এই ব্লগের সব লেখা সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
মোটা কালো ফ্রেমের চশমাটির কাঁচগুলো আজকাল কেমন বড় বেশী ঝাপসা লাগে ... বার বার মুছেও সেই আগের মতো স্পষ্ট দেখা যায় না ... চোখ দুটো ও যেন বড় বেশী বেয়াড়া হয়ে গিয়েছে ... বলা নেই কওয়া নেই যখন তখন, বয়ে চলা নদীর মতো জলের ধারা বইয়ে দিতে থাকে ... ইজি চেয়ারটাতে দোল খেতে বেশ ভালই লাগে ... তবে এখান থেকে উঠতে গেলে শরীরটাকে যেন আজকাল অনড় পাথরের মত ভারি অনুভূত হয় ... সামনের জানালায় ভারী পর্দা দেয়ার কারনে বাইরের কড়া রোদ ঘরে প্রবেশ করে না ... এতে অবশ্য খুব বেশী সমস্যা না হলেও মাঝে মাঝে হালকা শীত অনুভূত হলেই জীর্নশীর্ন শালটি আকড়ে ধরে নিজের শরীরের গরমটাকে ভিতরে ধরে রাখার আপ্রান চেষ্টা করে যান তিনি ... দু ছেলে এক মেয়ের সবাই আজ বড় হয়েছে ... মেয়েকে তার মনের মত জায়গাতে বিয়ে দিতে পেরেছেন, আর বেশ সুখেই আছে সে ... ছেলেগুলোও আজ যার যার জীবনে প্রতিষ্ঠিত... একসাথে দু ভাই থাকলেও কখনো তারা একে অপরের সাথে ঝগড়া করে না, তবে দিন দিন কেমন যেন একটা দুরত্বের কালো ছায়া গ্রাস করে নিচ্ছে ওদের সম্পর্ক কে ... এ বাড়ীতে দু বৌ ছাড়াও তার ৪ - ৫ জন নাতি নাতনী আছে ... ওদের সবার কোলাহলে বাড়ীটি সবসময় গমগম করলেও একটি ঘরে থাকে জমাট নিঃস্তব্ধতা ... এ ঘরের একমাত্র বাসিন্দাটা যেন সবার মাঝে থেকেও আলাদা এক জগতে বসবাস করে ... বৌ-মা রা ঠিক কি কারনে এখানে আসে না, তা তার জানা নেই ... তবে একদিন ওদের একে অপরকে বলতে শুনেছিলেন তার ঘরে ঢুকলে নাকি ওদের দম বন্ধ হয়ে যায় ... ছেলে গুলো আজকাল সারা দিন বাইরে থাকে, অনেক রাতে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফেরে, তাই ওরাও সময় করে উঠতে পারে না তার কাছে আসার ... আগে মাঝে মাঝে বাড়ীর বাইরের লনে তিনি হাটতেন, কিন্তু ওটা এভাবে নিজের দখলে থাকলে নাকি নাতি নাতনীদের খেলায় অসুবিধা হয় ... তাই তিনি আর ওখানে হাটতে ও যান না আজকাল ... এক সময় পর্যন্ত সবাই একসাথে ডাইনিং টেবিলে বসে রাতের খাবার খেতেন ... কিন্তু তিনি অন্যদের মতো কাটা চামচ দিয়ে খান না বলে অন্যরা নাকি ঠিকমতো খেতে পারে না , ওরা আধুনিক সমাজে বড় হচ্ছে, তাই হাত দিয়ে খাওয়া দেখলে ওদের ঘেন্না করে ... এ জানার পরে থেকে তিনি আর ওদের সাথে বসে খান না ... কাজের বুয়ার দিয়ে যাওয়া খাবার একলা একলা নিজের ঘরে বসে খান ... তার শুধু একটাই শখের জিনিস আছে , আর তা হলো একটা পুরোনো ভাঙ্গা রেডিও, যারা উনার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি অনেক দিন ধরে পয়সা জমিয়ে কিনেছিল ... প্রতিদিন রাতে তারা এই রেডিও তে গান শুনতে শুনতে ঘুমুতেন ... তাই আজও তিনি এই ভাঙ্গাচোরো রেডিওটিতে গান শোনার চেষ্টা করেন ... আর মনে মনে তার কথা মনে করেন যিনি তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন দুর কোন এক অজানা দেশে ... কিন্তু আজকে যেন কার উচ্চস্বরের কথা তার কানে আসলো ... কেউ বলছে -- ঐ বুড়ো না মরলে এই টিনের বাক্সের আওয়াজ বন্ধ হবে না ... এর শব্দের জন্য তো ঘরে মেহমান পর্যন্ত আনতে লজ্জা হয় ... মুখে কয়টি অপ্রতিরোধ্য কষ্টের ভাজ ছাড়া তিনি আর কোন রকমের বিমর্ষতার ছাপ আসতে দিলেন না নিজের মাঝে ... শুধু কাপা দু হাতে পুরোনো সে রেডিওটাকে তার বিবর্ন চামড়ার কভারে মুড়ে ঠিক সেভাবেই দাফন করে দিলেন একটি কংকালসার টিনের বাক্সে যেভাবে তিনি তার সকল কষ্টগুলোকে পিতৃত্বের মমতায় মুড়ে বন্ধ করে রেখেছেন নিঃশব্দে ....
আজ তিনি বড় ক্লান্ত ... কাঁপাকাঁপা দুটি হাতে মোটা ফ্রেমের চশমাটা মুছে চোখে দিতেই যেন হঠাৎ এক রঙ্গীন আলোর ঝলকানিতে যেন উদ্ভাসীত হয়ে উঠলো চারিদিক ... আলোর তীব্রতা কমতেই দেখতে পেলেন তার প্রিয় মানুষটি হাসিমুখে দু হাত বাড়িয়ে তাকে ডাকছেন নিজের দিকে ..
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।