আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইটালীতে আসার আগে ভাববেন কি একটু?

আমি খুব ভালো ব্লগ লিখি না। আমার দরকারি জিনিষ গুলো যাতে না ভুলে যাই তাই লিখি।

বাংলাদেশের শ্রম বাজারে ইটালী এক স্বপ্নময় রাজ্য। সে স্বপ্নকে বাস্থবায়ন করার জন্য কতজন যে জীবন বাজি রেখেছে আর কতজন যে জীবন বিলিয়ে দিয়েছে তার হিসেব হয়ত কাগজে কলমে কোথাও পাওয়া যাবে না- হ্যাঁ পাওয়া যাবে শুধু গল্পে গল্পে। আজ সে গল্পের কথাই বলব।

তবে এ গল্প কিন্তু শুনা গল্প নয়, চর্ম চোখে দেখা আর সময়ের বাস্তবতায় উপলব্দি করা। আমি এখানে শুধু নামগুলো কাল্পনিক ব্যাবহার করব আর বাকি সবই নিরেট বাস্তব-যা আমি স্বয়ং না দেখলে হয়ত নিজেও বিশ্বাস করতামনা। বাজি-১: সে দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু অফিসিয়াল কাজ শেষে রাস্থায় নামতেই এক বাংলাদেশী যুবকের সাথে দেখা। বাচ্চাদের খেলনা বিক্রি করছে। নাম কি, বাড়ী কোথায়, কবে এসেছেন.........এসবের মাঝেই শুনলাম তার জীবন বাজির কথা।

রফিকুল ইসলাম, বাড়ী খুলনা। ইটালী এসেছেন ৯ মাস। এক বন্ধু রুপী দালালের সাথে কন্ট্রাক হয় স্পন্সর ভিসা প্লাস ওয়ার্ক এর গেরান্টি, তাকে দিতে হবে ১৪ লাখ টাকা আর বিমান ভাড়া রফিকুলের নিজের। সব মিলিয়ে ১৫ লাখ খরচ হবে। কিন্তু এত টাকা রফিকুল কোথা থেকে জোগাড় করবে।

এ চেষ্ঠা সে চেষ্ঠায় মাত্র ৩ লাখ টাকা জোগাড় করতে পেরেছে। হাল ছাড়েনি রফিক- কেননা সে বিশ্বাস করে স্বপ্নের দেশ ইটালীতে পৌছতে পারলেই মাসে লাখ টাকা। এর জন্য জীবন বাজি রাখতেও প্রস্থুত। এবং তাই করল রফিক। দালালের সাথে কথা ফাইনাল- ৩ লাখ ক্যাশ, ৮ লাখ বাড়ী বাবদ (বাড়ীর বাজার মূল্য তখন ২০ লাখ রফিকের ভাষায়) আর বাকী ৩ লাখ আরেক বাড়ী বাবদ স্ট্যাম্প করে দিবে- ৬ মাসের মধ্যে টাকা দিতে না পারলে ২য় বাড়ীর মালিকও হয়ে যাবে দালাল।

যেখানে মাসে কম করে হলেও লাখ টাকা কামানো যায় সেখানে ৬ মাসে ৩ লাখ টাকা কোন ব্যপারইনা। দরকার হলে ৮ ঘন্টার বদলে ১২ ঘন্টা কাজ করবে। দালাল আরও বলেছে এয়ারপোর্ট থেকে লোক এসে তোমাকে সোজা কর্ম স্থলে নিয়ে যাবে............রফিক ইটালীতে এসে পৌছল। কথা অনুযায়ী একজন এসে রিসিভও করল এবং নিয়ে একটি মেসে উঠিয়ে দিল। ঐ লোকের দায়িত্ব শেষ।

চলে যাবার সময় বলে গেল ২ দিন রেস্ট নিয়ে কাজ খুজতে থাক। বেধে গেল তর্ক.........ঐ লোকের শেষ কথা আমি তোমাক চিনিনা, তোমার সাথে আমার কোন কন্ট্রাক্ট হয়নি। শুরু হল রফিকের স্বপ্ন ভঙ্গের পালা। ইটালীতে এসে সে জানতে পারল তাকে যে ভিসা দেয়া হয়েছে সেটা স্পন্সর ভিসা নয়- এগ্রিকালচার ভিসা যার মেয়াদ মাত্র ৬ মাস এবং সেটা রিনিউ হবেনা। ......।

। রফিক আর এখন স্বাভাবিক আচরন করতে পারেনা, একটুতেই রেগে যায়, নামায পড়াও ছেড়ে দিয়েছে (মুখে সুন্দর দাড়ি আছে, বুঝা যায় নামাজী লোক), আল্লাহ আছে বলেও আর বিশ্বাস করেনা- থাকলে আজ তার এ অবস্থা হবে কেন। এক বাড়ী বিক্রী করে ইটালী এসেছি আরেকটিও দালাল নিয়ে যাচ্ছে............। কথা বলতে বলতে আমি আর রফিকের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। ৯ মাস পার হয়ে গেছে এখনও ৩ লাখ টাকা জমাতে পারেনি।

কিছু টাকা দিয়ে দালালের কাছ থেকে আরেকটু সময় নিয়েছে। বললাম মেম্বার চেয়ারম্যানকে বলে দালালকে শায়েস্তা করেন। বলল ওরাও দালালের পক্ষে। তাছাড়া আমিতো স্ট্যাম্পে লিখে দিয়ে এসেছি ৬ মাসের মধ্যে টাকা না দিতে পারলে বাড়ী ওর দখলে চলে যাবে। জানিনা রফিক তার বাড়ী রক্ষা করতে পেরেছে কিনা।

বাজি-২: আমার ফ্যাকাল্টির কাছে একটা বাজার আছে সেখানে ব্যবসা করতে আসে এক ভাই- নাম মুসফিক। কথা বার্তা বলে বেশ শিক্ষিত মনে হল। প্রতি শনি রবি বার যেতাম উনার সাথে গল্প করতে। কেননা আমার বাসার কাছাকাছি উনিই একমাত্র বাংলাদেশী। গল্পে গল্পে শুনলাম উনার ইটালী আসার কাহিনী।

চিত্রপরিচালক হলে হয়ত সিনেমাও বানিয়ে ফেলতাম। বাড়ী বরিশাল, অনার্স করেছেন বিএম কলেজ থেকে। চাকরী করতেন শীপে, ঘুরে বেড়াতেন এ দেশ থেকে ঐ দেশে, বেতন পেতেন ১০০০ ডলারের মত। এরমধ্যে বিয়ে করেছেন লাখ টাকা খরছ করে। বিয়ের পর বাড়ীতে ছিলেন ২ মাস।

আবার গেলেন শীপে। শুনলেন ইটালীর গল্প আর শুরু করলেন স্বপ্ন দেখতে। এক ট্রিপে গেলেন ইটালীতে আর ফিরে আসেননি। থেকে গেলেন অবৈধ ভাবেই, আশা কিছুদিন পর সরকার হয়ত সবাইকে বৈধ করে নিবে আগের বারের (২০০২ সালের)মত। দিন যায় মাস যায় বছর যায় সরকার আর বৈধতার ঘোষনা দেয়না।

বৈধ কাগজ পত্র ছাড়া কাজও পাওয়া যায়না। নেমে পরলেন স্ট্রীট বিজনেসে, যা জীবনে কখনও ভাবেননি। যা রোজগার হয় তাতে কোন রকম জীবন চলে। লজ্জায় মানুষের সাথে মিশেনও কম। একদিন বলল মা খুব অসুস্থ, ছোট ভাই ঢাকায় নিয়ে এসেছে।

কাজে মন দিতে পারেননা মায়ের চিন্তায়। মা নাকি বলে আমি তোর চিন্তায় আরও বেশী অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। দেশে চলে আয় বাবা। কিন্তু মুসফিক ভাই আমাকে বলে কি করব দেশে যেয়ে বলুন, এই বয়সে কি কেউ আমাকে চাকরী দিবে? ব্যবসা করব সে পুঁজিওতো জোগার করতে পারিনি। এরিমধ্যে ২০০৮ এর আগস্টে মা মারা গেলেন।

যেতে পারেননি দেশে। কারণ কাগজ নাই, গেলে একেবারেই যেতে হবে। এ দিকে ইটালীতে নতুন সরকার এসেছে ক্ষমতায়, দেখা যাক একটা কিছু করে কিনা সরকার। এভাবেই মুসফিক ভাইয়ের কেটে গেছে ৫ বছর। স্বপ্ন আর পুরন হচ্ছেনা ।

অন্য দিকে উনার স্ত্রী পথ চেয়ে বসে আছে, ২ মাস মাত্র কাছে পেয়েছে স্বামীকে। চেনা জানাই হয়নি ঠিক মত। এ কেমন জীবন বাজি! বাজি-৩: ইটালীতে আসার জন্য জীবন বাজি রাখা আরেক যুবকের নাম পবন, বয়স ২৪-২৫, বাবা-মার একমাত্র সন্তান। বাবার সারা জীবনের কস্টার্জিত ৮ লাখ টাকা তুলে দেয় দালালের হাতে ছেলের ভবিষ্যত মঙ্গল কামনায়। পবন ইটালীর উদ্দেশ্যে বাড়ী থেকে রওয়ানা হয় ২০০৬ সালে।

চীন-কিরগিস্থান-কাজাকিস্থান-রাশিয়া-ইউক্রেন-স্লোভাকিয়া-অস্ট্রিয়া হয়ে ১৭ মাস পর পৌছে ইটালীতে। পথে ঘটে নানা দূর্ঘটনা। কিরগিস্থানে চোখের সামনে মরতে দেখেছে এক সহযাত্রী বন্ধুকে। ইউক্রেনে এসে জেল খাটতে হয় ৫ মাস। স্লোভাকিয়াতে আসার পর শুনতে পায় তার শ্রদ্ধেয় বাবার মত্যু সংবাদ।

যে বাবা সারা জীবনের অর্জন ব্যয় করেছে ছেলের সুখের জন্য সে বাবা জেনে যেতে পারেনি তার ছেলে আদৌ স্বপ্নের দেশ ইটালীতে পৌছতে পারবে কিনা। এতকিছুর পরও পবনের স্বপ্ন ভংগ হয়নি। কিন্তু ইটালীতে এসে সে এসব কি দেখছে! এতদিন সে যা শুনেছে, ভেবেছে, কল্পনা করেছে সব সব মিথ্যে। বাবার প্রথম মৃত্যু বার্ষিকীতে মায়ের হাতে তুলে দিতে পারেনি ক�টা টাকা। এ বেদনা সে কাকে বুঝাবে কোথায় সে শান্তনা খুজবে।

পবন আমাক অনুরোধ করেছে তার কথাগুলো যেন আমি কলম বদ্ধ করি,মানুষকে জানাই, ভুল করেও যেন কেউ ইটালীর নাম মুখে না আনে। বাজি-৪: দেওয়ান ভাই, বাড়ী কুমিল্লা। প্রথম দেখাতেই বুঝেছি শিখিত ভদ্র চাকুজীবি মানুষ। চলনে বলনে বুঝা যায় দেশে থাকতে ভাল চাকরী করতেন। আস্থে আস্থে জানলাম ওনার সম্পর্কে।

চাকরী করতেন নীটিং ওয়ারে, পরে গ্রামীন ফোনে। বললেন, যা বেতন পেতাম তাতে বউ বাচ্চা নিয়ে খারাপ ছিলামনা। ওনার বোন-ভগ্নিপতি থাকে ইটালীতে। তাদের সহযোগীতাতেই ইটালী আসা। শশুর বাড়ীর কেউ মত ছিলনা।

তাও গল্প শুনে আর স্বপ্ন দেখা বাদ দিতে পারেননি। বোন-ভগ্নিপতিও ইটালীর বাস্তব অবস্থটা খুলে বলেননি। বেশ কিছু দিন ছিলেন বোনের বাসায়, কিন্তু কাজ মেলেনি ঐ শহরে। দেখতে দেখতে চোখের সামনে মিল-কল-কারখানা একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তারপর এ শহর থেকে ঐ শহরে ঘুরে বেড়িয়েছেন কোথাও কাজ পাননি বৈধ কাগজ পত্র থাকার পরও।

২০ মাস পার হয়ে গেছে এভাবে। থাকা খাওয়ার পয়সাও এখন রোজগার করা কঠিন হয়ে গেছে। দেওয়ান ভাই নিজেকে ক্ষমা করতে পারছেননা। কি যে ভুল করেছেন জীবনে। বাজি-৫: ইটালীতে আসার পর যার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় তিনি হলেন সগির ভাই, বয়স ৩০-৩২।

বাড়ী মাদারিপুর। দেশ ছেড়েছেন ১০ বছর আগে ২০০০ সালে। এ দেশ সে দেশ ঘুরে এসেছেন স্বপ্নের দেশ ইটালীতে। ইউরোপে পৌছতে উনার সময় লেগেছে ১বছর। কাগজের আশায় ছুটে গেছেন পর্তুগালে।

২ বছর সেখানে থেকেও কাগজ পাননি। শুনলেন ইটালী সরকার সবাইকে বৈধ করে নিচ্ছে, আসলেন ইটালীতে। ডকুমেন্ট সব জমাদিলেন ২০০২ সালে। আজ পর্যন্ত বৈধতার কাগজ পাননি। এখনও আশায় বুক বেধে আছেন, কাগজ পেলে তবেই বউ বাচ্চার সাথে দেখা করতে যাবেন।

ছেলের কথা মনে হলেই ঢুকরে কেঁদে উঠেন। বললাম দেশে যেয়ে ছোট খাট একটা কিছু করেন। আমাকে বলে, দেখুন থাকা খাওয়ার পয়সাই জোগাতে পারছিনা, একটা কিছু করতে গেলেতো পুঁজি লাগবে। তাছাড়া দেশের যে পরিস্তিতি কোন কিছুরইতো নিরাপত্তা নাই। ধরেন পুকুরে মাছের চাষ করলাম, দেখা গেল রাতের বেলা এসে কেউ বিষ ছিটিয়ে দিয়ে গেল............।

শেষ পর্যন্ত উনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ২০১০ এ কাগজ না পেলেও ফিরে যাবেন-তবে পুর্ন হাতে নয় শুন্য হাতে। সম্প্রতি ইটালী সরকার সিজনাল (মুলত কৃষি) কাজের জন্য ৮০০০০ লোক নিবে (বিভিন্ন দেশ থেকে) বলে বিজ্ঞাপন ছেড়েছে অনলাইনে। আবেদন পত্র জমা পরতে শুরু করেছে। আমি বাংলাদেশী ভাইদের অনুরধ করব আবেদন না করার জন্য। আমি একজন সচেতন মানুষ হিসেবে এ আবেদন রাখছি।

যদি ইটালী না আসার সিদ্ধান্ত নেন তাহলে এটি হবে আপনার জীবনের সবচেয়ে ভাল ও মুল্যবান সিদ্ধান্ত। যারা আমার এ লিখা পড়বেন তাদেরকেও আনুরোধ করব আপনার পরিচিতদের কেউ যদি ইটালী আসতে চায় তাহলে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করুন। পরের কিস্তিতে আপনাদের জানাব ৮-১০ লাখ নয় ৪-৫ লাখ টাকা হলে বাংলাদেশে থেকেই কিভাবে সাবলম্বী হতে পারেন। লেখক: পিএইচডি গবেষক, ইটালী, . মুল : Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।