আমি একজন সাধারণ মানুষ। আর কিছু বলার নেই।
আমাদের কথাসাহিত্য আঞ্চলিক ভাষা
ড. আশরাফ সিদ্দিকী
পৃথিবীর সর্বত্রই ভাষার দুইটি রূপ-একটি লেখ্য এবং অপরটি কথ্য। কথ্য ভাষারও থাকে আঞ্চলিক রূপ-চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, সিলেট এবং বরিশালের সাধারণ লোকের যে প্রচলিত কথ্য ভাষা তাতে থাকবে আঞ্চলিক রূপ।
আমাদের বহু কথা সাহিত্যিকগণ যেহেতু সমাজ এবং গ্রামেরও মানুষ কাজেই তাদের সাহিত্য আঞ্চলিক ভাষা আসা বিচিত্র নয়।
যদিও তাকে সর্ব সাধারণের বোধগম্য হওয়া প্রয়োজন। ১৮০০ অব্দে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতগণ সংস্কৃতবহুল সমাসবহুল বাক্যে গ্রন্থ রচনা করে সাধু গদ্য রীতির প্রচলন করেন। কিন্তু সেই সময়েই উদাহরণস্বরূপ ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘কলিকাতা কমলালয়’, নববাবু বিলাস ‘নববিবি বিলাস’ ইত্যাদি এবং বিশেষ করে প্যারিচাঁদ মিত্রর ‘আলালের ঘরের দুলাল’ কথ্য এবং আঞ্চলিক ভাষার একটি দলিল বলে গণ্য হওয়ায় যোগ্য। সমালোচকের ভাষায়, সাহিত্যের ভাষাও যেমন সংকীর্ণ পথে চলিতেছিল সাহিত্যের বিষয়ও ততোধিক সংকীর্ণ পথে চলিতেছিল। সংস্কৃতি বা ইংরেজি গ্রন্থের সারসংকলন বা অনুবাদ ভিন্ন বাংলা সাহিত্য আর কিছুই প্রসব করিত না।
আলালের ঘরের ভাষায় তাই দেখা গেল আঞ্চলিক রূপ দুনিয়াদারী করতে গেলে ভালাবুরা দুইই চাইÐ দুনিয়া সাচ্চা নয়- মুই একা সাচ্চা হয়ে কি করবো- এ বক্তব্য আঞ্চলিক সাহিত্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই এ যুগের আঞ্চলিক কথা বাংলার প্রশংসা করতে গিয়ে সমালোচকদের বন্তব্য সাহিত্যের প্রকৃত উপাদান আমাদের ঘরেই আছে তাহার জন্য ইংরেজি বা সংস্কৃতের কাছে ভিক্ষা চাহিতে হয় না। ঘরের সামগ্রী যত সুন্দর পরের সামগ্রী তত সুন্দর বোধ হয় নাঃ।
আধুনিক যুগের সাহিত্যিকদের মধ্যে বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর পথের পাঁচালী, ইসমাইল হোসেন সিরাজীর রায় নন্দিনী, শেখ ইদরিস আলীর ‘বঙি্ক্ষম দুহিতা’ আজ্জমদ আলীর প্রেমদর্পন-সাধু, কথ্য এবং আঞ্চলিক ভাষার নিদর্শন বহন করে। বিভাগোত্তর যুগে আবুল মনসুর আহমদের ‘আয়না’, আবুল ফজলের ‘রাঙা প্রভাত’, আবুজাফর শামসুদ্দীনের ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’ শহীদুল্লাহ কায়সারের ‘সংসপ্তক’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
মোটকথা ৬০ দশকের পূর্ব পর্যন্ত আমাদের কথাসাহিত্য গ্রামীণ জীবন কেন্দ্রিকই ছিল এবং ভাঙা আঞ্চলিক ভাষার বহুল প্রচারও দেখা গেছে। কবি নজরুল ইসলাম খুব বেশি উপন্যাস বা গল্প লিখেন নাই। কিন্তু তার মৃত্যুক্ষুধায় আমরা উত্তর বঙ্গের কথ্য ভাষার পরিচয় পাই। এ যুগের অন্যান্য উপন্যাসের কথা ছেড়ে দিলেও দৃষ্টান্ত হিসাবে আমরা আবু ইসহাকের ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ কথা বলতে পারি। কারণ পরিবেশ এবং ভাষা দু’য়েরই সম্মিলন ঘটেছে এখানে।
আঞ্চলিক জীবন চিত্র হিসাবে আমরা শামসুদ্দীন আবুল কালামের ‘শাহের বানু’, আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘কর্ণফুলী’, তাসাদ্দুক হোসেনের ‘সাঁওতাল জীবনের চিত্র, মহুয়ার দেশ’ বদরুদ্দিনের ‘অরুণ মিথুন’, শামসুল হকের ‘নদীর নাম তিস্তা' আবুল কালাম-এর ‘কাশবনের কথা’, ‘কাঞ্চনমালা’ এবং বিশেষ করে শহীদুলøাহ কায়সারের ‘সারেং বউ’-এর কথা বলতে পারি।
৪৭-এর বিভাগ পূর্ব যুগে ছোটগল্পে কাজী নজরুল ইসলাম, ইব্রাহিম খাঁ, আবুল ফজল, মাহবুব উল আলম, সরদার জয়েন উদ্দীন, সাহেদ আলী, রাহাত খান প্রমুখ। যাদের অনেকের গ্রন্থাদি বেসির ভাগ ৪৭ পরবর্তীতে প্রকাশিত ভাষা ও রীতিকে অস্বীকার করেন নাই।
এ সময়ে কাজী আফসার উদ্দিনের ‘চর ভাঙা চর’ আকবর হোসেনের ‘অবাঞ্ছিত’, ‘কি পাইনি’ বেদুঈন সমসেরের ‘মোহমুক্তি’, ‘রিক্সাওয়ালী’, ‘বুড়ীগঙ্গার বুকে’, প্রভৃতি আঞ্চলিক ভাষা, জীবন এবং জীবন ভাবনার পরিচায়ক। শওকত ওসমানের বিভিন্ন উপন্যাস বিশেষ করে জুলু আপা ও সামান্য গল্প’, আঞ্চলিক জীবনচিত্রের ছবি পূর্ণ।
আঞ্চলিক ভাষা এবং সাহিত্য প্রতিভার পরিমাপে এই যুগে শামসুদ্দীন আবুল কালামের পূর্বোক্ত শাহের বানু, ‘পথ জানা নাই’, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লাল সালু’ চাঁদের অবামস্যা বিষয় ও ভাষার উপযুক্ত চিত্রায়ন এ মধুর। অপেক্ষাকৃত তরুণদের মধ্যে মিন্নাত আলীর ‘সম্বল সংবাদ’, আবুল গাফফার চৌধুরীর ‘চন্দ্রদ্বীপের উপখ্যান’, শহীদ সাবেরের ‘এক টুকরা মেঘ’, সুচরিত মাধুরীর ‘একদি এক রাত’, নাজমুল আলমের ‘ফুল মতি’, রাবেয়া খাতুনের মধুমতী’, রাজিয়া খানের ‘বটতলার উপন্যাস’ রিজিয়া রহমানের রক্তের অক্ষর’ দিলারা হাশেমের ঘর মন জানালা’- বিশেষভাবে উল্লেখের দাবীদার-যদিও এদের বাইরেও বহু মনীষী কথা শিল্পীদের নাম রয়েছে এবং থাকবে।
পূর্বে উল্লেখিত গ্রন্থাবলী ছাড়াও অন্যান্য গ্রন্থেও আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে-চরিত্র চিত্রণ এবং পরিবেশ রচনার স্বার্থেই। শেষ কথায় বলা যায় সাহিত্য যেহেতু জীবনচিত্র, আঞ্চলিকচিত্র কাজেই কথাসাহিত্যে আঞ্চলিক ভাষা এসে যাবেই। সাহিত্যিকগণ একথা মনে রেখে নিজ নিজ অঞ্চলের চিত্র বোধগম্য আঞ্চলিক শব্দ ভান্ডার সমৃদ্ধ করলে তাতে লাভ বই ক্ ক্ষতি নেই।
সাধু ভাষা এবং কথ্য ভাষার বিবাদ দীর্ঘদিনের- বঙ্গিমচন্দ্র এবং মীর মশাররফ হোসেন সাধু ভাষায় গ্রন্থ রচনা করেছেন। ব্যতিক্রম বীরবল, শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায় এবং এ যুগের সাহিত্যিকবৃন্দ। আঞ্চলিক ভাষাও পরিপূর্ণ নয়। আংশিকভাবেই এসেছে- যা বোধগম্য এবং এ ধারা জাতীয় স্বার্থেই বেগবান হবে।
সংগৃহিত: ইত্তেফাক
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।