[***পুরীতে আমার তোলা পাপার ছবি ***]
আজ father’s day – খুব ইচ্ছে হচ্ছে আমার প্রিয় পাপাকে নিয়ে কিচ্ছু লিখি। প্রায় তিন বছর হতে চল্ল পাপা আমার সঙ্গে আর নেই। পাপাকে খুব miss করি। পাপা আমার – শুধু আমার নয় বাপ্পারও সব ছিল-মা-বাবা দু’ই। সুতরাং খুবই স্বাভাবিক আমরা দু’জনেই পাপার ভীষন অভাব বোধ করি।
তবু মনে হয় পাপা যেখানে আছে নিশ্চয়ই খুব ভাল আছে।
আমার পাপা ভিষণ আমুদে ছিল। আমি বা বাপ্পা কেউ পাপার মত হইনি। পাপা থাকতে বাড়ি গম্ গম্ করত, সারাক্ষণ হই চই করত। ভোরবেলা উঠে, পূজো করে সারাবাড়ি ধুনো দিত।
ধুন তৈরিও একটা উৎসব ছিল। কত রকম জিনিষ এনে হামানদিস্তেতে গুড়োনো হত। বড়২ কৌটতে রাখা হত। সেই ধুনোর গন্ধে তিনতলা পর্যন্ত ম্ ম্ করত।
পাপা দাদু-দিদার প্রথম ও আদরের সন্তান ছিল।
তাই কম বয়সে একটু বেশি দুষ্টু ছিল। প্রায়ই বাড়ি থেকে পালাত। খুব ছোট্টবেলা এক কনভেন্ট স্কুলে পড়ত, দুষ্টুমির জন্য ফাদার বেত দিয়ে মারলে, বেত কেড়ে ছুড়ে স্কুল থেকে পালায়। দাদু ভিষণ রাগি ছিল-ধরলেই আবার মার খাবার ভয়ে ট্রেনে উঠে পরে। পরে ট্রেনের এক ভাল লোকের সাহায্যে বাড়ি আসে।
কিছুদিন আগেই মামাদাদু একটা গল্প বলছিল, পাপা যেহেতু প্রথম সন্তান আর ভিষণ দুরন্ত তাই সবাই পাপাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকত। ক্লাস এইট-নাইনে পাপা আবার মু্র্শিদাবাদ না কোথায় পালায়। মামাদাদু বলছিল এখন যেমন কম বয়সি ছেলেরা সিনেমা করবে বলে মুম্বাই যায়, পাপা তেমনি প্লাসটিকের ব্যবসা করবে বলে পালায়। পরে দাদু অনেক খোঁজাখুঁজি করে বাড়ি আনে।
পাপার খুব ব্যবসা করার ইছে ছিল।
মনে পরে জলপাইগুড়িতে আমাদের পোলট্রি ছিল। প্রায় ১০০০ মুরগি, ধপ্ধপে সাদা, এই বড় বড়। ভুলো তখন ছোট্ট। একটা গুন্ডা মুরগি সারা বাড়ি পাহারা দিত আর ভুলোকে তাড়া করে বেরাত। ব্যবসা কেমন চলত মনে নেই-কিন্তু খুব ভাল লাগত, আমরা সবাই সবসময় ডবল ডিমের অমলেট খেতাম।
যা রোজগার হত খেয়ে-খাইয়ে সব মনেহয় সমান সমান চলত।
এরপর হল মাসরুম চাষ। আমাদের বাড়ি ছিল একতলা, কিন্তু মাসরুমের ঘর হল তিনতলার সমান। কি ঠান্ডা ঘর! কত্তো বেড! একটার উপর একটা, কুড়িটা করে। তখন আমার ক্লাস সেভেন-এইট হবে।
এসময় আবার এই বড়২ সাদা ফুলের মত মাশরুম ভাজা করে, পায়েস করে খাওয়া হচ্ছে। ছাদে শুকনো হচ্ছে। হরেক রকম মেশিন এসেছে। প্যাকেট হচ্ছে। যারা আসছে তারা যেমন মাশরুমের পায়েস খাচ্ছে তেমনি প্যাকেটে করে ফ্রি স্যাম্পল নিয়ে যাচ্ছে।
কলকাতা থেকে লোক আসছে। বাড়ি ভাড়া নিয়ে ল্যাব হচ্ছে। কিন্তু শেষে সে ব্যবসাও উঠে গেল।
তবু জলপাইগুড়িতে পাপা বিভিন্ন experiment করে ভালোই ছিল। কিন্তু কলকাতার অতি আধুনিক, কিছু স্বার্থন্বেষি মানুষের চক্রে পাপা একদম শেষ হয়ে গেল।
পাপার সরলতায় তারাও পাপাকে বোকা বানিয়ে হয়ত মজা পেত। কিন্তু পাপা হঠাৎ একদিনেই এমনভাবে চলে গেল যে তারাও ভিষণ অবাক ও চমকে উঠেছিল। পাপা মারা যেতে কত্তো লোক এলো-পাপা খুব সাধাসিধে ভাল মানুষ ছিল সবাই বলে গেল।
জলপাইগুড়িতে পাপা ভোরবেলা উঠে ধুনো দিতে২ খালি আমার নাম ধরে ডেকেই যেত। আমি কিছুতেই ঘুম থেকে উঠতাম না।
পাপার কাছে যখন যা চেয়েছি পেয়েছি। পাপা কখন পড়তে বসতেও বলত না। তবু নিজের মত করে পড়তাম। প্রচুর গল্পের বই কিনে দিত। জলপাইগুড়িতে বড় বাড়ি, সামনে-পিছনে অনেক জায়গা, অনেক গাছ ছিল।
কত বিড়ালের বাচ্চা তুলে এনেছি। প্রথমটা একটু বকলেও পাপা তাদের খবরও নিত। ভুলোতো পাপা অফিস থেকে এলেই দৌড়ে২ গেটে চলে যেত, আর বড় কাল ছাতাটা মুখে নিয়ে হেলতে-দুলতে আসত। ভুলোকে পাপা খুব ভালবাসত। আমি বুলবুলি পাখি কুরিয়ে আনলাম, পাপা তারও ফড়িং ধরার ব্যবস্থা করে দিল।
কলেজ থেকে পরে যাওয়া দাঁড়কাকের বাচ্চা তুলে আনলাম, পাপা তার জন্য ছোট্ট মাছ-মাংস আনত। পাড়ার কালু ছিল মস্তান কুকুর। পাপা হাঁটতে বেরলেই কালু ঘাড় উঁচু করে পাপার পেছন২ হাঁটত।
পাপার প্রাণ ছিল ছোট্ট লুনা। সেই লুনায় করে পাপা আমায় টাউনে পড়াতে নিয়ে যেত।
কত্তো দূর বন্ধুর বাড়িও ঘুরতে নিয়ে গেছে। কিন্তু ছোট্ট লুনা গ্রামের আলের উপর উল্টে গেল। সে কি কান্ড! ফেরার সময় আমি রিক্সায়, পাপা কিন্তু লুনা ঠিক-ঠাক করে আবার রাজার মত ফট্ ফট্ করতে২ বাড়ি এলো।
আমরা হঠাৎ কলকাতা চলে এলাম। ভুলোকে আনার জন্য পাপা বড় পাঞ্জাবী লড়ি নিল-সামনে ভুলোর থাকার ব্যবস্থা হল, পিছনে মালপত্র।
সেই ভুলো যখন ১৫ বছর বয়সে কিছুদিন ভুগে মারা গেল, তখন পাপা যা করেছিল তা ভোলার নয়। আমার ১২ বছর বয়সে ভুলো এল-আমরা চিরদিন শহর থেকে দূরে থাকতাম। তার উপর আমি তেমন মিশুকে নই, শান্ত ধরনের। ভুলো, পাপা, বাপ্পাকে নিয়েই যেন আমার পৃথিবী। ভুলো যাবে যানতাম।
ভুলো মারা যেতে আমি স্থির হয়ে যাই। কান্নাকাটিও করিনি। গুম মেরে গেছিলাম। পাপা এমনি এত্তো হৈ চৈ করে, কিন্তু সে দিন আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল। কোথায় গাড়ির ব্যবস্থা করে এলো।
এত্তো বড় ব্যাগ আর এই বড় সাদা ফুলের রিং নিয়ে এলো। ছোট্ট কাঁচের পশু চিকিৎসালয়ের গাড়ি, পিছনে ভুলো শুয়ে। সামনে ছোট্ট জায়গা-চালক, তার পাশে পাপা, বাড়ি থেকে আমার যাবার দরকার নেই বলা হল। কিন্তু আমি যেতামই, পাপাও বারণ করলনা। কত্তো দূরে, প্রায় ৩ ঘন্টা ওভাবে কষ্ট করে যাওয়া হল।
যেখানে গেলাম, সেখানে গিয়ে মনটা শান্ত হল। কোনো এক গ্রাম-বিশাল এলাকা-কত্তো কুকুর সব ছাড়া। অনেক বিড়াল। এমন কি একটা অন্ধ বাঁদরও ছিল। সেখানে ভুলোকে শুইয়ে এলাম।
ফেরার সময় আমি ভাবছিলাম, পাপা ভুলোকে আর অবশ্যই আমাকে কত্তো ভালবাসে। এত্তো ছোট্ট গাড়িতে কি কষ্টই না সেদিন অত্তো বড় মানুষটা পেয়েছিল!
আমাদের রেজাল্টের সময় পাপা বেশি ভয়ে থাকত। ভাবত যদি ফেল করি তা’লে হয়ত বাড়ি ছেরে চলেই যাব। আবার ভাল ফল করলে পাড়ার সব বাড়িতে মিষ্টির বড়২ প্যাকেট পাঠাত। মোবাইল হবার পর ঘন্টায়২ পাপা ফোন করত-কি করছি, কি খাছি, জল খেয়েছি কিনা – তখন হাঁফিইয়ে উঠতাম।
এখন সে চুপ থাকে।
আমার পাপা আমায় কখন কিছুতে না বলত না। যা চেয়েছি তাই পেয়েছি। কত্তো যায়গায় ঘুরেছি। কলকাতায় আসার পর দূরে বর্ধমান ইউনিভার্সিটি যাব- প্রতিদিন পাপা সঙ্গে করে নিয়ে গেছে।
পাপার সঙ্গে বেরিয়ে মজা হত। পাপা ট্যাক্সি ছাড়া এক পাও নড়ত না। কত্তো ঘুরতাম, কত্তো খেতাম! গ্রামে২ পাপার সাথে ঘুরে মজা। বড়২ পদ্ম পাতায় গরম২ খাবার খাওয়া! খুঁজে২ পুরোনো২ দোকানে সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার খাওয়া পাপার নেশা ছিল।
পাপার গল্প লোকেদের মুখে শুনতে এত্তো ভাললাগে কি বলব! একটা বিয়ে বাড়িতে মামাদাদুর পাশে বসে২ আমি পাপার ছোট্টবেলার দুষ্টুমীর গল্প শুনছিলাম।
আবার দিদির কাছে পাপার গল্পও শুনেছি। আমরা তখন খুব ছোট্ট। পাপার তখন নতুন সংসার। মা একটু আদুরে ছিল, পাপাই বাড়ির অনেক কাজ করত। বিকেলে বাইরে টেবিলে পা তুলে পাপা পাইপ টানতে২ আরাম করত-দিদিও পাপার দেখাদেখি অমন করত।
দিদি বলে পাপার পাল্লায় পরে দিদিও ছোট্ট থেকে ছেলেদের মত হয়ে গেছে।
আমি যখন খুব ছোট্ট তখন আমার পক্স হয়। জন্মের পরে পরেই। পাপা-মা তখন শহর থেকে অনেক দূরে থাকত। মাসি-মেসো আমাকে প্রথম দেখতে এসেছে।
এদিকে পাপা ঘরে দরজা জানলা বন্ধ করে, মশারি টাঙিয়ে, ঘরে ধুনোর ধোঁয়া দিয়ে, মশারির মধ্যে আমাকে কোলে নিয়ে বসে। কিছুতেই আমাকে বাইরে আনবে না, যদি মরে যাই! মা বলে পাপা আমায় সারাদিন এতো কোলে নিয়ে২ ঘুরত যে তাই আমি বেশি বাড়িনি। আমি যখন হষ্টেলে তখন জলপাইগুড়িতে বাপ্পার একটা দুর্ঘটনা ঘটে, সেলাইও করতে হয়। শুনেছি পাপা এত্তো কান্নাকাটি করে যে পাড়ার সবাই জড় হয়। বাপ্পা তখন খুব ছোট্ট- এখনও বলে ও ভেবে অবাক হচ্ছিল পাপা এত কাঁদছে কেন।
কলকাতা আসার পর পাপার সাথে কয়েকবার পুরী যাই। প্রথমবার পুরী গেলাম, পৌঁছতে২ সন্ধে। আমি, পাপা, বাপ্পা বিচে গেলাম। আমার জ্ঞানত সেই প্রথম সমুদ্র দেখা। পাপাও অনেকদিন পর এল।
দু’জনের ভিষণ আনন্দ হচ্ছে। বাপ্পাটা বাইরে আরো চুপচাপ। তো, আমি আর পাপা উট দেখে তার পিঠে চরে বসলাম। পাপা আবার উটটাকে দৌড় করাতে বল্ল। উটটা ল্যাগ-ব্যাগে পা নিয়ে দৌড়চ্ছে-সে কি অভিজ্ঞতা! পরদিন সমুদ্রে নেমেও পাপা ছেলেমানুষ হয়ে গেল।
একা একাই মাঝ সমুদ্রের দিকে সাঁতার লাগাচ্ছে। পাপা আর বাপ্পা থাকলে এসময় বাপ্পাকেই অভিভাবক হতে হত। পাপা আর আমি ছেলেমানুষের মত যা খুশি করতাম।
আমার সব সময় কেন যানি মনে হয় আমায় শুধু পাপাই ভালবাসে। একবার দুঃখ করে বল্লাম আমারতো অন্নপ্রাশনই করনি।
পাপা অবাক হয়ে বল্ল কে বলেছে! আত্মীয়দের মাঝে সে সময় ছিলাম না ঠিকই, তবে যেখানে ছিলাম সেখানেই অন্নপ্রাশন হয়, এবং ৫০০ মুরগি রান্না হয়। শুনে মুরগিগুলোর জন্য কষ্ট হলেও কেন যেন একটু গর্বও হয়।
আজ এত সুন্দর দিনে পাপার কথা বলে খুব ভাল লাগছে। অবশ্যই সবার বাবাই খুব ভাল হয়। তবু আমার পাপা যেন একাধারে আমার বাবা-মা এবং ভীষণ প্রিয় বন্ধুও ছিল।
আমার পাপা যেখানেই থাকুক ঈশ্বর যেন তাকে এমনই খুব খুব ভাল রাখেন। ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।