হাঁটা পথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে হে সভ্যতা। আমরা সাত ভাই চম্পা মাতৃকাচিহ্ন কপালে দঁড়িয়েছি এসে _এই বিপাকে, পরিণামে। আমরা কথা বলি আর আমাদের মা আজো লতাপাতা খায়।
পানি ও সার্বভৌমত্বের পয়লা কোরবানী
বলি বা কোরবানির প্রয়োজন কেবল ধর্মীয়ই নয়, রাজনৈতিকও। টিপাইমুখ বাঁধবিরোধী সংগ্রামে এখন অবধি আত্ম বা পরকে বলিদানের ঘটনা সরাসরি ঘটেনি।
তবে জনতার পক্ষে ল্যাম্পপোস্ট নামক সংগঠনের কর্মীরা প্রতিবাদ করে বন্দী ও রিমান্ডে নির্যাতিত হওয়া আর ভারত-চটানো মন্তব্যের দায়ে সরকারের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমণির মন্ত্রীত্ব কেড়ে নেওয়ার সম্ভাবনার মধ্যে রাজনৈতিক কোরবানীর আলামত স্পষ্ট। দুটি ঘটনা দুই ধরনের বলি বা কোরবানীর ইঙ্গিত। আরেকদিক থেকে ল্যাম্পপোস্টের এই প্রতিবাদ আকারে ক্ষুদ্র হলেও মাত্রায় বিরাট। ২০০৭ সালের আগস্টের ছাত্র আন্দোলন যেমন একটা টার্নিং পয়েন্ট ছিল, ভারতীয় দূতাবাসের সামনের এই প্রতিবাদীদের ওপর পুলিশি বর্বরতাও ভারত বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে ওঠার সম্ভাবনাধর।
কোরবানী কেউ করে এবং কেউ তা হয়।
আত্মবলিদানও আসলে পরের হাতে কোরবানী। আত্মহত্যার সঙ্গে এখানেই তার পার্থক্য। বর্তমান পরিস্থিতিতে খুবই বিপজ্জনক প্রতিবাদ করায় ল্যাম্পপোস্টের কর্মীরা এবং ক্যারিয়ার-বিধ্বংসী মন্তব্য করে দীপুমণিও আত্মবলিদানের পথেই গিয়েছেন। প্রথমটি জনগণের তরফ থেকে দ্বিতীয়টি সরকারি দলের পক্ষ থেকে। কোরবানী হয় যে প্রিয় সে।
নিরাপদ পথ ছেড়ে কার্যকর প্রতিবাদের পথ দেখিয়ে ল্যাম্পপোস্ট টিপাইমুখ বিরোধী সংগ্রামকে এক স্তর উতরিয়ে অনেকের প্রিয় হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে নতুন মুখ দীপুমণিও ছিলেন আওয়ামী লীগের আদরের। আজ উভয় পক্ষই যার যার আদরের ধনকে কোরবানী করতে বাধ্য হচ্ছে। পরিস্থিতির তীব্রতা ও করুণ চিত্র এখানেই ফুটে উঠছে। এ ঘটনার মধ্যে বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী রাজনীতির ভবিষ্যতেরও একটি দিশা পাওয়া সম্ভব।
সামান্য আকারে সেটাই আমার আলোচনার বিষয়।
অডিসিয়াস ও ল্যাম্পপোস্ট
অডিসিয়াসের কাহিনী ট্রয়ের যুদ্ধ শেষে দেশে ফেরার দুর্ভোগের কাহিনী। দেবতার কাছে নত হতে অস্বীকার করায় সে অভিশপ্ত হয়েছিল। অভিশাপ কাটাতে লড়াইয়ের পথ বেছে নেয় সে। দানবীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে দুর্বলের লড়াই কৌশলী না হয়ে পারে না।
অডিসিয়াসের কৌশলটি ছিল অতি সরল। সেটা হলো, ভীত না হয়ে সরাসরি দানবকে আঘাত করো। আত্মবলিদানের ঝুঁকি নাও। যতদূর জানি, ল্যাম্পপোস্ট নামক সংগঠনটি ভারতদৈত্যের চোখের বালির বেশি কিছু নয়। সরাসরি ভারতীয় দূতাবাসের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদের মাধ্যমে এই সামান্য ক্ষমতার কৌশলগত ব্যবহার তারা করেছে ।
তাতেই ভারত ও তার করদ সরকারের দাঁতাল চেহারা বেরিয়ে পড়েছে। জনগণ দেখেছে তাদের বর্বর বাড়াবাড়ি। তারা নির্যাতিত হয়েছে, সংগঠনটির দুই কর্মী রিমান্ডের কয়েকদিন গুয়ান্তানামোর স্বাদ পেতে যাচ্ছে, তার থেকেও খারাপ পরিণতির ভয়ও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এদের ‘কোরবানী’ করে অন্যদের হুশিয়ারের মওকাও ছাড়ছে না সরকার। ‘চরমপন্থী’ তকমা লাগিয়ে মন্দ পরিণতির পথকে আরো পিচ্ছিল করছে কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম।
এককথায় ল্যাম্পপোস্ট জেনেশুনে আত্মবলিদানের পথে গিয়েছে।
আত্মবলিদান বা স্যাক্রিফাইসের মর্মটা এখানেই যে, এতে সকলের হয়ে একজনকে উৎসর্গ করে ন্যায় বা সুস্থিতি ফিরিয়ে আনার চিন্তা নিহিত থাকে। এর আরেকটা তাৎপর্য হচ্ছে, বড় কোরবানীর মহড়া। প্রিয় সন্তানের প্রতীক পবিত্র প্রাণী কোরবানী দেওয়ার মাধ্যমে নবী ইবরাহিম আসলে সর্বস্ব ত্যাগের সংকল্পেরই প্রকাশ করেছিলেন। তা ছিল আত্মবলিদানেরই মহড়া।
আত্মবলিদান তাই একইসঙ্গে ন্যায়ের জন্য বা বিজয়ের সংকল্প ও মহড়া দুটোই। যুগে যুগে প্রতিবাদীদের আত্মদান অধিকাংশ মানুষের মনে ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংকল্পকে তীব্রতর করতে পেরেছে। এটাই আত্মবলিদানের জাদুকরী জোর। ল্যাম্পপোস্টের এই প্রতিবাদের মধ্যে সেই ইশারা বিদ্যমান।
তোমরা কারা? উত্তর: আমরা কেউ না?
প্রথম আলোয় প্রকাশ, ল্যাম্পপোস্ট 'চরমপন্থী' সংগঠন।
প্রমাণ? প্রমাণ নাই। তবে এটা ‘জানা গেছে’ ‘সংস্লিষ্ট সূত্র’ মারফৎ। তারা কারা তা বলবার অপেক্ষা রাখে না। অথচ, জানা মতে তাদের সব কার্যক্রম আইনী সীমার মধ্যে থেকেই করা। আইনী প্রতিবাদকে চরমপন্থী তখনই বলা হয় যখন পরিস্থিতিই আসলে চরম হয়ে যায়।
বাংলাদেশে এখন সেই পরিস্থিতিই বিরাজ করছে।
একই সংবাদে বলা হচ্ছে যে, পরিচয় জানতে চাইলে মধুর ক্যান্টিনে হাজির ল্যাম্পপোস্টের কর্মীরা সাংবাদিকদের নামের বেশি কিছু বলতে চায়নি। (সাংবাদিকদের তারা কেমন বিশ্বাস করে এটা তার একটা বহিপ্রকাশ। ) এ থেকে কেউ যদি সিদ্ধান্তে আসেন যে, এটি একটি মাটির তলার সংগঠন, তা তারা আসতেই পারেন। আসলে উল্টাটা বেশি সত্য, যা অচেনা তাতেই তো ভয় বেশি।
বাংলাদেশে দিন দিন অচেনা প্রতিবাদীদের দেখা যাবে, কারণ চেনারা ব্যর্থ নয়তো ফোপরা বা ভেজালভরা।
গুহায় আটক অডেসিয়াসকে যখন পলিফেমাস নাম জিগগেশ করে তখন সে বলে, আমি ‘কেউ না’। অডেসিয়াসের নামের মূল ‘উদিস’ মানেও কিন্তু ‘নোবডি’ মানে ‘কেউ না’। শেষে যখন অডিসিয়াস একচোখা দৈত্যের চোখ কানা করে তার দুপায়ের ফাঁক দিয়ে পালিয়ে যাবে, আহত দৈত্যের চিৎকারে যখন দ্বীপের অন্য দৈত্যরা ছুটে এসে জানতে চাইবে, কে তার এমন দশা করেছে, তখন পলিফেমাস বলবে, ‘কেউ না’। ‘কেউ না’-কে দানবের গুষ্টি কীভাবে খুঁজে পাবে?
যে বলে যে সে ‘কেউ না’, সে আসলে বোঝাতে চায় সে আমজনতা, অর্থাৎ সে সবার অংশ মাত্র, আলাদা কেউ নয়।
ল্যাম্পপোস্টের পরিচয় বিভ্রাটের মনোদার্শনিক ব্যাখ্যা এটাই, তারা এতই ক্ষুদ্র ও অবিশেষ যে তারা জনগণেরই অংশ। যারা ‘কেউ না’ তারাই আজ মারণবাঁধের বিরুদ্ধে, দানবের ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে । এই ‘কেউ না’রাই এদেশের বেশিরভাগ মানুষ। সরকার বাহাদুর কতজনকে জেলে পুরবেন?
দীপুমণি না পিনাকরঞ্জন: বিসর্জিত হবে কে?
দীপুমণি প্রথম কয়েকমাসে অনেকের চোখে এই সরকারের নতুনত্ব, কলুষহীনতা, উদ্যম ও নবযাত্রার আশার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী করাটাও বিদেশে তাঁকে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতীক করেছে।
পিনাকরঞ্জনের ঔদ্ধত্যের জবাবে তাঁরই প্রথম দায়িত্ব ছিল প্রতিবাদ করার। এ দিক থেকে তিনি সার্বভৌমত্বেরও প্রতীক। কিন্তু দেরিতে হলেও মামুলি মিউমিউ করতে গিয়েই তিনি মিডিয়া, প্রভাবশালী নেতা এবং ভারত-দেবতার কোপানলে পড়েন। তাঁর মন্ত্রীত্ব এখন যায় যায়। দেবতাকে তুষ্ট করতে এখন তাঁকে বলি করার জোর সম্ভাবনা।
তা যদি হয়, তাহলে সেটা হবে এই সরকারের দাসত্বের মনোভাবের প্রথম বলিদান। হয় পিনাকরঞ্জন নয়তো দীপুমণি, প্রশ্ন হলো কে থাকবেন আর কে যাবেন?
গণআন্দোলন বেগবান করার এই চ্যালেঞ্জ আজ কে অস্বীকার করবে?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।