আমি সত্য জানতে চাই
লোকসঙ্গীতের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী, পল্লীগীতির রচয়িতা, সুরকার এবং বিশিষ্ট দোতরা বাদক কানাই লাল শীল। লোক-সঙ্গীতের ইতিহাসে কানাইলাল শীল ,একটি অপরাজেয়, অমর নাম এবং গ্রাম বাংলার মাটির মানুষের কাছে কানাই লাল শীলের অবদান চিরস্মরণীয়। এই গুণীশিল্পী প্রতিষ্ঠা পান মূলত: দোতারা বাদক, লোকগীতি সংগ্রাহক, লোকগীতি রচয়িতা ও সুরকাররূপে। তিনিই প্রথম বাংলা লোকসঙ্গীতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সুরের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। সঙ্গীতজ্ঞরা বলেন, কানাইলালের দোতরা তো নয় মনে হয় দোতরার সুরে কথা বলেন।
দোতরায় কথা বলে এই সক্ষমতা কেবল একমাত্র কানাইলাল শীলের যাদু স্পর্শে সম্ভব। ১৯৭৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরন করেন কিংবদন্তি লোক-সঙ্গীত শিল্পী কানাইলাল শীল। লোক-সঙ্গীতের ইতিহাসে অপরাজেয় ও অমর কানাইলাল শীলের ৩৯তম মৃত্যুদিনে তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায়।
কানাইলাল শীলেবাংলা ১৩০২ সালের অগ্রয়ন মাসে ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা থানার কৈরাইল গ্রামের জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আনন্দ চন্দ্র শীল এবং মাতা সৌদামিনী শীল।
মাত্র আড়াই বছর বয়সে পিতা আনন্দ চন্দ্র শীলের মৃত্যু হলে মাতা সৌদামিনী শীলের স্নেহে লালিত-পালিত হন কানাইলাল শীল। কানাইলাল শীলের কোন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা ছিলো না। ছিলো না কোন বিত্ত বৈভব। ছিলো না কোন পদ পদবীর দাবি। তবে সঙ্গীতের সুর সাধনায় গুরুগৃহেই পেয়েছিলেন শিক্ষা।
সেই শিক্ষার আলোতেই সারা কোলকাতা জুড়ে পল্লীগানের দোতরায় অসাধারণ সুর নৈপুণ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। খ্যাতিমান কণ্ঠশিল্পীদের গানে দোতরা সঙ্গত করেছেন। সেই বিদ্যা ও খ্যাতির অর্জন নিয়েও রাজধানী ঢাকা কেন্দ্রের সঙ্গীতের সাধানায়তর ছিলেন।
কানাইলাল শীল মাত্র ৮ বৎসর বয়সে বিখ্যাত বেহালা বাদক বসন্ত কুমার শীলের কাছে মাত্র প্রথম বেহালা বাদন শিখেন। পরে ১১ বৎসর বয়সেই ওস্তাদ মতিলালের কাছে বেহালায় পূর্ণপাঠ সমাপ্ত করেন।
সুর সাধনায় কানাইলাল শীলের একনিষ্ঠতায় ছোট বেলায় যাত্রাদল ও কবি গানের দলের সম্পৃক্ত হয়ে ফরিদপুর জেলা ও তৎসংলগ্ন এলাকায় বেরিয়ে পড়েন। এভাবে যাত্রাদল ও কবিগানের দলে ঘুরতে ঘুরতে ফরিদপুরের বইমহাট ফকিরবাড়িতে দরবেশ দাগুশাহের মাজারে এসে উপস্থিত হলে সেখানে মাজারে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এক শিল্পীর দোতরা বাদনের সুরে কানাইলাল শীল অভিভূত হয়ে পড়েন। দোতরার বাদনের সুর তাকে এতোটাই মোহাচ্ছন্ন করে তোলে যে কানাইলাল সিদ্ধান্ত নেন যেভাবেই হোক তাকে বেহালা ছেড়ে দোতরা বাদনের শিক্ষা নিতে হবে। সেই সিদ্ধান্তের ফলে ঐ অঞ্চলের বিশিষ্ট দোতরা বাদক তরচন সরকারের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং খুব অল্প সময়ে দোতরার বাদন রপ্ত করেন। সেই সাথে দোতরা হাতে নিয়ে কানাইলাল শীল কৃষ্ণলীলার দলে যোগ দেন এবং ফরিদপুরের বিভিন্ন জায়গায় কৃষ্ণলীলার ভক্তিমূলক গানে দোতরা বাজিয়ে সবার প্রশংসা অর্জন করেন।
গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরতে ঘুরতেই পরিচিত হন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লীকবি জসীমউদ্দীন, ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর সাথে। পল্লীগান রচনার ক্ষেত্রে তিনি অদ্ভূত সৃজনীশক্তির পরিচয় দিয়েছেন। কানাইলাল ওস্তাদ আয়েত আলীর সংস্পর্শে এসে তিনি এতই মুগ্ধ হন যে, ওস্তাদজীকে কানাইলাল ‘ধর্ম-পিতা’রূপে বরণ করে নেন।
কিংবদন্তী সঙ্গীত শিল্পী আব্বাস উদ্দিন যে সব গান গেয়েছেন, সে সব গানে কানাইলাল শীলের দোতরা বাদনের সুর অতুলনীয়। তাঁর গান একসময় আব্বাসউদ্দীনের সুরেলা কন্ঠে মানুষের মন জয় করে নিয়েছিল।
আব্বাস উদ্দিনের গাওয়া অধিকাংশ গানেই কানাইলাল শীলের দোতরা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মাঝি বাইয়া যাওরে/ থাকতে পার ঘাটাতে তুমি পারের নাইয়া/ ও ঢেউ খেলেরে, ঝিলমিল সাগের ঢেউ খেলেরে/ দিনের দিন ফুরাইলো শুখনাতে তরণী/ ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে এমন অসংখ্য গানেই কানাইলাল শীলের দোতরা বাদন গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে বিশেষ ভাবেই সমাদৃত ছিল। পরবর্তী সময়ে ভারত ভাগের পরে ১৯৪৯ সালে ঢাকায় চলে আসেন এবং তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রে নিজস্ব শিল্পী ও সুরকারের দায়িত্বে নিয়োজিত হন। ঢাকা কেন্দ্রে যোগদানের পর কানাইলাল শীল একনিষ্ঠভাবে পল্লীগীতি ও ভাওয়াইয়া গানে অংশ নিয়ে দোতরার সুরে মোহনীয় বাদনতুলে সবার দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন। অনেক ছায়াছবির গানেও তার অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।
‘আসিয়া’ ছায়াছবিতে ‘আমার গলার হার খুলে নে ওগো ললিতে’ কিংবা ‘আমায় ঘর ছাড়া করিলি রে/সুখ বসন্ত সুখের কালে’ এমনি অসংখ্য গানও তিনি নিজে লিখে সুর করেছেন। সে গানগুলো বাংলা সঙ্গীত জগতের এক একটি সম্পদ। তাঁর রচিত ও সুরারোপিত বহু গান শচীনদেব বর্মন, আব্বাসউদ্দীন, আব্দুল আলীম, ফেরদৌসী রহমান প্রমুখ গেয়েছেন।
দীর্ঘ সবল দেহী কানাইলাল শীল চলনে বলনে ছিলেন খুবই ভদ্র। কোনদিন কোন উচ্চবাচ্য কেউ শোনেনি।
পোশাকে আশাকে ছিলেন একেবারেই সাধারণ ছিলেন। জীবনে তার চাওয়া পাওয়া বলে কিছু ছিলো না। যে মানুষ কোলকাতার তৎকালীন সময়ে একজন বিশিষ্ট দোতরা বাদক ও সুরকার ছিলেন সেই মানুষটি দেশ ভাগের পর ঢাকায় এসেও কোন লোভ লালসার পথে পা বাড়াননি। কোন প্রাপ্তির আশায় কখনো মন খারাপ করেননি। ১৯৭৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর এই গুণী শিল্পী মৃত্যুবরন করেন।
গ্রাম বাংলার মাটির মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় লোকসঙ্গীতের এই দিকপালের আজ মৃত্যুদিন। মৃত্যু দিবসে শ্রদ্ধায় স্মরণ করি বাংলার পল্লী সঙ্গীতের দোতরার যাদুকর কানাইলাল শীলকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।