যবসায়ীদের ভাগ্যে ।

আর এ সময় থেকেই শুরু হয় টাটা-বিড়লা প্রমুখ পুঁজিপতিদের উত্থান। চলবে .............................................. পরের পর্ব Click This Link
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.