যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানী প্রকাশ্য পথে হত্যার প্রতিশোধ চায়না আমি তাদের ঘৃণা করি
ফায়ারব্রিক্সের চুলোটা সেই সাতসকালে জ্বলে ওঠে। গনগনে আগুনের লেলিহান শিখা কখনো ডানে-বায়ে বেঁকে যায়, আবার কখনো সোজা উপরে ধেয়ে ওঠে। গ্রাফাইড ইলেক্ট্রডস দিয়ে এমএস স্টিল গলানো হয়। লোহা গলে গলে তরল হয়ে পড়ে! এমএস রড হঠাৎ লম্বা হয়ে বেরিয়ে আসে। হাতে বস্তা দিয়ে বানানো দস্তানা পরে যে ছেলেগুলো লাল অভিব্যাক্তিহীন মুখে কাজ করে যাচ্ছে তাদের কারোরই বয়স ষোল-সতেরোর বেশী না।
গায়ে কিছু রাখতে পারেনা, একটা ছেঁড়া ময়লা গেঞ্জি কোনওমতে পেঁচানো!সেই যে কবে হাত-পায়ের লোম পুড়ে গেছে, তা আর গজায়নি। গজায়না। ভ্রু নেই। চোখের পাঁপড়ি নেই। পাঁপড়ির কি দরকার! মাস্কারা দেবে না তো! দুপুরে ওরা যখন আধাঘন্টার ছুটি পায় তখন কেউ কল্পনাও করে না, অথচ মনে মনে সকলেই নদীর ঠান্ডা জলে ডুব দেয়, সাঁতার কাটে, আবার ডুব দেয়- কিন্তু এবার জলে না, সেই ভয়ংকর বিপজ্জনক কাজে।
সময় গড়িয়ে একসময় ফেরার সময় আসে। ততক্ষণে কেটে গেছে ১২ ঘন্টা!
প্যান্টের হুক বানানোর কারখানায় কাজ করে আরো ছোট কিছু ছেলে। এদেরকে কেউ শ্রমিক বলেনা! শ্রমিক মানেই যেন বিশাল পেশিবহুল শরীরের কালোপনা এক দৈত্য, যে সারাক্ষণ কাজ করবে, আর মুখ বুজে অর্ডার শুনবে! সেই ছোট্ট ছেলেগুলো বলপ্রেসে ঘটাং ঘটাং শব্দে টিনের পাত কেটে কেটে হুক বানায়। বহুকাল আগে শ্রবনশক্তি হারিয়েছে! এখন কানের পাশে বোমা পড়লে ভাবে বেলুন ফাঁটল বোধহয়! এদেরও খেলাচ্ছলে কেটে যায় বারটি ঘন্টা! ঘুড়ি ওড়ানোর শখ গলাটিপে হত্যা করেছে কোন জনমে তা আজ আর মনেও নেই!
বার থেকে পনের-ষোল বছরের আরো শত শত ছেলে কাজ করে ম্যানুয়্যাল ডাইং ফ্যাক্টরিতে। ব্লাঙ্কাফল,কস্টিক,সোরা, রি-এ্যাক্টিভ ডাইস,ভ্যাট ডাইস আর বিষমাখানো কেমিক্যালস নাঙ্গা হাতে ঘেটে ঘেটে আঙ্গুলের ফাঁকে দগদগে ঘা হয়েছে প্রথম দিন দশেকের মধ্যেই! সেই ঘা খুব একটা কষ্ট দেয়না, শুধু ভাত খাওয়ার সময় জ্বলে ওঠে! কেন যে এরা কাটা-চামচে অভ্যস্ত হয়না!
ট্যানারীতে যারা আছে তারা কি সুখে যেন নেশা করেছে! পেটের নাড়িভুড়ি ঠেলে বেরিয়ে আসা গন্ধে দিব্যি মানিয়ে নিয়েছে।
ভয়ংকর টক্সিন বিষের দহনে সারা শরীর পুড়ে যাচ্ছে, তবুও একগুয়ে রোবটের মত কাজ করে যেতে হবে, কারণ এদের কেন যেন স্কুলে থাকার মত মনোনিবেশ ছিল না! কারা যেন বলেছিল-বাপের শীর্ণ দেহ, মায়ের ক্ষয়কাশি কিছুতেই সারবেনা যদি তুই কারখানায় না থাকিস! স্কুল আর কারখানা খুব কাছেই, কিন্তু ওদের কাছে সেই তেপান্তরের মাঠ পেরুনো দূরত্বে!
নাক ফুঁড়িয়ে কখনোই নাকফুল দেওয়ার সময় পায়নি, হাতের কাঁচের চুড়ি আর বদলানোর সময় হয়নি, অথচ জীবন বদলে ফেলেছে গার্মেন্ট নামক এক গোডাউনের ভেতরে! টিফিন ক্যারিয়ার হাতে যেদিন প্রথম ক্লপ্সিবল গেট গলে মেয়েগুলো ভেতরে ঢুকে গেল, সেদিনই তারা এই আল্ট্রাসিটির কেনা বাঁদী হয়ে গেল! ষোল থেকে আঠার ঘন্টার টানা খাটনির পর কল্পনায় ঘরে ফেরে, চুলো ধরায়, রান্না বসায়, একসময় গরম ভাত গ্রাস ভরে ভরে গিলতে থাকে..... বাস্তবেও গেলে, তবে গরম ভাত নয়, থুথু। সুপারভাইজার, পিএম বা জিএম এর চুমু নামক থুথু! এরপর আরো ক্লান্ত শরীরটা টেনে টেনে দোকানদার আর পাড়ার ইতরদের খিস্তি শুনতে শুনতে ঝুঁপড়িতে ফেরে। কোন কোন দিন রান্না করার শক্তিটুকুও থাকেনা।
কামারের হাপর টানছে যে ছেলেটি, তারও ঘুম পায়। চোখ মুদে আসে..... পাতা বুজলে যদি হাতুড়ি লোহার বদলে হাতে পড়ে, সেই আতংকে সেও ঘুমায়না।
জেগে থাকে অনির্বাণ।
এদের সকলেরই জীবনে দিন আসে, রাত আসে, ঘুম আসে, পিপাসা পায়, নদীতে ঝাপ দিতে ইচ্ছে করে, ঘুড়ি ওড়াতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে বনবন করে চরকি ঘোরায়, নাগরদোলায় উঠে আকাশ দেখে আসে! কিন্তু পেটের মরণ ক্ষুধা সেই সব চাওয়াগুলোকে গলাটিপে হত্যা করেছে। এদের শ্রমঘন্টা আট না বার, না ষোল তা এরা কেউ কোনদিন ভেবে দেখেনি। দেখার কথাও নয়, কেননা সেই মাপের চোখই এদের নেই! কারা যেন খুবলে তুলে নিয়েছে।
আমাদের এই অন্ধ মানুষগুলো যখন দিনের পর দিন চাবি দেওয়া পুতুলের মত মাথাগুজে কাজের উছিলায় জীবন শেষ করে অন্য জীবনের পথে ধাবিত হচ্ছে, তখন আমরা পেল্লাই আয়োজনে মাথায় লালপট্টি বেঁধে বিশাল মিছিল করছি। ঢোল-ডগর বাজিয়ে গেয়ে চলেছি-নিগ্রো ভাই আমার পল রবসন! হে হে হে হাতুড়ির ..... পল হেনরি..
আজকাল। হ্যাঁ আজকাল শ্রমিকদের আটঘন্টা কাজের দাবি প্রতিষ্ঠা করার সেই মহান মে দিবস ছিনতাই হয়ে গেছে। চরম প্রতিক্রীয়াশীল বুর্জোয়ারা এখন তাদের ফ্যাশনেবল ফেস্টিভেল হিসেবে নতুন এক উপলক্ষ আবিষ্কার করেছে-মে ডে! সারা দেশে নির্বিচারে শ্রমিকের অধিকার পদদলিত করে, শ্রমিককে বাপদাদার সম্পত্তিজ্ঞান করে, দাসানুদাস ভেবে তাদের সস্তা শ্রম নিংড়ে নিয়ে তারা কেতাবি সেমিনার আর নির্লজ্জ সভা করে চলেছে। আর নির্বোধ শ্রমিকরা দুবেলা দুটো খেতে পাবার বিনিময়ে অকাতরে দান করে চলেছে রক্ত আর ঘাম।
সভ্যতার কংক্রীট শরীরে একটু একটু করে পলেস্তারা লাগিয়ে দিচ্ছে সেই রক্ত আর ঘামের মিশ্রণ। আমাদের সভ্যতা তার রুপ-রস সহ একটু একটু করে বেড়ে উঠছে। আমরা আমাদের আরো একটি নিরুপদ্রপ দিন পার করে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হচ্ছি। আর ইতিহাসের পাতা থেকে কাট করে তুলে আনছি সেই মে দিবসের অমৃত বাণী—
“ আজ পহেলা মে, মহান মে দিবস। বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সংহতি প্রকাশের গৌরবময় একটি দিন।
প্রায় সোয়া শ’ বছর আগে শ্রমিকের বুকের তাজা রক্তে লেখা হয়েছিল যে ইতিহাস, তারই নতুন পাঠ গ্রহণের দিন।
১৮৮৬ সালের এ দিনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেট চত্তরে শ্রমিকরা জীবনের বিনিময়ে সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করেছিলেন। অথচ নির্মম বাস্তবতা হলো, সোয়া শ’ বছর পর আজকের দিনেও শ্রমিকদের জীবন-মানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে শ্রমিকদের অবস্থা আরো নাজুক।
বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে বাংলাদেশে শ্রমিকদের কিছু দাবি মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও পরে তা আর বাস্তবে রূপ পায়নি।
বিভিন্ন দুর্ঘটনায় সাধারণ শ্রমিকরা নানা বঞ্চনার শিকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকে প্রাণ হারালেও ক্ষতিপূরণ পায়নি নিহতের পরিবার। অনেকে কাজের জন্য দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছেন। দেশের শ্রমজীবী মানুষের এখন দুরাবস্থা। শ্রমশক্তি বাড়লেও সে তুলনায় কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে না।
কর্মক্ষম হাত হয়ে উঠছে ভিখারির হাত। বেড়ে যাচ্ছে বেকারত্ব। শ্রমবাজার সস্তা হয়ে যাচ্ছে। শ্রম আইনের প্রয়োগ নেই। শ্রম আদালত নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
নানা দিক থেকেই বঞ্চিত হচ্ছেন শ্রমজীবী মানুষ। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে প্রতিবারের মতো আজ পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস। এ উপলক্ষে সব শিল্প কারখানাসহ সর্বত্র সরকারি সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ”
আমরা কি নিবেদিতপ্রাণ ভালবাসার নিদর্শন হিসেবে আজ সরকারী ছুটি দিতে পেরেছি! তাই কি? আজ কি আসলেই শ্রমিকদের ছুটি ? দেখেছেন কেউ ?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।