হাঁটা পথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে হে সভ্যতা। আমরা সাত ভাই চম্পা মাতৃকাচিহ্ন কপালে দঁড়িয়েছি এসে _এই বিপাকে, পরিণামে। আমরা কথা বলি আর আমাদের মা আজো লতাপাতা খায়।
যে তথ্যের ভিত্তিতে টিপাই বাঁধ হলে পানি বাড়বে আবার বন্যাও কমবে বলে দাবি করছেন, সেই তথ্যের উৎস ফ্যাপ নামের গণধিকৃত ও সরকারি ভাবে বাতিল ঘোষিত প্রকল্প। এদের পানি বিষয়ক চিন্তাটা প্রকৃতির ওপর মাস্তানির সমর্থক।
এবং এটা যারা করে তারা মানুষকে দমনের পথই গ্রহণ করে। প্রকৃতি বিনাশী পানি ব্যবস্থাপনা তাই জনবিরোধী রাজনীতিরই ভায়রা ভাই।
এখানে অর্থনীতিবিদ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ড. স্বপন আদনানের লেখার দ্বিতীয় অংশ তুলে দিচ্ছি। তিনি এবং আরো অনেকে মিলে ফ্যাপ প্রকল্পকে বাতিল করায় আন্দোলনে ছিলেন এবং গবেষণাও করেছেন।
আগের কিস্তি: Click This Link
মোদ্দা কথা, আমার প্রস্তাবটা এই যে, নদী নিয়ন্ত্রণ ও পানি ব্যবস্থাপনার বর্তমান পুঁজি নির্ভর ধরনটাই প্রকৃতিবিনাশী।
আজ যারা আমাদের দেশের টিপাইমুখ বাঁধের গুণগান গাইছেন তারাই কিন্তু এদেশের জলদেহের সর্বনাশ ঘটিয়ে কখনো অতি খরা কখনো অতি বন্যা আর আর্সেনিকসহ যাবতীয় বিপর্যয়ের হোতা। তাদের দৃষ্টিভঙ্গির অপরাধমূলক দিকটি না বুঝলে আজ আমরা টিপাইয়ের ক্ষতিও পুরো বুঝতে পারবো না।
আজ দিচ্ছি স্বপন আদনানের প্রবন্ধের দ্বিতীয় কিস্তি। তাঁর লেখা এখানেই শেষ কিন্তু সিরিজটি চলতে থাকবে।
বন্যা নিয়ন্ত্রণ: ইতিহাস না পরিহাস ২
এদেশে বন্যানিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম প্রতিরোধের ইতিহাস এর আগে থেকে শুরু হলেও ১৯৬৪ সালের মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নের সময় থেকেই এর ব্যাপক নিদর্শন মেলে।
নানা কারণে এসব প্রকল্পের কাজ করার পদ্ধতি সাধারণ মানুষকে হতাশ করে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। যেমন, তৈরি হওয়া বাঁধের রক্ষণাবেক্ষণ কাজ। এজন্য যে কমিটি গড়ে দেওয়া হতো, তাতে দেখা যেত যে, প্রভাবশালীদেরই প্রাধান্য; ভূমিহীন এবং প্রান্তিক মানুষজনের কথা বলার কোনো সুযোগই নেই। এ ধরনের কাজের নিয়ন্ত্রণ মতা (যথা স্লুইস গেট খোলা বা বন্ধ করার অধিকার) নিয়ে বিবদমান গোষ্ঠীর মধ্যে সহিংস সংঘাতের নিদর্শনও পাওয়া গেছে। অসন্তোষ লতিয়ে উঠেছে বাঁধের জন্য জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া নিয়ে।
প্রাথমিকভাবে, বাঁধের জমির জন্য বহু লোকের বাড়িঘর জমিজিরাত তো গেছেই। এরপরও জমি অধিগ্রহণের
প্রক্রিয়া চলমান ছিল, যেহেতু নদীভাঙনের কারণে প্রতিনিয়ত বাঁধের সংস্কার করতে হয়েছে এবং এজন্য বিপুল পরিমাণ মাটির প্রয়োজন হয়েছে। তাছাড়া জমি অধিগ্রহণের জন্য যে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ছিল তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অত্যল্প এবং সেটাও ঘুষ না দিয়ে পাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। আর বাঁধের গড়বড় হওয়ার কারণে যেসব জমি জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে, কর্তৃপক্ষ সেসবের ব্যাপারে স্রেফ নির্বিকার ভূমিকা পালন করেছেন। এসব জনস্বার্থবিরোধী প্রক্রিয়াই মূলত ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীকে
রাষ্ট্রযন্ত্রের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
বন্যানিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে নানাভাবে। এমনকি যেখানে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রকাশের রাস্তা খুঁজে পায়নি, সেখানেও এসব দক্ষযজ্ঞে প্রকল্প এলাকার মানুষের অসহযোগ ছিল লক্ষণীয়। ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছেও যখন ভোগান্তির শেষ হয়নি, তখনই মূলত মানুষ সক্রিয় প্রতিরোধে শামিল হয়ে পড়েছে, কারো জন্য অপেক্ষা না করে।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজদৃষ্ট প্রতিরোধের ধরনটি ছিল, খুব ক্রিটিক্যাল কিছু পয়েন্টে বাঁধ কেটে দেওয়া, যাতে করে ভুক্তভোগী এলাকাবাসীর ঘরবাড়ি ও জমিজমা থেকে জলাবদ্ধতা দূর হয়। সরকারি প্রশাসন ও তার নথিপত্রে এরকম অনুমোদনহীন বাঁধ কাটাকে ‘পাবলিক কাট’ হিসেবে উলেল্গখ করে একে আইন-শৃগ্ধখলার পরিপন্থী বলে অভিহিত করা হয়েছে।
কিন্তু
সরকার এরকম প্রতিকূল অবস্থান নেওয়া সত্ত্বেও এই প্রতিরোধ প্রক্রিয়াকে বন্ধ করতে পারেনি এবং প্রায় প্রতিবছরই দেশের বিভিন্ন বন্যা-উপদ্রুত অঞ্চলে এরকম গণউদ্যোগে বাঁধ কেটে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বলা বাহুল্য, এই প্রতিরোধ কার্যক্রম সাধারণত পরিচালিত হয়েছে গোপনে, সরকারি কর্তৃপরে দৃষ্টির আড়ালে, কখনো রাতের অন্ধকারে। আবার, প্রকাশ্য প্রতিরোধের ঘটনাও কিন্তু বিরল নয়।
১৯৯০ সালের বিল ডাকাতিয়ার ঘটনাটি অনেকেরই জানা। জমির লবণাক্ততা কমিয়ে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর প্রতিশ্রুতিসহ এখানে মাস্টার প্ল্যানের আওতায় পোল্ডার তৈরি করা হয়েছিল।
সময়ান্তরে দেখা গেল যে, কারিগরি ক্রুটির কারণে তাতে লাভ হওয়া তো দূরের কথা, উল্টো ৪০
হাজার একর গ্রামাঞ্চল জুড়ে ব্যাপক জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে স্থানীয় মানুষ ‘বিল ডাকাতিয়া অ্যাকশন কমিটি’ গঠন করে এবং ১৯৯০ সালের ১৮ আগস্ট এক মহাসমাবেশের ডাক দেয়। সরকার এই মহাসমাবেশের দিন সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু সেই কারফিউ উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ ওই মহাসমাবেশে শামিল হয় এবং পোল্ডারের বাঁধ অচিরেই কেটে ফেলার প্রকাশ্য ঘোষণাকে সমর্থন জানায়। বেগতিক দেখে
প্রশাসন পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেয়।
ফ্যাপের বিভিন্ন প্রজেক্টেও এরকম স্বতঃম্ফূর্ত প্রতিরোধের ঘটনা ঘটেছে। পরবর্তী সময়ে জামালপুর এবং টাঙ্গাইল ফ্যাপ প্রজেক্টের বিরুদ্ধে এলাকাবাসী বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করেছে। কখনো কখনো স্থানীয় বা বাইরের সহায়ক সংস্থাগুলো এসে প্রতিবাদে শামিল হয়েছে।
এসব নানান ঘাত-প্রতিঘাত পার হয়ে ২০০০ সালের জাতীয় পানি ব্যবস্থাপনা নীতির খসড়ায় দেখা গেল, সাবেক রীতির বাইরে পা দিচ্ছেন দেশি-বিদেশি নীতিনির্ধারক ও কৌশলপ্রণেতারা। এতকাল বাংলাদেশের উন্নয়নচিন্তায় বন্যাকে ‘সমস্যা’ আর ‘বন্যানিয়ন্ত্রণ’কে এর ‘সমাধান’ ভাবা হয়েছে।
চিন্তার এ ধরনের সরলীকরণের খেসারত হাড়ে হাড়ে দিচ্ছে আমাদের ছোট-বড় নদ-নদীগুলো আর তার সঙ্গে জীবিকার প্রয়োজনে জড়িত জনগোষ্ঠী। মানুষের জীবনে পানির যে কত রকমের ভূমিকা আছে, সেসবকে আমলই দেননি সরকার ও কোম্পানি নিযুক্ত বন্যা-বিশেষজ্ঞরা। নদ-নদীর স্বাভাবিক বন্যা যে এদেশের পরিবেশের ভারসাম্য টিকিয়ে রাখার জন্য বা মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণিকুলের জীবনধারণের বেলায় অপরিহার্য ভূমিকা রাখে, সেকথা ভুলেই গিয়েছিলেন তারা। শুধু ভুলে যাওয়া হলেও কথা ছিল। প্রকল্পের ভেতরে বন্যানিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে যে কৃষি উৎপাদন কমে গেছে, পরিবেশের অবনতি ঘটছে, এসব তথ্য পর্যন্ত সচেতনভাবে গোপন করা হয়েছে।
বন্যা ‘নিয়ন্ত্রণ’ করতে গিয়ে প্রায়ই সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতার। এতে করে অবনতি হয়েছে পরিবেশের, ক্ষতি হয়েছে অর্থনৈতিকভাবে, বিবাদ লেগেছে মানুষে মানুষে, জনগণকে ‘পাবলিক কাট’ করতে হয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিকূলতা সত্ত্বেও। এসব ঘটনা এবং তার
পেছনের কারণাবলি দেশ-বিদেশের প্রতিষ্ঠিত বন্যা-বিশেষজ্ঞ বা নীতিনির্ধারকদের জানা ছিল না তা ভাবা কঠিন। কিন্তু বহুকাল পর্যন্ত এই অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের কোনো প্রভাব পড়েনি সরকার বা দাতাগোষ্ঠীর বন্যাসংক্রান্ত ধ্যান-ধারণায়। তবে, অবশেষে পরিবর্তন আসে ২০০০ সালের জাতীয় পানি ব্যবস্থাপনা নীতিমালায়।
এর খসড়ায় স্পষ্ট করে ঘোষণা করা হয়েছে যে, শহর এবং উপকূলীয় এলাকা ছাড়া গ্রামাঞ্চলে নতুন করে আর বাঁধ নির্মাণ করা হবে না। সেই সঙ্গে পুরনো বাঁধ-
পোল্ডারগুলোও মূল্যায়নের ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমে পরিত্যক্ত হবে।
এই নীতির বাস্তবায়ন হলে প্রশান্ত মহলানবীশের আত্মা হয়তো শান্তি পাবে, কিন্তু বিগত অর্ধশতাব্দী ধরে এই গাঙ্গেয় বদ্বীপের আনাচে-কানাচে যে কোটি কোটি ডলারের বাঁধ তৈরি করা হয়েছে, সেগুলোর কী হবে? পরিত্যক্ত সমাধিক্ষেত্রের মতোই কি সেগুলো অতীতের বন্যানিয়ন্ত্রণ বিভ্রান্তির সাক্ষী হয়ে থাকবে?
আবার, এই ঘোষিত নীতি-পরিবর্তন যে সত্যি-সত্যিই
বাস্তবায়িত হবে তার ওপর ভরসা করাও কঠিন। বন্যানিয়ন্ত্রণের
নির্মাণ কাজে যে কোটি টাকার খেলা ও কারচুপির পরিসর আছে
তার প্রলোভন এতই শক্তিশালী যে, এই নতুন নীতিমালাকে
বদলে দেওয়া বা নিষ্ক্রিয় করে ফেলার সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে
দেওয়া যায় না।
লেখক : গবেষক ও অধ্যাপক, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর
প্রকৃতির নিয়মকে যখন মানুষের সমাজের নিয়ম লংঘন করে তখন মানুষ, মানুষের সমাজ, মানুষের প্রবৃত্তিসহ গোটা জগতটাই বিকৃতির কবলে পড়ে।
প্রকৃতির আকার সম্পর্কে বোধ না থাকলে বিকার আসবেই। দৃষ্টিভঙ্গিটা আগে পাল্টাতে হবে, তারপর বাকিসব হিসেবনিকেশ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।