কবিতা লিখি, প্রবন্ধ লিখি, গল্প লিখি, রম্যরচনা লিখি, মানে লেখার চেষ্টা করি আর কী!
মুসাবিদা - ৪ (সুনীল সাগরে)
“ভোরবেলায় বৃষ্টি একজন সাক্ষী চেয়েছিল, তাই আমি হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে বাইরে আসি” (কত দূরে)।
কাকলি বাইরে এসেই বুঝতে পারল, ভুল করেছে। এ বৃষ্টি ঠিক মীর্জাপুরের নিরীহ বৃষ্টি নয়। সাগর ঘেঁষা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দু’তিনটে ঝাপটা হজম করার পর, এক দৌড়ে বিছানায়।
“কোথায় নামলো ঝড় - এখানে আকাশে
মেঘ ছোঁয়া পাখি এক ভয় পেয়ে ঘরে ফিরে আসে” (ঝড়)।
অনিমেষ, কাকলির স্বামী, তখনও নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। কাকলির মনে পড়ল, দাদার বন্ধু অনিমেষ, প্রায় রোজই আসত ওদের বাড়ি। হঠাৎ করেই ওকে ভালো লাগতে শুরু করল। কিন্তু মনের কথা জানান দেওয়া কঠিন, খুব কঠিন। ঠিক এই সময়ে নীললোহিতের “স্বপ্ন লজ্জাহীন” পড়ে মনে হলো, ঠিক, ঠিক, এটাই তো আমার মনের কথা।
“প্রবন্ধ ও রম্যরচনা, অনুবাদ, পাঁচ বছর আগের
শুরু করা উপন্যাস, সংবাদপত্রের জল মেশানো
গদ্য থেকে আজ এই সাড়ে দশটায় আমি সব ভেঙ্গেচুরে
উঠে দাঁড়াতে চাই” – (নীরা ও জিরো আওয়ার)
মতি নন্দী লিখেছিলেন, ভারতবর্ষে দু’জন “সু.গা” আছেন। একজন সুনীল গাভাস্কর, হাজার হাজার রান করেছেন, অন্যজন, সুনীল গাঙ্গুলী, শ’য়ে শ’য়ে উপন্যাস, গল্প, কবিতা লিখে গেছেন। একটা সভায় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলেছিলেন, আমি সুনীলের চারাগাছ থেকে মহীরুহ হয়ে ওঠা সামনে থেকে দেখেছি। আমরা পাঠকরাও কি দেখি নি?
“ইন্দিরা, লক্ষ্মী মেয়ে, তোমার একথা ভোলা উচিৎ নয়
মেঘের প্রাসাদে বসে তোমার করূণ কন্ঠস্বরেও
কোনো সর্বজনীন দুঃখ ধ্বনিত হবে না
তোমার শুকনো ঠোঁট, কতদিন সেখানে চুম্বনের দাগ পড়েনি”।
দুঃসাহসিক! ওই “শুকনো ঠোঁট” আর “চুম্বনের” ব্যাপারটা কেউ ইন্দিরা গান্ধীর কানে তুলেছিলেন।
ইন্দিরা মন্তব্য করেছিলেন, “নটি”। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এমনটাই লিখে থাকেন। সরাসরি।
“কাচের চুড়ি ভাঙ্গার মতোই ইচ্ছে করে অবহেলায়
ধর্মতলায় দিনদুপুরে পথের মধ্যে হিসি করি” (ইচ্ছে)
“বহু অর্চনা করেছি তোমায়, এখন ইচ্ছে
টেনে চোখ মারি” (চেনার মুহূর্ত)
সেবার কাকলি ক’দিনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি ছিল। প্রচুর লোকজন আসত বিকেলবেলার দিকে।
ভালো লাগত। তবে মাঝে মাঝে দর্শনার্থীদের আলাপ-আলোচনা শুনে মনে হত, ওঁরা কেন এসেছেন, সেটাই সম্ভবত ভুলে গেছেন।
“একবার হাসপাতালে যাও সুস্থ একটা আপেলের মতো
শায়িতা মূর্তিরা সব তোমাকে ঠোকরাবে চোখে চোখে
ছিমছাম নার্সেরা ঘুরবে, অবিন্যস্ত নম্রতায় নত
দৈনিক চাকরির মতো আত্মীয়েরা মুহ্যমান ধরাবাঁধা শোকে”। (একবার হাসপাতালে যাও)
কাকলিরা এখন পুরীর কাছে, কেদার-গৌরী ঘুরতে গেছে। গাইড বললেন, এখানকার জল খুব ভালো।
নিয়ে যান, খেলে সংসারে ঝগড়াঝাটি থাকবে না। অনিমেষ, স্বভাব রসিক, এক কথায় সে প্রস্তাব নাকচ করে দিল। ওর কথায়, সংসারে একটু-আধটু ঝগড়াঝাটি না থাকলে, সব কেমন একঘেয়ে, পানসে হয়ে যায়।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সব রকম লেখায় এই “একঘেয়ে” বা “পানসে” না হয়ে যাওয়াটা বোঝা যায় খুব স্পষ্টভাবে। একদম খোলা মনে একই সঙ্গে সুখ, দুঃখ, আনন্দ, প্রেম, বিরহ সব এসেছে তাঁর লেখায়।
“যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাব!
বিষণ্ণ আলোয় এই বাংলাদেশ
নদীর শিয়রে ঝুঁকে পড়া মেঘ
প্রান্তরে দিগন্ত নির্নিমেষ -
এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি
যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো
আমি বিষপান করে মরে যাব”।
ওপরের লাইনগুলোতে “আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো” একটু যেন পুরোনো ভাষা। কিন্তু খেয়াল করলে দেখবেন, ওটা অমোঘ। অমনভাবে লেখা বলেই লাইনটা পুরোনো দিনের দুরন্ত তৈলচিত্রের মতো হাজির পাঠকের চোখের সামনে।
আজ সমুদ্রের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার কথা ছিল খুব ভোরে।
বিছানা-কাতর অনিমেষকে দেখে খুব মায়া হল কাকলির। ঘুমোক লোকটা। অনিমেষ সময় মতো বাড়ি না ফিরলে, কাজের লোক না বলে কামাই করলে, বেড়াতে যাওয়া হঠাৎ বাতিল হলে, আরও অনেকের মতো, কাকলিরও মাথায় ঘোরে একটা লাইন -
“কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি” (কেউ কথা রাখেনি)
এই কবিতার সৃষ্টি কাহিনিও চমকপ্রদ। বারবার একজন প্রকাশককে কথা দিয়েও কবিতা না দিতে পারার থেকেই ওই প্রথম লাইন। সেটাও কবির কথা অনুযায়ী, প্রকাশক বাইরের ঘরে বসে আছেন, আর উনি ভেতরের ঘরে বসে লিখছেন।
তাৎক্ষণিক। ভাবা যায়! আমরা নিশ্চিত, নাগেরবাজারের ওই ঘরটা আরও এমন অনেক বিস্ময়কর সৃষ্টির সাক্ষী হয়ে আছে।
কাকলি, প্রচুর কবিতা পড়ার ফাঁকে, মাঝে মাঝে কবিতা লেখার চেষ্টা করে। কী ভাবে আসে কবিতা? সেদিন হঠাৎ চোখে পড়ে গেল, একটা কবিতা আর তার সৃষ্টিসুখের উল্লাস।
“প্রতিধ্বনি, তুমি তো স্বর্গের দিকে গিয়েছিলে
কেন ফিরে এলে
এই আমূল নশ্বর, শূন্যমাঘ, শরীরের কাছে”
এই কবিতা সৃষ্টির পেছনের ঘামের দাগগুলো কবি সামনে এনে দিয়েছেন।
তিন নম্বর লাইনটা সম্বন্ধে কবি লিখেছেন, “যে কোনো কবিতার তৃতীয় লাইনই বোধ হয় সবচেয়ে শক্ত। এভরি থার্ড থট ইজ মাই কিলার,..”। আর লিখেছেন, “‘আমূল’ শব্দটা আমি পাই একটা মাখনের (খালি) টিনের প্রতি চোখ পড়তে। কিন্তু সে সময় আমি পেচ্ছাপ করতে যাই। সুতরাং ও শব্দটা বসাতে ইচ্ছে হলো পুরুষের দন্ড অর্থে।
শুধু শরীরই নশ্বর নয়, ও জিনিসটা আরও আগেই নশ্বর যে। ‘শূন্যমাঘ’ শব্দটা কেন বসিয়েছি, ফ্র্যাঙ্কলি জানি না”।
কাকলির সবচেয়ে ভালো লেগেছে ‘শূন্যমাঘ” শব্দটা নিয়ে কবির সরল স্বীকারোক্তি। এখানেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর লেখার মতোই খোলামেলা, অকপট, অনন্য।
“সুনীল” সাগরে ঢেউ গুনতে গেলে দু’তিন জন্ম লেগে যাবে জেনেই কবিতার ডানা মেলা নিয়ে ব্যস্ত।
অজস্র প্রজাপতির ভিড়ে কাকলি কি কখনও “নীরা”কে হিংসে করতে শুরু করে!
“এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে কোনো পাপ করতে পারি”? (সত্যবদ্ধ অভিমান)
“নীরা, শুধু তোমার কাছেই এসে বুঝি
সময় আজো থেমে আছে”। (বয়েস)
“নীরা, মনে পড়ে, এই নদীর তরঙ্গে
তোমার শরীরখানি একদিন
অপ্সরার রূপ নিয়েছিল”? (যা ছিল)
“সিঁড়ির ধাপের মতো বিস্মরণ বহুদূর নেমে যায়
ভুলে যাই নীরার নাভির গন্ধ
চোখের কৌতুকময় বিষণ্ণতা
নীরার চিবুকে কোনো তিল ছিল”? (কৃতঘ্ন শব্দের রাশি)
উফ! নীরা, নীরা আর নীরা! এরপরেও আছে অনুপম প্রেমের অনন্য উদাহরণ, অক্ষর রোমান্টিকতায়।
“নীরার অসুখ হলে কলকাতায় সবাই বড় দুঃখে থাকে
সূর্য নিবে গেলে পর, নিয়নের বাতিগুলো হঠাৎ জেনে নেয়
নীরা আজ ভালো আছে”। (নীরার অসুখ)
এখানে এসে ‘নিবে’ শব্দটায় চোখ আটকে যায় কাকলির। কথ্য ভাষা বোধহয় একেই বলে।
ওই একটা শব্দ যেন ভাষার আন্তরিকতাকে দ্বিগুন করে দেয়। এরপর কাকলির চোখ আটকে যায় একটি কবিতার শেষ তিন লাইনে -
“আসলে কবির শেষ মুহূর্তটি মোটামুটি আনন্দেই কাটলো
মাটিতে পড়ে থাকা ছিন্ন হাতের দিকে তাকিয়ে তিনি বলতে চাইলেন,
বলেছিলুম কিনা, আমার হাতে শিকল বাঁধা থাকবে না”। (কবির মৃত্যুঃ লোরকা স্মরণে)
আন্তরিকতা থেকে এক লাফে সহমর্মিতায় পৌছে যাওয়া। পুরো কবিতাটা শেষ করতে হয় একটা ঘোরের মধ্যে। আচ্ছা, কবিও কি সেই ‘ঘোরের’ মধ্যেই লিখেছিলেন এই কবিতা?
কাকলিদের এবার বাড়ি ফেরার সময় হলো।
আজ রাতে ট্রেন, কাল সকাল থেকেই আবার দিনগত পাপক্ষয়। এ’কটা দিন দারুন কাটলো। মন খারাপের সন্ধ্যায়, কয়েকটা লাইন -
“ওপাশে নীরেনবাবুর বাড়ি, থাক। এ সময় যাওয়া চলে না - ডাকাতের
ছদ্মবেশ ছাড়া
চায়ের ফরমাশ করলে নিশ্চয় চা খাওয়াতেন, তিনদিন পরে
অন্য প্রসঙ্গে র্ভৎসনা”। (বাড়ি ফেরা)
কাকলি মুচকি হেসে ওই কবিতার শেষ লাইনে ঢুকে গেল, “আয়নায় নিজের মুখ চিনে নিয়ে বারান্দা পেরিয়ে ঢুকবো ঘরে”।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।