বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে বলি এই তো জীবন
বলতে পারেন, দুঃখের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কী আছে?
বলতে পারেন?
বাঁচার চেয়ে শ্রেষ্ঠ কী আছে?
পৃথিবীতে কী এমন শ্রেষ্ঠ আছে যার চেয়ে শ্রেষ্ঠ কিছুই নেই?
আজ ভালোবাসা দিবস। এ দিনে ক্যাকটাস কাউকে কষ্ট দিতে চায় না। সে দুঃখ কুড়ায়, দুঃখ জমায়। ভালোবাসা দিবসে তার কিছুই আসে যায় না। ভালোবাসা সুখীদের জন্য।
সে দুঃখী। তার গায়ে দুঃখ কাঁটা।
তবুও ক্যাকটাস মাঝে মাঝে খুব গোপনে, নির্লজ্জের মত স্বপ্ন দেখেÑ একদিন তার কোন কষ্ট থাকবেনা, একদিন সারাদিন সে শুধুই হাসবেÑ অশ্র“ গড়াবে না, সেদিন তার দেহের সমস্ত সুখ, সমস্ত ভালোবাসা জন্মদেবে একটি চমৎকার ফুলের। ভালোবাসার ফুল। সেদিন আদৌ আসবে কিনা তা তার জানা নেই।
ক্যাকটাস ঠিক করেছে আজ সে বাইরের পৃথিবী দেখতে বের হবে। যেখানে পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক দুঃখী, সেখানে দুঃখ-দিবস পালন না করে শুধুই ভালোবাসা দিবস পালন করার কারণটা কী আজ নিজ চোখে দেখবে।
সুতরাং... সেই চিরপুরাতন বারান্দার কোণ ছেড়ে বেরিয়ে এসে শুরু হল তার নতুন গন্তব্য যাত্রা।
ক্যাকটাস কোনদিন ভালোবাসা দিবস দেখেনি। শুধু শুনে এসেছে।
আজ স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছে! সব লোকজন কেমন জোড়া জোড়া বেঁধে আছে! তরুণ-তরুণী জোড়া, মধ্য বয়স্ক পুরুষ মহিলা জোড়া, বয়সী রোমান্টিক বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও জোড়া। অসীম সাহসী কিছু স্কুল পড়–য়া পুচকে ছেলে মেয়েরাও জোড়া!!
অবশ্য দলীয় কেউ যে নেই তা নয়। ছেলে মেয়েরা তাদের মা বাবাকে নিয়ে বেশ আমোদ করছে। একটা ছেলে পরম মমতায় তার মায়ের কাঁধে হাত রেখে হাঁটছে। আজ সবার জন্য ভালোবাসা।
ভালোবাসা বিলাতে বিলাতে আজ ফতুর হয়ে যাবে এই পণ করেছে যেন সবাই। খুব ভালো লাগছে ক্যাকটাসের। তার দুঃখী হৃদয় এত সুখ কখনও একসাথে দেখেনি। কি আনন্দ! কি আনন্দ!
শাহবাগ পেরিয়ে জতীয় জাদুঘরের সামনের ফুটপাত ধরে এগোতে থাকে সে। কোথায় যাবে জানা নেই।
সামনে নাকি একুশে বইমেলা হচ্ছে? ওখানে যাওয়া যেতে পারে।
পথে যেতে যেতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় ক্যাকটাস। এক জোড়া বয়স্ক দম্পতি বের হয়েছেন ভালোবাসা দিবস উপলক্ষ্যে। দুজনেরই মুখে চওড়া হাসি। মহিলা সেজেছেনও বেশ।
আহা! আজ এত বয়সে এসেও এদের ভালোবাসা অমলিন, কত সুখী এরা! লোভীর মত ক্যাকটাস ওদের পিছু নেয়।
ভদ্রলোক নিচু গলায় বলছেনÑ কী সুন্দর সকাল দেখেছ? মনটাই ভালো হয়ে যায়।
ভদ্রমহিলা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেনÑ আসলেই তাই। আমার কী যে ভালো লাগছে! মনে মনে বললেন, কচু হয়েছে তোমার সাথে ঘুরতে বেরিয়ে আমার। স্টার প্লাসে চমৎকার একটা সিরিয়াল ছিল।
এই তোমার জন্য মিস করলাম! ভালোবাসা দিবস! বুড়া বয়সে ভীমরতি!
ভদ্রলোক বউয়ের চাপা ফোঁস ফোঁস টের পান না। তিনি নিজেও মনে মনে ভাবছেন, কী চওড়া রোদরে বাবা! এমন রোদে মানুষ বের হয়? কোন কুক্ষণে যে আহ্লাদ করে ভালোবাসা দেখাতে বের হওয়ার চিন্তা মাথায় এল!
ক্যাকটাসের ভালোবাসা দেখতে আসার নেশা মরে গেছে। এই ভালোবাসার দিনে এ কেমন কথাবার্তা?
সে ওদের ছেড়ে হাটতে শুরু করেছিল অন্য পথে। আবারও দাঁড়িয়ে পড়তে হয় তাকে। শাড়ি পরা এক তরুণী এবং নক্সা করা শার্ট পরা এক তরুণ পাশাপাশি হাঁটছে।
তারা মনে মনে যা ভাবছে তা শুনে একেবারে টাসকি খাওয়ার মত অবস্থা ক্যাকটাসের। মানুষের মনের কথা শুনতে পাওয়ার জঘন্য ক্ষমতা বিধাতা তাকে কেন দিয়েছেন তা নিয়ে সে নিজেও বিব্রত।
সামনের ভ্যালেন্টাইনস ডে তে আমরা বিয়ে করব।
তরুণী তার খোলা স্ট্রেইটচুল নেড়ে বলল, শোন, বিয়ের পর আমরা কখনও ঝগড়া করবো না। আমি তোমার অভিমান ভাঙ্গাবো, আর তুমি আমার! (মনে মনেÑ ইশ্! আমার বয়ে গেছে নিজে থেকে তোমার মান ভাঙাতে।
দোষ তোমার হলেও আমি বলব স্যরি? অসম্ভব!
ঠিক বলেছ সুইট বেবী! আনন্দিত গলায় ছেলেটি বলল। (মনে মনেÑ হুঁ? আমি একটা পাঁঠা আরকি? অভিমান ভাঙাবো! কষে একটা দশ মনি চড় কষালে অভিমান এমনিতে ভাঙবে। অবশ্য অভিমান ভাঙানো পরের কথা। তোমার সাথে বিয়েরও এখনও ঠিক নাই। বউ তুমি না হয়ে সীমা, অদিতি কিংবা টিনাও হতে পারে।
দেখা যাক। )
ক্যাকটাস যেমন চমকিত হয়, তেমনি বেজার। এই মানুষগুলো এমন কেন? এরাই একসাথে জোট পাকিয়ে ভালোবাসা দিবস বানিয়েছে। আবার এরাই মনে দুঃখ পুষে। অযথা! কোন দরকার ছল না এই ভালোবাসা দিবসের।
ভালোবাসা যাদের আছে তাদের মনেই থাক।
ভালোবাসার বদলে দুঃখ দিবস পালন করা হোক। এ দিবসে সভা সেমিনার করা হবে। প্রত্যেকে যার যার দুঃখগুলো লিখিত আকারে জমা দেবে। সেগুলো কমাবার উদ্যোগ নেয়া হবে।
দুঃখ কমে যাওযা মানেই সুখ। আর সুখের দিনেই ভালোবাসা দিবস পালন করা হবে।
বই মেলা পর্যন্ত আর যাওয়া হলো না ক্যাকটাসের। সুখ দেখতে এসে দুঃখ কাঁটা বিধে গেছে তার গায়ে। যন্ত্রণা হচ্ছে।
পাঠকের মনে হয়ত এতটুকু পড়ে কিঞ্চিৎ অসন্তোষের জন্ম নিয়েছে। হৃদয়ে যাদের সত্যিকারের ভালোবাসা তারাও তো আজ বের হয়েছে। তাদের কেন চোখে পড়ছে না ক্যাকটাসের? নাকি ওর দুঃখী বিলাসী মন পৃথিবী জুড়ে শুধু দুঃখই খুঁজে বেড়ায়? ক্যাকটাসের এমন অযৌক্তিক আচরণ মানি না।
আপনাদের বলছি... আমি কিন্তু এখনও গল্পের শেষে আসি নি।
...মনে তীব্র কষ্ট নিয়ে আবার সেই বারান্দার নিভৃত কোণে ফিরে যাবে বলে মনস্থির করেছে ক্যাকটাস।
ভালোবাসা দিবসের সরূপ তার দেখা হয়ে হয়ে গেছে। একটা ব্যাপারই শুধু তার মনে হয়েছেÑ এই মানুষগুলোর মত ফাজিল জিনিস আর একটাও হয় না!
ফুটপাত ধরে ফিরেই আসছিল সে। হঠাৎ একটা অভাবনীয় দৃশ্য দেখে তার মনের ভেতরটা ছলাৎ ছৎ করে ওঠে। একটু আগে বিঁধে যাওয়া দুঃখ কাঁটাটা কখন যেন টুপ করে ঝরে পড়ে গেল। আনন্দে চোখে পানি এসে যাওয়ার জোগাড়! আজ জীবনে প্রথম ক্যাকটাস প্রাণ ভরে হেসে উঠলো!
আফা দেন... আফা দে-এন... করুণ অনুনয়।
আইসক্রীম হাতে হেঁটে যেতে থাকা ষোড়শী আপার বিরক্তি স্বত্তেও আইসক্রীমের শেষাংশটা পেয়ে গেল হাফ প্যান্ট পরা উদোম গায়ের টোকাই ছেলেটা। জীবনে সে কখনো এত দামী আইসক্রীম খায় নি। বড় একটা কামড় দিতে যাবে এমন সময় চোখে পড়ে তার সামনে দাড়িয়ে আছে একটা পিচ্চি মেয়ে। সেও টোকাই। লোলুপ দৃষ্টিতে দেখছে তাকে।
ছেলেটার কী মনে হলÑ আইসক্রীমটা দিয়ে দেয় মেয়েটার হাতে। বলাই বাহুল্য। আইসক্রীমে কামড় বসাতে বসাতে মেয়েটা ভো দৌড়। মেয়েটার চলে যাওয়া... কিংবা আইক্রীমটার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে ছেলেটা তার শুকনো জ্বিভ বুলায় ঠোঁটের চারপাশে।
জীবনে প্রথম একবার আইসক্রীম খাওয়ার সুযোগ এসেছিল তার, এই আইসক্রীমটা সে না দিতেও পারত।
মেয়েটার মাথায় কষে একটা চাটি দিয়ে ওর লোভী দৃষ্টি সরিয়ে দিতে পারত। কিন্তু সে নিঃস্বার্থভাবেই কাজটা করেছে।
ভালোবাসা দিবসে ওদের কেউ ভালোবাসে না, ওদের কথা মনেও করে না। কিন্তু এই স্বার্থহীন দানে কী ভালোবাসা নেই? বছরে একদিন ভালোবাসার নামে যে বাতুলতা মানুষ করে করে তার তুলনায় এই ছেলেটার কাণ্ডটা কী আমাদের লজ্জা দেয় না? তবে কী এই পথশিশুদের সারা বছর ভালোবাসা দিবস!!
ছেলেটা পুরোপুরি চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত ক্যাকটাস তার জন্য শুভকামনা করে। ক্যাকটাসের মনে কিছু প্রশ্ন ছিলÑদুঃখের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কী আছে? বাঁচার চেয়ে শ্রেষ্ঠ কী আছে? পৃথিবীতে কী এমন শ্রেষ্ঠ আছে যার চেয়ে শ্রেষ্ঠ কিছুই নেই?
ক্যাকটাস তার উত্তর পেয়ে গেছে।
স্বার্থহীন, নিখাঁদ ভালোবাসার চেয়ে শ্র্রেষ্ঠ কিছু পৃথিবীতে আছে বলে তার মনে হয় না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।