কয়েকদিন আগে দুপুরের ঘটনা। ধানমন্ডি রুটের ভার্সিটি বাস ছাড়ার অপেক্ষায় টিএসসি মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি। একটু সামনেই একটা মেয়ে খুব তেজী গলায় তার প্রেমিকের সাথে ঝগড়া করছে। ঝগড়ার এক পর্যায়ে মেয়ে হাত থেকে মোবাইল ছুড়ে ফেলে দিলো। ছেলেটাকেই আবার নির্দেশ আদেশ (!) দিলো মোবাইলটা তুলে এনে ঠিক করে লাগিয়ে দিতে! কিছুক্ষণ পর মেয়ে সেই ছেলেকে এমনই ধাক্কা মারলো যে ছেলের চশমা চোখ থেকে ছিটকে পড়ে ফ্রেম ও কাঁচ আলাদা হয়ে রাস্তায় লুটোপুটি খায়! এবার মেয়েটা একটু সরে বাসের কাছাকাছি এসে দাঁড়াতে তার কথা কানে এলো।
ঝগড়ার কারণ এবার স্পষ্ট হলো! '' তোমাকে বলসিলাম মে মাসের শেষে আমাকে মোবাইল কিনে দিতে। মে মাস শেষ হয়ে যাচ্ছে, এখনো তুমি মোবাইল দাও নাই!!"...মনে মনে ভাবলাম, এই তাহলে ঘটনা! এ কারণে ছেলে অপরাধী সাব্যস্ত! কিছুক্ষণ পর বুঝলাম ঘটনার ঘনঘটা আরো গভীর! ছেলে তার মা আর বোনের জন্য কিছু একটা কিনেছে, অথচ মেয়েটাকে সে ওই টাকায় মোবাইল কিনে দিতে পারতো!! কেন সে তাকে মোবাইল কিনে দিলো না- ঝগড়ার বিষয়বস্তু ফ্রয়েডিয় দর্শনের মারপ্যাঁচ পেরিয়ে শেষে এই বাক্যে ঠেকেছে! ছেলেটা হাসিমুখে সব ঝাড়ি সহ্য করে যাচ্ছে দেখে অবাক হলাম! ভাবলাম তবে মেয়েটা বোধহয় স্বভাবগতভাবেই তার প্রেমিকের সাথে প্রতিদিন যে কোনো বিষয়ে রাগারাগি করে। আর ছেলেটাও বহুদিনের অভ্যাসে এখন সেটাকে খুব স্বাভাবিক এবং নৈমিত্তিক আচরণ বলে ধরে নিয়েছে! মেয়েটা বলেই যাচ্ছে, ‘’যেদিন তোকে লাথি মেরে ফেলে চলে যাবো সেদিন বুঝবি......*****......এখন তো খুব ****.........”এর মধ্যে বাসের মামা থুক্কু ড্রাইভার ভাই চলে আসলো [ আমাদের বাসের ড্রাইভারদের আবার ‘ভাই’ বলার নিয়ম হয়েছে, তাদের ‘মামা’ বললে তারা অপমানিত হন! তারা আমাদের ভাই হতে চান, আমাদের মায়েদের নয়!], মেয়েটাও বাসে উঠে গেলো।
সবচেয়ে অবাক হলাম বাসে উঠবার পর মেয়ের আচরণ দেখে! একটু আগেই যে মেয়েটা প্রচন্ড অভিমান আর রাগ দেখাচ্ছিলো তার প্রেমিকের সাথে, সে-ই আবার তার বান্ধবীদের সাথে খুব হেসে হেসে গল্প করছে! এবং গল্পের বিষয়বস্তু এই যে সে আজ তার প্রেমিককে খুব একচোট নিয়েছে! এটা নিয়ে বান্ধবীদের সাথে তার খুব কৌতুক হলো! বাস ছাড়ার আগ মুহুর্ত পর্যন্তও ছেলেটা গোবেচারা মুখে বাসের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। মেয়েটা হাসি-ঠাট্টার ফাঁকে এটাও দেখে নিয়েছে ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে কি না, এবং তাদের কৌতুকের বিষয়বস্তুতে এটাও বাদ পড়লো না যে ছেলেটা এত কিছুর পরও ‘তার একান্ত বাধ্যগত’!! আমি মনে মনে হাসলাম, ‘হায়রে প্রেম!’
কিন্তু সেই সাথে কিছু বিষয় আমার ভাবনাকেও খোরাক জুগিয়েছে! মানুষ আসলে প্রেম করে কেন? কোনো সম্পর্কে কেন জড়ায়? ভাবছি মেয়ে এবং ছেলে দু’পক্ষের কথাই! অনেক মেয়েকেই আমি এভাবে ভাবতে দেখেছি যে তাদের প্রেমিক তাদের জন্য সকল অর্থ ব্যয় করতে বাধ্য! প্রেমিকের টাকায় মোবাইল কেনা, জামা-কাপড়-শাড়ি কেনা ইত্যাদি ইত্যাদি! যে প্রেমিক এসব চাহিদা ‘বলিবামাত্র মেটাতে অপারগ’ তারা আসলে প্রেমিকের পর্যায়েই পড়ে না! এই মেয়েগুলো প্রেম করে কিসের জন্য? একটা আর্থিক কোষাগার হিসেবে প্রেমিককে ব্যবহার করার জন্য? যতক্ষণ সেই ছেলে তাকে আর্থিক সেবা দিতে পারছে, দামি গিফট দিতে পারছে, যখন তখন শাড়ি-গহনা কিনে দিচ্ছে, দামী রেস্টুরেন্টে নিয়ে খাওয়াচ্ছে, ততক্ষণ তার সাথে সম্পর্ক।
আর একটু উনিশ-বিশ হলেই সেই সম্পর্ক ‘বিষময়’ হয়ে ওঠা! প্রেমিকেরা আবার কিছু মেয়ের কাছে ‘গাধা’র বিকল্প ভারবাহীও হয় বটে! বই-খাতা-জিনিসপত্র-শপিং ব্যাগ থেকে শুরু করে পারলে মেয়েটার হ্যান্ডব্যাগও কাঁধে করে বহন করা তার একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য! তাদের আরেকটি একান্ত কর্তব্য সবসময় মেয়েটার সাথে সাথে সবজায়গায় উপস্থিত থাকা এবং ‘ব্যক্তিগত সহকারী’র মতো মেয়েটিকে পানি খাওয়ানো থেকে শুরু করে বাসায় পৌঁছে দেয়ার কর্তব্য পালন করা! দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে কোনো ভুল হলে চাকরি নট! এই মেয়েদের ‘ভালোবাসা’র অনুভূতির জায়গাটা আসলে কোথায়?
আমার হয়তো পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যায় ভুলও হতে পারে! তবে আমি বেশির ভাগ মেয়েদেরকেই এভাবে প্রেম করতে ও প্রেম বিষয়ে ভাবতে দেখি! ভার্সিটিতে যখন কমনরুমে গিয়ে বসি, তখন বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের মেয়েদের আড্ডায় অনেক ধরণের কথা শুনি। কার বয়ফ্রেন্ড কি করেছে, কি কিনে দেয় নাই, কি দিয়েছে, কোন মেয়ের দিকে তাকিয়েছে, কোন মেয়ের কথা বেশি বলে,কার এক্স গার্লফ্রেন্ড কি করেছে...ইত্যাদি ইত্যাদি! আমি খুব মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শুনতে এবং আচরণ পর্যবেক্ষণ করতে চেষ্টা করি! বুঝতে চেষ্টা করি, কে কেমন ভাবে কি ভাবছে! তাতে দেখেছি, বেশির ভাগ মেয়েরই দৃষ্টিভঙ্গিগুলো খুব বৈষয়িক! ‘কার প্রেমিক কত ভালো’-এরকম একটা প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতা সবার মাঝে কাজ করে! যার প্রেমিক যত দামী মোবাইল গিফট করেছে সে তত বেশি রেটিং প্রাপ্ত! এই রেটিং এর মানদন্ড একদমই বৈষয়িক! ভালোবাসার মানদন্ডও তাই!!
এই প্রসঙ্গ নিয়ে লিখতে শুরু করলে অনেক কথা লেখা যায়! কিন্তু তাতে ব্লগ পোস্ট হিসেবে এর শারীরিক গঠন অনেক ভারী হয়ে যাবে! এমনিতেই অনেক বড় লিখে ফেলেছি। তবে এই প্রসঙ্গগুলো অনেক আলোচনার অবকাশ রাখে। সামাজিক এবং মনোবৈজ্ঞানিক দুই দৃষ্টিকোণ থেকেই।
সবার কাছে একটা প্রশ্ন – ভালোবাসার মানদন্ডটা ‘বৈষয়িক’ হওয়াটা আপনার কাছে ব্যক্তিগতভাবে কতটা যুক্তিযুক্ত ???
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।