মনের খোলা জানালয় কত আলো কত রঙ, খেলা করে চুপি সারে, আসে যায় কড়া নাড়ে ... ...
[হিন্দুকুশ পর্বত মালার সালাংগ চুড়ায়। ভূপৃষ্ট থেকে প্রায় ৩৮০০ মিটার উচ্চতায়!!!]
[ই নফর ডেরাইবার ই মটর এ মান আসত; মানে হল গিয়ে এই ভদ্রমহোদয় আমাদের গাড়ির চালক!!! ]
মাজার-ই-শরীফকে বলা হয় সমস্ত আফগানিস্তনের মাঝে সবচেয়ে নিরাপদ রাজ্য। বিদেশীরাই বলে, নিরাপত্তা জনিত উপমা। আর সাধারন আফগানদের জন্য মাজার হচ্ছে রোম্যান্টিক শহর, আফগানের প্যারিস যেন। এটাই আমার প্রথম মাজার যাত্রা।
প্রায় ৬০০ কি.মি. পথ ঘুরে ৩টি সাইটের প্যাট হবে, শেষ হবে মাজারে। আমি, কবির ভাই, এক জন রিগার, ড্রাইভার আর সিকিউরিটি কমান্ডার। যদিও এই পথে তালেবানের কোন নাম গন্ধ নাই, কিন্তু পুলিশ চেকিংয়ের ঝামেলা সামাল দেয়ার জন্য কমান্ডারকে (আসলে সিকিউরিটি ম্যনেজার) যেতে হল।
সকাল ন'টার পর আমাদের যাত্রা শুরু। কবুল পেরিয়ে হাইওয়েতে উঠে একটু অপেক্ষা করতে হল এমটিএনের গাডির জন্য।
তার পর শুরু হল পাল্লা-পাল্লি, ছুটে চলা। ঘন্টা দুয়ের পরই হিন্দুকুশ পর্বতমালার চডাই-উৎরাইর গহীণে। শাই করে পরিয়ে এলাম জাবুল-শিরাজ, এখানে এক রেষ্টুরেন্টে এক সন্ধায় 'ভয়ঙ্কর' খাওয়া দাওয়া করেছিলাম, একগাদা টমেটো দিয়ে ডিমের আজব রেসিপি, নান দিয়ে। এরা দুম্বা/পাঠা ছাড়া অন্য মাংস, এমন কি মুরগি পর্যন্ত করে না, ডিম অনেক দূরের কথা! আমাদের পই পই করে বুঝিয়ে দিয়েছিল আমরা নিতান্তই মেহমান বলে আমাদের জন্য এই ঝামেলা করেছে। এই ডিম কষ্ট কর, কিন্তু কি করা, এরা এটাই জানে কেবল! কিন্তু কাবুলি পাঠর গন্ধ? অসম্ভব!
পর্বতারোহনের সাথে সাথে দূরের সাদা বরফ চারদিকে ঘিরে ধরা শুরু করল।
শুরু হল একের পর এক টানেল। টানেল গুলো বানানো হয় রাস্তাকে বরফ মুক্ত রাখতে, যেন হিমবাহের মত নেমে এসে রাস্তা ভরিয়ে না ফেলে। আরো উপরে উঠার পর দেখি রাস্তার পাশে ট্রাক থামিয়ে চাকায় চেন লাগানো হচ্ছে, বরফে যেন পিছলে না যায়। ডানে অতল খাদ আর বয়ে দুইমানুষ সমান বরফের পাহাড়। বরফ সামান ভাবে কেটে রাস্তা পরিষ্কার রাখা হয়েছে।
সবচেয়ে বড় টলেনটা ৩.৫ কিমি লম্বা, রাশিয়ানদের করে যাওয়া।
ভেতরে প্যাচ প্যচে কাদা জমে বরফ হবার চেষ্টা করছে। টানেলের ভেতরে কোথাও ইন্জিন বন্ধ হয়ে ট্রাক দাড়িয়ে আছে। ভয়ংকর ঠান্ডায় দরদর করে ঘামছে ড্রাইভার, ইন্জিনের উপর ঝুকে।
আস্তে আস্তে বরফ কমে গেল, ঠান্ডাও কমে এল।
বেলা দেড়টা-দুটার পর মোটামুটি নিম্নাঞ্চলে এলাম, বরফ নাই এখানে। একটা পাহাড়ি রেস্টুরেন্টে মাছ পাওয়া যাচ্ছে দেখে খাওয়া সেরে নেয়া গেল। পাহাড়ি নদীর মাছ, বাষ্পে সেদ্ধ করা। খেতে যেমনই হোক, মাংসের চেয়ে ঢের ভাল।
বিকেল নাগাদ চারপাশের চেহারা বদলে যেতে লাগল।
চার-পাশ হয়ে গেছে অনেক কোমল, অনেক সবুজ। কগার সাইটের পথে বেশ খোলতাই হয়ে একে বেকে যাচ্ছে নদী। চার পাশে সবুজ ঘাসের চাদর। এখানেও পাহাড, কিন্তু অনেক আপন লাগে। কাবুলের মত রুক্ষনা।
মনে হয় বুঝি বাংলাদেশই! কেবল মোটা গুডির আম-জাম-বটের কোমল ছায়া নেই, নেই পাখির ডাক।
অপারেটরের ইন্জিনিয়ার দুটো সাইটেই কাজ দেখে খুশি। মাথা নেডে কালকের সময় বাৎলে দিয়ে শাই করে চলে গেল। আমরা চা নিয়ে বসলাম। ছবি তুলে নিতে ভুললাম না।
মাজারের পথ আরোও মশৃণ, এদেশের তুলনায় খুবই ভাল, বাংলাদেশের চেয়ে ভাল। গেল বার বিকাশদা এখানে অনেক বাঙালীর দেখা পেয়েছেন। ইন্জিনিয়ার থেকে শুরু করে লেবার, পাঁচক, এক এলাহি কারবার। রাস্তার কাজ চলছিল তখন। সেই রাস্তা তীরের মত সোজা হয়ে ছলে গেছে মাজার।
ড্রাইভার পচাগুল এই গাডি আর এই রাস্তা পেলে ১৭০ ছাডা কথাই বলতো না। এই জন একটু সাবধানী, রয়ে সয়ে চালাচ্ছে।
চারপাশের সবুজ ভাব আরও সবুজ, আরও বেশি কোমল হয়ে মনটা একেবারে ভরিয়ে দিল। চারদিকে দেখি সাদা সাদা ফুলের গছ। কমান্ডারের কথা মত জানালা খুলে দিলম, একরাস সুবাতাস ছুটে এসে প্রাণ জুড়িয়ে দিল।
আহ! কি সুন্দর গন্ধ! যাকে বলে একেবারে মন মাতাল করা। সবাই লহমায় নেমে ছুটে গেলাম নাম না জানা সারি সারি বাদাম গাছের দিকে। গাছে কোন পাতা নাই, শুধু নিষ্কলঙ্ক সাদা ফুল। আর তার সে কি রূপ। মাস পেরিয়েছে ছুটি থেকে এসেছি, একমাস পর হাত দিয়ে ছুয়ে দিলাম ঘাসের কোমল দেহ।
সবুজ ঘাস আর সাদা ফুলের মিলিত সৌরভে মাথা ঝিম ধরে উঠে। মনে হয় ''Perfume: The Story of a Murderer'' এ যেমন বলা হয়েছে, এ যেন সুগন্ধের সেই দূর্লভ ১৩তম নোড। যেন পাগলা হাওয়ায় আলতো ভাবে স্মৃতীর পাতায় ভেসে আসে হাজার মাইল দূরে ফেলে আসা কোন প্রিয় মুখ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।