আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আহত সিংহ ও রহস্যমানব

অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা

সিংহের বয়েস হয়েছে, অলস প্রান্তরে বসে স্মৃতিচর্বন করে আর দুরে ঘুরতে থাকা সিংহীদের দেখে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলছিলো। রহস্য মানব নিজের ফিকিরে ঘুরছিলো জঙ্গলাকীর্ণ মধ্যপ্রদেশে, প্রাচীন সভ্যতা হয়তো ছিলো কোনো দিন এখানে, সেসবের বিলুপ্ত ধ্বংসাবশেষের ছবি তুলে তুলে ক্লান্ত রহস্যমানবও প্রায়বিধ্বস্ত একটি দেয়ালের উপরে বসে ছিলো তখন, যখন এই গল্পের শুরু হলো। সিংহী নিজের লুপ্ত কেশরের শোক ভুলতে পারবে না কোনোদিন, হঠাৎ করেই সিংহ নিজেকে প্রবোধ দেয়, তার নিজের কেশরও প্রায় বিলুপ্ত, হঠাৎ করেই উপলব্ধি করে সিংহ, আদতে নিজের ন্ব্যুজ থাবা চাটা ব্যতীত অন্য কোনো কাজই সে করতে পারছে না। রহস্যমানব হঠাৎ করেই উপলব্ধি করলো, তারও আসলে কোথাও যাওয়ার নেই, অনেক মানুষের ভীড়ে একাকী, অকিঞ্চিৎকর হয়ে থাকা জীবনে একটু উন্মাদনা আনতে চেয়ে এই একাকী রোমাঞ্চঅভিযান এখন আর ভালো লাগছে না তার, তার আবারও মানুষের কাছে ফিরতে ইচ্ছা করে, কোলাহলে ফিরতে ইচ্ছা করে। আর কেউ তার গল্প জানতে চায় না, আর কেউ শুধাবে না তাকে, কি চমৎকার রোমাঞ্চকর একটা জীবন কাটালো সে, সিংহ বয়স্ক শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়ালো, টলোমলো পায়ে, অথচ অভিজ্ঞতার ঝুলিতে কত শত অভিজ্ঞতা নিয়ে বসে আছে সে, এই সিংহীগুলো এমন কি তাদের শিশু শাবকদেরও কোলছাড়া করতে চায় না, কি জামানা আসলো এখন।

ম্যান্দামারা পুরুষসিংহ হয়ে উঠতে পারবে না ওরা কেউই। রহস্যমানব হন্যে হয়ে সভ্যতার ছোঁয়া খুঁজছে। রসদ প্রায় শেষ, টেনেটুনে বড়জোর আর দুদিন, এরপরে শেষ এক্সপ্রেসো কফির প্যাকেট শেষ হয়ে যাবে, শেষ হয়ে যাবে চকলেট বার, সঙ্গে থাকা কাগজ বাদ দিলে এখানকার আদিবাসীদের সাথে তার আর কোনো তফাত থাকবে না আর। একটু পা চালিয়ে না গেলে সভ্যতা ছোঁয়া যায় না। সভ্যতা দুরে সরে যায়, প্রতিনিয়ত।

সভ্যতা থেকে দুরে সরে গেলেই মানুষের অসভ্যতা বাড়ে, কতটুকু উন্মোচন শোভন আর কোনটা অশোভন এই বোধটুকু হারিয়ে ফেলে মানুষ। পথভোলা একটা সিংহশাবক কাছে চলে এসেছিলো, তাকে জ্বুলজ্বুলে চোখে দেখছিলো উভয়েই। সিংহ আর রহস্যমানব সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি কারণে সিংহশাবকের প্রতি আকৃষ্ট হয়। সিংহের ধীর পদক্ষেপ রহস্যমানবের চোখে পড়ে সিংহের চোখে ধরা পড়ার আগেই। সিংহ নিজের ক্লান্ত পদক্ষেপ সামনে বাড়াতে গিয়ে নাক উঁচু করে বাতাস শুঁকে।

পশ্চিমে তাকিয়ে থাকে, মরুকগে, যার গন্ধ এসে লেগেছে নাকে, সে অন্য কেউ হতে পারে, হোক না, এই বয়েসে আর এসব ভেবে শঙ্কিত হওয়ার সময় আছে? বৃদ্ধ সিংহ পড়ন্ত যৌবনেও শেষ বার মাথা উঁচু করে চারপাশে দেখে, কাউকেই পরোয়া করি না আর, এমন একটা ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায়, থামে, আবার চলতে শুরু করে, যতক্ষণ না সিংহশাবকের কাছাকাছি আসে। বুঝলে শুধু কেশর ফুলিয়ে গর্জন করতে শিখলেই তুমি সিংহ হয়ে উঠবে না। সিংহ হতে আরও কিছু গুণ লাগে। আমি অভিজ্ঞতায় পোক্ত, তবে একটা কথা বলে রাখি, অভিজ্ঞতা এমন এক জিনিষ, তুমি চাইলেই এটা কিনতে পারবে না বাজারে। নিজের জীবন দিয়ে অর্জন করতে হয় এটা।

ক্ষেকিয়ে উঠলো এক সিংহী, বুড়োর আবার কথার ব্যামোতে পেয়েছে, যখনই সময় পায় তখনই নিজের অতীত চাটে, চাটবার এতই যদি ইচ্ছা, যাও না, গিয়ে কড়ই গাছের বাকল চাটো। চ এখান থেকে, ঐ পাগল মিথ্যুক বুড়োর কোনো গালগল্প শুনতে হবে না তোকে। শাবক দুরে চলে গেলে সিংহ পুনরায় বসে বসে নিজের থাবা চাটে। রহস্যমানব সে মুহূর্তে নিজের অতীত মনে করে হাসে, কত জায়গায় গেলো জীবনে, কত ঘাটের জল খেলো, কত মানুষের সাথে এত পরিচয়, তবু নিজের বলবার মতো মানুষ নেই তার। এত দিনে এত মানুষের সাথে পরিচয়, কাউকেই বলতে ইচ্ছা করে নি তার, কেনো এই নির্বাসন, কেনো হঠাৎ করেই নিজের সবকিছু বাদ দিয়ে হঠাৎ হাপিশ হয়ে যাওয়া।

এই প্রায়বিজন জঙ্গলে কেনো অবসরযাপন। এ কোন ধরণের ক্লান্তি। সিংহ নিজের মনেই কথা বলে, আজকালকার সিংহীদের এই এক সমস্যা, আমাদের সময়ে অন্তত একটু সম্মান দিয়ে কথা বলবার প্রবণতা ছিলো, মুরুব্বিদের সম্মান করতো মানুষ, প্রগলভতাকে ক্ষমাসুন্দরদৃষ্টিতে দেখতো। বৃদ্ধ সিংহ নিজের মনেই আত্মজীবনির খসরা করতে করতে বিপদসংকুল পথে হাঁটে। আমি উত্তরমেরুর কাছে কোনো এক ম্যানগ্রোভ বনে শিকার করতে শিখেছিলাম, বৃষ্টি ছিলো সেদিন অনেক অনেক দিন পরে সেদিন বৃষ্টি নেমেছিলো।

বৃষ্টিবিলাস করছিলো গাধাগুলো, স্বল্পবসনা গাধাদের আনন্দিত চিৎকার এখনও কান পাতলে শুনতে পাই আমি। গাধার সুন্দর নিতম্ব দেখে তাকে সামলে পাশের গাধার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, ভেবে নিজের ফোকলা দাঁতে হেসে উঠে সিংহ। দুরে সিংহীর চকচকে ত্বক দেখে জিহ্বা রসস্ত হয়। তবে এখন অনেক প্রত্যাখ্যানের পরে সিংহ জানে সব আহ্বানে সবাই সারা দেয় না, নিজের জিভের রস নিজের গালা ভেজাবে, অন্য কারো গ্রীবার ঝরবে না সেটা। তবুও তার লক্ষ্যে থাকে, তীক্ষ্ণ নজরে রাখে, সেইসব অশক্ত সিংহসঙ্গীদের, যাদের সঙ্গীরা অচিরেই ছেড়ে যেতে পারে, যদিও তাদের ত্বকের চিক্কনতা নেই, ক্ষিপ্রতা কমেছে, বরং চামড়ার নীচে চর্বির পাতলা স্তর পুরু হয়ে গেছে বুঝা যায়, তবু তাদেরই সাম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ঠিক করে নিতে হয়।

আমার যৌবনে আমি বুঝি নি এ কথার মানে, বৃদ্ধ সিংহ খানিক জিরিয়ে নিয়ে ভাবে, তখনও বুঝি নি, এক দিন শরীরের শক্তি ফুরাবে। একদিন যৌবনের তেজ কমে যাবে, যৌনাঙ্গের তেজ কমবে, তখন যদি বিশ্বস্ত একটা সঙ্গীর কথা ভাবতাম, যদি নিজের সঙ্গীর মজজুগিয়ে চলতে পারতাম তবে গাধানীর কথা হাতে নাতে ফলতো না। আবারও সেই ম্যাংগ্রোভ বনে শিকারের দৃশ্য মনে পরে, মনে পড়ে গাধীর নিটোল নিতম্ব, কণ্ঠার কামড় বসানোর আগে, গাধী বলেছিলো, আমার সবটুকু তোমাকে দিয়ে দিবো, শুধু প্রাণে মেরো না। তোর আবার আমাকে দেওয়ার মতো কি আছে? আমি সিংহ, তেজী, বলীয়ান, একদিন এই তেজ ফুরাবে তোমার, তখন বুঝবে, গাধা বাঁচে ৩০ বছর, আর তোমার যৌবন শেষ হয়ে যাবে ২২শেই, তখন তুমি বুঝবে আজকের কথার অর্থ। আর বুঝলে বুড়ো বয়েসে কুত্তার পুটকিও সন্দেশ মনে হবে।

আজ অসংখ্য প্রত্যাখ্যানের পরে তার মনে হয় হয়তো গাধীই ঠিক ছিলো। হয়তো তাৎক্ষণিক উচ্ছৃঙ্খলতার মোহে এতটা করা ঠিক হয় নি তার। উফফ, গর্জন নয়, কাতর চিৎকার বের হলো সিংহের গলা দিয়ে। হঠাৎ করেই অসাবধানতায় যেখানে পড়েছে, সেই খাদ থেকে বাহির হওয়ার ক্ষমতা তার নেই, পেছনটা হালকা লাগছে তার- রহস্যমানব একটা গাছের উপরে বসে ছিলো সন্তর্পনে, হঠাৎ করেই চলতি পথে সিংহ অদৃশ্য হয়ে যাওয়ায় আগ্রহ নিয়ে সামনে ঝুঁকলো ও। মোবাইলে লাইভ টেলিকাস্ট চলছিলো, বৃদ্ধ সিংহের দিনকাল।

সেটার মূল পাত্র চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পরে কিছুটা সময় উল্টা পাল্টা বলে পার করার পরে অন্য পাশ থেকে তার এই ফাঁকি ধরা পড়ে যাওয়ার লজ্জায় জিভ কাটলো রহস্যমানব। এবং তখনই মটাস একটা শব্দ। রহস্যমানব নিজের সামনে সিংহের মৃদু কাতর গর্জন শুনে সম্বিত ফিরে পেলো। সেও জড়িয়ে পড়েছে আষ্টেপৃষ্টে, বস্তুত সিংহের সাহায্য ছাড়া তারও গতি নেই এখান থেকে মুক্ত হওয়ার, সুতরাং আপোষের খেলা খেলতে হবে মাথা ঠান্ডা রেখে। গলা খাঁকরি দিয়ে রহস্যমানব শুরু করলো, আপনি ভালো আছেন? সিংহের তখন কথা বলবার অবস্থা নেই, কোনো মতে ল্যাজ তুলে ইঙ্গিত করলো- আপনার অবস্থা তো বিশেষ ভালো নয়, আপনার শুশ্রুষা প্রয়োজন, আপনাকে কোনো ভাবে সাহায্য করতে পারি আমি? সিংহ কোনো কথা না বলে ল্যাজটা সড়িয়ে নাড়ালো- আমি আপনাকে অপদস্ত করবার চক্রান্তের নিন্দা জানাই, আপনাকে এভাবে আটকে রাখবার কোনো আইনগত বৈধতা নেই, আমি এর প্রতিবাদ জানাবো যতটুকু শক্তি আছে সবটুকু দিয়ে আমি এর প্রতিবাদ জানাবোই জানাবো।

এই দেখেন আমার হাতে মোাইল ফোন, সিগনয়াল নেই, কোনো সমস্যা নেই তাতে- আমি পডকাস্ট করবো, আমি সমস্ত বিশ্বকে জানিয়ে দিবো সিংহ আহত গর্জনে জোর আনলো, ব্যাটা বেকুব তোকে যা বলছি সেটা দেখ, আমার পেছন দিকে রক্ত দেখা যায়? রহস্যমানব সেই জটিল জরদগব অবস্থা থেকে যতটুকু দেখতে পেলো, তাতে জিভ কেটে বললো, আপনার তো অবস্থা দফারফা- আপনার তো সাড়েসর্বনাশ। সিংহও আঁতকে উঠলো শুনে, ক্কাক্কা ক্যানো কি হয়েছে? আপনার তো বীচি শহীদ হয়েছে। আপনি বীচি শহিদ সিংহ। কোনো টোটকা জানা আছে? আমার মাথায় তো কোনো আইডিয়া আসছে না এই মুহূর্তে, আর বুঝতেছেন তো গুগল নষ্ট, চটজলদি কোনো আইডিয়া দিতে পারবো না। তবে পুরোনো একটা টোটকা আছে, সেটা কাজে দিতে পারে।

বেশী কথা না বাড়িয়ে সেটাই করো, সিংহ হঠাৎ করেই বুঝতে পারে, তার এই দুরাবস্থার পরেও তাকে অনেক ভয় রহস্যমানবের। দক্ষ শিকারী রহস্যমানব, যে নিজের নামে এবং বেনামে অনেক শিকারের গল্প লিখেছে, সেইসব গল্পের কোনোটাই তার বাস্তব জীবনে ঘটে নি, রহস্যমানব নিজের এই অবস্থায় শঙ্কিত, অবশ্য এটাতে কিছুটা হলেও আনন্দিত, স্বীয় জীবনের অভিজ্ঞতায় অন্তত একটাগল্প লিখতে পারবে ও, সিংহের খপ্পরে একটা বিকেল। কিন্তু তার আগে তো প্রাণে বাঁচতে হবে। রহস্যমানব নিজের জানা টোটকা প্রয়োগ করে , সে প্রানপনে আহত সিংহের শহীদ বীচির উপরে চামড়া চাটতে থাকে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।