আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দস্যুতাই যাদের জীবন ২: সত্যিকারের রবিনহুড সালভাতর জুলিয়ানো

সৃষ্টিকর্তার সকল অপূর্ব সৃষ্টির মাঝে একমাত্র খুঁত সম্ভবত তাঁর সেরা সৃষ্টি ...

দস্যুতাই যাদের জীবন ১: দস্যুরাণী ফুলন দেবী ধনীদের থেকে নিয়ে গরীবদের দেওয়া বলতেই প্রথম মনে পড়ে রবিন হুডের নাম। কিন্তু রবিন হুডের লিজেন্ড এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে সত্যি মিথ্যা যাচাই করা খুবই দুষ্কর হয়ে পড়েছে। তবে সত্যিকার রবিন হুড বলে যদি কোন দস্যুকে আখ্যা দেওয়ার কথা চিন্তা করা হয় তবে সে যে সিসিলির সালভাতর জুলিয়ানো ওরফে তুরি জুলিয়ানোই হবে এ লেখার শেষে আশা করি কারো এ বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকবে না। সালভাতর জুলিয়ানো(১৯২২-১৯৫০) [img|http://media.somewhereinblog.net/images/thumbs/major_fuad_1244703956_2-g11a[1].jpg] ১৯২২ সালের ১৬ নভেম্বর সিসিলির ছোট্ট গ্রাম মন্টেলেপ্রের সালভাতর আর মারিয়া জুলিয়ানোর তৃতীয় সন্তান এবং একমাত্র ছেলে সালভাতর জুলিয়ানোর জন্ম হয়। আদর করে সবাই তাকে তুরি ডাকতো।

ছোটবেলা থেকেউ সুদর্শন, মিষ্টভাষী ও সদালাপী তুরি ছিল গ্রামের সবার স্নেহের পাত্র। এমনকি কৈশোরে আশার পরও তার প্রখর বুদ্ধি আর অবাক করা দূরদৃষ্টির কারণে গ্রামের বয়স্কদের কাছে প্রিয় ছিল, আর গ্রীক দেবতা অ্যাপোলোর মতোই সুন্দর নিখাদ গড়ন আর চেহারার জন্য অনেকে মেয়েরই হৃদয়ের রাজা হয়ে উঠেছিল তুরি। সে আর তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু গাসপার পিসচিওতা ওরফে আসপানুর কাজ ছিল গ্রামে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো অর্থাৎ পরোপকার করা। আসপানুর সাথে কিন্তু তুরির মোটেও মিল ছিল না, আসপানু ছিল স্বভাবগত খুনী এবং হিংস্র ধারার ছেলে। কিন্তু তুরির সংস্পর্শে এসে সে পুরোপুরি বদলে যায়।

পরে তুরির বাবা এক সাক্ষাৎকারে বলেন, যে তুরি মানুষকে এতটাই নিজের আচরণে মুগ্ধ করে ফেলতে পারতো যে তার বন্ধুরা, অনুসারীরা তার জন্য নিজের জীবন দিয়ে দিতেও দ্বিধা করতো না। সে ছিল স্বভাবগত নেতা। এবং গ্রামে অন্যান্য ছেলেরা তার নেতৃত্ব নিয়ে কখনো প্রশ্ন তোলে নি। তার অস্বাভাবিক মেধা দেখে মুগ্ধ সিসিলি ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হেক্টর অ্যাডোনিস নিজে তাঁর পাঠদানের দায়িত্ব নেন। অল্প সময়ের মাঝেই দর্শন এবং ইতিহাসের বিষয়গুলোতে সে পারদর্শী হয়ে উঠে।

বড় বড় নেতা আর যুদ্ধের কথা পড়ে তার তাজা রক্ত টগবগ করে উঠে - সেও একদিন যুদ্ধ করে সিসিলিকে মাফিয়াদের অভিশাপ থেকে রক্ষা করবে। স্বপ্ন দেখে আর খেলাধূলায় ভালোই কাটছিল তুরির জীবন ঐ ছোট্ট গ্রামে, কিন্তু একদিন আসে যা তার জীবনের গতিপথ পাল্টে দেয় ভয়াবহভাবে। তুরির বোনের বিয়ে উপলক্ষে কালোবাজার থেকে সে আর আসপানু খাবার কিনে আনছিল এমন সময় তারা হঠাৎ কারাবিনেরি(ইটালিয়ান পুলিশ) র খপ্পরে পড়ে। এবং শুধুমাত্র তার কাছে আইডি পেপার না থাকার কারণে একজন পুলিশ তাকে গুলি করে, কিন্তু জুলিয়ানো সেরকম ছেলে ছিল না যে এতো সহজে নিজের মৃত্যুকে মেনে নেবে, সেও গুলি চালায় তার পায়ে লুকানো পিস্তল থেকে আর একজন পুলিশ নিহত হয়। প্রিয় বন্ধূর অবস্থা দেখে আসপানু হতবিহবল হয়ে পড়ে সে থাকে কাঁধে করে নিয়ে দৌড়াতে থাকে, মাইলের পর মাইল পাহাড়ী এলাকায় বন্ধুকে কাঁে করে নিয়ে সে একটা আশ্রমে পৌছায় যেখানকার প্রধান যাজক আসপানুর পূর্বপরিচিত।

তিনি গুলি খাওয়া জুলিয়ানোবক প্রথমে রাখতে না চাইলেও আসপানুর খুনী চেহারা দেখে ভয়ে রাজী হন। রাতের পর রাত মৃত্যুর সাথে লড়াই করে আসপানু আর যাজকদের সেবায় তুরি জীবন ফিরে পায়। ওদিকে হেক্টর অ্যাডোনিস খবর নিয়ে আসেন যে পুলিশ হত্যায় পুরো পুলিশবাহিনী পাগল হয়ে জুলিয়ানোকে খুঁজছে এবং কোন তথ্য না দেওয়ায় জুলিয়ানোর বাবা সহ অর্ধেক গ্রামবাসীকে জেলে পুরেছে। এই অরাজকতায় জুলিয়ানোর গায়ে যেন আগুন জ্বলে উঠে। বিনা কারণে তাকে গুলি করা হল আবার এখন তার প্রিয় জনদের প্রতি অত্যাচার চালানোও হচ্ছে? সে শপথ নেয় যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন ইতালিয়ান পুলিশদের হাত থেকে নিরীহ গ্রামবাসীদের রক্ষা করে চলবে।

সে একটা এমন পরিকল্পনা করে যা শুনে অ্যাডোনিস অবাক হয়ে যান তার বুদ্ধির মাত্রা বুঝে। এরপর ইতিহাস, মাত্র একটা পিস্তল সম্বল করে কাউকেই আহত না করে সতেরজন পুলিশ ভর্তি থানা তুরি জুলিয়ানো আর আসপানু দখল করে নেয়। তবে থানায় যে কর্পোরাল দায়িত্বে ছিলেন তিনি দৃঢ়চেতা মানষ ছিলেন, তিনি আত্মসমর্পণ করলেও সবসময়েই সুযোগ খুঁজছিলেন। এবং সুযোগ পেয়ে তার গুপ্ত পিস্তল বার করে তুরির মাথায় লাগিয়ে ট্রিগার চাপেন, কিন্তু ভাগ্যের কি খেলা গুলি বের হয় না। তুরি কর্পোরালের সাহস দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে ছেড়ে দেয়, আর কর্পোরাল মুগ্ধ হন তুরির ভদ্র আচরণ আর গুলির মুখেও তার নির্ভিক চেহারা দেখে।

তিনি পরবর্তীতে তুরির দস্যুদলে যোগ দেন এবং তাদের অস্ত্র বিভাগের প্রধান হন। তুরি সেদিন কারাগার থেকে যাদের মুক্ত করে তারা সবাই তুরির দলে যোগ দেয়। এদের মাঝে তখনকার বিখ্যাত খুনী ডাকাতদলের প্রধান টেরানোভা আর পাসাটেম্পোও ছিল। তারা এই ভেবে দলে যোগ দেয় যে সুযোগ পেলে তুরিকে হত্যা করে তার বাহিনী নিজের করে নেবে। কিন্তু তুরির নেতৃত্বগুণ তাদেরকে এমনি বিমোহিত করে যে তারা চিরদিনের জন্য তার আনুগত্য স্বীকার করে নেয়।

ছবি:জুলিয়ানো আর আসপানু সিসিলির পুলিশ এবং মাফিয়াদের বিরুদ্ধে জুলিয়ানো যুদ্ধ ঘোষণা করে। মাফিয়াদের চোরাকারবারীর চালান লুটে সে দরিদ্র গ্রামবাসীদের বিতরণ করতো। নারী এবং শিশুদের ওপর হাত তোলার ব্যাপারে কড়া নিষেধাজ্ঞা ছিল তার দস্যুদলের ওপর। এমনকি একজন মেয়েকে আঘাত করবার কারণে সে তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু আর সেকেন্ড ইন কমান্ড আসপানুকে চাবুক মারতেও দ্বিধা করে নি। তুরি ধনীদের বাড়ি লুট করতো এবং ধনী ব্যবসায় আর ডিউক, আর্লদের অফহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করতো।

কিন্তু যারা অপহৃত হয়েছিলেন তারা সকলেই পরে স্বীকার করেছিলেন যে তাঁরা তুরির প্রখর বুদ্ধি, রসবোধ এবং দর্শনশাস্ত্র এবং ইতিহাসের ওপর দখল দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। জুলিয়ানো ছিল অদৃশ্যমানব, তার পরিকল্পনাগুলি এতটাই নিখুঁত ছিল যে শত শত গার্ড থাকা সত্ত্বেও একটা বুলেট না খরচ করেও সে বড় বড় জমি মালিকদের বাড়ি লুট করে ফেরত আসতে পারতো। মাফিয়াদের দালালদের হত্যা করায় তার জনপ্রিয়তা বেড়ে যায় আরো। গ্রামবাসীরা সবাই মিলে তাকে সাহায্য করে। এমনকি তার সকল ডাকাতিতে গ্রামবাসীরাও পরিকল্পনার অংশে থাকতো তাই পুলিশ কিছুই করতে পারতো না।

জুলিয়ানো পরে সিসিলির স্বাধীনত আন্দোলনের অংশ হয়ে তার বাহিনী নিয়ে পুলিশের সাথে যুদ্ধ করে। সে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানকে সিসিলি স্বাধীনতার আন্দোলনে সমর্থন জানানোর আহবান জানিয়ে চিঠি পাঠায়। স্বাধীন সিসিলির পতাকাও তার বানানো এবং মন্টেলেডরোর যুদ্ধে জয়ী হয়ে প্রথম সে এই পতাকা উত্তোলন করে। ছবি: জুলিয়ানোর উত্তোলন করা স্বাধীন সিসিলির পতাকা তুরি জুলিয়ানোর জীবনের কালো অধ্যায় হলো পোর্তেলা দেল্লা গিনেস্ত্রার গণহত্যা। তখন সিসিলিতে কমিউনিস্টদের আগমন হয়েছে, ছোটবেলা থেকেই মেরি মা আর যীশুর ভক্ত তুরি তাদের একেবারেই পছন্দ করতো না।

তাই কমিউনিস্টরা যখন পোর্তেলা দেল্লা গিনেস্ত্রায় একটা সভার আয়োজন করে তখন তুরি পরিকল্পনা করে তাদের মাথার ওপর দিয়ে গুলি করে তাদের ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেবার। এই আক্রমণের দায়িত্বে ছিল তার দুই জেনারেল পাসাটেম্পা আর টেরানোভা। আর নজর রাখার দায়িত্বে ছিল আসপানু। কিন্তু হঠাৎই সে দেখতে পায় সভায় দাঁড়ানো মহিলার আর শিশুরা একে একে গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়ছে। সে চীৎকার করে থামার আদেশ দেয় কিন্তু ততক্ষণে অনেক মানুষ মারা গেছে।

এ ঘটনায় তুরি খুবই আহত হয়। অনেক খোঁজাখূঁজির পর বের হয়ে আসে আসল তথ্য, সে মাফিয়াদের লোকদের মারছিল বলে মাফিয়ারা পাসাটেম্পোকে টাকা খাইয়ে রাজি করিয়েছিল এ কাজের জন্য। পাসাটেম্পোকে নিজের হাতে তুরি হত্যা করে আর শহরের মাঝে তার লাশ ফেলে আসা হয় - বুকে লেখা ছিল "এভাবেই তারা সকলে মারা যাবে, যারা তুরি জুলিয়ানোর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। " পরবর্তীতে সকল ইনফর্মার আর মাফিয়ার দালালদের হত্যার পরও তাদের পাশে এই লেখা পাওয়া যেত। তবে এ ঘটনার পর তুরির অবস্থা খারাপ হতে থাকে।

সরকার পুরো শক্তির পুরিশবাহিনী এবং সাথে আর্মিও পাঠায় সিসিলির গুহাগুলোতে রেইড করবার জন্য। মাফিয়ারাও ছিল তার বিরুদ্ধে এবং এখন কমিউনিস্টরাও। তুরির এ নাজুক অবস্থার সুযোগে মাফিয়ারা আবারো নির্দয় কর চাপিয়ে অত্যঅচার শুরু করে কৃষকদের ওপর। তুরি এ সমস্যার সমাধান করে একসাথে আটজন মাফিয়া নেতাকে হত্যা করে। ছবি: পোর্তেলা দেল্লা গিনেসত্রা হত্যাকান্ডের পূর্বমুহূর্ত এতো শক্তি নিয়োগ করবার পরও জুলিয়ানো পুলিশের কছে অধরাই থেকে যায়।

এমনকি সবার সামনে সিসিলির সবচেয়ে বড় রেস্তোঁরায় খেয়ে ও সে বেরিয়ে আসতে পারতো বা সংবাদপত্রে তার পরবর্তী ডাকাতি কোথায় হবে সেটার তথ্য কিংবা তার চিন্তাধারা বিষয়ক আর্টিকেল লিখতে পারতো কেবল জনগণ তাকে ভালোবাসতো বলেই। তবে সে একসময় বুঝতে পারে যে সে একসময় না একসময় পুলিশের হাতে ধরা পড়বে বা মারা যাবে। তাই সে একটা পরিকল্পনা আঁটে, এ পর্যন্ত মাফিয়া, পুলিশ আর এমনকি সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, মন্ত্রী, চার্চের আর্চবিশপ সবার সাথেই সে কাজ করেছে। তাদের দুর্নীতির প্রমাণ কাগজে কলমেই তার কাছে আছে। এই সব দলিলপত্র যোগ করে সে একটা সংকলন করে যার নাম দেয় টেস্টামেন্ট।

এবং উচ্চমহলে খবর পাঠায় যে তাকে ধরবার চেষ্টা করলে সে এটা মিডিয়ায় প্রকাশ করে দেবে। এতে কর্তপক্ষের মাথায় বাজ পড়ে। তারা নির্বিচারে মানুষ আটক করে নির্যাতন করতে থাকে। তুরির দলের অনেক সদস্যই ধরা পড়ে কিংবা মারা যায়। তুরি আর আসপানু কোনমতে পালিয়ে বাঁচে।

কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস, কেবলমাত্র ঈর্ষা আর পুরষ্কারের কারণে তার সবচেয়ে কাছের মানুষ তার ছোটবেলার বন্ধু আসপানুই তাকে খুন করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। জনরোষ থেকে বাঁচতে আসপানু নিজেকেও পুলিশের হাতে তুলে দেয়। কিন্তু হাই সিকিউরিটি কারাগারেও বিষপ্রয়োগে কেউ তাকে হত্যঅ করে এবং নোট লিখে যায় "এভাবেই তারা সকলে মারা যাবে, যারা তুরি জুলিয়ানোর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। " ছবি:জুলিয়ানোর মৃত্যু [img|http://media.somewhereinblog.net/images/thumbs/major_fuad_1244704538_9-foto01[1].jpg] তুরি জুলিয়ানো ছিল এক অবিসংবাদিত নেতা, অনুসারীদের কাছে ঈশ্বরসমান, গরীবদের বন্ধু। এতো ডাকাতি করবার পরও সে নিজে কিন্তু মন্টেলেপ্রের সেই কুঁড়েঘরেই থেকে গেছে।

একটা পয়সাও সে উপভোগ করে নি। সারাটা জীবনই সে নিজের আদর্শর জন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ে গেছে। সে ছিল সিসিলিয়ানদের হিরো। এমনকি এখনো সিসিলিয়ানরা পারিবারিক প্রার্থনার সময় জুলিয়ানোর আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করে। তাই ফুলন দেবীর সময় যেমন প্রশ্ন করেছিলাম, আপনারাই বিচার করুন সে হিরো না ভিলেন - এবার আর দ্বিধা নেই।

জুলিয়ানো আসলেই হিরো, এবং সর্বকারের সকল যুবকদের জন্য আদর্শ। পরবর্তী পর্বে : দস্যুতাই যাদের জীবন ৩: পাঞ্চো ভিলা, দস্যু থেকে গেরিলা যোদ্ধা

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।