আর এ সকল কারনগুলোর মধ্যে কয়েকটি বড় কারন তুলে ধরা হলোঃ
ক) পাহাড় কাটা ঃ
বিশ্বায়নের এ যুগে ভোগবাদী মুনাফালোভী কিছু মানুষের কারনে দেশের প্রচলিত আইনের তোয়াক্কা না করে পাহাড় কেটে আবাসিক প্রকল্প গড়ে তোলা হচ্ছে সীতাকুন্ডের বিশাল পাহাড়ী এলাকা জুড়ে। সীতাকুন্ড উপজেলার সলিমপুর, কুমিরা,ছোট কুমিরা, বাঁশবাড়ীয়া,বার আউলিয়া সহ বেশ কয়েকটি স্থানে পাহাড় কেটে আবাসিক প্রকল্প গড়ে তোলা হেচ্ছ। এসকল হাউজিং প্রকল্পেরর সাথে জড়িত রয়েছে স্থানীয় সরকার, রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী ব্যক্তি, বিত্তশালী ব্যক্তিরা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে উল্লেখিত স্থানে বিস্তীর্ণ পাহাড় কেটে ইতিমধ্যে সাবাড় করে ফেলা হয়েছে। দেশের সবচেয়ে ভূমিকম্পন এলাকা চট্টগ্রাম।
এর অন্যতম কারন গুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে র্নিবিচারে পাহাড় কাটার কারনে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া। নানা রকম বনজ সম্পদের উৎস ছিল সীতাকুন্ডের পাহাড়। আজ সম্পদ বহুল এই পাহাড় ধু-ধু মরুভূমিতে পরিনত হয়েছে। যে পাহাড়ী বাঁশ বেতের উপর নির্ভর করে যুগ যুগ ধরে জীবন নির্বাহ করে আসছিল পাহাড়ী এলাকার লক্ষ লক্ষ দরিদ্র পরিবার আজ নিঃস্ব - অসহায়।
বাংলাদেশের মোট আয়তনের ১৮ শতাংশ পাহাড়ী এলাকা, যার অধিকাংশই চট্টগ্রাম অঞ্চলে অবস্থিত।
কিন্তু সা¤প্রতিক বছর গুলোতে অবৈধ ভাবে প্রকাশ্য অথবা লোকচক্ষুর অন্তরালে নিধন করা হচ্ছে এসকল পাহাড় বা টিলা সমূহ। ফলে প্রকৃতিতে দেখাদিচ্ছে বিরুপ প্রতিক্রিয়া। পাহাড় হচ্ছে সীতাকুন্ড তথা চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। র্নিবিচারে পাহাড় কর্তনের ফলে সৌন্দর্যহানীর পাশাপাশি বিভিন্ন নাগরিক সমস্যাও উদ্ভব হচ্ছে। পাহাড়ী পরিবেশে বসবসরত প্রাণী,উদ্ভিদ ও মনুষ্য প্রজাতীর উপর চরম বিরুপ প্রতিক্রিয়া ইতিমধ্যে দেখা দিয়েছে।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, অতীতে খুব বেশী এই এলাকায় বড় ধরনের ভূমিকম্প সংগঠিত না হলেও ভূতাত্তিক ও টেকটোনিক বিন্যাসের কারনে সীতাকুন্ড-টেকনাফ উপস্থল ও তৎসংলগ্ন বিস্তীর্ণ এলাকা ভূমিকম্পের ঝুকির মধ্যে রয়েছে। ১৭৬২ খ্রীষ্টাব্দে এই উপস্থলে সংগঠিত ৮ মাত্রার ভুমিকম্প সীতাকুন্ড পাহাড়ে দুইটি মাড ভলকানো(কাদা-বালির উদগীরণ) সৃষ্টি হয়। এতে টেকনাফ উপস্থলের অনেক ছোট খাটো দ্বীপ বঙ্গোপসাগরের নীচে তলিয়ে যায়। টেকনাফ অঞ্চল সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে দেড়-দুই মিটার উপরে উঠে আসে। যতদুর জানা যায়, ১৭৬২ খ্রীষ্টাব্দের এই ভুমিকম্পই আমাদের এই অঞ্চলের প্রথম সুনামী সৃষ্টি করে।
নিউইয়কের কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যামন্টডোহারর্টি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের যৌথ গভেষনা প্রকল্পের আওতায় ঢাকা,চট্টগ্রাম,খুলনা, রাজশাহী,সিলেট ও পটুয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ছয়টি স্থায়ী জিপিএস স্থাপন করে সার্বক্ষনিক উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভূখন্ডের গতি নির্ণয় করা হয়েছে। এসব এলাকায় বছরে ৩-৫ সেন্টিমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এর ফলে এই অঞ্চলের ভূতত্ত্বকে প্রচুর পরিমান শক্তি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি আমাদের জন্য অশনী সংকেত। এখানে যে কোন সময় ৮ মাত্রার মত শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার আশংকা রয়েছে।
বন উজার ঃ
অবাদে গাছ কাটার ফলে সীতাকুন্ডের বনাঞ্চলও উজার হয়ে যাচ্ছে। বৃক্ষ শূণ্য হয়ে পড়েছে এখানকার পাহাড়। উপকূলীয় বনাঞ্চলেও বৃক্ষ নিধন চলছে ব্যাপক হারে। বেপোরোয়াভাবে বৃক্ষ নিধনের ফলে এলাকাবাসীর প্রান রক্ষা বাঁধ হিসাবে পরিচিতি বেডি বাঁধ হুমকির সম্মুখিন হয়ে পড়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে।
দারগোরহাট হতে ফৌজদারহাট পর্যন্ত দীর্ঘ ৪৪ কিঃমিঃ উত্তর-দক্ষিন সীমান্ত পর্যন্ত এলাকার পূর্বে রয়েছে সবুজ বনভূমি, পশ্চিমে রয়েছে ৩২ কিঃমিঃ উপকূলীয় সমুদ্র অঞ্চল। পাহাড় ও উপকূলের সমন্বয়ে বনভূমির পরিমান এখানে প্রায় ২৫,০০০ একর । অত্র অঞ্চলের সবুজ বন দিন দিন উজার করে ভূুমিও উজার করার পায়তারা করছে এক শ্রেণীর অসাধূ ভুমি ব্যবসায়ী।
অপরিকল্পিত ইট ভাটা ঃ
সরকারী নিয়ম নীতি উপেক্ষা করে সীতাকুন্ড উপজেলা ২৩ টি ইটভাটা বেআইনি ভাবে চলছে। প্রতিদিনই এতে বিপুল পরিমান গাছকেটে পুরানের ফলে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের মারাতœক ক্ষতি হচ্ছে।
জানা যায়, স্থানীয় পরিবেশ বাদী সংগঠন গুলো এর প্রতিবাদ করেও কোন ফল হয়নি। পরিবেশ রক্ষায় ১২০ ফুট লম্বা চিমনী থাকার কথা থাকলেও হাতে গনা ৩-৪টি ছাড়া বাকী গুলো ৩০ ফুটেরও কম লম্বা চিমনী ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া ইট ভাটাগুলো লোকলয়ে হওয়ায় জনস্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রহ্য হচ্ছে। ইটভাটার পার্শ্ববর্তী আধা মাইলের কোন বৃক্ষ পরিপূর্ণতা পাচ্ছে না। এছাড়া ইটভাটাগুলোর কালোধূয়া আসপাশের এলাকার শিশুদের মারাতœক রোগে আক্রান্ত হতে হচ্ছে।
খ) জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের ফলে সৃষ্ট সমুদ্র এবং পরিবেশ দুষণ ঃ
সীতাকুন্ডের ২০ কিঃমিঃ জুড়ে রয়েছে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প। প্রায় দেড় লক্ষ লোক এই এলাকায় বসবাস করে। শিপ ইয়ার্ডে যে সকল জাহাজ কাটা হয় তার অধিকাংশই অয়েল ট্যাংকার। ভাঙ্গার জন্য আনা আমদানী করা জাহাজ গুলোতে থাকে কালো তেল ও বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য। এসব বর্জ্য ঠেলে দেওয়া হয় সমুদ্রে।
জাহাজ কাটতে গিয়ে সৃষ্টি হয় খন্ড বিখন্ড লোহার টুকরো ও গুরা। এসব পদার্থের শেষ গন্তব্য ঐ সমুদ্র। ফলে শিপ ব্রেকিং এলাকা সমুদ্র বর্জ্যরে আস্তাকুরে পরিনত হয়েছে। অথচ জাহাজের বর্জ্য ও বিষাক্ত দ্রবাদী ব্যবস্থাপনার জন্য কোন আয়োজন নেই। এর ফলে দুষিত হচ্ছে সমুদ্রের লোনা জন।
এসব এলাকার সমুদ্র উপকূল মাছ সহ অন্যান্য জলজ জীবের পরিমান দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। শব্দ দুষনতো এখানকার এলাকার নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে।
গ) অপরিকল্পিপ শিল্পায়ন ও পরিবেশ দুষণ ঃ
অনেক আগে থেকেই সীতাকুন্ড উপজেলা দেশের একটি বৃহত শিল্পাঞ্চল। ৩টি সিমেন্ট ফেক্টরী, ৪২টি রিরোলিং মিলস্ সহ নানা ধরনের কারখানা অপরিকল্পিত ভাবে জনজীবন ও পরিবেশের প্রতি হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে। যেখানে বিশ্বের কোথাও জন বসতি এলাকায় সিমেন্ট কারখানা নির্মানকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে সেখানে জনবসতি এলাকায় গড়ে তুলো হয়েছে এই সিমেন্ট কারখানা গুলো।
এসকল সিমেন্ট কারাখার ফলে যে সকল সমস্যা এখানে সৃষ্টি হচ্ছে তার মধ্যে হলো- সিমেন্ট কারাখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া ও বালিকানা প্রতিনিয়ন বায়ু দুষিত করছে। কারখানার বর্জ্য আশ পাশের চাষাবাদের জমির উর্বরতা শক্তি নাশ করছে। খালের পানির সাথে মিশে গিয়ে সমুদ্রের পানিকে দুষিত করছে। সিমেন্টের কণা বাতাসের সাথে মিশে কর্মরত শ্রমিক ও সাধরণ মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে যা তাদের চরম স্বাস্থ্য হানি ঘটাচ্ছে। আশপাশের বৃক্ষের উপর স্থায়ী সিমেন্ট বালির আস্তর পড়ে বৃক্ষের স্বাভাবিক প্রস্বেদনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে।
ফলে বৃক্ষরাজীর সবুজায়ন ধ্বংস হয়ে মরে যাচ্ছে। অন্যদিকে রোলিং মিল গুলোর সিসা মারাতœক বিষ। এখানে সিসা যুক্ত পেট্রোলিয়াম ও গ্যাসোলিন ব্যবহারের ফলে লেড/সিসা বাতাসে মিশে গিয়ে বায়ুকে করছে দুষিত আর এর প্রভাবে মানষিক প্রতিবন্ধি, মস্তিষ্ক জনিত রোগ এবং নবজাতকের শারীরিক গঠন ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া রোলিং মিলে কর্মরত শ্রমিকদের বিশেষ করে যারা চুল্লির সাহায্যের লোহা গালাইয়ের কাজ করে তাদের কাজের ক্ষেত্রে কোন নিরাপত্ত নেই। অত্যান্ত ঝুকিপুর্ন পরিবেশে তাদের কাজ করতে দেখা যায়।
যার ফলে যে কোন সময় তাদের শরীরে লোহার জ্বলন্ত রড লেগে দিয়ে মারাতœক দুঘর্টনা ঘটতে পারে। মূল কথা হচ্ছে, সীতাকুন্ডে গড়ে উঠা কারখানা সমূহ পরিকল্পিত ভাবে গড়ে না উঠায় এবং পরিবেশ বান্ধব না হওয়ায় তা সীতাকুন্ড বাসীর জন্য হুমকি হিসাবে দেখা দিয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, বেশীর ভাগ কারখানাই নিয়োগ প্রাপ্ত শ্রমিক হচ্ছে দেশে ভিন্ন ভিন্ন জেলার। স্থানীয় শ্রমিকের সংখ্যা খুবই কম। ফলে কারখানার কারনে ক্ষতিগ্রস্থ জনগোষ্ঠির সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
ঘ) আর্সেনিক প্রবন সীতাকুন্ড ঃ
শরীরে যে কোন কালো দাগ দেখলেই সীতাকুন্ডের সাধারণ মানুষ আর্সেনিকোসিস- এ আক্রান্ত হয়েছে মনে করে আতংকিত হচ্ছে। নলকুপের পানিতে আর্সেনিক আছে যেনেও সীতাকুন্ড উপজেলার মানুস আর্সেনিক যুক্ত নলকুপের পানি পান করতে বাধ্য হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার মতে, পানিও জলে আর্সেনিকের স্বাভাবিক মাত্রা ০.০১ মিঃগ্রাম/লিটার। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সহনীয় মাত্রা ০.০৫ মিঃগ্রাম/লিটার। কিন্তু আর্সেনিক মিটিগেশন ফোরাম ও বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ইপসা পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে সীতাকুন্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে নলকুপের পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা ০.২+মিঃগ্রাম/ লিটার।
যা জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য খুবই ঝুকিপূর্ণ।
ঙ) জলাবদ্ধতাঃ
অপরিকল্পিত শিল্পায়ন,অপরিকল্পিত খালকাটা,গৃহায়ন উন্নয়নের নামে যত্রতত্র রাস্তা, কালভাট নির্মান, খাল সংষ্কারের অভাবে সীতাকুন্ডের পরিবেশ মারাতœক ব্যাহত হচ্ছে।
সীতাকুন্ডের পরিবেশ সংরক্ষনের উপায়ঃ
১। শিল্প প্রতিষ্ঠান সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা এবং পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক সকল শিল্প কারখানা পর্যায়ক্রমে বন্ধ ঘোষনা করা।
২।
পরিবেশে বান্ধব এবং দেশীয় ফলজ,বনজ ও ঔষুধী গাছ লাগানো জন্য সাধারণ জনগনকে উদ্ভুদ্ধ করা এবং সংরক্ষন করা।
৩। বৃক্ষ নিধন এবং পাহাড় কর্তক কারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করা।
৪। শিপ ব্রেকিং শিল্পের জন্য সরকারী নীতিমালা প্রণয়ন, পরিবেশ বান্ধব শিপ ব্রেকিং গড়ে তোলা এবং সকল দুষিত বর্জ্য বাহী জাহাজ কাটা সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ করা।
৫। পরিবেশ আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।