আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

৯ বছরের ভাষাশহীদ অহিউল্লাহ,তার দেখা ভালোবাসার গল্প এবং উইকিপিডিয়া নিয়ে ছোট্ট কিছু কথা

সাদ আহাম্মেদ

ছিপছিপে গড়নের ছেলেটি অনেকক্ষণ ধরে বায়োস্কোপের পাশে দাড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা রশীদ মিয়ার ভাল লাগছেনা। প্রতিবার সে ছেলেটির দিকে তাকাচ্ছে আর মুখ দিয়ে এক দলা থুতু বের করে ছেলেটির পায়ের একটু সামনে সই করে ফেলছে। এই বায়োস্কোপটি সে বহু কষ্টে কিনেছে। এর আগে তার তিনটি মেশিন চুরি হয়েছে।

তাই এখন সে অনেক সাবধানে থাকে,এক মুহুর্তের জন্যও বায়োস্কোপ চোখ ছাড়া করেনা। দুনিয়ার সবাইকে তার কেমন যেন সন্দেহ হয়। দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিকেও কেমন কেমন যেন লাগছে। সকাল থেকে খাওয়া হয়নাই,মুখ ভর্তি করে খালি থুতু আসছে,এর মধ্যে এই ছেলের যন্ত্রণা। এইসব কথা চিন্তা করে মুখ বেজার করে সে ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করে “রিস্কা চালাস?”বলতে বলতেই ছেলেটির সামনে উঁকি দিয়ে বলে “"হেইডা তোরনি?”" ছেলেটি একবার উপরে নিচে মাথা নাড়ায় আর বায়োস্কোপের দিকে আরো মনোযোগ নিয়ে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে বলে “"থুতু শইলে লাইগলে তোর মুখে _ইগা দিমু”"।

রশিদ মিয়া নিজেও এইবার মাথা নাড়ায়,চুপ করে থাকে কিছু বলেনা। তার কাছে মনে হলো এমন বলাটাই স্বাভাবিক। সে চারপাশে তাকিয়ে জোরে জোরে হাঁক ছাড়ে ,"বায়োস্কোপ বায়োস্কোপ,দুই আনায় বায়োস্কোপ"”। যে ছেলেটির কথা বলা হচ্ছে তার নাম অহিউল্লাহ। দরিদ্র ঘরে জন্ম নেয়া ছেলেটি তার গ্রাম থেকে দিনমজুর পিতার মারের হাত থেকে বাচতে পালিয়ে এসেছে ঘর থেকে।

বাংলা ভাষার দাবিতে ঢাকা তখন উত্তল। ৪৭ এর ৮ ডিসেম্বর শুরু হওয়া আন্দোলন দিন দিন আরো বাড়ছে। ৯ বছরের অহিউল্লাহ এইসব বুঝেনা। সে শুধু জানে দেশের অবস্থা সুবিধার না,খুব তাড়াতাড়ি একটা বড়সড় ঝামেলা হতে পারে। আর যখনই এই সব কথা মনে হয় তখনই তার বুকে কেমন চিন চিন করে ব্যাথা করে উঠে।

বেশিরভাগ সময় সে এইসব জ্ঞ্যানের কথা চিন্তা করে নিশিকালে ঘুমানোর আগে,কিন্তু আজকে এই সন্ধ্যাকালেও তার বারবার যুদ্ধ আর রক্তের কথা মনে হচ্ছে। এর কারণ বরকত ভাই। বরকত ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টিরী পড়ে। বিকেল বেলা যখনই সে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে রিকশা টানতে যায় তখনই সে দেখতে পায় বরকত ভাই রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে। বেশিরভাগ দিন অহিউল্লাহকে বরকত ভাই ডাক দিয়ে বিস্কুট কিনে দেয়।

মানুষটাকে তার বড় ভাল লাগে। কি সুন্দর সুন্দর কথা বলে আর যখন বলে তখন অহিউল্লাহর নিজেকে বড় মানুষ মনে হয়। আজকে বিকেলেও বরকত ভাই তাকে ডাক দিয়ে চা আর বিস্কুট কিনে খাওয়াইলো। চা খেতে খেতে সে বড়দের মত করে বরকত ভাইকে জিজ্ঞেস করে "“বরকত ভাই দেশের অবস্থা কীরাম?”";বরকত ভাই কিছু বলেনা,আকাশের দিকে তাকায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অহিউল্লাহ বুঝেনা কিছু,তার মনে হয় ভাইয়ের মন খারাপ।

সে বড়দের মত ভাব করে মাথা নাড়ায়। একসময় বরকত ভাই নিজেই বলে “"বাঙ্গালী জাতি কি জিনিস এইটা জিন্নাহ জানেনা,ব্যাটা দশ দিন দেশ ভ্রমণ করে উর্দুর বাণী শিখায়। কালকে ওরে আমরা শিখাবো উর্দু কাকে বলে”। "অহিউল্লাহ ফিক করে হেসে দেয়। বরকত ভাইয়ের মানুষের হাসি দেখতে ভাল লাগে।

নয় বছরের এই ছোট্ট কিশোর যখন তাকে বরকত ভাই বলে তখনও সে বেশ আনন্দ পায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার কাছে সে বরকত ভাই। কলাভবন দিয়ে বের হলেই রিকসাওয়ালারা তাকে ছেঁকে ধরে জিজ্ঞেস করে "“বরকত ভাই,কই যাইতেন,আমার রিস্কায় আয়েন। নতুন হাওয়া ভরছি”"। অহিউল্লাহ সন্ধ্যার পরপর রিকসা নিয়ে মেডিকেলের দিকে যায়।

তখন এক লোক তাকে হাত দেখায় থামায়। অনুরোধের কন্ঠে জিজ্ঞেস করে “ছোটভাই একটু মেডিকেল লইয়া যাইবানি?”। অহিউল্লাহ দাঁড়িয়ে পড়লে রিকসায় উঠে বসে লোকটি। আস্তে আস্তে প্যাডেল চালাতে থাকে অহিউল্লাহ। “"নাম কিরে ভাই তোর”",যাত্রীর কন্ঠ শুনে পিছনে তাকায় অহিউল্লাহ।

সাধারণত তাকে কেউ তুই বললে সে পছন্দ করেনা। কিন্তু এই লোকটার কন্ঠে একটা আপন ভাব আছে। সে নাম বলে। এরপর গ্রামের বাড়ি,কবে থেকে রিক্সা চালায় এইসব জিজ্ঞেস করলে তাও বলে। সেও জানতে পারে যাত্রীর দেশ ময়মনসিং।

মেডিকেলে তার শ্বাশুরী আছে। কি যেন এক মরণব্যাধি হয়েছে নাম বলে আন্সার। রিক্সা মেডিকেলের সামনে থামলে লোকটি ছুটে গিয়ে নেমে এক মহিলার কাছে যায়। মহিলা উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে “"এত দেরী করলা কেন?",”লোকটি হাসে আর মমতামাখা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে “"আম্মায় কেমন আছে?"। ”মহিলা মাথা নেড়ে বলে “বাদলের শইল্টা ভালা না,থাইম্যা থাইম্যা জ্বর আসে।

”কথা শুনে তার স্বামী চিন্তিত মুখ করে অহিউল্লাহর দিকে তাকায় আর স্ত্রীকে বলে “"এই দেহ,এই ছুট্ট পোলা আমারে টাইন্যা আনছে আজকে,জানিনা কেমতে রিস্কা টানে”"। কথা শুনে অহিউল্লাহ হাসে তারপর আস্তে রিক্সা ঘুরাতে থাকে অন্যদিকে। "“কিরে ব্যাটা ভাড়া নিতিনা?"”,হাসি হাসি কন্ঠে জিজ্ঞেস করে লোকটি। জবাবে আরেকটা সুন্দর হাসি দেয় অহিউল্লাহ। তারপর দ্রুত রিক্সা টেনে অন্যদিকে চলে যায়।

অহিউল্লাহর এই যাত্রীর নাম ছিল আব্দুল জব্বার। জব্বার জানতোনা পরের দিন তাকে এই ঢাকা মেডিকেলেই আহত হয়ে আসতে হবে। কামরান আলি ছোট-খাটো গড়নের মানুষ,প্রায়সময় সে তার প্রিয় নীল পাঞ্জাবী পড়ে থাকে,বিশেষ করে যেদিন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সাথে মিটিং থাকে ওইদিন তার এই পাঞ্জাবী ছাড়া কিছুই পড়তে ভাল লাগেনা। এর পিছনে অবশ্য একটা সূক্ষ্ম কারণ আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে সে কবিতা লিখা শুরু করে,কবি মানেই তার কাছে উশকো খুশকো দাড়ির পাঞ্জাবীপরিহিত এক যুবকের কথা মনে হয়।

বাংলাতে সম্মান পাশ করেছে তা প্রায় ২ বছর হলো। কিন্তু এখনো বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে পারেনি। প্রায়সময় দেখা যায় তাকে সভাসমিতিতে যেয়ে জ্বালাময় বক্তব্য রেখে ছাত্রদের উদ্ধার করে আসছে। এজন্য কেউ কেউ যেমন তাকে ভয় পায়,কেউ আবার গদগদ হয়ে তাকে নানান রকম হাওয়া বাতাস দেয়। কামরান আলী সবই বুঝে,নিজের গুণগান শুনতে তার ভালোই লাগে।

সবচেয়ে ভালো লাগে যখন তাকে কেউ বলে “কবি কামরান”। আজকে তার বাসায় বিশাল সমাবেশ। তার সকল গুণমুগ্ধ ছাত্র জনতা বাসার বাইরে ছোট খালি জায়গায় এক হয়েছে। এরা সবাই এসেছে ভাষার দাবী নিয়ে তার কথা শুনতে। কামরান আলী একটি চেয়ারে বসে তাকে ঘিরে মানুষজনের আগ্রহ উপভোগ করছে।

কখনো কখনো উত্তেজনায় আপনা আপনি তার পা কেঁপে কেঁপে উঠছে। একটু পরই সে উঠে দাড়ালো হাতে একটা কাগজ নিয়ে। বজ্রকন্ঠে বলা শুরু করলো “"৪৭ এর ৮ তারিখ তোমরা এক হয়াছিলা,কি জন্যে বলো”", আশেপাশের মানুষের দিকে তাকিয়ে সে জবাব প্রত্যাশা করে। বেশিরভাগ চুপ করে থাকে,দুই একজন বলে “"মায়ের ভাষা বাংলা ভাষার জন্যে”"। কামরান আলী আবার বলা শুরু করে "“তুমি আমি কথা বলতেছি বাংলা ভাষায়,উর্দু আবার কি।

ওইটা আমার মায়ে না বাপে জানে। শহীদুল্লাহ স্যার,মজলিশের আবুল কাশেম স্যার বহুভাবে সরকারকে বুঝাইছে বাংলা ভাষার গুরুত্ব। কিন্তু জিন্নায় এইটা কি করলো। সে আমাগো ভার্সিটিতে আইসা ৪৮ এর ২৪ তারিখ কইলো বাংলা নাকি ভুয়া ভাষা,উর্দুই হইবো একমাত্র। আমি কই আবে হালায় তোর ভাষা উর্দু হইবো বুঝলাম,আমি তো উর্দু পারিনা।

তুই বাংলা না শিইখ্যা আমগোরে কেন উর্দু শিখাইবার চাস। আমি তখন তরুণ ছাত্র। কিন্তু তোমাগো মত দুধ খাওয়া শিশু ছিলাম না। এই কথা কওনের সাথে সাথে খাড়ায় গেছি। আমি প্রতিবার করছি।

কিন্তু জিন্নায় শুনেনাই”"। এইটুকু বলে দম নেয় কামরান আলী। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। অধিক উত্তেজনায় তার ভাষা অনেকটাই বিকৃ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু এদিকে তাকালে চলবেনা।

পাবলিক কথা গিলছে,তাকে আরো ভিটামিন বানিয়ে খাওয়াতে হবে। আশেপাশে তাকিয়ে সে আবার মাথা দুলিয়ে বলে “"যেই কথা আমি বারবার বলছি কেউ তখন বুঝলোনা। আমার কথা শুনলো সবাই ৩১ তারিখ। মিয়ারা আমি কইনাই সব দল এক হয়া কমিটি করতে। আজকে ঠিকই সবাই আমার কথা শুনছে।

আমি বলতেছি এই সর্বদলীয় কমিটি আমার তোমার সন্তানের মুখে বাংলা আইনা দিবো। ভাসানী সাব কি কম মাওলানা বুঝে। ওই উর্দু হালারা কয় উর্দু নাকি মুসল্মানের ভাষা,বাংলা কয় হিঁদুর। আরে মিয়ারা তোগো চেয়ে বহুত ভাল নিয়তের মানুষ,সাচ্চা মুস্লিম এই দেশে আছে। হেরা বাংলাতেই কথা বলে।

ভাসানী সাব বাংলারে আকঁড়ায় ধইরাই ভাষা কমিটির সভাপতি হইছে। শুনো ছাত্ররা,শুনো হে জনতা ৪ তারিখ আমরা বহুত ফাল পাড়ছি,কিন্তু কামের কাম হয়নাই। ২১ তারিখ শুধু লাফ দিলে হইবোনা,চিল্লাইতে হইবো। ১৪৪ ধারা কিসের ধারা। উর্দুগুলানরে ২১ তারিখ আমি ধারাপাত শিখায় ছাড়মু।

স্বরে-অ কয়ায় বাথরুম করামু। ওই মিয়ারা গলায় জোর নাই। জোরে সবাই চিক্কুর পাড়ো একটা। বলো সবাই,যে কহেনা বাংলা,তারে কহে ছাগলা”"। নিজের কবি প্রতিভায় মুগ্ধ হয় কামরান আলী।

জনতা সবাই এখন ছাগলা ছাগলা বলে গর্জন করছে। অনেকদিন পর কামরান আলীর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। ছোট থেকে তার একটাই স্বপ্ন রবিঠাকুরের মত একজন কবি হওয়া। সে মনে করে উর্দু ভাষায় এমন মহান কবি হওয়া যাবেনা। * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * ২১ তারিখ সকাল নয়টায় কামরান আলী ঢাকা ভার্সিটি যায়না।

তার পেট খারাপ করেছে। একটু বেশি খারাপ করেছে,আর তাই বিছানায় পড়ে পড়ে সে বিলাপ বকে যাচ্ছে। পাশে এক ছাত্র বসে অনেকক্ষণ ধরে কবির বেহাল দশা দেখছিলো। অবশেষে সে বলেই ফেললো, “"কবি পেট খারাপ হইলে কাউকে তো এমন বিছানায় শুয়ে হাঁসফাঁস করতে দেখিনাই”"। কথা শুনে কামরান আলীর প্রথম বেশ রাগ পেয়েছিলো,কিন্তু পরে মাফ করে দিলো।

হাজার হোক কবি বলে ডেকেছে। রাগ করে কি করে। ২১ তারিখ সারাদিন সে বিছানাতেই শুয়ে রইলো। সবাই চলে গেলে তার স্ত্রী চুপে চুপে এসে বললো, “"কবি ভাই,তোমার মত ভন্ড এই দুনিয়ায় আর একটাও নাই”"। কামরান নীরবে শুনে আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো।

ওদিকে আব্দুল জব্বার খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেছে। ফজর নামায আদায় করে সে অভ্যাসমতো হাত পা কিছুক্ষণ ছুড়াছুড়ি করলো। হাসপাতালের একটি কোণে সে তার বউ,অসুস্থ শ্বাশুরী আর ছেলে নিয়ে আছে। গ্রামে যেতে মন চায়। কিন্তু কিছু করার নাই।

মনটা তার ছেলের জন্যও খারাপ হয়ে আছে। দুই বছরের ছোট্ট ছেলে নিয়ে মুসিবতে পড়ে গেছে জব্বার। ছেলের খালি জ্বর হয় আর পেট খারাপ করে। এই সাতসকালে তার এইসব হাবিজাবি ভাবতে আর ভালো লাগছিলোনা। গুটি গুটি পায়ে সে তার স্ত্রীর কাছে যেয়ে বলে, “"আমিনা ভালো লাগতেছেনা বুঝলা।

জগৎ সংসার তিতা লাগে"”। আমিনা খাতুন ঘুম ঘুম ঘোরে বলেন “"আইসেন আমার পাশে বইসেন"”। স্বামীকে তার বড় মায়া হয়,কিন্তু কখনো মুখ ফু্টে বলা হয়না। মাটির মত কোমলমনা তার স্বামী অথচ সেই তাকেই কেন যেন সে অনেক ভয় পায়। জব্বার আমিনার পাশে যেয়ে বসে বলে “এইবার গ্রামে যায়া তোমার জন্য একটা গাভি কিনা দিমু।

বাচ্চারে নিয়মিত গাভির দুধ খাওয়াবা”। ঘুমের ঘোরেই আমিনা হেসে উঠে। জব্বার এবার তার সন্তানের দিকে তাকায়। বাচ্চাদের মত করে বলে উঠে, “"ওরে আমার বাদলারে”"। নিষ্পাপ শিশু তার বাবার কথা কি বুঝেছে কে জানে।

শুধু একটু ফিক করে দুই দাঁত দেখিয়ে হেসে দিলো। আব্দুল জব্বারের চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেলো। জগতের সকল মমতা দিয়ে সে তার সন্তান আর বধূর কপালে হাত বুলিয়ে দিলো। সকাল ৮টার কিছু আগে আব্দুল জব্বার হাসপাতালের বারান্দায় ঘুরাঘুরি করছিলো। আশেপাশের মানুষ থেকে জানতে পায় আজকে নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আন্দোলন করবে।

কিছুক্ষন পরে সে জানতে পারে এইসব কিছু ভাষার জন্য। সবশুনে তার চোখের সামনে ভেসে উঠে ছোটকালের কথা। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত সে পড়েছিলো। বাংলা পড়াতো দাঁড়িওয়ালা এক স্যার যার নাম এখন তার মনে নেই। শুধু মনে আছে স্যারের কবিতা আবৃত্তির কথা।

আঁহা! কি সুন্দর লাগতো শুনতে। স্যার বলতেন,"“ভাষা যদি না থাইকতোরে তবে কবিতা গল্প কিছুই হইতোনা। তোরা বইসে বইসে পুকুরেপাইড় যায়ে মাছ মাইরতি আর বাসায় যেয়ে লবণ মেখে খাইতি। পড়াশোনা আর লাইগতোনা”"। জব্বার গুনগুন করে বলতে থাকে “"আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে”"।

রাত্রি নয়টার কিছু পরে আব্দুল জব্বারকে ঘিরে তার বউসহ অনেক লোক দাঁড়িয়ে থাকে। সে আবছা শুনতে পায় আমিনার গলা। আমিনা জোরে জোরে বিলাপ করতে থাকে “"রাস্তায় কেন গেছিলেন। আমার বাদলের এখন কি হইবো?আপনের কিছু হইলে আমি বাচুমনা”"। জব্বারের দুচোখ গঁড়িয়ে পানি পড়ে,কিন্তু পরক্ষণেই আবার মূর্ছা যায়।

ঘন্টাখানেক পরে আমিনা দেখে জব্বার তাকে আলতো সুরে ডাকছে, কাছে গেলে জব্বার তাকে বলে “"তোমার জন্য পরান পুড়েরে বউ। আমার বাচ্চাটারে দেইখ্যা রাখিয়ো"। ”একটু সামনে জব্বার তাকিয়ে দেখে অহিউল্লাহ বসে আছে। ছোট্ট করে একটা হাসি দেয় জব্বার ওকে দেখে। অহিউল্লাহ চুপ করে বড় বড় চোখ নিয়ে বসে থাকে।

সে বুঝতে পারেনা কিছু বলা উচিত কিনা। আমিনা স্বামীর কপালে হাত রেখে বলে “"এই পিচ্চি অনেক কাম করছে। অই সব অষুধ আইন্যা দিতাছে”"। জব্বার আমিনার দিকে তাকিয়ে বেদনার চোখে তাকিয়ে তার শেষ কথাটি উচ্চারণ করে ,"“বাদলারে কবিতা শিখায়ো,রবীনাথ এর কবিতা”"। এটুকু বলে পাশ ফিরে চিরনিদ্রা যায়।

অহিউল্লাহ তার গুঁটি গুঁটি পায়ে লুকিয়ে লুকিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে যায়। সারাদিন সে লুকিয়ে লুকিয়ে থেকেছে। এখনো তার বুক ঢিপঢিপ করে কাঁপছে। আজকে একদিনে সে অনেক বড় হয়ে গেছে। সে বুঝতে শিখেছে জীবন বড় কঠিন।

কার্জন হলের পাশ দিয়ে যাবার সময় সে শুনতে পায় ছাত্ররা বলছে বরকত ভাই নাই। বুক উঁথলে তার কান্না আসে,কিন্তু ছেলেমানুষের নাকি কাঁদতে নাই। এইটাও বরকত ভাই তাকে শিখিয়েছে। কান্না চেপে রেখে সে অন্ধকার রাস্তায় হারিয়ে যায় আর ভাবতে থাকে,বরকত ভাই মেডিকেলে কোথায় ছিলো,কেন সে তার দেখা পেলোনা? ২২ তারিখ কামরান আলীর বাসায় বেশ কিছু ছাত্র একসাথে হয়েছে। তারা সবাই অপেক্ষা করছে সে কিছু বলবে।

অনেকক্ষণ পরে কামরান আলী তার ঘর থেকে বের হয়ে আসে রোগাক্রান্ত শরীর নিয়ে যদিও মুখটা ছিলো হাসি হাসি। হাত উপরে তুলে সে জিজ্ঞেস করে,"“শুনলাম বরকত নাকি নেই"। সামনের জনতা মাথা নাড়ে। দুইএকজন বলে, "“আজকে আবার ১৪৪ দিছে। এই ধারা আবার আমরা ভাঙ্গবো।

কার্জন হলের কাছে সবাই কিছুক্ষণ পর এক হবো বলে ঠিক করছি"। ”কামরান আলী শুনে,সবার কথা শুনে,নিজে কিছু বলেনা। একসময় নীরবতা ভেঙ্গে সে বলে ,“"আমি ভীতু,আমি তোমাগোরে আন্দোলন করতে বইল্যা নিজে ইঁদুরের মত ঘরে বইস্যা ছিলাম। আসো আমার গায়ে ছেপ দাও”"। উপস্থিত সবাই এহেন কথা শুনে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।

কামরান আলী আবার বলে ,“"আমার পোলাগোরে মাইরা ফেলাইছে আর আমি ঘরে বইসা বার্লি খাইছি,আয় আমার পশ্চাতে লাথি মাইরা যা সব"। ”ঘরে পিনপতন নীরবতা। কারো মুখে কথা বের হয়না। আবারো কামরান আলীই বলে, "“আমার বাপেরে যখন ব্রিটিশরা জুতার বাড়ি দিয়া গুঁতায় গুঁতায় মারছিলো,আমি কিছু বলিনাই। কিন্তু আজকে আমার পোলাগোরে এমনে রাস্তায় গুলি কইরা মারছে আর আমি ঘরে বইস্যা বাথরুম করমু এইটা হইবোনা”"।

এটা বলে কবি তার ঘরের দরজা দিয়ে একটা দৌড় দিলো। পেছনের সবাই শুনলো এক পাগল পাগল উস্কো খুস্কো চুলের নীল পাঞ্জাবী পরা লোক রাস্তা দিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে আর চিৎকার করে বলছে “"ছাড়মুনা ছাড়মুনা,উর্দু ভাষা মানমুনা”"। কার্জন হলের কাছে ভীড় দেখে অহিউল্লাহ এগিয়ে যায়। সে দেখতে পায় সবরকমের মানুষ চিৎকার করছে বাংলা ভাষার দাবী নিয়ে। রক্ত গরম হয় তার।

এই ভাষার জন্য বরকত ভাই প্রাণ দিছে,দরকার হইলে সেও দেবে। মিছিলের সাথে সেও ছুটে যায়। গলা ফাটিয়ে বলতে থাকে “"রাইস্ট্র ভাষা বাংলা চাইইই"”। জীবন বড়ই কঠিন,তাই দিনশেষে নয় বছরের অহিউল্লাহকে নবাবপুর রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায় আরেক শহীক শফিউরের সাথে। নিথর দেহটা অনেকক্ষণ কেউ ছুঁয়ে দেখেনা।

দূর গ্রামে শুধু তার মায়ের মন কে যেন রক্তচাবুক দিয়ে ছুঁয়ে নিয়ে যায়। দুইদিনের ভুঁখা অহিউল্লাহের মা বাড়ির উঠানে যেয়ে হাঁপুড় পেড়ে কেঁদে উঠে, একবার মাটিতে হাত আঁচড়ায় আর একবার নিজের মাথায়। আশেপাশের কুটিরে শুনতে পাওয়া যায় চিঁৎকার,"“আমার মানিকের যেন কি হইছে রে,ও আল্লাহ আমার মানিকরে কেডায় মারলো রে”"। দূর থেকে অহিউল্লাহর পিতা চিঁৎকার শুনে ছুটে আসে আর কান্না জুড়ে রুগ্ন কন্ঠে বলে, "“আমি পাষন্ড পিতা,অরে মাইরা ঘর থেকে বাহির কইরা দিছি। আমার দুধের পোলা...”"।

এই দম্পতি অহিউল্লাহ পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে প্রতিদিন না খেয়ে হলেও একবাঁটি ভাত আর একটা আধা পিঁয়াজ় খাটের নিচে লুকিয়ে রাখতো। ভাবতো যদি ছেলে ফিরে আসে! এই গল্পের দুইএকটি চরিত্র কাল্পনিক হলেও সব নয়। লেখাটিতে তথ্যগুলো জোগাড় করেছি উইকিপিডিয়া থেকে। আমি এখন যদি শুধু উইকিপিডিয়া বলে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি তাহলে অন্যায় হবে বলে মনে করি। এ কারণে যারা উইকিপিডিয়ায় লিখেছেন তাদের সবার নাম বলা উচিৎ।

কিন্তু সংখ্যাটা অনেক বড়,তাই আমি বিশেষ কিছু নাম উল্লেখ করতে চাই যেমন রাগিব স্যার,তারিফ এজাজ,আরমান আজিজ,আদিত্য কবির এবং আরো অনেকে। তাদেরকে অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ভাষা আন্দোলন নিয়ে কলামটি পড়তে গিয়ে ভাষা শহীদদের কলামও পড়েছি। একটি বিভ্রান্তি চোখে পড়েছে। আমি চেষ্টা করেছি নিজে থেকে ঠিক করার।

কিন্তু এই সংশোধনের ব্যাপারে আমি সন্দিহান। তাই কারো কাছে সঠিক তথ্য থাকলে অনুগ্রহপূর্বক এখানে জানিয়ে বাধিত করবেন। বিভ্রান্তি ছিলো আব্দুস সালাম এর মৃত্যুতারিখ নিয়ে। উইকিতে দুরকম তারিখ আমি পেয়েছি। একটি ৭ই এপ্রিল,আরেকটি ১৭ই এপ্রিল।

বাংলাপিডিয়া অনুযায়ী তারিখটি হবে ৭ই এপ্রিল। আমি যদিও উইকিতে পরিবর্তন করেছি,তবুও নিঃসন্দেহ হতে চাই। লিখা শেষ করবো একটি দুঃখের কথা জানিয়ে। যাদের জন্য আপনি আমি বাংলায় কথা বলতে পারছি আপনি কি জানেন সেই ভাষা শহীদদের দুইজন আব্দুস সালাম(তার ভাই ২০০০ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন যাকে দিয়ে সহজেই হয়তো তার কবর সনাক্ত করা যেত) এবং রফিক উদ্দিন আহমেদ এর কবর আজো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ছোট্ট ছেলে শহীদ অহিউল্লাহর ব্যাপারে অনেকে ঠিকমত জানেন না।

বয়স কম বলেই হয়ত আমার জানা মতে তাকে আজ পর্যন্ত কোন সম্মানোনা জানানো হয়নি। [আমার লেখাটির বেশিরভাগ অংশ এবং দু একটি চরিত্র কাল্পনিক কিন্তু তা কিছু সঠিক তথ্যের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। কেউ যদি লেখাটি পড়ে কোন কারণে আহত হোন তবে আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। আশা করি আমাকে এই ভেবে ক্ষমা করবেন যে,আমি নিতান্তই নবীশ ব্লগার। লেখক হওয়ার মত গুণ আমার আছে বলে মনে করিনা এবং আমার মতে আমার লেখার হাত নিতান্তই দুর্বল।

তারপরেও যারা কষ্ট করে লিখাটি পড়েছেন তাদেরকে ধন্যবাদ। ]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।