প্রান্তিক জনগোষ্ঠিগুলোর ভাষা ও জাতিগত অস্তিত্বের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও সমমর্যাদা দাবী করছি
মনশিক্ষা বা দেহতত্ত্বের গানগুলো বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী কাব্যসাহিত্যের মুল্যবান নিদর্শন। অষ্টাদশ শতকে বৈষ্ণব ধর্মের বলয়ে আসার পর থেকে মণিপুরী দের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিণ্পকলা প্রবলভাবে বৈষ্ণবদর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়। শ্রীচৈতন্যর ভক্তি আন্দোলন মণিপুরে পৌঁছলে তৎকালীন বাংলা অঞ্চল থেকে বঙ্গদেশ-পালা নামে একশ্রেণীর কীর্ত্তনভিত্তিক নৃত্যগীত সেখানে বিস্তার লাভ করে। এর সাথে মণিপুরীদের নিজস্ব সুর, তাল, রাগ-রাগিনী এবং তারসাথে নিজস্ব বাদ্যযন্ত্র যেমন পুঙ, করতাল, মঞ্জিলা, মাঙকাঙ, সেলবঙর, মইপঙ ইত্যাদির সমন্বয় সাধন করে মণিপুরী পালার নিজস্ব একটি ফর্ম প্রবর্তিত হয়েছিল। বৈষ্ণবধর্মের প্রভাবে জয়দেব, গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস, কৃষ্ণদাস প্রমুখের রচিত বৈষ্ণবপদাবলী তুমুল জনপ্রিয়তা পায়।
সে সময় ব্রজবুলি, মধ্যযুগীয় বাংলা, সংস্কৃত বা মৈথিলী ভাষায় রচিত এসব পদাবলী কীর্ত্তনগুলো সাধারন মণিপুরী শিল্পী ও পালাকারেরা অর্থ না বুঝেই গাইতো। বৈষ্ণব সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসেন মণিপুরী রাজারা । বৈষ্ণবধর্ম মণিপুরের রাজধর্মের মর্যাদা লাভ করে। পরবর্তীতে মণিপুরী 'অজা' বা গুরুরাও নিজেদের ভাষা বাদ দিয়ে বাংলা- ব্রজবুলিতে পালা ও গীতরচনা শুরু করেন। বর্তমানে মণিপুরী রাসলীলা য় যেসব গান গীত হয় সেগুলোর অধিকাংশ বাঙালী বৈষ্ণবপদকর্তাদের রচিত গান - মধ্যযুগের বাংলা, ব্রজবুলি নয়তো মৈথিলী ভাষায়।
বিংশ শতকের প্রথমভাগে মণিপুরীদের মধ্যে জাতিগত চেতনার পুনর্জাগরন ঘটলে মণিপুরী গুরুরা আবার নিজেদের ভাষায় গীতরচনার দিকে মনোযোগ দেয়।
রাসলীলা, নটপালা, বাসকসহ অন্যান্য কাব্যগীতাশ্রয়ী পালার মতোই মনশিক্ষা বা দেহতত্ত্বের গানগুলোর দার্শনিক ভিত্তি বৈষ্ণবিজম। তবে এই গানগুলোর বিশেষত্ত্ব হলো ধর্মীয় আচারের বাইরে এসে মণিপুরী চিন্তক ও সাধারনের লোকাচার চর্চার নিজস্বতার মধ্য দিয়ে স্বাতন্ত্র্য রূপ লাভ। এগুলোর সাথে আবহমান বাংলার বাউল, সুফী ও মারফতী ধারার যথেষ্ঠ মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
পুরাণ ও ধর্মগ্রন্থের শিক্ষাকে লোকাচারের সাথে সমন্বয় ঘটিয়ে মাতৃভাষার বাইরে বাংলা বা বৈষ্ণব পদাবলী ও কীর্ত্তন রচনার ধারাটি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা আজো অক্ষত রেখেছে।
এসব পদকর্তা বা পালাকারের বেশীর ভাগেরই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, নেই বাংলা বা ব্রজবুলি ব্যকরনের উপর প্রাথমিক ধারনা। তাই ভাষাগত সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও কেবল গুরুপরম্পরায় প্রাপ্ত জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে তারা মণিপুরী সুরের উপর ভাব-রস-ছন্দ অব্যহত রেখে অবলীলায় লাইনের পর লাইন বাংলা ও ব্রজবুলি কথামালা যেভাবে সাজিয়ে যান, ভাবতে অবাক লাগে। এখানে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী 'ইসালপা' বা পালাকার গোপীচাঁদ সিংহের একটি মনশিক্ষা ও একটি দেহতত্ত্বের গান হুবহু পত্রস্থ করা হলো।
মনশিক্ষা - ২১
ধনী কি গরীব সুখী বুঝা অতি বিষম দায়।
কোন ধনেতে কেবা সুখী অভাবে কেবা দুঃখী হায়।
।
ধনে সুখী বিদ্যায় সুখী পুত্রে সুখী বিশ্বময়।
চিরসুখের চিন্তাধারা করিছে সেই সুখী সর্বদা নয় । ।
ভবের মুক্ত সুখী গুরু শ্রীহরির চরন লভিছে যেই।
আপন ভোলা জন্ম মৃত্যু এই জগতে সত্য সুখী সেই। ।
দীন গোপীচাঁদে কহে মানব জন্মে পড়িল ছায়।
মানবাকৃতি ধরি জীবে হায় সাজ'তে বিষম দায়। ।
দেহতত্ত্ব - ১৪
রংমহল কল কব্জার ঘর দেহ কলেবর।
দেখনা চেয়ে পর্দা খুলে কিবা আছে তার ভিতর। ।
লক্ষ নাড়ি সারি সারি, মাংস পেশী জড়াজড়ি।
রাঙা রোধির তার ভিতরে স্রোতে বৈছে নিরন্তর।
।
অস্থি মজ্জা জোড়াজাড়া, মধ্যে আছে পেরাক মারা।
কব্জায় কব্জায় নারা-চারা তারি মধ্যে কারিগর। ।
ব্রহ্মান্ডেরই দুই জ্যোতিস্ক অতি যত্নে করে দৃষ্ট।
নাসারন্দ্রে রেচক কুম্ভক সাধনেতে রূপান্তর। ।
হৃদি পদ্ম সিংহাসনে বসে আছেন নিরঞ্জন।
যোগী ঋষি মুনিগনে না পায় ভজে নিরন্তর। ।
দীন গোপীচাঁদে বলে গণার দিন ফুরায়ে গেলে।
কল কব্জা সব অচল হবে দেহ হবে স্থানান্তর। ।
_____________________________________________
গোপীচাঁদ সিংহের জন্ম মৌলবীবাজার জেলার কমলগঞ্জের ডালুয়া নামের প্রত্যন্ত গ্রামে, বাংলা ১৩৩৮ সনে। ছোটবেলা থেকেই নাটকের প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল তাই নাটকের দল গড়েছেন।
নিজে নাটক লিখেছেন, অভিনয় করেছেন। ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও পাকিস্তানিদের বর্বরতার চিত্র তুলে ধরে লিখেন "বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ" নামের পালাগীতির পুস্তিকা। প্রকাশিত গ্রন্থ: গীতিকাব্য (২০০৫)। বৈষ্ণব পদাবলী, পালা, কীর্ত্তনের গান রচনা ও সুরারোপে সমান দক্ষ এই গুণী শিল্পীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই বললেই চলে। কেবল পিতা ভদ্র সিংহ ও পিতামহ দঙ্গ সিংহের কাছ থেকে পাওয়া জ্ঞান ও বিদ্যাটাই পুঁজি।
তথ্যসূত্রঃ
* Dr M. Kirti singh / Religious Developments in Manipur,1980
* N. Tomba Singha / Bhakti Rasa Numbumari, Imphal, 1969
* তরুন কুমার সিংহ / মণিপুরী নৃত্য প্রবেশিকা, ১৯৬৮
* গায়ত্রী চট্টোপাধ্যায় / ভারতের নৃত্যকলা, ১৯৯৫
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।