দাগ খতিয়ান নাইতো আমার/ঘুরি আতাইর পাতাইর...
'ইবার আমার ৬ কিয়ার খেত নিবার লাগিই হিল (শীলা পাথর) আইছিল। ছফা খইরা লইয়া গেছিগে হখল ধান' এভাবেই প্রকৃতির প্রতি ােভ প্রকাশ করছিলেন সুনামগঞ্জের দেখার হাওরপাড়ের গ্রাম জানিগাও গ্রামেরর আধিভাগা কিষাণী জাহানারা খাতুন। তার মতো আরো অনেক কৃষকেরই সর্বনাশ করেছে শীলাবৃষ্টি আর খরা। তাই বোরো ফসল হারানো এসব কৃষক এখন সারা বছরের খোরাক নিয়ে রয়েছেন টেনশনে। তাছাড়া বর্তমানে ধানের মূল্য কম থাকায়ও কৃষকরা হতাশ।
কৃষকের মন খারাপ থাকার এসব কারণেই এবার অনেক কৃষকের উঠোনে বসবেনা চিরায়ত বাংলার পৌরাণিক কাহিনীর কিচ্ছার আসর!
বোরো ফসল ভালো হলে সুনামগঞ্জের কৃষকরা মনের আনন্দে রাতে কুপি বাতি জ্বালিয়ে নেকড়ে বিছানো উঠোনে বসে সপরিবারে কিচছার আসর উপভোগ করেন। আনন্দ ফুর্তিতে মজে কৃষক মন। কৃষক বাড়িতে বেড়ে যায় নাওরীদের আনাগোনা। ছেলেমেয়েদের ঘটা করে বিয়ে দেন কৃষকরা। এভাবেই যুগ যুগ ধরে বোরো প্রধান অঞ্চল সুনামগঞ্জের কৃষকরা ‘বৈশাখী’ তোলা শেষে বিভিন্ন উৎসবে মেতে উঠেন।
বাংলার সংস্কৃতিকে এই উৎসব সমৃদ্ধ করলেও তাদের জীবন আটকে আছে সমস্যার জালে।
শীলাবৃষ্টি ও খরায় বোরো ফসলের তি
জানিগাও গ্রামের কিষাণী আরিজা খাতুন জানান, তিনি ৯শ শতাংশ জমিতে ধান লাগিয়েছিলেন। প্রথম দিকে খরায় তার ধান তিগ্রস্থ হয়। তারপর বৈশাখের শুরুতে শীলাবৃষ্টিতে তার সব গুলো জমির প্রায় ৮০ ভাগ ফসলই তিগ্রস্থ হয়। শ্রমিকরা পারিশ্রমিক সম্ভাবনা না থাকায় এই ধান কাটতে অস্বীকার করায় তার ঘরের কামলা ও বাচ্চারা কেটেছে ধান।
৯শ শতাংশ ভূমিতে মাত্র ৪০ মন ধান হয়েছে তার। যা সার ও ব্যয়মূল্যর চেয়েও অনেক কম। এখন সারা বছরের খোরাকি নিয়েই তিনি ও তার পরিবার চিন্তিত। একই গ্রামের কিষাণী জাহানারা খাতুনের বোরো জমি আছেই মাত্র ১৮০ শতাংশ। সব জমিই তার শীলায় নিয়ে গেছে।
তার জমিতে ধানের বদলে কেবল নেকড়েই অবশিষ্ট থাকায় আর কাটা হয়ে উঠেনি। দেনাগ্রস্ত এই প্রান্তিক কিষাণী সারা বছর কিভাবে চলবেন তাই নিয়েই চরম চিন্তিত। তার ধানের উগার (ভাড়ার) এবার প্রায় খালি পড়ে আছে। উৎসবের কথা ভুলে গেছেন তিনি।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে সুনামগঞ্জ সদর, দণি সুনামগঞ্জ, বিশ্বম্ভরপুর ও তাহিরপুর উপজেলায় শীলাবৃষ্টি বোরো ফসলের ব্যাপক তি করেছে।
এসব উপজেলার বিভিন্ন হাওরের বোরো ফসল তোলার অনুপযুক্ত ছিল। যার ফলে শ্রমিকরাও পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক না পাওয়ায় কাটেনি।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার শাহপুর গ্রামের কৃষক ইকবাল আহমেদ জানান, তার ১০ কেদার জমিকে কাটার উপযুক্ত রাখেনি শীলাবৃষ্টি। সুদে ঋণ করে তিনি জমিতে ধান লাগিয়েছিলেন। কিন্তু পুরো জমির ফসল মার যাওয়ায় এখন সুদের দেনা পরিশোধ নিয়েই তিনি মহা টেনশনে।
তিনি বলেন, যেসব কৃষক ভালো ফলন পেয়েছেন তারাও এবার টেনশনে আছেন ধানের মূল্য কম থাকায়। গ্রামে বর্তমানে চারশ টাকা মূল্যে প্রতিমন ধান বিক্রি হচ্ছে বলে তিনি জানান।
সদর উপজেলার এরালিয়া গ্রামের কৃষক আলীনূর বলেন, ১৮০ শতাংশ জমিতে ভালো ফলন হয়েছিল। কিন্তু বৈশাখের শুরুতে শীলাবৃষ্টিতে তার েেতর ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। যা তোলেছেন তা দিয়ে সারের মূল্যই হয়নি।
তিনি বলেন, ধানের মূল্য কম থাকায় অনেকে ফসল ঘরে তোলার পরও সন্তুষ্ট নন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, তিন বস্তা ধানের মূল্য এক বস্তা সারের মূল্যের সমান!
কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের বক্তব্য
সুনামগঞ্জ কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে জেলায় হাইব্রীড, উফশী, স্থানীয়সহ বোরো ধানের আবাদ হয়েছে ১ল ৯৫ হাজার ৭শ হেক্টর। অর্জিত হয়েছে ২লাখ ২৫০ হেক্টর। যা ল্যমাত্রার চেয়েও বেশি। তাদের হিসেবে খরা ও শীলাবৃষ্টিতে মোট তি হয়েছে ১৫ হাজার ১শ হেক্টর।
কিন্তু মাঠ পর্যায়ের অবস্থা ঠিক তার উল্টো। যা জাহানারা খাতুনদের বক্তব্য থেকে অনুমেয়।
সুনামগঞ্জের কানলার হাওর, খরচার হাওর, জোয়ালভাঙ্গা হাওর, দেখার হাওরসহ বিভিন্ন হাওরের ফসল এবার শীলাবৃষ্টিতে ব্যপক তি হয়েছে। যার ফলে ঋণগ্রস্ত ও দায়গ্রস্থ কৃষকরা রয়েছেন টেনশনে।
সুনামগঞ্জ কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মোঃ আব্দুল জলিল জানান, খরা ও শীলা বৃষ্টিতে কয়েকটি উপজেলার হাওরের ফসলের কিছু তি হয়েছে।
তির পরিসংখ্যান কিভাবে নিরূপন হলো এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন তাদের ব্লক সুপার ভাইজারররা ফিল্ডে গিয়ে মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য নিয়ে এসে এই রিপোর্ট পেশ করেছেন্ এবং এই রিপোর্ট গ্রহণযোগ্য। কিন্তু সুনামগঞ্জের ব্লক সুপার ভাইজারদের সম্পর্কে রয়েছে কৃষকদের তিক্ত অভিজ্ঞতা। কারণ কে কোন ব্লকে কাজ করে তা জানেননা কৃষকরা। এবং তারা কখন ফিল্ডে যান তাও চোখে পড়েনা তাদের। কৃষকরা বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ করেছেন ঘরে ও অফিসে বসেই ব্লক সুপার ভাইজাররা মাঠের ‘গ্রহণযোগ্য’ রিপোর্ট দেন যা কৃষকদের কাছে বরাবরই ‘অগ্রহণযোগ্য’ হিসেবে বিবেচিত।
কৃষকমনে আনন্দ নেই: ভুলে গেছে উৎসব
ধান ভালো হলে সুনামগঞ্জের কৃষকরা গোলায় ধান তোলে বিভিন্ন আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেন। রাতে কুপি বাতি জ্বালিয়ে কৃষক উঠোনে বসে কিচ্ছার আসর। বউঝিসহ সবাই মেতে উঠে আনন্দে। রাতে আলোড়া দেয়া মাছভর্তি খলুই দেখে আবেগে উৎলে উঠেন কৃষক বধু। এমনই কৃষকবাড়ি উৎসবমুখর হয়ে উঠে।
জৈষ্ট আষাঢ় মাসে বেড়ে যায় নাইওরীদের আনাগোনা। কুস্তি-হাডুডুর আসর বসে গ্রামেরে মাঠে। কৃষক পরিবারের মেয়ে, বোনদের নাইওর আনা হয় বাড়িতে। তাদের সঙ্গে আসে স্বামী সন্তান ও শ্বশুর বাড়ির লোকজন। সবাইকে উপুযক্ত সমাদর করে পোশাক আশাক দিয়ে বিদায় করা হয়।
এই সময় অনেক কৃষক তাদের উপযুক্ত ছেলে মেয়ে, ভাই-বোনদের বিয়ে দেন। এভাবে সবাই নির্মল আনন্দে মেতে উঠেন। আর বোরা ফলনকে কেন্দ্র করেই এই আনন্দ আবর্তিত হয়। কিন্তু এবার কৃষি অফিস কর্তৃক বাম্পার ফলনের কথা বললেও বাস্তব অবস্থা ভিন্ন। খরা ও শীলায় ফসল হারিয়ে তারা দিশেহারা।
যাদের ফসল একেবারে মারা গেছে তারা উৎসব ’মিসের’ কথা ভেবে নয় উপযুক্ত ছেলে-মেয়ের বিয়ে শাদি ও সারা বছরের খোরাকি নিয়েই দিশেহারা!
এরালিয়া গ্রামের কৃষক ও গ্রাম্য ডাক্তার আব্দুস সবুর জানান, ‘বৈশাখী’ ঘরে তোলার পর কৃষকরা বিভিন্ন আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেন। এটা যুগ যুগ ধরে সুনামগঞ্জের চিরায়ত সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। কিন্তু এবার অনেক কৃষকেরই মন খারাপ। খরা ও শীলাবৃষ্টি মার খাওয়া কৃষকদের উৎসব-আনন্দ কেড়ে নিয়েছে। তিনি বলেন, সরকার এই ফসল মার খাওয়া কৃষকদের পূনর্বাসনের জন্য বিনা সুদের ব্যবস্থা করা উচিত।
কিচ্ছা শিল্পি সুরুজ আলীকে ‘মিস’ করছেন হাওরবাসী
সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলের কৃষকদের বৈশাখ পরবর্তী পুরো বর্ষা মওসুম যে মানুষটি তার সঙ্গী সাথীদের নিয়ে আনন্দে মাতিয়ে রাখতেন সেই মানুষটির নাম সুরুজ আলী। কিন্তু ীণকায় আতœসম্মান বোধসম্পন্ন সেই কিচ্ছা শিল্পি সুরুজ আলী আজ না ফেরার দেশে। গত বছর ৪ মে স্ত্রী ও দুই সন্তান রেখে দারিদ্রের নির্মম কাষাঘাত ও চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু হয়েছে তার। তাকে হারিয়ে তার প্রিয়তমা স্ত্রী মনজিলঅ ও তার কিচ্ছার টুল্লুক হিসেবে পরিচিত ছায়া সঙ্গী নূর আহমদও নির্বাক। তার স্ত্রী সন্তান ও রয়েছেন অবর্ননীয় কষ্টে।
সেই উৎসবমুখর মানুষটির পরিবারের খবর নিচ্ছেনা কেউ।
গ্রামীন মাটি, আলো হাওয়া আর সার্বিক আবহ তাকে মানুষের শিল্পি করেছিল। যার ফলে প্রতিটি উৎসবে তিনি আপন করে নিতে পারতেন শত শত দর্শকদের। মাত্র হাজার খানেক টাকা পারিশ্রমিক নিয়ে এই মহান শিল্পি রাত পার করে কৃষকদের আনন্দ দিতেন। আর এই স্বল্প আয়েই চলেেতা তার ও তার কয়েকজন সঙ্গীর সংসার।
টানা তিন যুগ তিনি কিচ্ছা গেয়েই কাটিয়েছেন। সামান্য চাহিদাই তাকে গ্রামের কৃষকদের কাছে মহান ও জনপ্রিয় করে তোলেছিল।
তার সব সময়ের ছায়া সঙ্গী নূর আহমদ জানান, সুরুজ আলীর সঙ্গে তিনি প্রায় ২শ আসরে কিচ্ছা পরিবেশন করেছেন। সারারাত বিরামহীন দর্শকদের নির্ঘুম রেখে সুরুজ আলী বলে গেছেন পৌরানিক কাহিনী নির্ভর কিচ্ছা। আর এই বিরামহীন রাতজাগাই তাকে রোগে কাবু করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।
তিনি বলেন, গহর বাদশা বানেছাপরী, ছয়ফল মুলক বদিউজ্জামাল, ইউসুফ জুলেখাসহ অসংখ্য কিচ্ছা বলতে গিয়ে মানুষকে আনন্দ দিতে যে ঢংয়ে কথা বলতেন তা বিরল। চরিত্রের প্রয়োজনে রঙ মেখে সঙ সাজলও মানুষটি ছিলেন কাদামাটির। তাই এরকম চল্লিশটি মুখস্ত কেচ্ছা বলে মাতিয়ে রাখতে পারতেন হাজারো দর্শকদের।
নূর আহমদ জানান, এই মহান শিল্পির জীবদ্দশায়ই বিভিন্ন অডিও প্রতিষ্টান প্রায় চল্লিশটি অডিও এলবাম বের করেছিল। কিন্তু কোন প্রতিষ্ঠানই তাকে পারিশ্রমিক ও রয়েলটি দেয়নি।
তিনি জানান, গ্রামের লোকজন এখন তার অবর্তমানে এই অডিও ক্যাসেট থেকেই তার কিচ্ছা শোনে এই মহান শিল্পিকে স্মরণ করছেন। তবে তার আশংকা এই ডিজিটাল বাংলাদেশে এক সময় সুরুজহ আলীদের এই অডিও ক্যাসেটের ঠাই হবেনা। তখন কি গ্রামীণ সংস্কৃতির নায়ক সুরুজ আলীরা হারিয়ে যাবেন!!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।