আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নেড়িকুকুরের ইন্টারভিউঃ এক জোড়া জুতা, একজন প্রেসিডেন্ট ও তিন সেনাপ্রধান



ঘটনাটি এখন বিশ্ববাসী জানেন। কিন্তু এই ঘটনার পেছনে বাংলাদেশের একটা প্রভাব যে কাজ করেছে সেটা বিশ্ববাসী জানেন না। রোববার ১৪ ডিসেম্বর, ২০০৮-এ আমেরিকার বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাবলিউ বুশ গিয়েছিলেন বাগদাদে। সেখানে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী নূরী কামাল আল-মালিকির সঙ্গে একটি প্রেস কনফারেন্সে তিনি উপস্থিত হন। আমেরিকা ও ইরাক যে একটি নতুন নিরাপত্তা চুক্তি করেছে সেই বিষয়টি খুলে বলার জন্য এই প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন হয়।

এই চুক্তিতে আমেরিকা অঙ্গীকার দিয়েছে ২০১১ সাল শেষ হবার আগে ইরাক থেকে সব আমেরিকান সেনা প্রত্যাহার করা হবে। বিষয়টি ইরাকিদের জন্য একটি সুখবর হলেও তারা তখন জানতেন না যে একটি আনন্দের খবরও তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ওই প্রেস কনফারেন্সটি রেডিও-টিভিতে লাইভ বা সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছিল। সেখানে প্রেসিডেন্ট বুশের কাছ থেকে প্রায় সাড়ে তিন মিটার বা বারো ফিট দূরে উপস্থিত ছিলেন আল বাগদাদিয়া নামে একটি স্বাধীন রেডিও-টিভি স্টেশনের রিপোর্টার ২৮ বছর বয়স্ক মুনতাদির আল-জায়দি। হঠাৎ তিনি উঠে দাঁড়ান এবং আরবি ভাষায় চিৎকার করে বলেন, ইরাকিদের কাছ থেকে তোর জন্য একটা উপহার।

এটা একটা বিদায়ী চুমু। তুই একটা কুত্তা! এ কথা বলার পরপরই তিনি তার পায়ের একটা জুতা খুলে বুশের দিকে ছুড়ে মারেন। বুশ মাথা নিচু করে সরে যান এবং অল্পের জন্য জুতাটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। উপস্থিত সিকিউরিটি এজেন্ট, গার্ড ও জার্নালিস্টরা সবাই হতভম্ব এবং হতবুদ্ধি হয়ে যান। এরপর জায়দি তার পায়ের অপর জুতাটি খুলে ছুড়ে মারেন বুশের দিকে।

এবার তিনি আরবিতে চেঁচিয়ে বলেন, এই উপহারটা বিধবা, অনাথ এবং যারা ইরাকে নিহত হয়েছেন তাদের পক্ষ থেকে। এই জুতাও অল্পের জন্য মিস করে যায় বুশকে। এই সময়ে মালিকি তার হাত বুশের মুখের সামনে বাড়িয়ে তাকে রক্ষার চেষ্টা করেন। সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ হুলস্থুল বেধে যায় কনফারেন্স রুমে। সিকিউরিটি এজেন্ট ও গার্ডরা ঝাঁপিয়ে পড়ে জায়দির ওপরে।

তারা তাকে চেপে ধরে মাটিতে শুইয়ে ফেলে কিল ঘুষি লাথি মারতে থাকে। এক পর্যায়ে আহত জায়দিকে তারা একটি অজানা স্থানে নিয়ে যায়। ইতিমধ্যে বুশ নিজেকে কিছুটা সামলে নেন। সামনের সারিতে উপস্থিত কিছু ইরাকি রিপোর্টার ক্ষমা চান বুশের কাছে। বিষয়টিকে ঝেড়ে ফেলতে বুশ ঠাট্টা করে বলেন, আমি শুধু আপনাদের কাছে রিপোর্ট করতে পারি ওটার সাইজ ছিল দশ।

বুশ আরো বলেন, এই ঘটনাই দেখিয়ে দিল যে ইরাকে গণতন্ত্র আছে। একটি মুক্ত সমাজে মানুষ তার নিজের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করানোর জন্য এমন ঘটনা ঘটাতেই পারে। বুশ যখন একথা বলছিলেন তখন বাইরে থেকে জায়দির আর্তচিৎকার শোনা যাচ্ছিল। যাই হোক। ওই জুতা জোড়ার সাইজ নাম্বার টেন ছিল কিনা অথবা ইরাকে কোনো সত্যিকারের গণতন্ত্র আছে কিনা সেই বিতর্কে আমি এখন যাবো না।

আমি শুধু বলবো যে দুটি ফ্যাক্ট এখন তর্কাতীত হয়েছে। এক. তাৎক্ষণিকভাবে ওই জুতা জোড়া হয়েছে বিশ্বে সবচেয়ে দামি। এবং দুই. তাৎক্ষণিকভাবেই জায়দি হয়েছেন আরব বিশ্বের সবচেয়ে প্রিয় সাংবাদিক। তবে জায়দি আমার প্রিয় হননি। কারণ এক. তিনি এই ঘটনার পেছনে যে বাংলাদেশের প্রভাব রয়েছে সে কথা বলেননি এবং দুই. তিনি কুকুর জাতিকে অপমান করেছেন।

আমরা চারপেয়ে কুকুররা দুপেয়ে মানবজাতিকে ভালোবাসি। মানুষের অনুগত ও বিশ্বস্ত প্রাণী রূপেই আমরা কুকুররা সুপরিচিত। অথচ বুশের মতো একটা নরাধম মানুষকে জায়দি কুকুর বলে গালি দিলেন! জায়দির এই আচরণ খুবই দুঃখজনক। আমি গোটা কুকুর জাতির পক্ষ থেকে তার প্রতি তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। মানুষের সঙ্গে কুকুরের অনেক তফাৎ আছে।

আমরা কুকুররা কখনোই বেইমানি করি না। আমরা জুতা ছোড়াছুড়িও করি না। কারণটা অবশ্য দৈহিক। কারণ আমাদের যে চারটি পা আছে সেগুলো হাতেরও কাজ করে। তাই আমরা জুতা পরি না।

তাই আমাদের কাছে কোনো জুতাও নেই। কিছু ধনী মানুষ যারা কুকুর পোষেন তারা শীতকালে আমাদের গায়ে বাহারি কোট পরিয়ে দেন, অথবা অন্য সময়ে গলায় রিবন বেঁধে দেন� কিন্তু তারাও কখনো আমাদের পায়ে জুতা পরিয়ে দেন না। তাই জুতা কালচারের অভিজ্ঞতা আমাদের কখনো হয়নি। বাংলাদেশে জুতা কালচার বৃটিশ শাসনের অবদান। এই দেশে মানুষ আগে খড়ম পরতো।

রামায়ণ মহাভারতে খড়মের উল্লেখ আছে। আপনি যখন দৈনিক ইত্তেফাকে পঞ্চাশের গোড়ার দিকে কাজ করতেন তখন নিশ্চয়ই দেখেছেন পত্রিকাটির সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া খড়ম পরতেন। সম্ভবত বিংশ শতাব্দির গোড়া থেকে বাঙালিরা নিয়মিতভাবে শু অথবা পাম শু পরা শুরু করেন। শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত বইতে পাম শু’র গল্প আছে। ক্রমেই বাঙালির জীবনে জুতা কালচার বাড়তে থাকে।

প্রধানত তিনটি দিকে এই কালচারের বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। এক. ধর্মীয় দিকে। মানুষ মসজিদেও জুতা পরে যায় এবং সেখানে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের পাশে নিমেষের মধ্যে জুতা চুরিতে এক্সপার্ট চোররাও যায়। তাদের নিবৃত্ত করার জন্য এখন কিছু মসজিদে কাগজ অথবা পলিথিনের ব্যাগ বিলি করা হয় যার মধ্যে জুতা জোড়া রেখে মুসল্লিরা নিশ্চিন্তে নামাজ পড়তে পারেন। দুই. অর্থনৈতিক দিকে।

বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতে কর্মসংস্থানের সংখ্যা বাড়ছে না। ফলে বেকাররা হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছেন এবং ক্লান্ত হয়ে দিনের শেষ বাড়ি ফিরে এসে ক্ষেদোক্তি করেন, জুতার সোল ক্ষয়ে ফেলেও চাকরির সান মিললো না। তিন. রাজনৈতিক দিকে। কোনো পলিটিশিয়ানকে পছন্দ না করলে তাকে ভোটাররা জুতাপেটা করতে পারে অথবা তার গলায় জুতার মালা পরিয়ে দিতে পারে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দিকে জুতার এই কালচার বেশ পুরনো এবং প্রায়ই তার বিকাশ ঘটে থাকে।

আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে যে সশস্ত্র বাহিনীর একজন সাবেক প্রধান পরে বিএনপিতে যোগ দিয়ে ২০০১-এ এমপি নির্বাচিত হন। তার দলীয় প্রধান বেগম খালেদা জিয়া ২০০৭-এ জেলবন্দী হবার পর তিনি সংস্কারপন্থী হন। তার এই আচরণে বিক্ষুব্ধ হয়ে রাজপথে জনৈক বিএনপি কর্মী তাকে জুতা দিয়ে আক্রমণ করেন। এই ছবিটি ক্যামেরায় ধারণ করা হয়েছিল কিন্তু প্রায় সব পত্রিকাই সেই সময়ে ছবিটি ছাপেনি। আপনি তখন দৈনিক যায়যায়দিন-এর সম্পাদক ছিলেন।

আপনার পত্রিকাটি ওই ছবিটি ছেপেছিল এবং এ জন্য একটি বিশেষ কর্তৃপক্ষের কাছে আপনাকে জবাবদিহি করতে হয়েছিল। আপনি ওই ক্ষুব্ধ কর্তৃপক্ষকে বলেছিলেন, সাবেক সেনাপ্রধান যে আর সেনাবাহিনীতে নেই সেটা বুঝতে হবে। যে মুহূর্তে ওই সেনাপ্রধান রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন সেই মুহূর্ত থেকে তার স্টেটাস বদলে গিয়েছে। তিনি সোলজার থেকে পলিটিশিয়ানে রূপান্তরিত হয়েছেন। আর একজন পলিটিশিয়ান তার রাজনৈতিক জীবনে ফুলের মালা যেমন পেতে পারেন ঠিক তেমনি জুতার মালাও পেতে পারেন।

আমি জানি আপনার যুক্তিতে ওই কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হননি এবং এজন্য আপনাকে পরবর্তীকালে বড় খেসারত দিতে হয়েছে। আপনি আপনারই প্রতিষ্ঠিত ও দীর্ঘ ২৪ বছর যাবৎ লালিত যায়যায়দিনের সম্পাদক পদটি হারিয়েছেন গত মে মাসে মাত্র ৭২ ঘণ্টার নোটিশে। তবে আপনার সম্পাদিত পত্রিকায় ওই ছবিটি প্রকাশিত হবার পরপরই বিএনপি সংস্কারপন্থীরা প্রচণ্ড ভীত হন এবং তারা রণে ইস্তফা দেয়া শুরু করেন। সংস্কারপন্থীদের উত্থান রহিত হয়। ঘরের ছেলেরা ঘরে ফিরে আসতে থাকেন।

ওই সাবেক সেনাপতিও ঘরে ফিরে যান। বিএনপির রাজনীতি ঘুরে যায়। দেশের রাজনীতিও ঘুরে যায়। তাহলে দেখুন, সামান্য একটা জুতা কতো শক্তিশালী হতে পারে এবং কিভাবে একটি দেশের রাজনীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন মুখে চালিত করতে পারে। অবশ্য এটা নির্ভর করবে কোথায় কখন এবং কার প্রতি জুতা প্রয়োগ করা হবে।

এই রাজনৈতিক অস্ত্রটির ব্যবহার যে বাংলাদেশ থেকে জায়দি শিখেছেন সেটা তিনি বলেননি। এ কারণেও তার প্রতি আমি ক্ষুব্ধ। আইনজীবী গোখলে এক সময়ে বলেছিলেন, হোয়াট বেংগল থিংকস টুডে ইনডিয়া থিংকস টুমরো (বাংলা আজ যা চিন্তা করে আগামীকাল সেটা ইনডিয়া চিন্তা করে)। তারই কথার জের ধরে এখন বলা যেতে পারে, হোয়াট বাংলাদেশ থিংকস টুডে ওয়ার্ল্ড থিংকস টুমরো (বাংলাদেশ আজ যা চিন্তা করে আগামীকাল সেটা বিশ্ব চিন্তা করে)। বাগদাদে আমেরিকান প্রেসিডেন্টের প্রতি একজন আরব রিপোর্টারের জুতা ছোড়ার ঘটনাটি এই উক্তিরই অকাট্য প্রমাণ! আপনি জানেন ইরাক অভিযানের অজুহাতস্বরূপ আমেরিকা ও বৃটেন বলেছিল তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন কিছু গণবিধ্বংসী অস্ত্র বা ওয়েপনস অফ মাস ডেসট্রাকশন (weapons of mass destruction) বানিয়েছেন যার প্রয়োগে নিমেষের মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটানো সম্ভব।

পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয় সেই রকম কোনো অস্ত্র সাদ্দামের কাছে ছিল না। কিন্তু এখন জনৈক ইরাকি লেখক বলেছেন, ইরাকের কাছে যে একটি সর্বশক্তিমান ধ্বংসাত্মক অস্ত্র (weapon of comprehensive destruction) আছে সেটিই প্রমাণিত হলো। তার মতে, গত প্রায় ছয় বছর যাবৎ দখলদার আমেরিকান বাহিনী এবং তাদের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনী যেসব যুদ্ধাস্ত্র প্রয়োগ করেছে সেসবের তুলনায় মাত্র কয়েকটি অপ্রত্যাশিত সেকেন্ডে এক জোড়া জুতা আরো বেশি মারাত্মক যুদ্ধাস্ত্র রূপে পরিচিত হয়েছে। সাদ্দাম আমলে ইরাক থেকে বহিষ্কৃত সামি রামাদানি এখন লন্ডন মেট্রোপলিটান ইউনিভার্সিটিতে সিনিয়র লেকচারার পদে কাজ করছেন। তিনি লিখেছেনঃ দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ফালুজা, নাজাফ, বসরা ও বাগদাদে যেসব মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে সেসব অবশ্যই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

কিন্তু অপ্রত্যাশিত কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে জুতা ছোড়ার ঘটনাটি যে গোটা ইরাককে ঐক্যবদ্ধ করেছে সেটা বিস্ময়কর এবং খুবই নাটকীয়। আরব সংস্কৃতিতে জুতা একটি খুবই নিচু জিনিস। কারণ এটা মানুষ পায়ে পরে এবং এতে অনেক ময়লা লেগে থাকে। তাই জুতা ছোড়াটা চরম ক্ষোভ ও পরম ঘৃণার প্রকাশ রূপে বিবেচিত হয়। কিন্তু শুধু জুতা ছোড়াই নয়� একই সঙ্গে ওই তরুণ আরব রিপোর্টার যা বলেন, সেসব গোটা মধ্যপ্রাচ্যে আরবদের দেহে বিদ্যুতের শক দিয়েছে।

তারা সবাই উপলব্ধি করেছেন জায়দি ভয়ংকর নির্যাতনের মুখে পড়বেন জেনেও তার দেশের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষের পক্ষে সাহসী কথা বলেছেন। জায়দির এই কথার পর গোটা আরব বিশ্বে আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। বাগদাদ থেকে প্যালেস্টাইনে গাজা এবং ইজিপ্টে কায়রো থেকে মরক্কোতে কাসাব্লাংকায় আরবরা উৎসবমুখর হয়। এমনকি বাংলাদেশেও বাঙালিদের উল্লাসের খবর প্রকাশিত হয়। মধ্যপ্রাচ্যে কেউ কেউ বলেন, একজন নিমন্ত্রিত অতিথিকে জুতা ছোড়াটা হয়েছে অসভ্যতা।

কিন্তু তাদের বিপরীতে অনেকে বলেন, বুশ একজন গণহত্যাকারী যুদ্ধ অপরাধী। সে ইরাকে ঢুকে পড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ খুন করেছে। সে একটি দেশকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছে। পশ্চিমিরা একটি দেশকে বশে রাখার জন্য ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি অর্থাৎ দেশবাসীকে বিভক্ত করে দেশকে শাসন করার নীতি অনুসরণ করে। ইরাকেও আমেরিকা-বৃটেন তাই করেছে।

সাদ্দামের পতনের পর ইরাকিদের তারা বিভক্ত করেছে জাতিগত ও ধর্মীয়ভাবে। যেমন, কেউ আরব, কেউবা কুর্দি। কেউ সুন্নি, কেউবা শিয়া। ইত্যাদি। সামি রামাদানি লিখেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ইরাকিরা এই আরোপিত বিভেদ ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ হবার দিকে এগোচ্ছিল।

জায়দির এই বীরোচিত ঘটনায় ওই ঐক্যবদ্ধ হবার প্রক্রিয়া আরো বলীয়ান হয়েছে। ঘটনাটির পর ইরাকে কেউ প্রশ্ন তোলেনি জায়দি আরব না কুর্দি? সুন্নি না শিয়া? বরং আমেরিকান ও বৃটিশ মিডিয়া চেষ্টা করেছে জায়দির পূর্ণ পরিচয় প্রকাশ করতে। এখন জানা গেছে, জায়দি বাগদাদ ইউনিভার্সিটির মিডিয়া কলেজে একজন বামপন্থী ছাত্রনেতা ছিলেন। তার আদর্শ পুরুষ দক্ষিণ আমেরিকার বিপ্লবী চে গুয়েভারা। সাংবাদিক রূপে তিনি ইরাকের বিভিন্ন রণাঙ্গন থেকে ফার্স্ট হ্যান্ড রিপোর্ট দিয়ে প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেন।

তার রিপোর্টে দখলদার বাহিনীর অত্যাচার ও নির্যাতন এবং সাধারণ মানুষের দুঃখকষ্টের কথা ফুটে উঠতো। আল বাগদাদিয়া টিভি স্টেশনের তিনিই ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয় স্টার। জায়দি এখন ইরাকের ন্যাশনাল হিরো বা জাতীয় বীরে পরিণত হয়েছেন। অসংখ্য ইরাকির কাছে তিনি এখন জাতীয় ঐক্যেরও প্রতীক এবং তারা তাকে তাদের প্রিয়তম ছেলে রূপে বলছেন। জায়দির জনপ্রিয়তা ইরাকের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে।

সউদি আরবের এক ধনকুবের তাকে এক পাটি জুতার জন্য এক কোটি ডলার বা প্রায় সত্তর কোটি টাকা দিতে চেয়েছেন। অনেক ধনবান আরব পিতা তাকে জামাই হবার প্রস্তাব দিয়েছেন। বাংলাদেশের জনৈক ব্যবসায়ীও বিশ লক্ষ টাকায় তার জুতা জোড়া কেনার প্রস্তাব দিয়েছেন। এক জোড়া জুতার এত দাম এবং তার মালিকের এত কদর যে হতে পারে তা কি কেউ কখনো ভেবেছিল? আমরা কুকুর জাতি অবশ্য কখনোই এই সম্মান ও টাকার অফার পাবো না। কারণ তো আগেই বলেছি।

আমরা জুতা পরি না। কিন্তু এখন জায়দির এই খ্যাতিতে আমি ঈর্ষান্বিত হচ্ছি। চেষ্টা করেছি জানতে মানবজাতি কখন থেকে জুতা পরা শুরু করলো? মধ্যযুগে বৃটিশরা কর্ডওয়েন (Cordwain) নামে খুব শক্ত চামড়ার জুতা পরতো। এটা ছাগলের চামড়া থেকে তৈরি হতো এবং স্পেন থেকে আমদানি করা হতো। সেই সময়ে চর্মকাররা খুব প্রতাপশালী ইউনিয়ন করেছিল।

নতুন জুতা শুধু তারাই বানাতো। আর সাধারণ মুচিরা শুধু পুরনো জুতা সেলাই ও বিক্রি করতো। চৌদ্দদশ ও পঞ্চদশ শতাব্দিতে ইওরোপে লম্বা ও চোখা জুতা জনপ্রিয় হয়। এসব জুতাকে বলা হতো পাইকড শু (Piked Shoe)। এই জুতার দাম ছিল খুব বেশি এবং গরিবদের এটা পরা নিষেধ ছিল।

শুধু অভিজাত শ্রেণীর মানুষরাই পাইকড শু পরতেন। পাইকড জুতা হাঁটু পর্যন্ত হতে পারতো এবং পা থেকে হাঁটু পর্যন্ত ফিতা ছিল এসব জুতায়। কিন্তু এই চোখা জুতা পরাটা আরামদায়ক ছিল না। ষষ্ঠদশ শতাব্দিতে জুতার সামনের দিকটা বদলে যেতে থাকে। চোখা জুতার বদলে চওড়া জুতা হয়।

এমনকি নয় ইঞ্চি পর্যন্ত চওড়া হয় তখনকার জুতা। ইংল্যান্ডে টিউডর রাজত্বের সময়ে এই ধরনের জুতা পরা নিষিদ্ধ করা হয়। শিল্প বিপ্লব বা ইনডাসট্রিয়াল রিভলিউশনের সময়ে জুতা পরার অভ্যাস ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়। সেই সময়ে জুতায় ফিতা বা লেসের পরিবর্তে বাকল ব্যবহার শুরু হয়। এর কিছু কাল পরে কর্ক-এর হিল জুতার সূচনা হয় এবং নারীদের মধ্যে হাই হিল জুতা দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়।

বিংশ শতাব্দিতে চামড়া ও কর্কের সঙ্গে জুতা বানানোতে যুক্ত হয় প্লাস্টিক ও পলিইউরিথিন জাতীয় ইনডাসট্রিয়াল প্রডাক্ট। মানুষ একাধিক জুতা তার কালেকশনে রাখা শুরু করে। কথিত আছে ফিলিপিন্সের স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট মার্কোস-এর স্ত্রী ইমেলদার কালেকশনে ছিল কয়েক হাজার জুতা। বিংশ শতাব্দিতে জুতার ব্র্যান্ডিং হতে থাকে। বৃটেনে পুরুষদের সবচেয়ে নামি ব্র্যান্ড চার্চেস (Church`s)-এর এক জোড়া জুতার দাম নূ�নতম দুশো পাউন্ড (প্রায় পঁচিশ হাজার টাকা) হতে পারে।

সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে নামি ব্র্যান্ড ব্যালি (Bally) যার অনুকরণে বাংলাদেশে হয়েছে বেলি শুজ! তবে জুতা শিল্পে বিশ্বে সবচেয়ে অগ্রগণ্য দেশটি হচ্ছে ইটালি। বিশ্বের নারী-পুরুষ সবারই প্রথম পছন্দটি হচ্ছে ফ্যাশনেবল ডিজাইনের ইটালিয়ান শু। সে যাই হোক। সাবেক এক সেনাপ্রধান-কাম-প্রাক্তন এক বিএনপি সংস্কারপন্থীর অভিজ্ঞতা এবং বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বুশের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হতে পারে, মানুষের কাছে জুতা গেলেই জুতা সংবাদ শিরোনাম হয়। কিন্তু এই ধারণা ভুল।

জুতার কাছে যদি খ্যাতিমান ও ক্ষমতাশীল মানুষ যান সেটাও সংবাদ শিরোনাম হতে পারে। যেমনটা কিছুকাল আগে হয়েছিল এই বাংলাদেশেই এবং এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন কোনো সাবেক সেনাপ্রধান নয়� বর্তমান সেনাপ্রধান। তিনি গিয়েছিলেন গাজীপুরে একটি জুতার কারখানা ভিজিটে এবং অনেক জোড়া জুতার সামনে তার দণ্ডায়মান অবস্থার ছবিটি আপনারই সম্পাদিত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু এ নিয়ে বর্তমান সেনাপ্রধানের কোনো উষ্মা বা ক্ষোভ প্রকাশিত হয়নি। অনুমান করা যায় জুতা বিষয়ে বর্তমান সেনাপ্রধান অত্যন্ত দূরদর্শী ও সদা সতর্ক।

সম্ভবত সেই কারণেই তিনি এই বছরের এপ্রিলে একটি প্রেস কনফারেন্সে জানিয়ে দেন ক্ষমতার প্রতি তিনি আগ্রহী নন। তিনি যদি তার ওই অঙ্গীকার রক্ষা করেন তাহলে জুতা দ্বারা তিনি যে কখনো আক্রান্ত হবেন না সে বিষয়ে আমি গ্যারান্টি দিতে পারি। জায়দির জুতার দাম সত্তর কোটি টাকায় উঠেছে। ইরাকি কর্তৃপক্ষ অবশ্য ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে ওই জুতা জোড়ায় বোমা বা বিস্ফোরক কোনো পদার্থ ছিল কি না সেটা পরীক্ষা করতে গিয়ে তাদের নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। ইরাকি কর্তৃপক্ষের এই দাবি বিশ্বাসযোগ্য নয়।

আসলে বুশকে চরম অপমানের সাক্ষী হয়েছে বলেই জুতা জোড়াকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। এই সংবাদে অন্তত একজনের খুব খুশি হওয়ার কারণ আছে। তিনি হলেন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ড. মুসা বিন শমশের। লন্ডনের দি সানডে টেলিগ্রাফের মতে, বিশ্বের যেসব ধনাঢ্য ব্যক্তির সবচাইতে এক্সপেনসিভ জুতার কালেকশন আছে তাদের অন্যতম হচ্ছেন মুসা বিন শমশের। সম্ভবত তিনি খুব দুঃখ পেয়েছিলেন কোথাকার কোন ছোকরা জায়দির এই ছোড়া জুতার আকাশ ছোঁয়া দাম তার নিজের সব জুতাকে ডিভ্যালু করে দিয়েছে।

নিশ্চয়ই তিনি জায়দির জুতা ধ্বংসের সংবাদে খুশি হয়েছেন। ভেবেছেন যাক, বাঁচা গেল। আমার চাইতে দামি জুতার কালেকশন আর কারো নেই! মুসা বিন শমশেরের জুতা দামি হবার অনেক কারণ আছে। এক. এসব জুতা বিভিন্ন প্রাণীর চামড়ার তৈরি। যেমন, উটপাখি, হরিণ, ছাগল, ব্যাঙ, সাপ, মাছ প্রভৃতি।

তার কিছু জুতা সিল্কের তৈরি। দুই. জুতাগুলো ইটালিতে বানানো। কারিগর কম্পানি দুটির নাম ট্রেসটনি (Trestoni) এবং আরটিওল্লি (Artiolli)। ইটালি থেকে বাংলাদেশে এসব জুতা পৌঁছে দেয় সউদি আরবের জুতা পরিবহনে বিশেষজ্ঞ বৃটিশ কম্পানি হোয়াইটস (White`s)। যে বাক্সে জুতাগুলো আসে তারই দাম হাজার বিশেক টাকা হতে পারে।

আর জুতার দাম? এটা নির্ভর করে মুসা বিন শমশের তার জুতায় কোন ডায়মন্ড বা মণিমানিক্যের চেইন লাগাবেন। সাধারণত তার জুতার ওপরাংশে দুটো আংটা থাকে। ছোট সাইজের ডায়মন্ড বা অন্য কোনো দামি পাথরের চেইন এই দুটো আংটায় আটকিয়ে তিনি জুতার আকর্ষণ ও দাম বাড়ান। এসব ডায়মন্ডের চেইন সাপ্লাই করে বিখ্যাত ইন্টারন্যাশনাল জুয়েলার্স টিফানিস (Tiffany`s)। তার জুতা রিপেয়ারিং শপে যায় না।

এবং কোনো জুতা তিনি পলিশও করেন না। পলিশ করার প্রয়োজনীয়তার আগেই হোয়াইটস তার গুলশানের বাড়িতে পৌঁছে দেয় আরো এক মখমলে মোড়ানো শু বক্স। তার ওই বাড়ির দোতলায় বাথরুমের পাশেই আছে এয়ারকন্ডিশন্ড শুরুম। জুতা কালেকশনে ড. মুসা বিন শমশেরের আন্তর্জাতিক প্রতিদ্বন্দ্বী কে? তিনি মনে করেন এক্ষেত্রে আছেন আরো দুজন। এক. জেমস বন্ড চরিত্রে অভিনয় খ্যাত অ্যাক্টর রজার মুর এবং দুই. আমেরিকান প্রপার্টি টাইকুন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

বাংলাদেশে তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী আছে কি? মুসা বিন শমশেরের মেয়ের বিয়েতে উকিল ছিলেন আরেক সাবেক সেনাপ্রধান ও সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তার সর্বশেষ ডিভোর্সড স্ত্রী বিদিশা যিনি শত্রুর সঙ্গে বসবাস বইটি লিখে আরো খ্যাতি অর্জন করেছেন তার সূত্রে জানা গেছে তাদের দাম্পত্য জীবনের সময়ে এরশাদের একশরও বেশি জোড়া জুতা ছিল। তবে এগুলো ছিল নিচু মানের� ইংল্যান্ডের মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সার-এর তৈরি অথবা ইনডিয়ার উডল্যান্ডস-এর তৈরি। এরশাদ বাকলওয়ালা খুব চকচকে জুতা পছন্দ করেন। অবশ্য সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

সেনাপতিরা সাধারণত চকচকে জুতাই পছন্দ করেন। তবে এই চকচকে করণের পরিশ্রমের কাজটি তাদের করতে হয় না� সেটি করেন তাদের অধস্তন কর্মচারিরা। বিদিশার সূত্রে আরো জানা যায়, একটি ব্যভিচারের ঘটনা জানাজানি হবার পর বিদিশা নিজ হাতে অন্তত একশ জোড়া জুতা কাচি দিয়ে কেটে ফেলেন। ঘটনাটির উল্লেখ আছে বিদিশার বইয়ে। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ সম্প্রতি খবরে এসেছেন আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে মহাজোটের ব্যানারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণায়।

এই ঘোষণার পর এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ১৯৯০-এ নিহত ড. মিলনের মা সেলিনা আখতার টিভি এবং বিভিন্ন সম্মেলনে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থকরাও গোপনে স্বীকার করেছেন এরশাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধাটা অনৈতিক হয়েছে এবং যে মরাল হাই স্ট্যান্ডার্ড বা উঁচু নৈতিক মান আওয়ামী লীগ দাবি করতে চায় সেখান থেকে তারা মাটিতে পড়ে গিয়েছে। আওয়ামী লীগ অতি অশ্লীলভাবে আদর্শচ্যুত হয়েছে এবং এরশাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে হতাহতদের প্রতি চরম অশ্রদ্ধা প্রকাশ করেছে। এরশাদের সঙ্গে চুক্তির ফলে আওয়ামী লীগের আদর্শবান বহু সমর্থক ভোট দানে বিরত থাকতে পারেন। তাই আওয়ামী লীগ নির্বাচনে হেরে যেতে পারে।

আওয়ামী লীগের সঙ্গে এই জুটি বাঁধা এখন কিছুটা হাস্যকর পর্যায়ে গিয়েছে। সম্প্রতি এরশাদ একাধিকবার দাবি করেছেন শেখ হাসিনা তার ছোট বোন! শেখ হাসিনা এখন পর্যন্ত এই দাবির কোনো প্রতিবাদ জানাননি। এই দাবি অনেকের কাছে আশ্চর্যজনক মনে হয়েছে। তারা বলেছেন, তারা জানতেন না যে বঙ্গবুর প্রথম সন্তানটি ছিল একটি পুত্র এবং সেই পুত্র এখনো জীবিত আছে। এরশাদের নিজের পুত্রসন্তানের বিষয়টি যেমন রহস্যাবৃত ঠিক তেমনি তার এই সর্বশেষ দাবিটিও বঙ্গবুর সন্তানদের সংখ্যা বিষয়টিকে রহস্যময় করে তুলেছে।

এরশাদের এই দাবি যদি সত্যি হয় তাহলে সম্ভবত তার অন্যতম প্রিয় গান হচ্ছে মান্না দে-র গাওয়া� সে আমার আদরের ছোট বোন। এই নির্বাচনের পর দেখা যাবে এরশাদের এই আদরের ছোট বোনের সঙ্গে সম্পর্কটি কোথায় গড়ায়। এখন আপনি দয়া করে ওই গানটি আমাকে শোনাতে পারেন। ধন্যবাদ। ইন্টারভিউ নিয়েছেন শফিক রেহমান ২১.১২.০৮


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.