শীতের পড়ন্ত বিকেলে তাকে পিছন থেকে দেখা মাত্রই চিনতে পারলাম। আমি দ্রুত হেটে তাঁর কাছাকাছি চলে এলাম। ভাবলাম হাসব কিনা। দশ বছর বলে কথা। সে আমাকে প্রথমে দেখতেই পায়নি।
একটি দোকানের ভিতরে তাকিয়ে ছিল। আমি প্যান্টের পকেটে দু হাত ঢুকিয়ে গলা ঝাড়লাম।
- নাজু!
আমি জানতাম তাকে চিনতে আমার ভুল হয়নি। আমি সবসময়ই ভাবতাম কোন একদিন নিশ্চয়ই আমাদের দেখা হয়ে যাবে, হয়তো কোন বাস স্টপে, কোন ভীড়ের মাঝে অথবা শহরের কোন ব্যাস্ততম রাস্তায়।
- হোসাইন!
আমি বুঝতে পারছি তার হৃদপিন্ড দ্রুত উঠানামা করতে শুরু করেছে।
তার নিশ্চয়ই মনে আছে সেই দিনগুলির কথা। অফিস শেষে একসাথে বাসে করে গন্তব্যে যাওয়া, চা খাওয়া, কলিগের বেবী শাওয়ারে যাওয়া, সেই শনির মন্দিরের পেছনে কথা বলা। তার চেয়ে আমার আগ্রহই ছিল বেশী। হয়তো তার কোন আগ্রই ছিলনা। শুধু মাত্র ভদ্রতার খাতিরেই ভদ্রতা করা।
- চিনতে পেরেছো?
- কেনো চিনব না! তুমি এখানে?
- আর তুমি?
আমার হাত দুটো তখনো প্যান্টের পকেটে। সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমিও তার দিকে। তার মুখে সেই পরিচিত হাসি। যে হাসি একটুও বদলাইয়নি।
শুধুমাত্র মুখটা যেন একটি গোল হয়ে এসেছে।
- আমার বাবা অসুস্থ। হসপিটালে আছে।
- আমি দুঃখিত।
যদিও তাকে তেমন দুঃখিত মনে হলো না।
যদি সে দুঃখিত হবেই তবে আমাকে এভাবে ফিরিয়ে দিতো না। সে বলেছিল কাউকে ভালবেসে সে তার বাবা-মাকে কষ্ট দিতে চায়না। এটা কি সত্যিই তার মনের কথা ছিল? নিজেকে স্বান্তনা দিয়েছিলাম এই ভেবে যে হয়তো আমি তার যোগ্য হতে পারিনি।
- ধন্যবাদ। তুমি বিয়ে করেছো?
সে হাসল।
যে হাসি দেখলে একসময় আমার বুকের ভিতর হুহু করে উঠত। আমার সেই দিনগুলির কথা মনে পড়ে গেল।
- কথা কাটিয়ে সে উত্তর দিলোঃ বোনের বিয়েতে ঢাকা এসেছি।
- খুব ভালো।
সে তার বোনকে খুব ভালোবাসতো।
রাত জেগে বোনের জন্য হ্যান্ডনোট তৈরি করতো। বোনের কথা ভেবে আড়ালে চোখের পানি মোছার কি বৃথা চেষ্টাই না করতো! এখনো নিশ্চয়ই খুব ভালোবাসে। বোনের বিয়ের কথা উঠতেই তার মুখটা কি উজ্জ্বল হয়ে গেলো!
- আর তোমার বাবা-মা? বড় ভাই? বড় বোন?
- হুম, খুব ভালো আছেন।
আমার মনে পড়ল। কতো কিনা ভাবতাম তাদের নিয়ে! আমার খুব ঈর্ষা হতো।
সে প্রতি বছর পারিবারিক পিকনিকে যেতো। তার মা-বাবা তার জন্য অপেক্ষ্যায় থাকতো। বাড়ি যাওয়ার আগে তার মুখে সেই গল্প মুগ্ধ হয়ে শুনতাম।
- তুমি কি খুব ব্যাস্ত?
- না। তেমন ব্যাস্ত না।
- চলো কফি খাই।
আমরা একটা কফি শপে ঢুকলাম। আমরা কখনো একসাথে কফি খাইনি। আমি খুব লাজুক ছিলাম। আর সে ছিল খুব কনজার্ভেটিভ।
তবে কলিগদের সাথে একত্রে চা খেয়েছি। আমরা পরস্পর মুখুমুখি হয়ে বসলাম।
- হোসাইন? তুমি কি এখনো ঔষদ কোম্পানীতেই আছো? পিএইচডি করেছো?
আমার ঔষদ কোম্পানীতে চাকুরী করার কোন ইচ্ছাই ছিলো না। বই পড়ার আগ্রহ দেখে সে আমাকে পিএইচডি করতে বলতো। কিন্তু আমার তাতে তেমন আগ্রহ ছিলোনা।
আমার ইচ্ছা ছিল কোন বিদেশী হসপিটালে চাকুরী করা। সে জন্য কতো কিনা করেছি! ফেইসবুকে বিভিন্ন গ্রুপ খুলেছি। বাংলাদেশে যেসব বই পাওয়া যেতো না ইন্টারনেট থেকে নামিয়ে নীলক্ষেত থেকে প্রিন্ট করে এনেছি। কতো স্বপ্ন দেখেছি! সেও কি স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলো? তা না হলে সেও কেনো নীলক্ষেত থেকে আমার একটি বই প্রিন্ট করেছিলো?
- নাহ্। এখনো ঔষদ কোম্পানীতেই আছি।
- তাই! তুমি কি তাই চেয়েছিলে!
- হ্যা, আমি মিথ্যা বললাম।
- আর তুমি? তোমার বর কি করেন?
সে কিছু একটা বলল। আমি ভালো শুনতে পেলাম না। হয়তো আমার অবচেতন মন শুনতে দেয়নি। আমি তার জীবনসঙ্গী হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম।
তার বাবা-মা বলেছিলো রাত করে মাস্টার্সের ক্লাস করতে দেওয়া হবেনা। যদি করতেই হয় তাহলে বিয়ে করতে হবে। যেন রাতের ক্লাস শেষে তার স্বামী বাসায় নিয়ে আসার দায়ীত্বটুকো নিতে পারে। আমি নিজেকে তার বরের আসনে বসিয়ে স্বপ্নে বিভোর হতাম। ভাবতাম তাকে পেলে কি সুখেরই না হবে দিনগুলি!
তার কথায় হঠাৎ সম্ভিত ফিরে পেলাম।
- হোসাইন, আমি আসলেই জানি না কেন আমরা ভালোবাসতে পারলাম না।
- বাদ দাও ওসব। আমরা তখন ছেলে মানুষ ছিলাম। ছেলে মানুষেরা এমনি করে।
আমি প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাইলাম।
আমি সত্যিই তাকে মনে প্রাণে ভালোবেসেছিলাম। আমি জানি তার মতো অন্য কারো সাথে আমার কখনো দেখা হবে না।
- হয়তো তুমি ঠিকই বলেছো। আমার এখন যেতে হবে, হোসাইন।
- এতো তাড়াতাড়ি? আমি ভেবেছিলাম তোমার হাতে কিছু সময় আছে!
- হ্যা ছিল, এখন শেষ হয়ে এসেছে।
আমার ভুলও হতে পারে, তবে আমি লক্ষ করলাম তার চোখের কোনে নোনা পানি চকমক করছে। সে আবার বলল
- আমার হাতে সত্যি সময় কম।
- হ্যা, আমি বুজেছি। ধরা গলায় বললাম, যদিও আমি বুজতে পারিনি কিসের এতো তাড়া।
আমি বললাম,
- আমি কি আমার ফোন নম্বরটা তোমাকে দিতে পারি?
সে হাসল।
আমি আমার ফোন নম্বরটা কফি বিলের উলটা পিঠে লিখে তার হ্যান্ড ব্যাগে গুজে দিলাম।
- ধন্যবাদ, হোসাইন।
- বিদায় নাজু।
আমি জানিনা তার ব্যাগে আজও আমার নাম্বারটা আছে কিনা। আশায় থাকি কোন একদিন হয়তো তার ফোন থেকে কল আসবে।
যেভাবে দশ বছর আগে আশায় থাকতাম। কোন দিন তার ফোন আসেনি। আর কোনদিন আসবেও না। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।