ছায়ায় হারাই
এক.
মডেল স্কুলের পাশে লম্বা চালাঘরটা। দুটো ঘর। একটা ধোপাখানা। অন্যটা নারানকাকুর হোমাপ্যাথী। মালিক রত্তন মোল্লা।
লম্বা দোহারা চেহারা। রুটির দোকান ছিল। বন্ধ করে দিয়েছেন। পান খেতে খেতে বলেন- তোমাগো দাদী হলেন গে মোগোলগো মাইয়া। তার একটা উজ্জত আছে না!
একটা খটো মটো টেবিল , একটা নড়বড়ে টেবিল আর পাতা ছেড়া মেটিরিয়া মেডিকা... এই নিয়ে নারান কাকুর হোমাপ্যাথী।
রোগী পত্তর নাই। চলে না।
একদিন আরেকটা টেবিল পড়ল অই ঘরে। নারান কাকু বললেন, ভাড়া দিতে অসুবিদা। সাবলেট আর কি।
সাবেলেটে ওটা একটা রাজনীতির অফিস। ইউপিপি। ইউনাইটেড পিপলস পার্টি। বেড়ার গায়ে কাজী জাফরের ছবি। আর নয়াযুগ পত্রিকা।
রাজনীতির লোকটি মুনসুর মোল্লা। কালো। মুখ গম্ভীর। হাফ শার্ট। মাথায় লেনিন টুপি।
পায়ে সাদা কেডস। একদিন বিকেলে আমাদের ঝালমুড়ি খাওয়ালেন। বললেন, কাল ভোর ভোর আসপি।
ভোরেই এসেছিলাম। কিন্তু দেরী হয়ে গেল-খোল খুঁজতে খুঁজতে।
খোল পাইতো করতাল পাই না। ততক্ষণে ইউপিপির অফিসের সামনে মুনসুর মোল্লা দ্রুত পায়চারী করছেন। হাতের মুঠো একবার খুলছেন আর বন্ধ করছেন। মাথা ঝাকাতে ঝাকাতে বিরক্তির সুরে বললেন-দেরী করলা ক্যান কমরেড। বিপ্লবের টেরেন কি তোমাগো জন্যি বইসা থাকপি?
ট্রেন বসে থেমেছিল কিনা জানি না।
কিন্তু সেদিন আমাদের পাছায় বেতের দাগ বসে গিয়েছিল। প্রভাতফেরীতে আমরা কজন তারস্বরে গাইছি.. মুক্তির মন্দির সোপান তলে... কত প্রাণ হল বলিদান। মুছে যাবে অশ্রুজলে...। কানা কেষ্টোর মতো কি আর গাইতে পারি। আমাদের প্রভাত ফেরীটা লঞ্চঘাটে মোড় নিতেই পল্টা বলল, অই তর ছোটো মামা আইছে।
হাতে ঝোলা গুড়। পেছন থেকে লাল ঝান্ডা নিয়ে একটা মিছিল বেরিয়ে গেলো।
আমি কি তখন ঝোলা গুড়ে আছি। মুনসুর মোল্লা বললেন, জোরে জোরে গাও। বিপ্লব আইতাছে।
গানের জোরে মুনি সিংয়ের শোদনবাদীগো চাপা দ্যাও। হালাগো জইন্য বিপ্লবের দেরী হইতাছে।
বাড়ী ফিরে দেখি বাবা রেগে মেগে আছেন। পাশে ছোটোমামা। বাবা ঝপাঝপ বেতের বাড়ি মারতে থাকলেন।
বললেন- হারামজাদা, তুই রাজাকারদের মিছিলে গিছিলি। রাজাকারের লগে মিছিল করছিস! বললাম- বিপ্লবের মিছিল...। বাবা আরও রেগে গেলেন। বললেন, তর বিপ্লবের পোঙা মারি।
বিজিতেন ডাক্তারের তিন টাকার দাওয়াই আমার পাছার দাগ মুছতে পারনি।
আমার বিয়ের বাসররাতে মহা সমস্যা হয়ে গিয়েছিল। বারবার লুকোনোর চেষ্টা করলেও ঠিকই বউয়ের কাছে ধরা পড়ে গেলাম। নতুন বউমুখ ফাটিয়ে বুক ফাটিয়ে বলে বসল- এইডা কি? সে রাতে আমার কোনো ব্যাখ্যাই কাজে দিল না। বিড়ালও মারা হল না। অনেকগুলো রাত কালরাত্রি হয়ে গেল।
বাবা বেত মারতে মারতে হাপিয়ে উঠলেন। নারিকেল গাছের গোড়ায় উবু হয়ে বসে ফোপাতে লাগলেন। ছোটো মামা আমার ছিড়ে যাওয়া প্যান্ট পাল্টে দিতে দিতে বলল- ও হল খুনী। মালেঙ্গার খুনী মুনসুর। একাত্তরে যারা পলাইছিল মালেঙ্গার বিলে তাদের নিজির হাত ব্রাশ ফায়ার করে মারিছে।
মালেঙ্গা গ্রামের কোনো হিন্দু ফ্যামিলি এর হাত থিকা রেহাই পা্য় নাই। আওয়ামী লীগের কোনো মুসলমানরেও বাচায়া রাখে নাই। ঘরবাড়ি লুট করছে। জ্বালায়া পুড়ায়ে দিছে। এতদিন পলায়া ছিল।
কি আর করা। স্কুলে পড়তে পড়তে শুনি কমডে কাজী জাফর আহমদ জিয়াউর রহমানের সরকারে শিক্ষা মন্ত্রী হিসাবে যোগ দিয়েছেন। আর মুনসুর মোল্লাও নারানকাকুকে দোকান থেকে বের করে দিয়েছেন। কাকুর সংগতি নেই। এরপর বটতলায় মেটিরিয়া মেডিকা নিয়ে বসলেন।
কাজী জাফর তখন জিয়ার দলে যোগ না দিলেও মুনসুর মোল্লা কিন্তু ইউপিপিতে ফিরে এলেন না। তার ট্রেন কিন্তু বসে রইল না। ট্রেনের নাম হয়ে গেল জাতীয়তাবাদী। তখন তিনি আর খুনী মুনসুর না, বিপ্লবী মুনসুর না, কালা মুনসুর। এরপর জিয়া মারা গেলে এরশাদের সংগে।
তিনি এখন বিএনপির একটা জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।