আমার বড় বোনের একটা ফুটফুটে বাচ্চা আছে। পরিবারের নতুন প্রজন্মের প্রথম সন্তান,সবার বড় আদরের। কোল থেকে হামাগুড়ি দিয়ে কুটকুট করে হাঁটতে হাঁটতে ৫ বছরে পড়ে গেছে। কলকল করে হাসে,বাড়িময় ঘুরে বেড়ায়,বড় ভাল লাগে দেখতে। একটা নতুন ক্যামেরা কিনেছি, সাথে সাথে রাখি,দুরন্ত বাচ্চাটা একমুহূর্তের জন্যও স্থির হয়না,এরমাঝেই তক্কে তক্কে থাকি,একটু সুযোগ পেলেই ছবি তুলে ফেলি।
কান্না কাকে বলে জানে না সে,সময় পেলেই তাই বসে বসে বাচ্চাটার হাসিমুখের ছবিগুলো দেখি,মাটির পৃথিবীটাকে স্বর্গের কাছাকাছি বলে ভ্রম হয়,নইলে দেবশিশু কিভাবে আসে আমাদের ঘরে?
স্বার্থপর হলেও মাঝে মাঝে নিজের এই শান্তি ছেড়ে দুনিয়াদারির খবর নিতে পত্রিকার পাতায় চোখ বুলাই,ভুল করে টিভির খবরও দেখি কখনো কখনো। যদিও তারা আমার পেটের ভাত জোগাবে না তারপরেও চোখ মাঝে মাঝে পড়ে যায়। কিছুদিন হলো পত্রিকার পাতাগুলোতে বড় বড় ছবি দেখি। ধোঁয়ার ছবি,আগুনের
ছবি,সাইন্স ফিকশন মুভিকে হার মানানো চেহারার অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন সৈনিকদের ছবি,যারা নিজেদের ইসরায়েলি বলে পরিচয় দেয়। আর দেখি বড় বড় চোখের, কোঁকড়া কোঁকড়া চুলের শিশুদের ছবি।
দেখলে মনে হয় গালটা টিপে দেই, কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াই,ঘাড়ে চড়িয়ে আকাশটাকে দেখাই,
আর তার বদলে ওরা কলকল করে হাসুক, আমি শুনে প্বথিবীটাকে আরেকবার স্বর্গ বলে ভুল করি,নিজের জন্মের জন্য বিধাতাকে ধন্যবাদ জানাই।
কিন্তু এই শিশুগুলো হাসে না। ওদের ছবিতে হাসিমুখ থাকে না। ওদের চোখে জল থাকে,ওদের গালে কান্নার দাগ থাকে,ওদের গায়ে বারুদের কালি থাকে,ওদের চুলে ধুলোর জটা থাকে। ওদের ছবিগুলো প্রতিদিন বদলে যায় খবরের পাতায়,কারণ আরো একবার ছবি তোলার জন্য ওরা বেঁচে থাকে না।
ওরা ফিলিস্তিনের শিশু,ঘৃণার আগুনে পুড়ে ওরা জন্মানোর আগেই মরে যায়। ওরা বাতাসে ফুলের গন্ধ চেনে না,ওরা নীল আকাশ চেনে না,ওরা পাখি চেনেনা,ওরা গান বোঝেনা।
বারুদের ঝাঁঝ ওদের সুগন্ধি,কালো ধোঁয়া ঢাকা আকাশের নিচে ওরা বন্দী, ইসরায়েলের কুৎসিত ফাইটার জেটই ওদের পাখি,কামানের গোলা আর রকেটের শব্দ ওদের সংগীত,ওরা ফিলিস্তিনের নিষ্পাপ শিশু,যারা নিজের মৃত্যু পরোয়ানা হাতে নিয়ে জন্ম নেয়।
আমার ঘরে দু'জন মানুষ আছে। আমার মা, আমার বাবা।
সবাই বলে, সেই ছোটবেলা থেকে মা'কে দেখেছে আঙ্গুল ধরে স্কুলে নিয়ে যেতে, আর দেখতে দেখতে আজ আমি মায়ের মাথা ছাড়িয়ে গেছি। লাঠি নিয়ে যে বাবা তাড়া করতো এককালে,এখন মাঝে মাঝে আমিই তার অভিভাবক। তার পরেও এখনো মা মুখে তুলে খাওয়ায়,বাসায় ফিরতে একটু দেরি হলেই বাবার ফোন পেয়ে অস্থির হয়ে উঠি, বাসে করে বাড়ি ফিরতে পারবো কিনা সেই চিন্তায় গুরুজনরা চিন্তিত।
বাসায় ফিরে মায়ের দেয়া চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে সকালের বাসি পত্রিকাটা নিয়ে বসি। আবারো ভেতরের পাতায় চোখ আটকায়, আমাদের কিছু যায়-আসে না তারপরেও আটকায়।
আমার বয়সী কোন ফর্সা তরুণের লাশের সামনে মাথা ঢেকে বসে এক ফিলিস্তিনি বাবা,পাশের ছবিতে কিশোর ছেলের গুলিবিদ্ধ মৃতদেহের সামনে আহাজারি করা কোন এক মা। আমার মা নয়,কোন এক অজানা কিশোরের মা,কিন্তু মা,যে মায়ের পরিচয় মুসলিম মা নয়,ইহুদী মা নয়,শুধুই মা,যার সন্তানকে একটু পরে কবরে নামিয়ে দেয়া হবে। সন্তানের লাশটা কাঁধে নিয়ে যিনি হেঁটে যাবেন,তিনি ফিলিস্তিনের কোন এক বাবা। সন্তানের জন্মের পরই যিনি ধরে নেন এই সন্তানের জন্য দুশ্চিন্তা করার ভাগ্যও তার হবে না,জন্মানোর সাথে সাথেই কোন একটা ঘাতক বুলেটের গায়ে তার সন্তানের ঠিকানা লেখা হয়ে গেছে।
আমার বয়স ২৫ বছর,আমি বাংলাদেশের এক তরুণ।
আমার এক দঙ্গল বন্ধুবান্ধব আছে,আমার একটা স্বপ্ন আছে,আমার একগাদা হতাশা আছে। কিন্তু আমার চারপাশে সবুজ আছে,আমার দেশের মুক্ত ভূমি আছে,নিজের মাটিতে হেঁটে বেড়াবার স্পর্ধা আছে। আমার সাথে স্বপ্ন দেখার মানুষ আছে,আমার স্বপ্ন ভেঙে দেবার মানুষ আছে,সেই স্বপ্ন আবারো দেখার সাহস আছে। আমি হাসতে পারি আমি গাইতে পারি আমি গলা ছেড়ে গলাবাজি করতে
পারি। আমি আমেরিকার মুভি দেখে ইসরাইলের সুন্দরীর ব্লন্ড চুলের মুগ্ধতায় ভেসে যেতে পারি,আমি বারাক ওবামার দিনবদলের বাগাড়ম্বরে নিজেকেও শামিল ভেবে বিশ্বের সব মুক্তিকামীর চামড়া তুলে নিতে পারি,আমি কোকাকোলা খেয়ে নাইকির টিশার্ট পরে স্ট্যাচু অভ লিবার্টির মশালের আলোয় নিজেকে আলোকিত মানুষ
করতে পারি,আমি আইনস্টাইনের মেধাকে পূজা করে স্পিলবার্গের ম্যূভি টেকনিকের সাথে নিজেকে ট্রান্সফর্ম করতে পারি,আমি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার সংগ্রামকে পিপীলিকার পাখা গজানো বলে বিদ্রুপ করে ইসরাইলের সাথে শান্তি চুক্তি চাইতে পারি, আমি আরবের মেরুদণ্ডহীন নেতাদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজেকে দুর্বল ভেবে
হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি,দুনিয়ার এত অত্যাচারিত থাকতে ফিলিস্তিনিদের জন্যই এত কথা বলাকে বানরের নাচ বলে নিজেকে বেকুবের কাতারে শামিল না করে ঘরে বসে মুসলিম ব্রাদারহুডের গুষ্ঠি মেরে নিজেকে মহাজ্ঞানী প্রমাণ করতে পারি।
আমি অনেক কিছুই করতে পারি। কিন্তু ফিলিস্তিনের কোন সদ্য তরুণ,জন্ম যার মৃত্যুশিবিরে, কামানের গোলা আর জেটবিমানের শব্দে যার শৈশব কাটে,কৈশোরে যার পা দিতে হয় ইসরাইলি ট্যাঙ্কের গায়ে ঢিল মেরে,সেই তরুণের হাতে প্রেমিকার হাতের চেয়ে একে-৪৭ ই ভাল মানায়। তাদের আমরা সন্ত্রাসী বলতে পারি,তাদের জন্য সামান্য সহানুভূতিও না দেখিয়ে তাদের বোকা ফিলিস্তিনি বলে বিদ্রুপ ছুঁড়ে দিতে পারি,কিন্তু তাতে পুরুষান্তরে স্বপ্ন দেখা কোন ফিলিস্তিনি তরুণের স্বাধীনভূমির স্বপ্ন মরে যায় না,লায়লা খালেদের মত কোন তরুণীর জন্ম তাতে ঠেকানো যায় না। জায়োনিস্ট নিয়ন্ত্রিত পশ্চিমা মিডিয়া আমাদের চোখে যে রঙিন চশমা এঁটে দিয়েছে,নিয়ত মৃত্যুর সাথে হেঁটে চলা তরুণের চোখ সেই চশমা ছেড়ে সাদাকালো পৃথিবীকে অনেক আগেই দেখতে শিখেছে, আমরা কি ভাবলাম কি বললাম তাতে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেয়ার জন্য ছটফট করা ফিলিস্তিনের মানুষের কিছু যায়-আসে না।
ফিলিস্তিনের মত আমাদেরো কিছু যায়-আসে না,যায়-আসে না মৌলবাদের বিষ রক্তে নিয়ে বেড়ে ওঠা ইসরাইলের সৈনিকদেরও,যায়-আসে না সারা বিশ্বকে কাচকলা দেখানো বিশ্বমোড়লেরও।
তারপরেও আমাদের বোকা মানুষেরা রাস্তায় নামে,গলা ফাটায়,স্লোগানে মুখরিত করে পথ,পোস্টার হয়, কুশপুত্তলিকা পোড়ে বুশের, পতাকা পোড়ে ইসরাইলের। পৃথিবীতে বোকা মানুষের অভাব নেই,তাই কিছুই হবে না জেনেও আমেরিকার পথে পথেও মিছিল হয়,মিছিল হয় পৃথিবীর সব কোণে। মুক্তিকামী মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা এড়াতে না পেরে কিছু হবে না জেনেও ভেনেজুয়েলা আর বলিভিয়া ঘাড় ধরে বের করে দেয় ইসরাইলের রাষ্ট্রদূতকে,কিছু হবে না জেনেও বাংলাদেশের সরকারী চুক্তিপত্রে লেখা থাকে--"অল কান্ট্রিস এক্সেপ্ট ইসরায়েল"। কিছু হবে না জেনেও আঁদ্রে মালরো ঘোষণা
দেন বাংলাদেশের পক্ষে অস্ত্র ধরার,কিছু হবে না জেনেও জর্জ হ্যারিসন গেয়ে ওঠেন বাংলাদেশের গান,কিছু হবে না জেনেও একজন মার্ক ওডারল্যান্ড অস্ত্র ধরেন বোকা তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য,কিছু হবে না জেনেও চে গুয়েভারা ছুটে যান কঙ্গো আর বলিভিয়ার অরণ্যে। অসম্ভবের স্বপ্ন নিয়ে তাই ঘর ছাড়ে মাথায় গামছা বাঁধা বাংলার তরুণ,বাঘের ছাপ দেয়া ইউনিফর্মের জাফনার তামিল যোদ্ধা গুঁড়িয়ে গিয়েও স্বাধীন ভূমির স্বপ্ন দেখে,ইন্তিফাদার পতাকা গায়ে জড়িয়ে ফিলিস্তিনের তরুণও মুক্ত হাওয়ার গান শোনে।
তাই আমাদের মত যারা আরব বাদশাহর পশ্চিমপ্রীতির দোহাই দিয়ে ফিলিস্তিনিদের যুদ্ধে আমাদের সমর্থনকে হেয় করে,তাদের কথায় কোন উদ্ধত তরুণের স্বাধীন আবাসভূমির স্বপ্ন মরে যাবে না। মুসলিম ব্রাদারহুড নিয়ে যারা গলা ফাটায় আর প্রথম সুযোগেই আমেরিকান ড্রিমার হতে চায়,তাদের নাকিকান্নাতেও ঐ মৃত শিশু প্রাণ ফিরে পাবে না। আমাদের প্রতিবাদ বুলেটবিদ্ধ কিশোরের জীবন ফিরিয়ে দেবে না,কিন্তু আমাদের আক্রোশের চিৎকার মানুষ হিসেবে আমাদের পৃথিবীর বুকে দাঁড়াবার অধিকার দেবে। পাথর হাতে দাঁড়ানো নিষ্পাপ মুখের কিশোরটিও জানে তার পাথরে দানবের ট্যাঙ্কে ফাটল ধরবে না,পরাধীন বাংলাদেশের যে কিশোরটি বুকে মাইন বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ট্যাংকের নিচে সেও জানতো স্বাধীন দেশ দেখার জন্য সে বেঁচে থাকবে না। তারপরও মানুষ লড়াই করে যায়,তারপরেও মানুষ মাথা উঁচু করে মানুষ পরিচয়ে পরিচিত হতে চায়।
আমি জানতে চাই না ফিলিস্তিনিরা মুসলিম কিনা,আমি এও জানতে চাই না ফিলিস্তিনের কেউ আমার দেশের নাম জানে কিনা,কিন্তু আমি মানুষ হতে চাই। ঘাতকের ট্যাঙ্কের সামনে দাঁড়ানো পৃথিবীর প্রতিটি সাহসী মানুষের কাছে আমি মানুষ হিসেবে নিজেকে দাবী করতে চাই,হয়তো ভীতু মানুষ যার গোলার সামনে বুক পেতে দেয়ার সাহস নেই,কিন্তু একজন মানুষ যার মানুষ হয়ে ওঠার ইচ্ছা মরে যায়নি,দূর থেকে হলেও মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানো সাহসী মানুষগুলোর জন্য যার গর্বে মাথা উঁচু হয়ে ওঠে। আমার চিৎকার দানবের গায়ে কুটোটিও ঝরাবে না জেনেও শুধুমাত্র মানুষ হবার জন্য আমি চিৎকার করে বলে যেতে চাই--- "ফিলিস্তিন মুক্ত
হোক,পৃথিবীর রং দেখার আগেই যে শিশুটি খুন হয়ে গেছে তার ঘাতকের বিচার হোক, সত্য প্রকাশিত হোক,পৃথিবীর সব প্রান্তের মুক্তিপাগল মানুষের জয় হোক। "
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।