কম্পিউটার বিশারদ পেশায়, নেশায় যুক্তিবাদী
আগেই বলে রাখছি - আমি কোনোভাবেই এল-টি-টি-ই ও প্রভাকরণের সমর্থক নই কিন্তু আমি তামিলদের বঞ্চনার ইতিহাসে তাদের সাথে সমব্যথী।
শ্রীলঙ্কায় তামিল-সিংহলী বিবাদ সম্পর্কে অনেকেওই সঠিক ধারণা নেই। প্রভাকরণের মৃত্যুর সাথে সাথে এই বিবাদের আশা করি অন্ত হল। আমি একটা সংক্ষিপ্ত টাইমলাইন দিলাম কিভাবে এই বিবাদের সূত্রপাত তা নিয়ে।
১৮১৫ - ব্রিটিশরা শ্রীলঙ্কা দখলে আনে।
১৮৩৩-১৯৪৮ - ব্রিটিশ শ্রীলঙ্কায় অসংখ্য তামিলদের ধরে এনে চা-বাগানের কাজে লাগানো হয়। এই সময় সংখ্যাগুরু সিংহলীরা তামিলদের বৈরীতার সূত্রপাত কারণ তামিলেরা ব্রিটিশদের হয়ে কাজ করত। এই তামিলেরা সারা শ্রীলঙ্কায় বিচ্ছিন্নভাবে থাকলেও উত্তরাঞ্চলে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। ব্রিটিশরা সুযোগ বুঝে ডিভাইড আর রুল চালিয়ে যায়। (সূত্র ১,২)
১৯৪৮ - সিলোন সিটিজেনশিপ আইনে তামিলদের শ্রীলঙ্কার নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়।
এই আইন অনুসারে শ্রীলঙ্কায় জন্ম হলেই কারো শ্রীলঙ্কার নাগরিকত্ব থাকবে তা নয়, বরং তার পিতা অথবা পিতামহেরও শ্রীলঙ্কায় নাগরিকত্ব থাকতে হবে। অপরদিকে ভারত সরকার ১৯৫০ সালে যারা ভারতে বসবাস করে তাদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। এর ফলে সরকারিভাবেই শ্রীলঙ্কার প্রায় অর্ধেক তামিল জনগণ (সংখ্যায় দশ লক্ষ - মোট জনসংখ্যার ১০%) নাগরিকত্ব বিহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। পরের বছরের ভোটে নাগরিকত্বকে ভোটার তালিকায় নাম তোলার মূল প্রমাণ হিসাবে দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। (সূত্র ১)
১৯৫৪ - তীব্র বিরোধিতার মুখে সিটিজেনশিপ আইনের রদবদল ঘটিয়ে কিছু তামিলদের নাগরিকত্বের ব্যবস্থা হয় নিবন্ধীকরণের মাধ্যমে।
এই সংশোধনীর মাধ্যমে ভারতীয় বা পাকিস্তানী তামিলেরা যদি একটানা ১৩ বছর শ্রীলঙ্কায় আছেন এমন প্রমাণ দেখাতে পারেন, তবে তাদের নাগরিক হিসাবে নিবন্ধন করার সুযোগ দেওয়া হল। আবার অন্যান্য ইচ্ছুক তামিলদের সরাসরি ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবার ব্যবস্থা করা হয় কলোম্বোয় ভারতীয় হাইকমিশনে। কিন্তু শ্রীলঙ্কায় এই নিবন্ধন পদ্ধতি অত্যন্ত ধীরে চলতে থাকে - মূলত তামিল-ভাষিদের ১৩ বছর একটানা থাকার প্রমাণ না থাকায়। ১৯৬৩ সাল অবধি আবেদনকারীদের মাত্র ৮ ভাগের ১ ভাগ জনগণ এই পদ্ধতিতে নাগরিকত্ব পায়। অপরদিকে একই সময়ের মধ্যে যতজন ভারতীয় নাগরিকত্বের আবেদন করেছিলেন, তারা সকলেই নাগরিকত্ব পেয়ে গিয়েছিলেন।
(সূত্র ১)
১৯৫৬ - সিংহলি ওনলি আইন অনুসারে তামিল ভাষাকে সবরকম স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করা হল। এই সময় তামিল ভাষাভাষিদের সংখ্যা ছিল ২০%। এমনকি উত্তরাঞ্চলের জন্যও সিঙ্ঘলী ভাষা বাধ্যতামূলক করা হল। এর ফলে তামিল মধ্যবিত্তদের পক্ষে সরকারি চাকরি পাওয়া একরকম অসম্ভব হয়ে গেল। আরো দুবছর পরে সরকার এই আইন প্রত্যাহার করে সিঙ্ঘলীকে মূল ভাষার মর্যাদায় রাখা হলেও তামিল ভাষাকে স্বীকৃতিতে আনা হল।
অনেক পরে ১৯৮৭ সালে এই আইন পুনর্বিন্যাস করে উভয় ভাষাকেই জাতীয় মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। (সূত্র ২)
১৯৫৮ - তামিল-সিঙ্ঘলী দাঙ্গায় কয়েকশ তামিলের মৃত্যু। পরবর্তী অধ্যায়ে তামিলেরা শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন অংশ থেকে উত্তরাঞ্চলে চলে আসে।
(সূত্র ২)
১৯৬৪ - দীর্ঘ আলোচনার পরে তথাকথিত নাগরিকত্ব বিহীন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৪:৭ অনুপাতে শ্রীলঙ্কা ও ভারতের মধ্যে নাগরিকত্ব বন্টনের প্রস্তাবনা হয়। এই চুক্তিতে প্রায় তিন লক্ষ তামিলকে শ্রীলঙ্কা নাগরিকত্ব দেবে ভারত দেবে পাঁচ লক্ষ তামিলকে ও তাদের ভারতীয় রাজ্য তামিলনাডুতে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে।
বাকি দেড় লক্ষ তামিলকে নিয়ে কোনো সিদ্ধানে পৌঁছন যায় নি। ১৯৮১ সালের মধ্যে এই প্রক্রিয়া শেষ করার কথাও হয়। কিন্তু ১৯৭৪ সালে হিসাবে দেখা যায় যেখানে এক লাখ তামিল ভারতে চলে গেছে ও বাকি এক লাখ ভারতীয় নাগরিকত্ব পেয়ে গেছে, সেখানে মাত্র ৬০ হাজার তামিল শ্রীলঙ্কার নাগরিকত্ব পেয়েছে। (সূত্র ১)
১৯৭০ - ভারত থেকে তামিল বই ও ম্যাগাজিন শ্রীলঙ্কায় আমদানি করা নিষিদ্ধ করা হয়। (সূত্র ২)
১৯৭৪ - ভারত ও শ্রীলঙ্কা বাকি দেড় লাখ তামিলকে সম-অনুপাতে ভাগাভাগি করে নিতে রাজী হয়।
(সূত্র ১)
১৯৭৬ - প্রথম তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ। এতকাল ধরে যে তামিলেরা শ্রীলঙ্কার নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন তারা নিজেদের জন্য একটি রাজ্যের দাবী রাখছিলেন। কিন্তু তামিল ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট এই বছরেই প্রথম স্বাধীন তামিল রাষ্ট্র বা তামিল ইলমের প্রস্তাব করে ও একটি ছোটো সংগঠন তৈরী করে। ১৯৭৭ সালের ভোটে এই সংগঠন বেশ কয়েকটি সিটও পায় কিন্তু শ্রীলঙ্কা সরকার তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী দাবীর জন্য তাদের রাজনীতি থেকে বহিষ্কার করে। কার্যত এর পরে এই গোষ্ঠীই জঙ্গী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়।
(সূত্র ২)
একই বছরে তামিল ইলমের সমর্থকেরা লেবাননের বেইরুটে প্রথম সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে যান। প্রশিক্ষক ছিল ইয়াসর আরাফতের নেতৃত্বে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন। শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ উপেক্ষা করে আরাফত সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ট্রেনিং চালিয়ে যেতে নির্দেশ দেন। (সূত্র ৩)
১৯৮১ - ভারত সরকারের সাথে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। চুক্তিশেষে দেখা যায় শ্রীলঙ্কা কোটার দুই-তৃতীয়াংশ মাত্র জনগণকে নাগরিকত্ব দিয়ে উঠতে পেরেছে।
১৯৮৬ সালে অন্য আরেকটি সংশোধনীর মাধ্যমে এই বাকিদেরও শ্রীলঙ্কার নাগরিকত্ব দেওয়া হয়, কিন্তু ততদিনে ক্ষতি যা হবার তা হয়ে গেছে। একই বছরে শ্রীলঙ্কার উত্তরাঞ্চলে জাফনা শহরে একটি দাঙ্গায় তামিল গ্রন্থাগার ও ওই শহরের জনপ্রতিনিধির (তামিল) বাড়ি পুড়িয়ে ফেলা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় স্থানীয় পুলিশও দাঙ্গাকারীদের সাথে হাত মিলিয়ে এই কাজে হাত দিয়েছিল। (সূত্র ১,২)
১৯৮৩ - ব্ল্যাক জুলাই মাসে এল-টি-টি-ই ও শ্রীলঙ্কা সেনাবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ শুরু। এল-টি-টি-ই প্রথমে আক্রমণ করে ১৩ জন সেনাকে মেরে ফেলে।
পালটা আক্রমণ চালিয়ে সেনাবাহিনী প্রায় চারশ (পৃথক হিসাবে তিন হাজার) তামিলকে মেরে ফেলে ও হাজার হাজার লোক গৃহহীন হয়ে ভারতে উদ্বাস্তু হয়ে আসতে শুরু করে। সারা দেশে দাঙ্গা শুরু হয় ও তামিলেরা সব বিভিন্ন প্রতিবেশীদের বাড়িতে বা মন্দিরে আশ্রয় নেয়। (সূত্র ২ http://en.wikipedia.org/wiki/Black_July)
এর পরবর্তী ঘটনা বহুল-প্রচারিত ও সকলেই জানে, তাই আর আলাদা করে লিখছি না।
সূত্র -
১) Nationality and international law in Asian perspective By Swan Sik Ko
২) Wikipedia - Click This Link
Click This Link
৩) http://www.atimes.com/ind-pak/DC09Df04.html
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।