আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিষুতি নিশিতে পোড়বাড়ি

কত আজানারে জানাইলে তুমি, কত ঘরে দিলে ঠাঁই দূরকে করিলে নিকট,বন্ধু, পরকে করিলে ভাই।
১৪জুন । আজ থেকে ১৪ বছর আগের কথা । ১৯৯৫সাল। লালমনিরহাট যাবার উদ্দেশ্যে ঢাকার কমলাপুর স্টেশন থেকে একতা ট্রেনে রওনা দিয়েছে।

কাউনিয়া স্টেশনে যখন ট্রেন এসে দাঁড়াল তখন সকাল সাতটা বাজে। এবার ট্রেন বদলাবার পালা। শাটল ট্রেনে করে লালমনিরহাট পৌঁছাতে পৌছাতে বেলা ১০টা বেজে গেল। অফিস থেকে থাকবার ব্যাবস্থা করা হয়েছে একটি বাঙ্গলোতে। বাংলোটি বিরাট।

প্রায় ছয় বিঘা জমির উপরে। ডুপ্লেক্স বাংলো। ব্রিটিশ আমলে তৈরি লাল বাংলো। প্রতিটি ঘরে ফায়ার প্লেস আছে। ফায়ার প্লেসের টাইলসগুলি এখন ও চকচক করছে।

এমন পুরাণো বাংলোতে থাকতে হবে দেখে লুনা, পপি, আমি ও সাথী সবারই মন প্রথমেই দমে গেল। সুন্দর করে সাজানো এত্ত বড় বাংলো দেখেও খুশি হতে পারলাম না। গাড়িতে আসতে আসতে ড্রাইভার বলছিল----- আপা আপনেরা কেন স্যাররা যেখানে থাকে সেই মেসে উঠলেন না ? রুমা বলল ---অফিস যেখানে ব্যাবস্থা করবে সেখানেই তো থাকব?! কেন ঐ বাংলোতে থাকলে কি আসুবিধা? ড্রাইভার তাড়াতাড়ি বলল-------- না কোন আসুবিধা নাই। আনেক দিন কেউ থাকে না তো তাই?? তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে অফিসে গেলাম। বিকালে বাসায় আসার পর কেয়ার টেকার মতিয়ার জানালো এই বাংলোর সীমানা প্রাচীর ঘিরে যে ছোট ছোট ঘরগুলি আছে ঐ গুলি এই বাংলোর আউটহাউজ।

আর সেখানেই সে থাকে বউ বাচ্চা নিয়ে। তবে সে সন্ধ্যার পর পরই চলে যাবে। তার নাকি কি কাজ আছে। একটু পরে এসে বলল ----------------- আপনাদের একটা কথা বলি কিছু মনে করবেন না, আমার দোষ দিয়েন না , বড় স্যার জানলে আমার চাকুরী যাবে। জিজ্ঞাস করলাম---কি কথা ?? সে বলল -----আসলে এই বাংলোতে স্বাধীনতার পর থেকে কেউ থাকেনি? রাতের বেলা এই দিকে কেউ আসে না ।

এই বাড়িতে দোষ আছে। !! আমরা কেউ রাতের বেলা এই বাংলোর আসে পাশে আসি না। দেখেন না এখন কেউ নাই সবাই চলে গেছে। যারা ঘাস কাটছিল, গরু চড়াচ্ছিল, তারা কেউ নাই। আর কেউ আসবে না।

এই বাংলোটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দেখে এটাকে থাকার মত করে ঠিকঠাক করা হইছে এক বছর আগে। সবাই শহরে ছোট বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে , তাও কেউ এই বাড়িতে থাকে না। খুব বড় গলায় আমরা চার জনই বললাম---- ধ্যাৎ এসব বাজে কথা । । ওর কথায় খুব একচোট হেসেও নিলাম।

। বললাম বটে, কিন্তু গলায় জোর কই?????? বাংলোর চারিদিকে বড় বড় রেইনট্রি, আম, দেবদারু, শিমুল গাছ। আমরা চার জন মেয়ে। থাকার ব্যাবস্থা ছিল উপরের দুই রুমে দুইজন, নিচের দুই রুমে দুই জন। সন্ধ্যার আগেই আমরা চার জন নিচে রুমে থাকার ব্যাবস্থা করলাম।

সন্ধ্যার পর পর মতিয়ার যখন চলে গেল তখন আমরা চার জনই এক রুমে। কি করি, টিভি নাই, ওয়াকম্যান আর বই ভরসা। কিন্তু মনতো কোথাও বসে না। ক্লান্ত দেহে শুয়ে পড়লাম, ঘুম আসে না। আমরা ভাবলাম গল্প করলে বোধ হয় ভয় কমবে।

কিন্তু কারও মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। বের হোলেও আওয়াজ নাই। যেন আমরা শব্দ করলেই অশরীরী ওরা এসে পরবে। এমন দম বন্ধ অবস্থায় সবাই মুখ শুকনা করে বসে আছি। রুমা বলল--- খাবার খেয়ে নেই।

। হ্যাঁ তাড়াতাড়ি খাবারের পর্ব শেষ করা ভাল। খেতে গেলাম। এমন সময় কে যেন গলা খাঁকারি দিল। আমরা চারজন সমস্বরে চিৎকার করে উঠলাম -----------কে?? লুনাতো জোরে জোরে আয়াতুল কুসরী দোয়া পড়া শুরু করে দিল।

তখন বাইরে থেকে দারোয়ান বলল----------আপা আমি। ভয় পাইয়েন না আমরা তিন জন আছি তিন দিকে। আমি বাংলোর কাছেই থাকব। আমরা চারজন সব কাজ করি একসঙ্গে। এমনকি টয়লেট পর্যন্ত যাচ্ছি এক সাথে।

টয়লেটের দরজা বন্ধ করার প্রশ্নই আসে না। একজন ঢুকলে ওর দিকে পিছন দিয়ে তিনজন দাড়িঁয়ে থাকি। মোটামুটি ভহাবহ অবস্থা। দুই খাট জোড়া দিয়ে চার জনই একই বিছানায় শোবার ব্যাবস্থা করলাম। রাত ৮.৩০র মধ্যেই সবাই মশারির ভিতরে।

ঘরের ভিতরে নিয়ন বাতি জ্বলছে। পানি খাবার জন্য গেলাসটা হাত বাড়িয়ে নেবার ক্ষমতা কারো নাই। চার জন ফিসফিস আলাপ গল্প গুজব করতে করতে হয়ত ঘুমিয়েই পড়েছিলা। ঘুম ভেঙ্গে গেলে ছোট্ট বাচ্চার কান্নার শব্দে। মনে হচ্ছে উপর তলায় কোন বাচ্চা কাদঁছে।

উপর তলায় পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। কে যেন হাঁটছে। পপি ও সাথীর গায়ে হাত দিলাম। পপি বলল------- চোখ বন্ধ করে থাক কিচ্ছু দেখতে হবে না। মরলে চোখ বন্ধ রেখেই মরব।

ভয়ংকর কিছু দেখার চেয়ে না দেখাই ভাল। শুনতে পেলাম কে যেন পাশের রুমে নূপুর পড়ে হাঁটছে। ছম-ছম ছম-ছম ছম-ছম। তারপরেই ধাম ধাম শব্দে ঘরের জানালা গুলি ধাক্কা খেতে লাগল বাতাসে। ঘরের জানালা যে খোলা ছিল ভয়ে তাও খেয়াল করা হয় নি।

বাইরে বোধ হয় ঝড় শুরু হল। কে জানালা বন্ধ করে ? থাক্‌ খোলাই। ?! লুনা শক্ত করে আমার হাতে চাপ দিল, ইশারায় জিজ্ঞাস করলাম--কী?? ও খুব নিচু স্বরে বলল-----পাশের ঘরে। আমি ওকে চুপ থাকতে বললাম। এমন সময় কারেন্ট চলে গেল।

। আমাদের মনে ভয় কারেন্ট কি সত্যিই গেল নাকি অলৌকিক ভাবে পাওয়ার চলে গেল। বারান্দার তানিনের প্লাস্টিকের চেয়ার গুলো কে যেন টেনে টেনে নিয়ে বেরাচ্ছে। চেয়ারগুলো সারা বারান্দা ঘুরে বেরাচ্ছে। আমাদের কাছে একটা টর্চ পর্যন্ত নাই।

মা একটা পেন্সিল টর্চ দিয়েছিল তা তো ট্রাভেলিং ব্যাগে। চারদিক ঘুটঘুটে আধাঁর। আর বিভিন্ন ধরনের শব্দ। নিজের শরীর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। একটা তীব্র ভয়ের স্রোত আমাদের মেরুদন্ড বেয়ে নেমে গেল।

আমার মনে হল আমি এক পরাবাস্তব জগতে চলে এসেছি। ভয় এমন একটা জিনিস যদি সে একবার মনের মাঝে আশ্রয় করে নেয় তা হলে তা আর তাড়ানো যায় না। শুধু মনে হচ্ছে, আমি কি সত্যিই সত্যিই পপি ও সাথীর গায়ে হাত দিয়ে আছি?? নাকি এরা অন্য কেউ??? হঠাৎ শুরু হল বজ্রপাত। বজ্রপাত হচ্ছে আমাদের খুব কাছেই। আমরা চারজন নিজেদের সাথে ঘেঁসাঘেসি করে বসে আছি।

বজ্রপাত কিছুতেই কমছে না। মনের ভয় তাড়াতে পারছি না। প্রচন্ড শব্দে আমরা দিশেহারা। সেই সময় ভুতের ভয় বেশি ছিল নাকি বজ্রপাতের ভয় বেশি ছিল তা মনে পরছে না। টর্চ নিতে হলে বিছানা থেকে নামতে হবে।

কিন্তু কার সাধ্য এখন আমাকে বিছানা থেকে নামায়?? আমি হয়ে পরেছি চলৎ ক্ষমতা রহিত। বজ্রপাতের আলোতে দেখি জানালার বাইরে কে যেন সাদা কাপড় পরে দাঁড়িয়ে । বাতাসে তার আঁচল উড়ছে। তবে কি সত্যিই আমরা আজ অস্বাভাবিক কোন কিছুর মুখমুখি হব। রাত তো আর শেষ হয় না।

কটা বাজে তাও জানিনা। বজ্রপাত থেমে গেল, বৃষ্টি থামে না আর আসে না পাওয়ার। ভোর হয়ে আসছে। মাঝে মাঝে বাতাসের ঝাপটা বলে দিচ্ছে ঝড় এখনও থামে নি। আকাশে ধল পহড়ের আলো দেখা যাচ্ছে।

এই ভোর হয়ে এল প্রায়। --------------- পরদিন সব রহস্যের মোটামুটি সমাধান আমরা করতে পেরেছি। পুরানো বড় বড় গাছ বাড়ির চারিদিকে। তারই কোন একটা গাছে হয়ত শকূন বাসা বেঁধেছে। বাচ্চার কান্নাটা শকূনের বাচ্চার কান্না হবে হয়ত।

বাতাসে খালি ঘরে বিভিন্ন ধরনের শব্দ হয়েছে। বাতাসে তানিনের প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে নিয়ে গেছে এ প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্তে। আর জানালার বাইরে শাড়ি পরিহিতা অশরীরী মহিলা আর কেউ নয় উনি একটি কলাগাছ। শুধু নূপুরের শব্দের কোন সমাধান আমরা বের করতে পারিনি। আজ এত বছর পর এই পার্বতীপুরে এসে আমি সেই নূপুরের শব্দের উৎস খুঁজে পেয়েছি।

পরিত্যাক্ত বাড়ির বা রাস্তার ইটের ফাঁকে ফাঁকে এক ধরনের পোকা থাকে। যারা দেখতে অনেকটা তেলাপোকার মত কিন্তু সাইজে তেলাপোকার চেয়ে দ্বিগুন, গায়ের রঙ মাটির মত মাথার দুই পাশ দিয়ে কাঁকরার মত দাঁত আছে। এই পোকা গুলি থেকে এই ধরনের শব্দ আসে। মতিউর তার বক্তব্যে সত্য মিথ্যা মিলিয়ে আমাদের মোটামুটি ভালই ভয় দেখিয়েছিল। এর পরের রাতগুলিতে আর ভয় পাই নি।

আসবার দিন বলে এসেছি---------- এবারের মত তোমার চাকুরী বেঁচে গেল। দোয়া কর আমাদের কারো পোস্টিং এখানে যেন না হয়। আমাদের কাড়ো পোস্টিং এখানে হলে তোমার কিন্তু তখন আর চাকুরী থাকবে না।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।