আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নোটস্ : শাহীন আখতারের একটি গল্প



শাহীন আখতারের পুরো গল্পটাই তুলে দিতে ইচ্ছা করে, এমনই গল্প এক ‘মধুপূর্ণিমার রাতের গল্প’। অনেক গল্পই তাঁর পড়া হয়ে গেছে দু-তিনদিনে, বলতে পারব না কোনটি সেরা বলে বিবেচিত হতে পারে, কিন্তু এই গল্প ফিরে-ফিরেই টেনেছে আমাকে। ইসমত এসেছে তার অনেকদিনের বান্ধবীর বাসায় এক সন্ধ্যাবেলা। গল্প হচ্ছে দুজনে। ‘আমি যখন দোলনা ছেড়ে উঠি উঠি করছি, ঠিক তখন পাশের নির্মীয়মাণ ভবনের বড় বড় খাম্বার পেছন থেকে লালচে মস্ত বড় চাঁদখানা উঁকি দেয়।

ইসমত নড়েচড়ে বসে। মানে, যা বলার জন্য কাউকে কিছু না জানিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে, এবার চাঁদের আলোয় হয়তো বলবে। ’ ইসমত গল্প বলে। এলোমেলো গল্প। আলোচনাও হয়।

‘ছেঁড়া ছেঁড়া। আগের মতো জমছে না। যা যায়, চিরদিনের মতোই যায়। ’ গ্রামের নারীপুরুষের কথা হয়। কারা বেশি বোকা বা চালাক।

গল্পটি যিনি লিখছেন তিনি বলেন, ‘আমরাই বোকা। আমার গলার স্বর নিজের কাছেই নরম শোনায়। ’ কারা তালিম দিতে পারে? শহরের লোকেরা, না গাঁয়ের? কারা বেশি সভ্য? ইসমত বলে, ‘কে যে সভ্য আর কে যে অসভ্য! নিজের মায়ের পেটের ভাই। সাত বচ্ছর স্পেনে কাটিয়ে দেশে ফিরেছে। ডিভোর্সি বোনকে বলে, বেশ্যা।

খানকি। ঘুমের মধ্যে নাক ডাকে বলে কেউ স্বামীর ঘর থেকে চলে আসে, এক খানকি ছাড়া! -তুমি নিজের কানে শুনেছ? -এ এক সমস্যা। সবাই ডাক্তারের মতো জেরা করে। ’ ইসমত নাকি ভুগেছে সিজোফ্রেনিয়ায়। তাই বোধহয় ডাক্তারের জেরা করার কথাটা উঠল।

আমি-আমি করে যিনি গল্পটি বলছেন তাঁর মাথায় এটি গেঁথে যায়। গল্প চলে। দুঃখেরই গল্প স্বভাবত। মেয়েদের কাহিনী সুখের কীভাবে হয়? গল্পে যিনি ‘আমি’ তিনি বলে ওঠেন, ‘চাঁদের আলোয় নিজেদের ছায়া দুটিকে ভুতুড়ে লাগে। আবার আমার পালাতে ইচ্ছে করে...’ এ এমন এক সময়ের গল্প ‘যখন দেশে ধর্ষণ নাই, এসিড মারা নাই, হোমিসাইড---কিচ্ছু নাই।

রাস্তার ছেলেগুলোও মনে হয় মেয়েদের বিরক্ত করতে ভুলে গেছে। ’ এমন অবস্থাও আমাদের দেশে কখনো কখনো অল্প কিছু সময়ের জন্য ছিল বইকি, ২০০৭ সালের অক্টোবরে লেখা হয়েছে গল্পটি, কিন্তু সে সময়ের অবস্থাও কেমন ছিল দেখুন : ‘ঘরের বগলের মসজিদে তারাবির নামাজ তখনও শেষ হয় নাই। জ্যোৎস্নারাত বলেই হয়তো ঠিক করি---হাঁটাও হবে, ইসমতকে বড় রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি। ...বাসায় গিয়ে তোপের মুখে পড়তে হবে। দেখো, আমার বয়স পঁয়তাল্লিশ, তোমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে---রাত দশটা পর্যন্ত আমি কোথায় কার কাছে ছিলাম?...আমার গায়ে ঘরে-পড়ার কাপড়...আমগাছের তলায় আলো-আঁধারে আমরা গা-ঢাকা দিয়ে দাঁড়াই।

...দুজন আরোহীসমেত একটি মোটরবাইক গায়ের ওপর পড়তে পড়তে সুড়ৎ করে বেরিয়ে যায়। আমি ওর হাত চেপে ধরি---দেখলা, কী বলল? -না তো, কী বলেছে? ইসমত আমার দিকে অবাক হয়ে তাকায়। -আমরা ওদের সঙ্গে যাব কি না জিগ্যাসা করছে। -আমাদের বোধহয় রাস্তার মিশকিন ভেবেছে। -না, ফ্লোটিং বেশ্যা।

মেয়ে হান্টিংয়ে বেরিয়েছে রাস্কেলগুলা। বাসায় এসে ঘটনাটা বলতেই শ্রোতার চক্ষু চড়কগাছ---তুমি নিজের কানে শুনেছ? কী মুশকিল। সবাই ডাক্তারের মতো জেরা করে। ’ আলোচনা করার কিচ্ছু নাই। গল্পটাই পড়ার।

শাহীনের গল্প এমন যেন যা-ই ঘটছে তাঁর জীবনে তা-ই লিখছেন তিনি, যেমন যেমন অনুভব করছেন তিনি লিখছেন, আর তা-ই হয়ে উঠেছে অনুপম সাহিত্য। ছোট এক গল্পে যেন উপন্যাস লেখা হয়েছে একটি। শহর ও গ্রামের নারীর অবস্থানটি, লোকসংস্কৃতির ছবি ফুটে উঠেছে স্পষ্ট কিছু সংলাপে, কিছু গানের কথায়। গল্প পড়তে-পড়তে মনে হয় শাহীন লিখতে চাইলেই লিখতে পারেন, শুধু কম্পিউটারে বসে গেলেই হয়, এমন অনায়াস, এমন স্বাচ্ছন্দ্য তাঁর লেখায়। সবশেষে, গল্পে যিনি ‘আমি’, (যিনি এমনই বিষণ্নতায় ভোগেন যে বোঝেন না কখন বলে ওঠেন, ‘আবার আমার পালাতে ইচ্ছে করে...’) তিনি অস্ফুটে বা মনে মনে বলে ফেলেন, ‘সবাই ডাক্তারের মতো জেরা করে’ আর গল্পটি যেন সংক্রামিত হয়ে পড়ে সিজোফ্রেনিয়ায়, বা, ভিন্ন উচ্চারণমতো, স্কিটশোফ্রেনিয়ায়।

আলোচনা কীভাবে করব? বড় বিষণ্ন লাগে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।