অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা
৫ই নভেম্বর ১৯৭৫, নয়া দিল্লী
নিহত শেখ মুজিবর রহমানের ৪ ঘনিষ্ট সহযোগীকে জেলখানায় হত্যা করা হয়েছে। ঢাকা থেকে পালিয়ে আসা একজন সামরিক কর্মকর্তা বলেছেন, খন্দকার মোশতাক আহমেদকে কার্যত বন্দী করে রাখা হয়েছে, নতুন সেনা প্রধান তাকে বাংলাদেশের বাইরে যেতে বাধা দিচ্ছে।
শেখ মুজিব হত্যাকান্ডের পর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলী এবং প্রাক্তন সরাষ্ট্রমন্ত্রী কামরুজ্জামানকে দুর্নীতির অভিযোগে আটক করা হয়।
গত মঙ্গলবার খালেদ মোশাররফ জিয়াউর রহমানকে পদচ্যুত করে নিজেকে সেনাপ্রধান হিসেবে ঘোষণা দেন, এবং চারজন মন্ত্রী পদত্যাগ করেন। তাদের দুজনকে দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য গ্রেফতার করা হয়েছে।
সৈয়দ ফারুক রহমান, এবং এই ক্যুয়ের আর দুজন গুরুত্বপূর্ণ অফিসারসহ ২৬জন সেনা কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবার ব্যাংককে উপস্থিত হয়েছেন। তারা বলেছেন আরও রক্তপাত এড়ানোর আশংকায় তাদের সোমবার রাতেই স্বদেশ ত্যাগের অনুমতি দেওয়া হয়।
এক সাক্ষাৎকারে সৈয়দ ফারুক রহমান বলেন এই পাল্টা ক্যুয়ের ঘটনা ঘটিয়েছে তারাই যারা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গণতান্ত্রিক উত্থান পছন্দ করে নি। কর্নেল ফারুকের সাথে ব্যাংককে উপস্থিত অন্য দুজন গুরুত্বপূর্ণ সেনা কর্মকর্তা হলেন – লে. কর্নেল কে এ রশিদ এবং লে. কর্নেল শরিফুল হক।
থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে এই ২৬জন সেনাকর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারদের ২ সপ্তাহ ব্যাংককে থাকবার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
৫ই নভেম্বর, ১৯৭৫, ঢাকা শাহবাগ
এলিফ্যান্ট রোডের কর্নেল তাহেরের বড় ভাইয়ের বাসায় হাবিলদার আব্দুল হাই মজুমদারসহ অন্যান্য বিক্ষুব্ধ সেনাসদস্যদের একটি দল কর্নেল তাহেরের কাছে এই সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে তাদের করণীয় নিয়ে জানতে চান।
কর্নেল তাহের তাদের আশ্বস্ত করেন সিপাহী জনতা বিপ্লব হবে, মেজর জিয়াউর রহমানকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে উদ্ধার করে আনা হবে। সে সময়ে উপস্থিত ছিলেন সিরাজুল আলম খান, তিনি তখন জাসদের তাত্বিক নেতা, সেই সাথে সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন হাসানুল হক ইনু। আব্দুর রব এবং মেজর জলিল তখন জেলখানায়।
এই আলোচনা চলবার সময়ই সিরাজুল আলম খান উধাও হয়ে যান।
নয়া দিল্লী থেকে ৬ই নভেম্বর ১৯৭৫ ভোরে জানানো হয় সেনাবাহিনীর উর্ধতম কর্মকর্তাগণ খন্দকার মোশতাক আহমেদ বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছেন এবং বিচারপতি এ এম সায়েম নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহন করেছেন।
তবে হাবিলদার আব্দুল হাই মজুমদারের ভাষ্যানুসারে ৫ই নভেম্বর সারা দিনই ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় সিপাহী জনতা বিপ্লবের আহ্বান সম্বলিত লিফলেট ছড়ানো হয়। এবং এ কাজে সক্রিয় অংশগ্রহন করেছিলেন তারাই।
পূর্বসিদ্ধান্ত মোতাবেক তারা ৬ই নভেম্বর বিকেলে মিলিত হন এলিফেন্ট রোডে কর্নেল আবু তাহেরের ভাইয়ের বাসায়। সেখান থেকে তারা উপস্থিত হন শাহবাগস্থ রেডিও বাংলাদেশের প্রধান সম্প্রচার কেন্দ্রে।
রাত ১২টার পরে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা হয়। এবং তিনি সিপাহীদের ১২ ফা দাবি শুনেন এবং তাতে নিজের সম্মতি প্রদান করেন।
৮ই নভেম্বর বিপ্লবে মদত দানের জন্য সিরাজুলআলম খানকে আটক করা হয়, পরবর্তীতে তিনি মুক্তি পান। মেজর জলিল এবং আব্দুর রবকে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী জিয়া মুক্তি প্রদান করেন ৮ই নভেম্বর সকালেই।
৬ই নভেম্বর নয়া দিল্লির বরাতে ভার্জিন আইল্যান্ড ডেইলিতে সংবাদ ছাপা হয়, সেনাবাহিনী এবং বেসামরিক প্রশাসনে ব্যপকরদবদল হয়েছে।
চারজন মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন এবং তাদের মধ্যে দুজনকে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্ণীতির জন্য আটক করা হয়েছে। এটা ছাড়া খন্দকার মোশতাক আহমেদের সরকারের অবস্থা বেশ ভালো।
ঠিক একই দিনে পিটসবার্গ নিউজেই নয়া দিল্লীর বরাতে বলা হয়েছে ৬ই নভেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমেদ পদত্যাগ করেছেন।
জেলখানায় ৪ জাতীয় নেতা হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা শহরে হরতাল পালিত হয় এবং ৫০০০ ছাত্র খন্দকার মোশতাকের পদত্যাগের দাবিতে মৌন মিছিল করে।
দ্যা লেজার-এ ৯ই নভেম্বর ১৯৭৫ একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়, বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে শুধুই ব্যর্থতা শিরোনামে-
সেখানে বলা হয়, ৪বছর আগে ইউ এলেক্সি জনসন বলেছিলেন বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি, ৪ বছর পরে পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয় নি।
মানুষের পেটে ভাত নেই, তবু প্রতিদিন বাড়ছে ১০ হাজার মানুষ,দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতির কারণে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবর রহমানের সাথে সাধারণ জনগণের দুরত্ব বেড়েছে এবং তিনি মিলিটারি ক্যুতে পরিবার পরিজনসহ নিহত হয়েছেন।
৭ই নভেম্বরের সিপাহী বিপ্লবের ঘটনায় দেশটির পররাষ্ট্র নীতিতে ব্যপক প্রভাব ফেলতে পারে, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ক্ষমতা গ্রহনের পর থেকেই ভারতের রাজনৈতিক বলয় থেকে দেশটিকে সরিয়ে আনবার চেষ্টা করছেন এবং পাকিস্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হয়েছেন । তিনি দেশটির সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনেও আগ্রহী ছিলেন।
তবে নভেম্বরের ৯ তারিখ থেকেই হাওয়া বদলাতে থাকে এবং কর্নেল তাহের এবং তার অন্যান্য সাথীদের আটক করা হয়।
তাহের তখন সামরিক বাহিনীর কোনো সদস্য নন, তিনি সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক নেতা হয়ে উঠেছেন তখন।
অবশ্য কর্নেল তাহেরের এই নেতৃত্বসুলভ গুণ নতুন কিছু নয়, ৮ই নভেম্বর ১৯৭১ ভারতের হাসপাতাল থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে পাঠানো চিঠিতে তিনি স্পষ্ট বলেছিলেন-
জনসাধারণের সাথে মুক্তিযোদ্ধার সম্পর্ক সম্পর্কে তোমাদের কোনো ধারণা নেই। তোমরা স্বাধীন বাংলার জন্য যুদ্ধ করছো, কাজেই তোমরা ভাবো জনসাধারণের কাছ থেকে যা খুশী তাই নিতে পারবে। …… এই সমর্থন তোমাদের অনেককেই নষ্ট করতে পারে। জনসাধারণের কাছ থেকে তোমরা যদি টাকা পয়সা, খাবার আশ্রয় ছিনিয়ে নাও তবে এ জনসমর্থন নষ্ট হয়ে যাবে এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধ করবার কোনো উপায় থাকবে না।
তোমরা যদি কোনো কৃষকের বাসায় আশ্রয় নাও তবে তোমরা তার সাথে একাত্ম হওয়ার চেষ্টা করো,
তোমাদের মধ্য যদি কেউ জুলুম করে, মেয়েদের শালীনতা নষ্ট করে তবে জনসাধারণের দ্বারা বিচার করে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করো।
১৯৭২ সালে তাহের সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন এবং জাসদের সাথে সার্বক্ষণিক যুক্ত হয়ে যান। বিপ্লবী কিংবা মহান মুক্তিযোদ্ধার বদলে তার লেখা এবং চরিত্র দেখে তাকে আমার দ্রষ্টাপুরুষ মনে হয়, তার নিজস্ব একটা স্বদেশকল্পনা ছিলো এবং সেটা শুধুমাত্র দিবাস্বপ্নের ঘোর নয়, বরং প্রাকটিক্যালিটি সেন্স থেকে সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর একটা পন্থাও তার ভাবনায় ছিলো। সে ভাবনা আমার কাছে যতই হাস্যকর কিংবা উদ্ভট মনে হোক না কেনো, অন্তত বাংলাদেশকে পরিবর্তিত করবার এখটা লক্ষ্য এবং সে লক্ষ্য কিভাবে পৌঁছানো যাবে সে সম্পর্কে একটা রুপরেখা তার তৈরি ছিলো।
তার ভাষ্য
তার পদত্যাগ পত্রের ভাষা এবং পদত্যাগের কারণ পড়ে আমি নিজে পুনরায় চিন্তিত হলাম। ভারতের সহায়তা নেওয়ায় সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধাদের স্পষ্ট আপত্তি ছিলো, তারা ভারতকে এই সংগ্রামের অংশভুক্ত করতে চায় নি কোনো সময়ই।
তাহেরের ভাষ্য সম্মুখ সমরে বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে কোণঠাসা করে ফেলবার পরেও ভারত বিজয়ের গৌরব ছিনিয়ে নিতে পেরেছে এটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দৈনতা। তাদের কারণেই এমনটা ঘটা সম্ভব হয়েছে।
১৯৭২ সালে যখন শেখ মুজিবর রহমান তাহেরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে অনুরোধ করেন তখনই তাহের জানতে পারেন শেখ মুজিবকে উৎখাত করবার ষড়যন্ত্র চলছে, তবে সেই ষড়যন্ত্রের হোতাদের আটক না করে তাকে পদচ্যুতি করা হয়
পদত্যাগের কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন- আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিলাম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে নয়, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, আমি এটাকে আমার জন্য অত্যন্ত সম্মানজনক বলে মনে করি। জনগণের স্বার্থই আমার কাছে সর্বোচ্চ। আমি সেনাবাহিনী ত্যাগ করে জনসাধারণের কাছেই ফিরে যেতে চাই, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার চারপাশে জড়ো হয়েছিলো।
আমি তাদের বলবো কি ধরণের বিপদ তাদের দিকে ধেয়ে আসছে।
সে বিপদ অবশ্য কাটানো যায় নি। বাংলাদেশ সেই বিপদ আর বিপর্জয় মাথায় নিয়েই পার করলো বিজয়ের ৩৮ বছর। আজ বিকেলে কর্নেল তাহেরের মৃত্য দিবসে আনোয়ার কবিরের সেনাবাহিনীতে গণহত্যা শিরোণামের ডিভিডির উদ্বোধন করা হবে। সেখানে ১৯৭৫এর অসংখ্য ঘটনার বয়ান আছে।
সাধারণ মানুষ ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত হোক। সেটাই হয়তো সবচেয়ে বড় পাওয়া।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।