আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মর্মঘাতী ভাললাগার গতানুগতিক পরিণতি ...



কিছু কেনাকাটার উদ্দেশ্যে গত শনিবার সকালবেলা এলিফ্যান্ট রোড যাচ্ছিলাম । বাসের টিকেট কেটে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি । সামনে সাত-আট জন হবেন । তাকিয়ে দেখি, আমার দু’জন সামনে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে । পেছনে আছি বলেই তার পেছন দিকটা দেখা যাচ্ছে ।

জীবনে আর কোন মেয়েকে পেছন থেকে দেখে এতটা মুগ্ধ হইনি । আমার এই অতি মুগ্ধতার কারণ তার ‘সুদীঘল কেশরাশি’। একদম হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ছুঁয়েছে । লম্বা চুল আগেও দেখেছি । ছোটবেলায় গ্রামে বেড়াতে গেলে দু-একজন গ্রাম্যবধূ চোখে পড়তো, যাদের চুল থাকতো হাঁটু পর্যন্ত দীর্ঘ, ঘন নারিকেল তেলে চুপসানো ।

এই ঢাকা শহরেও স্কুল জীবনে কত মেয়েকে দেখেছি লম্বা চুলের বেণী দুলিয়ে স্কুল-কলেজে যেতে । তবে এই মেয়েটার চুলগুলো অদ্ভুত অন্য রকম । গত অর্ধ যুগে আধুনিক ঢাকায় নিশ্চিতভাবে এতটা সুন্দর চুলের অধিকারিণী আর কোন মেয়েকে দেখিনি । তার চুল ছিল সযত্নে সুবিন্যস্ত । খোলা, পরিপাটি, রেশমী ।

এতদিন শুধু মেয়েদের চুল কেটে ছোট করতেই দেখেছি । তবে চুল লম্বা রেখেও কাটিকুটি করে সৌন্দর্য যে এতটা ফুটিয়ে তোলা যায়, তার চাক্ষুষ প্রমাণ পেলাম এই প্রথম । অপেক্ষায় আছি একই বাসে উঠবো বলে । প্রচন্ড গরমে খোলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকাই দায় । মিনিট বিশেক পর বাস এলো ।

রীতি মোতাবেক ঢাকা শহরের নিয়মিত পাবলিক বাসগুলোর মতোই তা পরিপূর্ণ । আমি আশাবাদী ছিলাম, এই গরমে পরিপাটি চুল নিয়ে এত্তো ভীড়-বাট্টাওয়ালা বাসে সম্ভবত মেয়েটি উঠবে না । আরো কিছুক্ষণ তার কেশ-দর্শনের সুযোগ পাবো । মেয়েটির হয়তো তাড়া ছিল অথবা আমি অতি আশাবাদী ছিলাম । আমার অনুমান ভুল প্রমাণ করে মেয়েটি বাসে উঠে পড়লো ।

আর সম্মোহিতের মতো আমিও তাকে অনুসরণ করলাম । বাসের ভেতর আমাদের অবস্থানটা ছিল বেশ রোমান্টিক ! আমি দাঁড়ালাম সিঁড়ির ঠিক উপরে – বাম পাশের প্রথম সারির আসনগুলোর সামনে । আর মেয়েটি আসন না পেয়ে দাঁড়িয়েছে একটু নিরাপদ অবস্থানে, ডান পাশের প্রথম সারির আসনগুলোর সামনে, ইন্জিনের ঠিক পেছনে । আমাদের মাঝখানে ছাদ আর মেঝের বিভেদটা সুনিশ্চিত করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে মোটা লোহার রড । আমরা দুজনেই সেই রড ধরে দাঁড়ালাম ।

প্রথমবারের মতো সুযোগ হলো মেয়েটিকে সরাসরি দেখার, মুখোমুখি । অপার মুগ্ধতায় আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম । নিজেকে অনেকটা নাটক বা সিনেমার নায়কের মতো মনে হচ্ছিল, প্রথম দর্শনেই নায়িকার প্রেমে পড়ে যাওয়া । বেশ কয়েকবার চোখাচোখি হলো । চোখে চোখ পড়লেই কখনো আমি সরিয়ে নিচ্ছি ।

কখনো বা সে । কই, আর কারো সাথে তো তার চোখাচোখি হচ্ছে না । আমিও বা কেন বার বার ফিরে তাকাচ্ছি ? এর আগে কারো সাথে একবার চোখাচোখি হলেই চোখ অন্যদিকে সরিয়ে ফেলতাম । তবে আজ কেন এমন হচ্ছে ? কাকরাইল পর্যন্ত আমাদের অবস্থানের কোন পরিবর্তন হয়নি । একটি নিরেট লৌহদন্ড, যার কোন অনুভূতি নেই, তাকে অবলম্বন করে চারটে হাত ।

ইস্‌, লোহার এই রডটার যদি স্পন্দন থাকতো ! কোন এক স্পন্দনে তা নিশ্চয়ই পৌছে দিত আমার ভাল লাগার কথা । প্রথাবিরুদ্ধ চালক অতি সতর্কতায় কদাচিত হার্ডব্রেক কষছেন, আর তার দরুণ মাঝেমধ্যে ঘটছে অনিচ্ছাকৃত স্পর্শ । তারপর স্বাভাবিকভাবেই বিব্রতকর চোখাচোখি । রডটাকে আঁকড়ে ধরে রাখা তার দুহাতের দিকে তাকালাম । ডানহাতের চতুর্থ আঙ্গুলে চমৎকার একটি আংটি শোভা পাচ্ছে ।

মনটা দমে গেল । ইতিমধ্যে আধা-ঘন্টা সময় পার হয়েছে । কিন্তু মনে হচ্ছে মাত্র কয়েক সেকেন্ড । আর কপাল এতোটাই ভাল যে আজ রাস্তায় একটুও জ্যাম নেই !! কাকরাইলে এসে তার বসার জায়গা হলো । ডানদিকের তিন নম্বর সারির দুই নম্বর আসন ।

আমি তখনো সে রড ধরে দাঁড়িয়ে । তার স্পর্শের উষ্ণতার শেষটুকু প্রাপ্য বুঝে নিচ্ছি আর তার চাহুনিগুলোর মর্মার্থ উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছি । তাকিয়ে দেখি, কার সাথে যেন হাসিমুখে মোবাইলে কথা বলছে । কেন যেন আবারো মনটা খারাপ হয়ে গেল । শাহবাগ এসে আমিও বসার জায়গা পেলাম ।

তার এক সারি আগে । দেখতে পাচ্ছি না, তবে বসে বসে ভাবছি নামার পর কথা বলবো কিনা? সিদ্ধান্ত নিলাম একই স্ট্যান্ডে নামবো । আমার মূল গন্তব্য এলিফ্যান্ট রোড পার হয়ে যাচ্ছি । আমার ধারণা ছিল, মেয়েটি হয়তো নিউমার্কেট বা ইডেন কলেজ এলাকায় এসে নামবে । কিন্তু তার গন্তব্য শেষ হলো এলিফ্যান্ট রোডের শেষ মাথায় এসে ।

অতি দ্রূততায় বাস থেকে নামলো । সম্বিত ফিরে পেয়ে আমিও নেমে পড়লাম । অধিক দ্রুততায় সে উঠে পড়লো ওভারব্রিজে, গন্তব্য হয়তো সিটি কলেজ বা ধানমন্ডি । আমিও উঠলাম ওভারব্রিজে । কি করা উচিৎ ? ছুটে গিয়ে থামাবো ? কথা বলবো ? “আপনার ঘন কালো রেশমী চুলে আমি তো আমার মনটাকে হারিয়ে ফেলেছি !!” পাবলিক প্লেসে আবেগঘন দৃশ্যের অবতারণা !!! আমার দুর্বল হৃদয় অতটা সাহসী হয়ে উঠতে পারেনি ।

কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের মতো আবারো্ পরিস্থিতি ছেড়ে দিলাম নিয়তির উপর । কতবারই তো চোখে চোখ পড়েছে, এর সবই কি ছিল স্বাভাবিক দর্শন ? একবারো কি দৃষ্টির পেছনে তার ভালোলাগার অনুভুতি ছিল না ? যদি একবারো তার দৃষ্টিতে ভালোলাগার অনুরণন থেকে থাকে, তবে অবশ্যই সে ফিরে তাকাবে । আমি সেটা স্রষ্টার সম্মতি হিসেবেই ভেবে নেব । ছুটে যেয়ে বলবো আমার মুগ্ধতার কথা, আমার ভাললাগার কথা । স্রষ্টা রীতিবিরুদ্ধ হয়ে সম্মতি দিলেন না ।

নাহ্‌, মেয়েটি আর তাকায়নি । হনহন করে নেমে রিকসায় চড়ে রাইফেলস্‌ স্কয়ারের দিকে চলে গেল । আর আমি ? ফিরে চললাম আমার গন্তব্যের দিকে । আপন মনে নিজেকেই নিজে উপহাস করলাম । সবকিছু হয়তো নিয়তির উপর ছেড়ে দেয়া উচিত নয় ।

জানি । তবু কেন যেন পারি না কারো পথ আটকাতে । এটা কি কাপুরুষতা, নাকি নিরর্থক অহংবোধ, নাকি বাস্তবতার পিছুটানে গতানুগতিক ধারায় আটকে যাওয়া ? অথচ ঘটনাটির যবানিকাপাত এমনটাও হতে পারতো – বাস থেকে নেমেই মেয়েটি ইতস্তত সামনে পা বাড়ালো । মনটা যেন পেছনে কোথায়ও ফেলে এসেছে । হঠাৎ পথচলা থামিয়ে ফিরে তাকালো পেছনে ।

যে আমি তার ফিরে তাকানোর প্রত্যাশায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, হাসি মুখে এগিয়ে গেলাম তার পানে । মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রথম কথা, “নারীর এমন অনিন্দ্য সুন্দর চুল আমি জীবনেও দেখিনি, সেজন্যেই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বারবার তাকাচ্ছিলাম । “ - “হুম, সেটা তো আপনার তাকানো দেখেই বোঝা যাচ্ছিল । আপনি অবাক বিশ্ময়ে চেয়েছিলেন”। " - “কিন্তু আমি মনে হয় বিষন্ন দৃষ্টিতেও তাকিয়ে ছিলাম ।

বিশেষত আপনার অনামিকায় ওই আংটিটা দেখার পর । “ - “ওহ, এটা !!! এটা হাতে দেয়ার মূল কারণ আশপাশের সবাইকে বিভ্রান্ত করা । ইদানিং যেখানেই যাই, আশপাশের ছেলেগুলো যেরকম বিরক্ত করে !!” - “আমি কি আপনাকে বিরক্ত করছি ?” - “মোটেও না । আপনি কিন্ত এখনো আপনার নামটাই বলেননি ?” - “আমি অপার্থিব । আপনি ?”


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.