আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মেয়ে শেকড় (২)



শঙ্করী দরজা বন্ধের শব্দে চমকে উঠে নন্দিনীর দিকেই তাকালো। বৃন্দাবন তাকালো শঙ্করীর দিকে। নন্দিনী ওদের দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে নি:শব্দে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। শঙ্করী দুহাতে মুখ ঢেকে আচমকাই ডুকরে কেঁদে উঠলো। বৃন্দাবনের মনে হলো সে একেবারে একলা হয়ে গেল।

মনে হতেই, আশ্চর্য, বৃন্দাবনের ভেতরের অদ্ভুত কাঁপুনিটাও একেবারে থেমে গেল। আজও নিত্যদিনের মতোই অফিস থেকে ফেরার পথে পাড়ার চায়ের দোকানে বেশ ভিড় দেখে একটু অবাক হলো সুজন। হাটের দিন বেশ ভালোই ভিড় হয়। কিন্তু আজ তো হাটবার নয়! --সুজনদা, এক মিনিট! পাড়ারই এক হতশ্রী আঠারো। রাস্তার মোড়ে এঁকেবেঁকে দাঁড়িয়ে কায়দা করে সিগ্রেট টানে।

বিদ্ঘুটে ছেঁড়া-ফাটা জিন্স আর বেঢপ সাইজের বিচিত্র রঙের শার্ট ছাড়া ওকে দেখাই যায় না। ছোকরার ডাক নাম আলু। ভালো নাম বোধহয় আলো কিংবা অলোক! আমাদের দেশে নামের সঙ্গে কবে আর পাত্র-পাত্রীর সামঞ্জস্যের কথা ভাবা হয়!--সুজন থমকে দাঁড়ালো। তাকালো আলুর দিকে। --একটু ছাইডে আসুন।

ছিক্রেট! আলু দোকান থেকে প্রায় লাফিয়ে সুজনের সামনে এসে দাঁড়ালো। সুজন অবাক হচ্ছিল আলুর হাবভাব দেখে। একটু অন্ধকার দেখে আলুর কথা মতো সাইডে দাঁড়ালো। --কি ব্যাপার, আমাকে কিছু বলবে? --হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কি কিছুই জানে না? --না তো! --গোটা বেঙ্গল জানে আর আপনি জানে না! --বললাম তো জানি না! জানলে আর সিক্রেট হয় কি করে? --বেন্দাবনবাবুর বড় মেয়ের কথা আপনি শোনেনি? --হ্যাঁ, সে তো কবে হারিয়ে গেছে শুনেছি-- --ঠিকই শুনেছেন।

তবে সে এখন সুপারহিট হিন্দি ফিলিম! আলুর দাঁতগুলো অন্ধকারে ঝকঝক করে ওঠে। চোখ দুটো গোল গোল। --হিন্দি ফিল্ম! অস্ফুটে উচ্চারণ করে সুজন। --বেন্দাবনবাবুর সেই মেয়ে ছ'বছর ইন্টরভ্যালের পর আজই ইন করেছে। ক্যালকাটা পুলিশ ইন করিয়ে দিয়ে গেল।

--তাই নাকি! বা:! খুবই আনন্দের কথা। কিন্তু এটাকে সিক্রেট বলছো কেন? --আসলি খবরটা শুনলে আপিনও বলতেন এটা ছিক্রেট ব্যাপার! --তা আসল খবরটা কি? --মেয়ে তো ফিরেছে। কিন্তু কোথা থেকে ফিরেছে? আলু সুজনের নাকে নিজের নাক প্রায় ঠেকিয়ে ফিস ফিস করে ওঠে। --কোথা থেকে ফিরেছে? -কলকাতার মেয়েছেলেদের বাজার থেকে। স্পষ্ট করে থেমে থেমে শব্দগুলো উচ্চারণ করলো আলু।

সুজন আচমকাই চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল। কিন্ত ঠিক সময়মতো নিজেকে সংযত করে নিল। সুজন আর বিন্দুমাত্র কৌতুহল না দেখিয়ে হনহন করে বাসার দিকে এগিয়ে গেল। বাইরে থেকে তালা খোলার শব্দ শুনে ঘড়ির দিকে তাকালো শঙ্করী। সাড়ে সাতটা বাজে।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে আলোর অস্তিত্বও টের পেল। আজ এত তাড়িতাড়ি ফিরলো ছেলেটা। খবরটা নিশ্চয়ই কানে গিয়েছে। ভেতরের দরজা দিয়ে উঠোনে নেমে কলতলা-বাথরুমে যেতে হয়। শঙ্করী তাড়াতাড়ি ভেতর-বারান্দায় বেরিয়ে এসে দেখলো নন্দিনী বারান্দার শেষপ্রান্তে খুঁটিতে হেলান দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

একপিঠ খোলা চুল পিঠের ওপর ছড়িয়ে রয়েছে। মুখের রঙ ধুয়ে-মুছে ফেলেছে। কিন্তু চুড়িদারটা ছাড়েনি। জামা-কাপড় তো কিছুই সঙ্গে আনেনি। একটা ছোট ভ্যানিটিব্যাগ ছাড়া সঙ্গে আর কিছুই ছিল না।

শঙ্করীর পায়ের শব্দ শুনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো নন্দিনী। পড়ার ঘরে আনন্দ আর নন্দিতা পড়তে বসেছে। অন্যদিনের মতো হৈ-চৈ নেই। শুন গুন শব্দ ভেসে আসছে। --নিজের ঘরে যা।

বাইরে ঠাণ্ডা লাগছে না? নন্দিনী শঙ্করীর চোখের দিকে তাকালো। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। ভেতরের দরজা খুলে সুজন উঠোনের মাঝখানে নেমে এল এবং অনিবার্য কৌতুহলবশত: নন্দিনীর দিকে তাকালো। আলোর জোর কম। খুব স্পষ্ট মুখটা দেখা যাচ্ছে না।

--কি হলো? বললাম যে ঘরে যেতে! চাপা অথচ স্পষ্ট বিরক্তিতে ফেটে পড়লো শঙ্করী। --যাব না। ঘরে দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। এখানেই বেশ লাগছে। তোমরা চা খাও না? শঙ্করী স্তম্ভিত বিস্ময়ে ফ্যাল ফ্যাল করে কয়েক সেকেণ্ড নন্দিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।

--এই বুঝি আপনাদের সেই হারানো মেয়ে নন্দিনী? দু'এক পা এগিয়ে এসে পেয়িং গেস্ট সুজন শঙ্করীকে প্রশ্ন করলো। গোপন করা গেল না। গোপন করা যেতও না। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় শঙ্করীর বিহ্বলতা এখনো কাটেনি। সুজনের দিকে না তাকিয়েই হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো শঙ্করী।

নন্দিনী পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালো সুজনের দিকে। চেনা সব শেয়াল-কুকুরের সঙ্গে এক্ষুণি মেলানো যাচ্ছে না। কিন্তু যখন জানবে নন্দিনীকে গত ছ'বছর ধরে শেয়াল-কুকুরে টানাটানি করেছে দু'চার টাকার বিনিময়ে তখন এর চোখ দুটোও দুপুরে দরজায় ভিড় করে দাঁড়ানো লোকগুলোর মতো হয়তো চকচক করে উঠবে। সুযোগ পেলেই হাত বাড়াবার চেষ্টা করবে। নন্দিনী পায়ের ভর পাল্টে একটু বেঁকে দাঁড়ালো।

শঙ্করীর ইচ্ছে হচ্ছিল চুলের মুঠি ধরে সর্বনাশী মেয়েটার মুখটা দেওয়ালে ঘষে দেয়। --মাসিমা, চা করলে আমাকে এককাপ পাঠিয়ে দেবেন। ততক্ষণে আমি হাত মুখ ধুয়ে নিই। সুজন বাথরুমে ঢুকে গেল। বারান্দা থেকে কিছু চাপা তর্জন-গর্জন ছাড়া স্পষ্ট কোনো কথা সুজন শুনতে পাচ্ছিল না।

আসলে সে শুনতেও চাইছিল না। ...আনন্দ-নন্দিতার পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছিল না। শঙ্করী বারন্দা থেকে ধমক দিল-- --তোরা চুপ করলি কেন? আজ বাদে কাল পরীক্ষা না? --আমি চা করবো? নন্দিনী জানতে চাইলো। --না। --আমি চা বানাতে পারি।

--থাক। --তোমাদের কাজের লোক নেই? --আছে। বিকেলে আসার কথা ছিল। হযতো আর আসবে না-- --আমার জন্যে? নন্দিনীর স্পষ্ট প্রশ্নে শঙ্করী থতমত খেলো। কি বলবে ভেবে পেল না।

নন্দিনী কি একটু মুচকি হাসলো? সম্পর্ক ধরে নন্দিনী এখনো একবারও কাউকে সম্বোধন করেনি। অথচ সম্পর্কটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সম্পর্কের সূত্র ধরেই ছ'কছর পরে পরস্পরের কাছাকাছি আসা। --সন্ধেবেলায় চা না খেলে আমার মাথা ধরে। নন্দিনী সোজা হয়ে দাঁড়াতেই শঙ্করীর চোখ দুটো আবার ধাক্কা খেল।

বুকের ওপর ওড়না নেই। বিস্ফোরক যৌবনের উগ্রতা বড় স্পষ্ট। শঙ্করী দ্রুত ঘরে ঢুকে নিজের একসেট শাড়ি-শায়া-ব্লাউজ এনে নন্দিনীর হাতে গুঁজে দিল। --এসব ছেড়ে শাড়ি পরে নে এক্ষুণি! প্রতিবাদ করতে গিয়েও থেমে গেল নন্দিনী। বাথরুম থেকে বেরিয়ে সুজন আবার তাকালো নন্দিনীর দিকে।

একটু হাসলো। --মেসমশাইকে দেখছি না যে! --বাজারে গেছেন। শঙ্করী তাড়াতাড়ি নন্দিনীকে আড়াল করে সুজনের সামনে দাঁড়ালো। --ও। মাসিমা ঠিকই বলছেন নন্দিনী, ঘরে যাও।

এখানকার ঠাণ্ডা খুব খারাপ। পরে কথা হবে। বলে সুজন ঘরে ঢুকে গেল। নন্দিনীও শঙ্করীর শাড়ি-জামা নিয়ে ঘরে চলে গেল চুপচাপ। শঙ্করীর মনে হলো এই অত্যন্ত ভদ্র ছেলেটি তাদের পারিবারিক বিপর্যয় নিয়ে মজা মারবে না ঠিকই, কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি তাদের ঘর ছেড়ে চলে যাবে অন্য কোথাও।

ছ'বছর পরে নন্দিনী ফিরে এসে তুলে নিচ্ছে মুঠো মুঠো শান্তি ও স্বস্তি। শেষপর্যন্ত কপালে যে কি আছে ভাবতেও ভয় পাচ্ছে শঙ্করী। অন্যদিনের তুলনায় আজ রাতের খাওয়া সকাল সকাল মিটে গেল। বৃন্দাবন আর শঙ্করী নামমাত্র বসেছিল। আনন্দ আর নন্দিতাও অন্যদিনের মতো হৈ হৈ করে খেতে পারেনি।

অদূরে একসঙ্গেই খেতে বসা নন্দিনীর দিকেই সকলের চোখ ছিল। নন্দিনীর কিন্তু খিদে পেয়েছিল খুব। দুপুরে তো প্রায় কিছুই খাওয়া হয়নি। সময় নষ্ট না করে পেট ভরে খেতে ব্যন্ত ছিল সে। হঠাৎ এক আধবার লক্ষ্য করছে সকলেই তাকে দেখছে কিন্তু কোনো কথা বলছে না।

মনে মনে প্রচণ্ড বিরক্ত হচ্ছিল। খাওয়া শেষ করে তাই আচমকাই কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে উঠলো-- --তোমরা তো আমার খদ্দের নও, এত ড্যাব ড্যাব করে দেখার কি আছে? ঘরের মধ্যে আচমকা বাজ পড়লে মানুষের চেতনা-চৈতন্য যেমন লুপ্ত হয়ে যায়, নন্দিনীর কথা শুনে বৃন্দাবন আর শঙ্করীর অবস্থাও কয়েকমুহূর্তের জন্যে সেইরকম হয়ে উঠলো। ভয়ঙ্কর এক কঠিন পরীক্ষার মুখে এসে যেন গোটা পরিবারই অনিবার্য পতনের প্রহর গুণছে। মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বৃন্দাবনের চেনা জগৎটাই কেমন পাল্টে গেছে। বন্ধু-বান্ধব পরিচিতজনের দৃষ্টি--ঠোঁটের রেখা ভাষা ও শব্দের পরিচিত ছক সবই যেন পাল্টে গেল! (চলবে)


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.