নিরুপমা
ভূত তো শর্ষের মধ্যেই
২০০৭ সালের ২২শে জানুয়ারির নির্বাচন বাতিল হয়েছিল অ™ভুত পরিস্থিতিতে। পরে টানা দু’বছর নানা উত্থান-পতন জিইয়ে ছিল গোটা সময়কাল ধরেই। সবই পুরনো বোলচাল। পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ নেইÑ তা হয়তো নিন্দুকের কাজ। কিন্তু আমরা দেখলাম নতুন সরকার নানা আশঙ্কা পেছনে ফেলে; রোডম্যাপ, মহাসড়ক অতিক্রম করে লাইনচ্যুত অবস্থা থেকে লাইনে চলতে শুরু করে গত ৬ই জানুয়ারি।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৩২ সদস্যের তরুণ-উদ্যমী মন্ত্রিপরিষদ শপথের মালা গলায় নিলো ওই দিন। যবনিকা ঘটল পুরনো অধ্যায়ের। আর সূচনা হলো নতুন পঞ্চবার্ষিকীর। সঙ্গে পর্দা উঠলো আমাদের সোনার ছেলেদের (ছাত্র নামধারী বিশৃঙ্খল ছাত্রলীগ কর্মীদের) নানা দখল-পাল্টা দখলের। বাংলা ফিল্মের মতোই মহাসমারোহে চলছে সপ্তাহব্যাপী জমজমাট, আংশিক সাদাকালো, অ্যাকশন হিরোদের দোর্দণ্ড প্রতাপ।
বিনা টিকিটে যে কেউ এই সোনার ছেলেদের অপকর্ম দেখতে পারেন। শিক্ষার পরিবেশের বারোটা বাজাতে যারা বদ্ধপরিকর। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ উপেক্ষা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের মধুর বোলচাল কোন কিছুই থামাতে পারেনি ছাত্রলীগের দিগি¦জয়ী সেনাদের। একদিকে বঙ্গভবনে শপথ নিচ্ছে মন্ত্রিসভাÑ সূচনা করছে নতুন দিনের দিনবদলের অন্যদিকে সারাদেশের হলগুলোতে অন্য দলের কর্মী-সমর্থক থেকে শুরু করে সাধারণ ছাত্ররা আতঙ্কে হল ছেড়ে পালিয়েছে। তাতেও নিষ্ক্রান্ত হয়নি ছাত্রলীগ; বরং বেপরোয়া হয়েছে।
রুমে থাকা স্থাবর-অস্থাবর, থালা-বাটি-কম্বল জবরদখল করেছে। রুমে রুমে জয়ের খুশিতে নিজেদের পকেটের তালাগুলো ঝুলিয়ে দিয়েছে। নতুন বিজয় কেতন আর আনন্দের উৎসবে সারাদেশকে শামিল করেছে ছাত্রলীগ এভাবেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার পরিচালনার দশম দিনে দুঃখ করেছেন, দশ দিন চলে গেল অথচ কিছুই করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর এই দুঃখবোধের, হতাশার সুর যেভাবে স্পর্শ করেছে সব মহলকে ঠিক একইভাবে চিন্তিত ও আতঙ্কিত করে তুলেছে ছাত্রলীগের দখল মহড়াকে অবলোকন করে।
আমাদের এই সোনার ছেলেদের ভাবখানা এমন দশদিন হয়ে গেল, এখনও কিছুই দখল করা হয়নি। পত্রিকান্তরে নানা সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে এই দখলোৎসব নিয়ে। একাধিক জাতীয় দৈনিকে এ নিয়ে অনুসন্ধানী ও মন্তব্য প্রতিবেদন আরও আতঙ্কিত করে তুলেছে। পত্রিকার গত ক’দিনের শিরোনাম ছিল, ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণহীন, বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ছাত্রলীগ, প্রধানমন্ত্রী: ছাত্রলীগ সামলান, চবি অশান্ত, অবরোধ চলছে, জাবিতে শিক্ষার্থীদের চরম দুর্ভোগ, কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত অমান্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি’র অফিসে তালা দেয়া হয়েছে, পদত্যাগের সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। ভিসি’র বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে তিনি বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত।
তাই বলে কি জোরজবরদস্তির দিনবদল শুরু হলো। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, প্রশাসন বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত হওয়ায় কোন ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অন্ধকার ঘরে কালো বেড়াল খুঁজছেনÑতা না হলে যখন ছাত্রলীগ ক্রমাগত কেন্দ্রের নির্দেশকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে। একের পর এক প্রীতিকর (পিরিতিকর) অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে তখন বিএনপি-জামায়াতের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে পার পাবার চেষ্টা মানুষ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টার মতোই দেখছেন। একই কাজ শপথ নেয়ার পরদিনই করে বসেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এডভোকেট সাহারা খাতুন।
নির্বাচনোত্তর সারাদেশে সংঘটিত সহিংসতাকে দেখছেন বিএনপি’র অভ্যন্তরীণ কোন্দল হিসেবে। মাননীয় মন্ত্রীদের প্রতি অনুরোধ- দেশের মানুষ আপনাদের অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করেছে আপনাদের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়ার। আপনাদের ওপর ভরসা করেছে। দয়া করে, মিথ্যাকে সত্য বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করবেন না, পানি ঘোলা করবেন না। সত্যকে সত্য বলুন।
সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলতে ভুল করবেন না। মানুষ বুঝতে শিখেছে। মানুষ প্রত্যাখ্যান করতে জানে। মানুষ বিজয় মাল্য দিয়েছে, ম্যান্ডেট দিয়েছে শান্তির জন্য। নিশ্চিন্তে নিরাপদে ঘুমোবার জন্য।
আপনারা একদিকে বলছেন ব্যবস্থা নিতে। অন্যদিকে ছাত্রলীগ সারাদেশে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ছাত্রলীগ হল দখল করছে, টেন্ডারবাজির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও নগর পিতারা নির্বাচন কমিশনের আইন ভঙ্গ করে উপজেলা দখল করতে মাঠে নেমেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পদে তাড়াহুড়া করে পার্টিমজান একজনকেই বসানো হয়েছে।
দায়িত্ব নিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ববর্তী রেকর্ডকে করেছেন কালিমা লিপ্ত। নতুন এক রেকর্ড গড়েছেন। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরীও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে দায়িত্ব নেন নি। যেটি করেছেন নতুন ভিসি আরেফিন সিদ্দিক। তিনিই আবার দাবি করেছেন দায়িত্ব পালনে তিনি থাকবেন নিরপেক্ষ।
কি অসাধারণ ম্যান্ডেট পেয়েছে আওয়ামী লীগ। দিনবদলের বেপরোয়া ম্যান্ডেট পেয়ে দিন দখলের অ™ভুত খেলায় লিপ্ত হওয়া আমাদের কারও জন্যই শুভ নয়। ইতিমধ্যে গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যেসব সন্ত্রাসী ও গডফাদার শেখ হাসিনাকে ক্ষমতার মসনদ থেকে বিদায় নিতে, বিপুল পরাজয়ের গ্লানি মেনে নিতে সহায়তা করেছিল তারা আবারও ফিরে আসতে শুরু করেছে। জনমনে নানা আতঙ্কের সূচনা ঘটেছে। দেখার বিষয় পরিবর্তিত ও নতুন রূপে পরিচিতি পাওয়া শেখ হাসিনা কিভাবে পরিস্থিতি সামাল দেন।
প্রথম আলো ১৯শে জানুয়ারি সংখ্যায় ‘প্রধানমন্ত্রী, ছাত্রলীগকে সামলান’ শিরোনামে মন্তব্য প্রতিবেদনে মতিউর রহমান লিখেছেন ১৯৯৯ সালের মে মাসেও তিনি এমনি এক শিরোনামে প্রধানমন্ত্রীকে খোলা চিঠি লিখেছিলেন। ১৯৯৯ সালের মে মাস জুড়েই ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাণ্ডব চালিয়েছিল। তৎকালীন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলে তৎকালীন সরকারি দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের দুই পক্ষে বন্দুকযুদ্ধ হয়। এতে ৫৫টি গুলি বিনিময় হয়েছিল। গুলিবিদ্ধ হয়েছিল তিনজন।
১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৮। খুব বেশি দীর্ঘ সময় নয়। কিন্তু একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আরও ন্যক্কারজনকভাবে ঘটে চলেছে। তখনও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৯ সালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সঙ্গে এক আলোচনায় বলেছিলেন, ‘আমরা তো শিক্ষাঙ্গনকে যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়ে রাখিনি। কিন্তু অন্য দল যখন অস্ত্র নিয়ে সন্ত্রাস করে তখন আমাদের ছেলেরাও উৎসাহী হয়।
তারাওতো তরুণ’। তিনি তখন এ-ও বলেছিলেন ‘সন্ত্রাসীরাই অনেক সময় ছাত্রলীগে জোর করে যোগ দেয়। সেটা কি করা যাবে?’ প্রধানমন্ত্রী এবারের ঘটনাবলীকে কিভাবে দেখবেন? কোন অভিধায় ভূষিত করবেন? প্রধানমন্ত্রী আচার-আচরণ ও সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসতে আন্তরিক। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে কি ঘটছে। ছাত্রলীগই ছাত্রলীগের জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উদ্দেশ্য টেন্ডারবাজি, হল দখল, ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তার। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ, ছাত্রলীগ নেতাদের ডেকে তিনি যে কোন মূল্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। এর পরপরই ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন, কেউ অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু ছাত্রলীগ নেতাদের মুখে এমন কথা শুনে সাধারণ মানুষ অনেকটাই ভূতের মুখে রামনাম শোনার মতোই ভিরমি খাচ্ছেন। ভূত যেন শর্ষের মধ্যেই।
যাই হোক, দেশের সজ্জন মানুষ মাত্রই শান্তি চায়। আর অস্থিরতা নয়; অস্ত্রের ঝনঝনানি নয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।