জীবন্ত মানব সত্তার অস্তিত্বই নিঃসন্দেহে মানবের সকল ইতিহাসের প্রথম আরম্ভ...
বনশ্রী কল্যান সমিতির বিশাল জনাকীর্ন সাংবাদিক সম্মেলন। সামনের দিকের সারিতে বসে ছিলেন কামরান ভাই, আমাকে দেখে হাত উচু করে ডাকলেন— হাতে এক গোছা কাগজ, নিচু হয়ে মনে হলো কিছু নোট নিচ্ছিলেন।
বনশ্রীতে আমার প্রতিবেশি কামরান ভাই সামহোয়ারইনের একজন প্রথম সারির ব্লগার। সিরিয়াস টাইপের এই ব্লগারের অনেক পরিশ্রমলব্ধ এবং গবেষনামুলক পোষ্ট সামহোয়ার এর ফার্স্টপেজ কে এযাবৎ সমৃদ্ধ করেছে এবং উল্লেখ করা দরকার, তার অধিকাংশ লেখাই যথেষ্ট পাঠকপ্রিয়। এভারেজ যে কোন পোষ্টেই তিনি শতাধিক মন্তব্য স্বাভাবিক ভাবেই পেয়ে থাকেন।
ব্যক্তিজীবনে গার্মেন্টস, সুতা এ সবের ব্যাবসার সাথে যুক্ত কামরান ভাই একজন সফল ব্যবসায়ী। কিন্ত উনি যে একজন পরিস্কার চিন্তার লোক, তার লেখালেখি পরলে যে কেউ তা অনুভব করতে পারেন।
বনশ্রী প্রকল্পের বাসিন্দাদের সামনে আজ মহা দুর্দিন। বিকালে মিট দ্য প্রেস নামের এই অনুষ্ঠানে ডাকা হয়েছে সাংবাদিকদের, আর তাদের সাথে ডিল করার জন্য প্রকল্পে বসবাসরত বাসিন্দা, যারা বিভিন্ন মিডিয়ার (প্রেস, ইলেক্ট্রনিক ইত্যাদি) সাথে যুক্ত, তাদের দ্বায়ীত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা উপস্থিত জাতীয় সাংবাদিকদের সাথে কথা বলে একটা জনমত তৈরীর চেষ্টা চালাবেন।
মিডিয়ার সহানুভুতি আদায়ের চেষ্টা করবেন। অল্টারনেটিভ মিডিয়া—ব্লগের সাথে যুক্ত হিসাবে কামরান ভাই ও এসেছেন, তার ভুমিকা পালনের জন্য। এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরও কয়েকজন ব্লগার, ভার্চুয়াল চরিত্র না হলে হয়তো আরও বেশি সংখ্যক ব্লগারদের সেখানে চোখে পড়তো।
রামপুরার বনশ্রী প্রকল্পের মাঝখান দিয়ে যে খাল চলে গেছে তার অপর পারে আফতাবনগর প্রকল্প। আমরা যারা বনশ্রী প্রকল্পের বাসিন্দা, গত তত্ত্বাবধায়কের আমলের সময়টা কেটেছে বিস্তর তকলিফের ভিতর দিয়ে।
গ্যাঞ্জামটা হলো এই খাল নিয়া, সরকারের তরফ থেকে অভিযোগ, মুল প্লানে খাল যেভাবে ছিল, পরবর্তীতে তার অনেক খানি অবৈধ ভাবে ভরাট করে ফেলা হয়েছে।
অভিযোগ তুলেই শেষ নয়, একদিন সকালে দেখি ড্রেজার এসে সেই খাল উদ্ধারের নামে খালের পাশের মাটি কাটা শুরু করে দিছে। জায়গাটা আফতাবনগর প্রকল্পের ডি আর ই ব্লকের মাঝামাঝি জায়গায়। চমৎকার সমতল ভরাট জমি, সীমানার জন্য খুটি দিয়ে চিহ্নিত করা। বাড়ীর প্লান নিয়ে মালিকরা রেডী, বাড়ি বানানো শুরু করবেন বলে—ঠিক এ সময় সরকারের এমন বাধা।
প্রকল্পের অধিবাসিরা ড্রেজারের এই হামলা আর প্রকল্পের মাটি কেটে ফের খাল বানানোতে যার পর নাই হতাশ এবং আতঙ্কিত তাদের বিনিয়োগের ভবিষ্যত নিয়ে।
আমার অবাক লাগছিল যে বনশ্রী প্রকল্পে মিডিয়ার এত লোকজন বসবাস করেন? তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন টেলিভিশনের কল্যানে রীতিমতো পরিচিত মুখ। প্রায়শই টকশোগুলোতে তারা আবির্ভুত হন-দর্শকদের উচি্ত অনুচিত বোধে নতুন নতুন শান দিতে। আরও কয়েকজন দেখলাম যাদের আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি, প্রিন্ট মিডিয়ায় আছেন। পত্রিকার উপসম্পাদকীয়তে তাদের মতামত দৃঢ় ভাবে ব্যক্ত করেন।
বিভিন্ন দৈনিকে তাদের শানিত যুক্তি পাঠকদের নতুন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষার্থী, সংবেদনশীল তরুন বুদ্ধিজীবিদের চিন্তার নতুন খোরাক যোগায়।
পরদিন বিকালে কামরান ভাইএর সাথে আবার দেখা কিংস এ বন্ধুদের সাথে কফি খেতে গিয়ে। পেছনের খোলা জায়গায় ছাতার নিচে বসে—কফির কাপ আর সামনে খোলা ল্যাপটপ। নিজের মনে কাজ করছেন কামরান ভাই।
ইতিমধ্যে আমি সহ অন্যান্য উপস্থিত ব্লগাররা সবাই জেনে গেছি—গতকাল মিট দ্য প্রেস এ মিডিয়ার লোক হিসাবে প্যানেলে নাম থাকা সত্ত্বেও কামরান ভাইকে শেষ পর্যন্ত স্টেজে ডাকা হয় নাই, কথাও বলতে দেওয়া হয় নাই। কামরান ভাই রেডী হয়ে ছিলেন, একটা পেপারও তৈরী করেছিলেন। রাতে অবশ্য সচিব সাহেব ফোন করেছিলেন—উনাদের সময়ের একটু টানাটানি ছিল, আর অলটারনেটিভ মিডিয়া টার্মটি নাকি তাদের মধ্যে একটু দ্বিধা তৈরী করেছিল, কামরান ভাইকে না ডাকাটা মোটেও তাদের ইচ্ছাকৃত ভুল নয়- ব্লা ব্লা ব্লা...
সন্ধ্যায় কামরান ভাই এর সাথে বাসায় ফিরছি-ঘুরে ফিরে গতকালের প্রশঙ্গ উঠতেই কামরান ভাই বললেন—আমার একটা বোধোদয় হয়েছে, বুঝেছো?
—ব্লগারদের জন্য এটা খুব শকিং... আমি মন খারাপ করে বলে উঠি।
—শকিং তো বটেই, তবে আমি মনে করি এই শকের খুব দরকার ছিল, বিশেষ করে যারা নিজদের সেলেব্রিটি ব্লগার ভাবি। আমাদের একটু হুঁশে আসা উচিত সবাই কে।
তুমি ভেবে দেখ, বাংলা ব্লগে এখন কারা রাজত্ব করে? মেইন স্ট্রীম মিডিয়াতে তাদের অবস্থান কোথায়? আমরা ব্লগাররা কোন মুর্খের স্বর্গে বসবাস করছি, আমরা কি তা টের পাচ্ছি?
সাধারন মানুষের মধ্যে মিডিয়ার প্রভাব খুব জোরালো ভাবে কাজ করে। নতুন নতুন যুক্তি আর বাস্তবতা সে পায় মিডিয়া থেকে। শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভা কতটা দক্ষ, শেখ রেহানার রাজনীতিতে আশা উচিত কিনা? বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনে গিয়ে ঠিক করেছেন নাকি তার নির্বাচন বয়কট করা উচিত—ভাবনার পক্ষে বিপক্ষের যুক্তিগুলো মিডিয়াই তাকে যোগান দেয়। একেকটা সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় বা কলাম কখনও কখনও পুরা জনমতটাকেই উলটে দেয়। টেলিভিশনের একটা টকশোই হয়তো ঠিক করে দেয়--ডঃ ইউনুসের রাজনৈতিক দল বানানো উচিত নাকি উচিত না।
ট্রানজিট চুক্তি নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যকে বিশ্বাস করা যায় কিনা?
প্রিন্ট মিডিয়া বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার তুলনায় বাংলা ব্লগ বয়সে নবীন আর সুযোগ-সুবিধার দিক অনেক এগিয়ে থাকা মাধ্যম। সহজ যোগাযোগ, একই সাথে ইন্টার-এ্যকটিভ হওয়ার সুবিধা থাকার জন্য অবশ্যই তা বেশি প্রভাবশালী এবং সে হিসাবে মানুষের মধ্যে প্রতিফলিত তার সে প্রভাব সুদুর প্রসারী হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাব্লগের এমন কোন ব্লগ অথবা ব্লগারকে আমরা কেন দেখি না—জনগনের মতামতকে বদলে দিতে তা নুন্যতম ভুমিকা পালন করতে পারছে? অথচ বাংলা ব্লগের আলোচ্য বিষয় বস্তু তো সেই একই ধরনের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়েই, প্রিন্ট মিডিয়া বা টিভি মিডিয়াতে যা আলোচ্য। মেধার বিষয়টা পরিমাপ করা মুশকিল, কিন্ত প্রিন্ট মিডিয়া বা টিভি মিডিয়ার কন্ট্রিবিউটারগন কি আমাদের সেরা মানের একজন ব্লগারদের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করেন, বেশি গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করেন? আমার তা মনে হয় না। আমাদের শীর্ষ ব্লগারদের অনেকেই আছেন—যাদের একটা পোষ্ট পড়লেই বোঝা যায়—সেটা দাঁড় করাতে কি ধরনের পুর্ব-প্রস্তুতি, অনুসন্ধান, গবেষনা বা ডিটেলস নোটস নেওয়ার প্রক্রিয়া চালাতে হয়েছে।
ফলে বাস্তবতার দিক থেকে, বাংলা ব্লগের- এমনকি শীর্ষমানের ব্লগাররাও এখনো পর্যন্ত সমাজে নাড়া দেওয়া দূরে থাক, যে কোন ইস্যুতে ঢেউ তোলার ক্ষমতাটাও রাখেন না। সমাজের কোন স্তরেই তার বক্তব্য, অবস্থান বিন্দুমাত্র ছাপও ফেলে না।
অথচ মেধা দক্ষতা বা কমিটমেন্টের সিরিয়াসনেস কোন দিক থেকেই তার কোন ঘাটতি নাই। চমকে দেওয়ার মতো ব্লগ, ভাবনার নতুন মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া বক্তব্য-- হামেশাই ব্লগের প্রথম পৃষ্ঠা দখল করে রাখে।
নিজের বানিয়ে নেয়া এক টুকরা জগত, যা শুধু মেলে দিকশুন্যপুরের মায়ার রাজ্যে, একটা অলীক ফানুষ, যা বাস্তবতার কোন স্তরেই অবস্থান করে না।
নেভিগেশন সিস্টেম যার তত্ত্বতালাশ করতে পারে না—আমাদের শীর্ষ ব্লগাররা কি সেই মিছামিছির রাজত্বে নিজকে অধীশ্বর হিসাবে ভেবেই পুলকিত হতে থাকেন?
আমি জানি না, বাংলা ব্লগের ব্লগারদের প্রতি এ সমালোচনা কেউ তুলেছেন কিনা, কিন্ত আমি নিশ্চিত ততদিন পর্যন্ত কারও অপেক্ষা করাও কোন সুবিবেচনা নয়। তার আগেই আমাদের মেধা আমাদের সক্রিয়তা নিয়োজিত করা উচিত-কি ভাবে বাংলা ব্লগকে আমরা গনচরিত্র দিতে পারি, এর ব্যাপ্তি বাড়িয়ে—কি ভাবে আমরা কয়েক হাজারের নিয়মিত এক পাঠক শ্রেনী সৃষ্টি করতে পারি। নতুন ব্লগার/পাঠকদের জন্য বন্ধুভাবাপন্ন এক আবহ তৈরী করতে পারি। জীবনের যে কোন ক্ষেত্রে যে কারো কাছে বাংলা ব্লগকে কোট করতে পারি। রেফারেন্সের জন্য লিঙ্ক দিতে পারি।
কোন শিক্ষক অথবা বয়োজেষ্ঠ্য কাউকে বলতে পারি—সামহোয়্যারে অমুক বিষয় নিয়ে একটা প্রাণবন্ত বিতর্ক হচ্ছে, [বাস্তবে অনেক সময়ই যেটা হয়] আপনি ভিজিট করতে পারেন।
আগামী দিনের দিক নির্দেশনা বাংলাব্লগ থেকে আসবে নাই বা কেন??
ফলে, হে শীর্ষ ব্লগারগন, বাংলা ব্লগে আপনি নিঃসন্দেহে সেরা মানের ব্লগার, আপনার নিজস্ব জগতে আপনিই অধীশ্বর... কিন্ত আত্মপ্রশাদ উপভোগের কোন জায়গা এখনো নাই—যতদিন বাংলা ব্লগ মিডিয়ার মুল স্রোতে তার যথাযোগ্য স্থান না করে নিতে পারছে? বাকি অন্যান্য মিডিয়ার সাথে সমান তালে না চলতে পারছে?
নিজদের শ্রেষ্ঠত্ব উপভোগ করতে চাইলে চোখ কচলে উঠে দাড়ান, নিজ নিজ মায়ার জগত ভেঙ্গে ফেলুন, অনেক কাজ বাকী রয়ে গেছে...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।