যখন বিকাল হতে থাকে, হতে হতে সূর্যটা ঢলে পড়ে, পড়তে থাকে
যে গুটিকতেক ফরেনারের সাথে পরিচয় আছে তাদের গায়ের চামড়া সাদা। শৈশবকাল থেকে ফরেনার মানে সাদা চামড়াই বুঝি। সাদা চামড়ার বৃটিশদের উপমহাদেশ শাষণের গল্পগাঁথা থেকে ফরেনারের সাথে হোয়াইট সিম্বলিক হয়ে ওঠে। ব্যাপক উন্নত, নতুন সব যন্ত্রপাতি, নারীদের এক্সপ্লোসিভ ফিগার, পুরুষগুলান লম্বা এমন একটা পূর্ব ধারণা আমার ভেতরে গ্রোথ্থিত থাকতো। ফরেনার বলতে এখনও আমি ইন্ডিয়ান বা আফ্রিকানদের বুঝি না।
তবে আগে যেমন ফরেনারদের ভাষা মানেই ইংরেজি বুঝতাম সেটা চেঞ্জ হয়েছে। কিন্তু এই সাদা চামড়াদের অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে আমার বিষ্ময়ের সীমা থাকতো না। আইখম্যানের ৬০ লাখ ইহুদী হত্যার বই পড়ে সেই শৈশবে ইহুদীদের রহস্যময় ট্রাজেডির নায়ক মনে হতো। রক্তে এবং শিরার গহীনে এমন কোন ধনুকভাঙা পন তাদের তাড়িত করে যা আনব্রেকেবল বাই এনি কস্ট।
এরপরে রোমাহর্ষক চলচ্চিত্রে ইহুদী সাদা চামড়ার নিধন দেখে, শেক্সপিয়ার থেকে শুরু করে বিভিন্ন নাটকে ইহুদীদের ভূমিছাড়া উদ্বাস্তুজীবের আখ্যান পড়ে একটা জাতি স্বত্ত্বার অবোধগম্য ভাবানুবেগ সম্বন্ধে কিঞ্চিত তাড়িত হয়ে উঠি।
এমন সময় ফ্রাংক কালিবের সাথে আমার পরিচয়। বাবা কুটনৈতিক। ফ্রাংক আর আমার কাজিন মুনা খুব ভাল বন্ধু ছিল। আমাদের বাড়ীর পাশের বাড়ীর দাদি ছিলেন ইন্ডিয়ান এ্যাংলো-ইহুদী, বৃদ্ধা থুরথুরে। দানিয়া দাদি বলতাম তারে, কিন্তু উনি মুসলমান হয়ে গেছিলেন সেই বৃটিশ আমলেই।
ফ্রাংককে কখনও তিনি ভাল চোখে দেখতেন না। তখন আমাদের বয়স কত হবে! ১৯/২০। ফ্রাংকের টকটকে লাল বর্ণ দেখে হয়তো মুনা তার প্রেমে পড়ে গেছিল, তখনও আমি ভাবতাম সাদাদের ঘৃনা করা যায় না। কলোনিয়াল সাদার মহত্বের কিছু বীজ আমার ভেতরে জেনেটিক্যালী দাসত্ব মানতো।
ফ্রাংক পরিষ্কার বাংলা বলতে পারতো।
বুড়ির ছেলে মেয়ে মানে পাড়াতো চাচা, ফুফুরা খাঁটি বাঙালী হয়েছে, একটু ফর্সা এই যা। বুড়ির দাদাও জার্মানী থেকে ইন্ডিয়া এসেছিলো, কোন বাঙালী মেয়েকে বিয়ে করে সেটেল হয়েছিল। তাদের সন্তান বাঙালি বটে তবে এ্যাংলো ভাবটা থাকতোই। বুড়ো বয়সেও বুড়ি জার্মান বলতে পারতো অনর্গল। ফ্যাংককে দেখলেই অন্য দিকে লাঠি ঠুকে ঠুকে পালাতেন।
বুঝতাম বুড়ির স্বজন হারানোর ব্যাথাটা এত এত বছর পরেও টনটনে। স্মৃতির আস্তরে, জাতিয়তার ঘোরটোপে অভিযোজিত নানা সংস্কৃতির আড়ালেও সে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ফ্রাংক বলতো এরা সারাজীবন ঘৃণা পুষে থাকবে, কখনও ভালবাসতে পারবে না আমাকে।
বুড়ির নাতি একটা আমাদের সাথে ব্যাডমিন্টন খেলতো। বুড়ি তাকে নিষেধ করে দিলো ফ্রাংকের সাথে মিশতে।
ফ্রাংক সহজভাবে নিলেও আমি নিতে পারি নাই সহজভাবে। তাকে বললাম, তোমার সমস্যাটা কি দাদি?
দাদী কিছু বলতে চাইতো না। মাঝেমাঝে ঘোত ঘোত করে বলতো, আমার রক্ত গরম হইয়া যায় ওরে দেখলে! ওরে আমার সামনে নিয়া আবি না!
দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছি অনেক বৎসর পরে এই একই ঘটনা হয়তো রিপিট হবে। আজকের কোন এক প্যালেস্টাইনী শিশু সেদিন দাদী হবে। কোন এক ইজরায়েলী বালককেও সে ফ্রাংকের মতই ঘৃনা করবে।
বংশ পরম্পরায় চলতেই থাকবে আর রক্ত উষ্ণ হয়ে উঠবে উত্তরসূরীদের।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।