আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার মূক ও বধির বাবা।

আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ........
বাবা দিবস আজ। ধারনা ও প্রচলনটা হয়ত অনেক নতুন আমাদের দেশে কিন্তু তা আমাকে ভেতর থেকে তাড়িত করার জন্য যথেষ্ট। আমার বাবা, মুহাম্মদ আতাউর রহমান (মন্টু)..., জন্ম- বাঙলা ১৩৫৬ সাল, ছোটখাটো মাঝারী স্বাস্থ্যের সম্প্রতি ডায়বেটিসে পর্যুদস্ত একজন আক্ষরিক অর্থে নির্বাক মানুষ। এই ৬০ বছরের জীবনে- যিনি তার নিজের বাবার মুখ থেকে কখনো 'বাবা' ডাক শুনেননি। যিনি নিজের বাবাকে জীবনে একবারো 'বাবা' বলে ডাকতে পারেননাই।

আমার 'আব্বা' ডাক যার কানে কোনদিনই পৌছাঁয়নাই। যিনি আমাকে একবারও 'বাবা' বলে ডাকতে পারেননাই। অথচ জন্মাবধি যার সঙ্গে অদ্ভুত এক মায়ার বাধন ... ... আমার বাবা আর আমি...... আমি আর আব্বা ... ... এই বাবা দিবসে আমার সেই আজন্ম শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী এবং মানসিক ভাবে অনেকখানিই অপ্রকিতস্থ বাবা কে অপরিসীম শ্রদ্ধা আর এক সমুদ্র ভালোবাসা জানাই। বড় সড় এক যৌথ পরিবারে মানুষ হওয়া আমি জন্মের পর থেকেই ধীরে ধীরে অভ্যস্ত চোখে দেখছি স্বাভাবিক ভাবেই আমার আব্বার সাথে সকল যোগাযোগ করতে হয় ইশারায়, অংগ-ভঙ্গীতে; কিন্তু ভালোবাসা ব্যাপারটা টা বোধহয় কখনোই কোন মাধ্যমের ধার ধারেনা। আমার দেখা সত্যিকারের প্রগতীশিল একজন মানুষ, আমার দাদী।

নিজেরা গ্রামে বসবাস করা স্বত্বেও আমার আব্বাকে ছোট বেলায় ঢাকার বধির স্কুলে ভর্তি করেছিলেন দাদী নিজের উদ্যোগে। সেই থেকে আব্বা বাংলা এবং সামান্য ইংরেজী লিখতে ও পড়তে পারেন। বধির স্কুল থেকেই আব্বা সেলাই এর একটা প্রশিক্ষনও করেছিলেন। আব্বা একসময় আমাদের বাজারের একটা টেইলার্সও চালাতেন। তাছাড়া সোমবার ছিলো হাটের দিন, প্রতি সোমবারে বিকালে আব্বা সেলাই মেশিন নিয়ে হাটের একটা নির্ধারিত জায়গায় বসতেন।

আমি থাকতাম সহকারী এবং হিসাব রক্ষক। কাজ শেষে পারিশ্রমিক হিসাবে হাতে জুটতো নগদ ২ টাকা, সাথে ১ টাকা দামের দুর্দান্ত স্বাদের ক্রিম বিস্কুট (কাচের বাক্সে করে আগে হাটের দিন ফেরিওয়ালারা বেচতো)। আমাদের ভাইবোনদের অনেক ছোট বেলায় খেলতে গিয়ে যেকোন ঝগড়ার সময় বিরোধী শিবির থেকে শুরুতেই যে অবশ্যম্ভাবী আঘাতটা হজম করতে হতো সেটা বাবা সংক্রান্ত। গায়ের জোরে মাইর লাগাইয়া দেওয়া কিংবা না পারলে মাইর খাওয়া ছাড়া কিছুই আর করার থাকতো না। এত কষ্ট লাগতো..... আর ক্ষোভ, আর বুকের ভেতরে খালি জ্বলতো।

আমার মা বলে, আমরা তিন ভাইবোন যখন খুব বেশি ছোট তখন নাকি তার বড় ভয়টাই ছিলো আমরাও বাবার মতো হই কিনা। মা আমার নাকি আমাদের কানের কাছে ঝুনঝুনি বাজিয়ে বুঝতে চেষ্টা করতো আমরা কানে শুনি কিনা, আর কাদঁতো.... মা অবশ্য তার একটা জীবনে সব সময়ই খালি কাঁদতো (তখন না বুঝলেও এখন বুঝি কেন মা'র এত কান্না) আর আমার দাদীও কাঁদতো। বাবা হলো দাদা-দাদীর প্রথম ছেলে। আমি মূলত শৈশবে বাবার ভুমিকায় পেয়েছি ম্যাক্সিমাম আমার দাদা (আমরা ডাকি 'দাদু') কেই। অ-আ-ক-খ হাতে খড়িও দাদু আর ফুপুদের কাছে।

২য় বিশ্বযুদ্ধের রয়্যাল বৃটিশ নেভীর এ্যাসিস্ট্যান্ট ওয়্যারলেস অপারেটর, অত:পর ই.পি.আর, অত:পর স্কুলে শিক্ষকতা এবং কৃষিকাজ দিয়ে যার কর্মজীবন মোটামুটি বৃটিশ, পাকিস্তান আর বাংলাদেশ এই তিন আমলের স্বাক্ষী আমার শৈশবের সেই সুপার হিরো দাদু প্রায় নব্বই বছর বয়সে অথর্ব পড়ে আছেন আর কাউকেই চিনতে পারেননা। এই বাবা দিবসে আমার আরেক বাবা সেই সুপার হিরো দাদুকে কে অপরিসীম শ্রদ্ধা আর এক সমুদ্র ভালোবাসা জানাই। সেই স্কুল জীবন থেকে আমি হোস্টেল মেসে বড় হলাম। যতবার ছুটিতে বাড়ীতে গেছি বা বাড়ী থেকে ফিরে আসতাম ক্যাম্পাসে, আব্বা রীতিমত সৌদি আরবের কায়দায় গালে চুমু খেতো সবার সামনে (আব্বা আবার খুব বিদেশ ভক্ত। বিভিন্ন বিদেশী কেতার আদর তার বিরাট পছন্দ)।

এত্ত বিরক্ত লাগতো তখন। এখন বড় হয়ে গেছি কতো। এখন ঈদে পার্বনে বাড়ী যাই বউ নিয়ে। অথচ আব্বা আগের মতই জড়িয়ে ধরে দু’গালে চুমু দেয়। আমারও আজকাল চোখ ভিজে যেতে চায়, বহু কষ্টে সংবরন করি।

আমার ৩য় শ্রেণী পড়ুয়া একমাত্র ভাগনী জয়িতা খুব মজা পায় এ দৃশ্য দেখে। খিলখিল করে হাসে। আমি ভাব নেই, বলি “দেখছিস আমার আব্বু আমারে কত আদর করে। তোর বাপ করে, তোরে? ...... হুমমম??” এটা খুব সত্যি যে, আজ আমার মন অনেক বেশি খারাপ। আপনারা কি ধরতে পারছেন কেন? আমার আব্বা কথা বলতে পারেননা, তাই? -না আমার আব্বা শুনতে পান না, তাই? -না আমি ঢাকায় আছি, আব্বার জন্য গিফ্ট নিয়ে বাড়ী যেতে পারিনাই, তাই? -তাও না দুখ:টা হলো আমি তো বাবা দিবসে আব্বাকে জানাতে পারছিনা "আব্বা, আপনাকে আমি অনেক ভালোবাসি।

" আপনাদের অনেকের সুযোগ আছে হয়ত দূর থেকে ফোন/মোবাইল/এস.এম.এস/ইমেইল করছেন বাবা মাকে..... কিন্তুর আমার আব্বা তো আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু দেওয়া ছাড়া অন্য কোন ভাবে পারেন না আদর করতে। আমিও তো জানিনা সামান্য ইশারা-ইঙ্গিত ছাড়া অন্য কোন ভাষা। তাহলে আমার নির্বাক বাবাকে বাবা দিবসের মেসেজ আমি কোন মাধ্যমে পাঠাবো বলেন তো?
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।