আগুন্তক ঘটনা স্থল শাহাবাগ... দেখছিলাম সমাবেশ আর মাঝে মাঝে স্লোগানে গলা মেলানো চলছিল। একটু পর একটা ফাঁকা যায়গা পেয়ে বসে ভাবতে লাগলাম। পাশে বসা এক ভদ্রলোক তার পাশের জনের সাথে কথা বলছিলেন আর মাঝে মাঝে স্লোগানে গলা মেলাচ্ছেন। ভদ্রলোকের কথা শুনে বুঝতে পারছিলাম উনি আওয়ামীলীগের সমর্থক। উনি কিছুক্ষণ পাশের জনকে আর কিছুক্ষণ আমাকে বলেন।
আমিও কথায় কথায় উনাকে প্রশ্ন করলাম “আচ্ছা আমি আসলে একটা জিনিস ক্লিয়ার না, আমরা যে এই ফাঁসির দাবী জানাচ্ছি সেটা কাকে? কার কাছে বা কার বিরুদ্ধে আন্দোলন ? সরকার আর ট্রাইব্যুনাল? “
উনি একটু থমকে গেলেন। চিন্তিত ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তার পর আবার কয়েকটা স্লোগান দিয়ে উঠে একটু দূরে দাঁড়ানো বাদামওয়ালার কাছ থেকে বাদাম নিয়ে সেখানে দাড়িয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বাদাম খেতে থাকলেন। বার কয়েক আমার দিকে তাকালেনও। লোকটার প্রতি একটু শ্রদ্ধা অনুভব করলাম।
যাক, সে অন্তত অন্য অনেকের মত আমার কথায় বিরোধী দলের/জামাত/শিবিরের সমর্থকের গন্ধ খুঁজে বেড়ায় নি । আমার কাছে পুরো শাহাবাগের চিত্রটাও কিছুটা এমনি মনে হল। দ্বিধান্বিত, বিশৃঙ্খল, Un-organized। ঠিক যেন একটা বিশৃঙ্খল কোরাস গানের মত। কেউ গানের এক লাইন বলছে তো আরেকজন বলছে অন্য লাইন।
চিন্তা করতে থাকলাম আসলে সমস্যাটা কোথায় এবং আমার মন উত্তর দিল সমস্যা টা আমাদের মনে। আমাদের মেন্টালিটিতে। ঠিক যেমন দাবী সরকারের/ ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে বলার পর ঐ ভদ্রলোকের দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ার মত। কারন এটা তার সমর্থিত দলের বিপক্ষে যাচ্ছে। সমস্যাটা এখানেই।
আমরা যে এখনো দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারিনি বা চিন্তা করতে শিখিনী।
শাহাবাগের সমাবেশে ভিন্ন ভিন্ন জটলা করে আন্দোলন হচ্ছে, কোন ঐক্যতানে নয়। অনেক লোক এসেছে কিন্তু উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরাঘুরি করছে। যেমন কোথাও উদীচী জটলা করছে, আবার কোথাও বামপন্থী কোথাও লীগের নেতা কর্মী কোথাও অন্য কেউ... মানুষ আসছে ঘুরে ফিরে দেখছে বিভিন্ন জটলা, আবার চলে যাচ্ছে। কেমন যেন মেলার মত, বিভিন্ন স্টলে স্টলে ঘুরা।
কারন সমন্বয়হীনতা। এভাবে চলতে থাকলে একঘেয়েমিতে পেয়ে বসবে। আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে যাবে আন্দোলন। ঠিক যেন শুরু হইয়াও হইলনা শেষ। আর এসব সমস্যার কারণও সেই দলীয় সংকীর্ণ মনোভাব।
সমস্যাটা এখানেই। যেমন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জাফর ইকবাল স্যার এবং উনার সহকর্মী এসে যুদ্ধপরাধিদের ফাঁসির সাথে সাথে বললেন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধের দাবী। কিন্তু ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ তো জাতীয় দাবী নয়। এটা তো উনার এবং উনার মতাদর্শের সমর্থকদের কথা বা দাবী। এটা নিয়ে তো জাতী বিভাজিত হতে বাধ্য।
আমি জানি আমার এইসব কথা শুনে অনেকে বলবে বা মনে করবে আমি জামাত/শিবির সমর্থক কিন্তু আবার ওরাই বলবে ইসলাম আর জামাত এক নয়। এখানেও সমস্যাটা সেই আমাদের দলীয় সংকীর্ণ মনোভাবের। এক্ষেত্রে আমার রুমি ভাইয়ের আমাকে বলা একটা কথা মনে পড়ে গেল। উনি বলেছিলেন আন্দোলন বা বিপ্লব এসব এতো সহজ জিনিস না। এর জন্য যে মন-মানসিকতা দরকার তা আমাদের মধ্যে নেই।
কারন আমরা স্বার্থপর এবং সংকীর্ণ মনোভাবের। আসলেই তাই। আজ তা হাড়েহাড়ে টের পেলাম। আরেকটা কারণও আছে। তা হচ্ছে ভয়।
আমরা সত্য বলতে ভয় পাই। শুধু তাইনা অন্য কেউ বললে তাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করি। যেমন যদি বলি এই দাবী সরকারের প্রতি তখন অনেকে ভয়ে পালাবেন। কারন আর তখন পুলিশ/সরকার এবং আওয়ামীলীগের সোনার ছেলেরা এখন ওখানে যেমন বন্ধুত্বপূর্ণ আছে তা থাকবে না। পুলিশ নিরাপত্তা না দিয়ে পিপার স্প্রে করবে।
আমরা যে স্বার্থপর। আমরা যে হুজুগে। দেশ গড়তে ভয় পাই। কিন্তু সুবিধার গন্ধ পেলে আগে দৌড়াই। তাই সব মিলিয়ে সমস্যাটা সেই আমাদের সংকীর্ণ মনের।
এখন আসি এই দাবী বা আন্দোলন কিভাবে সফল করা সম্ভব তা নিয়ে আমার ব্যাক্তিগত মতে। শাহাবাগের আন্দোলনে একটা জিনিস বুঝতে পারলাম যে কোন পরিকল্পনা, সমন্বয় , কর্মসূচি ছাড়া একটা আন্দোলনকে সফল রুপ দেয়া যায়না। আর এর জন্য দরকার হয় নেতৃত্বের। সেটাই নেই এখানে। রাখাল ছাড়া একটা বিশাল গরু বাছুরের দল যেমন এলোমেলো ভাবে চলতে থাকে এবং একসময় বিভক্ত হয়ে হারিয়ে যায় বা গন্তব্যে পৌছতে পারেনা তেমনি নেতৃত্বের অভাবে একটা আন্দোলনও সফল হয়না।
অনেক দল, মতাদর্শের লোক নেতৃত্বের চেষ্টা করছে বা করেছে কিন্তু ঐ দলীয় সংকীর্ণ মনোভাব বা দলীয় মতাদর্শের মনোভাব নিয়ে কখনোই জন বিপ্লব সম্ভব নয়। নেতৃত্ব দিতে হবে জাতীয় মনোভাব নিয়ে। কোন রাজনৈতিক ট্র্যাপ এ যেন না পড়ে যায় কেউ। কোন রাজনৈতিক দল যাতে এর থেকে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করতে না পারে। দেশের আজকের পরিস্থিতির জন্য ওরাই দায়ী।
কোন রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে ওখানে যেন কেউ না আসতে পারে, কোন রাজনৈতিক আদর্শের কথাও নয়। ওখানে যেন আবার কোন রাজনৈতিক নাটক মঞ্চস্থ না হয়। কথা হবে বাংলাদেশ নিয়ে। অন্য কিছু নিয়ে না। কোন আওয়ামীলীগ/ বিএনপি/ জামাত/ জাপা/ বামপন্থী ইত্যাদি ইত্যাদি যেন এই আন্দোলনের সুবিধা বা নেতৃত্বে না আসতে পাড়ে।
রাজনৈতিক পরিচয়ে বা দলের পক্ষ হয়ে কোন কথা বলবে তাদেরি যেন বেড় করে দেয়া হয়। অন্ততঃ তাতে উনাদের টনক নড়তে পাড়ে। আর একটা সমাবেশ বা আন্দোলন সফল করতে হলে তাতে বৈচিত্র্যতা থাকতে হবে। সবাইকে ঐক্যতানে আনতে হবে। বিভিন্ন ইভেন্ট উপস্থাপন করে সবাইকে উৎফুল্ল রাখতে হবে।
তার আগে সবাইকে এক হতে হবে। একটা নির্দিষ্ট কেন্দ্র থাকতে হবে। সেটা এখানে নেই। আর একটা আন্দোলনের জন্য আবেগ যেমন প্রয়োজন তেমনি দরকার এমন একটা দাবী যা বর্তমান জীবন ব্যবস্থার সমস্যা বা সাধারণ জনগণের জীবন ব্যবস্থার সমস্যা। শুধু আবেগ দিয়ে আন্দোলন হয়না।
অভাব দরজা দিয়ে প্রবেশ করলে ভালোবাসা যেমন জানলা দিয়ে পালায় তেমনি বাধা আসলে আবেগ পালিয়ে যায়। কারন আবেগকে ধরে রাখার জন্য প্রয়োজনীয়তা বা need জিনিসটার প্রয়োজন। যুদ্ধপরাধিদের ফাঁসির দাবীর প্রতি যথেষ্ট সম্মান রেখেই বলছি যে শুধু "যুদ্ধপরাধিদের বিচার" এই দাবিটা দেশবাসীকে জাগাতে পারছেনা। কারন দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমরা সবাই এটা নিয়ে সমান ভাবে সচেতন না। আমদের স্বার্থের সাথেও জড়িত না, আমাদের আমাদের জীবন ব্যবস্থার সাথে জড়িত সমস্যা নয়।
তাই এটা পুরো জাতিকে তেমন করে নাড়া দিতে পারছেনা যাতে পুরো জাতী একই সঙ্গে চাওয়া শুরু করবে বা প্রাণপণ লড়াই করার ফুয়েল পাচ্ছে না। আমাদের জীবন ব্যবস্থার প্রধান সমস্যা হচ্ছে দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনীতি। দুর্নীতিগ্রস্থ সিস্টেম। অনেকে বলবেন যে আগে একটা সমস্যা সমাধান করি তারপর আরেকটা। কিন্তু আপনি পদ্মা সেতু, ফেলানি, শেয়ার বাজার, হলমার্ক, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি , অরাজকতা, নিরাপত্তাহিনতা এসব কিছু একটা একটা করে কখনো সমাধান করতে পারবেন না যদি না এসবের মুলে থাকা দুর্নীতি গ্রস্থ সিস্টেম / দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনীতিকে আগে শেষ না করেন।
যুদ্ধপরাধিদের বিচার এর রায় ও কিন্তু সেই সিস্টেম এরই একটা অংশ। তাই আগে এই আন্দোলনের মুল লক্ষ্য ঠিক করে এগিয়ে যেতে হবে। মুলের সমাধানের সাথে সাথে বাকি গুলোও একসাথে সমাধান হয়ে যাবে।
এখন আসি সিস্টেমের কথায়। অনেকে বলবে জানি যে এরা তো আমাদেরই লোক, আমরাই তো ঠিক না, রাজনীতিতে কেউ আসতে চাই না , আগে আমি ঠিক হই তারপর অন্যটা ইত্যাদি ইত্যাদি।
সেটাও কিন্তু আমাদের দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনীতি/সিস্টেম এবং সংকীর্ণ মনোভাবের জন্যই। মনোভাব ঠিক হলে নিজে নিজে ঠিক হবেনই। কিন্তু সবাই ব্যক্তিগত ভাবে ঠিক হবে তারপর বদলাবে দুর্নীতিগ্রস্থ সিস্টেম সেখানেও কিন্তু বাধা ঐ সিস্টেমটাই। তাই না? আপনি যেমন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বা মেডিকেল কলেজ এ তাদের সিস্টেম এর মধ্যে থেকে ইঞ্জিনিয়ার/ডাক্তার হয়ে বেড় হচ্ছেন তাতে আপনার মনোভাব/ইচ্ছের সাথে সাথে প্রধান প্রভাবক কিন্তু ঐ প্রতিষ্ঠানের সিস্টেমটাই। তাই না? আপনি সিস্টেম এর মধ্যে থেকে সিস্টেমের আলাদা কিছু হতে পারবেননা, বা হতে দেয়া হবে না।
যেমন আপনি মেডিক্যাল এ পড়ে কখনোই ব্যারিস্টার হতে পারবেননা। So 1st we have to change the system and then the system will change all individuals.
তাই সিস্টেমটা বদলাতে হবে, বদলাতে হবে দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনৈতিক সিস্টেম। শাহাবাগের এ আন্দোলন হোক “দুর্নীতির বিরুদ্ধে” .
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।